মেহেদী হাসান
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা বিষয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এখানে সামরিক বাহিনীর ফিরে আসার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায়না।
এতে ব
লা হয়েছে সহিংসতার কারনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়েছে । উভয় দল থেকে পরষ্পরের প্রতি সেনা হস্তক্ষেপের উসকানির অভিযোগ করা হচ্ছে বারবার। বাংলাদেশকে এ অচলাবস্থা থেকে বের করে আনার জন্য সরকারের সামনে একটি মাত্র পথ খোলা আছে এবং সেটি হল সংলাপের আয়োজন করা এবং বিরোধীদের সাথে একটি সমঝোতায় আসা।
২৬ মার্চ প্রকাশিত এ প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে শাসকদলের ঘণিষ্ঠ মিত্র ভারতের উচিত বিরোধীদের সাথে সমঝোতায় আসার জন্য ঢাকাকে পরামর্শ দেয়া।
রাজা রুমি লিখিত ‘বাংলাদেশ অন দি ব্রিঙ্ক’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে দুই নেত্রীর ইগোর কাছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা জিম্মি হয়ে আছে। মূল আরেকটি পক্ষ তথা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কোন হস্তক্ষেপ ছাড়া নিরবে এ অবস্থা অবলোকন করা হিসেবে বেছে নিয়েছে। শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে সংবিধান নিরপেক্ষ করা হয়েছে এবং বিপুলসংখ্যক সেনাকর্মকর্তার বিচার করা হয়েছে। পাকিস্তানের মত সেনাবাহিনীর প্রত্যাবর্তনের ফিরে আসার সম্ভবনা রয়েছে এখানে ।
প্রবন্ধে আরো বলা হয়েছে বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক এবং শাসন ব্যবস্থায় সংস্কার খুবই অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নতুন পদক্ষেপ প্রবর্তন করা দরকার।
প্রতিবেদনটি এখানে হুবহু তুলে ধরা হল
জানুয়ারি থেকে চলতে থাকা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সহিংসতায় শতাধিক লোকের প্রাণহানি হয়েছে। হরতালের কারনে দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র রাজধানী ঢাকা স্থবির হয়ে পড়েছে। পাকিস্তান থেকে আলাদা হবার পর দেশটি বারবার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কবলে পড়ে। বারবার সামরিক হস্তক্ষেপ, শীর্ষ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ হত্যাকান্ড এবং দুই দলের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকা অকার্যকর গণতন্ত্রের কারনে বাংলাদেশ বারবার এ অস্থিতিশীলতায় নিমজ্জিত হচ্ছে। বাংলাদেশের দুই শিবিরে শীর্ষে রয়েছেন দুইজন মহিলা যারা ‘বেগমস’ নামে পরিচিত। এদের একজন হলেন দেশটির প্রতিষ্ঠাতা এবং জাতীয় হিরো শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা । আরেকজন হলেন, দেশের প্রথম সেনাশাসক জেনারেল জিয়উর রহমান এর বিধবা স্ত্রী। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে রক্ষনশীলদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন।
রাজনৈতিক দল, নেতৃবৃন্দ এবং তাদের সুশাসনের ফলস্বরূপ দেশটিকে বারবার রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা গ্রাস করেছে। বর্তমানে চলামান সংঘাতের সূচনা হয় ২০১৪ সালে বিতর্কিত নির্বাচনের পর থেকে। বিরোধী দল ওই নির্বাচন বর্জন করে। বিরোধীদের বর্জনের ফলে এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী একটি নিরপেক্ষ অন্তবর্তীকালীন প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন দাবি করেছিল। হাসিনা এ দাবির প্রতি সাড়া দেননি এবং একরতফা নির্বাচনের দিকেই তিনি এগিয়ে যান যা পরিষ্কারভাবে তাকে আরেক দফায় ক্ষমতায় বসায়।
নির্বাচন পথ পিছলে সহিংসতা :
গত ৫ জানুয়ারি ছিল ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের বর্ষপূর্তি। বিরোধী দল এ দিনটিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ আখ্যায়িত করে সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেয়। সরকার কঠোর হাতে এটা দমনের উদ্যোগ নেয়। বিক্ষোভ সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং বিরোধী নেতাকর্মী গ্রেফতারের মাধ্যমে সরকার এটা দমনের পদক্ষেপ নেয়। সরকারের এ আচরনের প্রতিবাদে বিরোধী দল সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধের ডাক দেয়। এরপর থেকে বিরোধী এবং শাসক দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিক্ষোভ চলতে থাকে এবং কখনো কখনো তা সহিংসতায় গড়ায়। সরকার বেগম খালেদা জিয়াকে দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে অবরুদ্ধ করে রাখে এবং তার বিরুদ্ধে দুর্ণীতি মামলা সচল করে। একইভাবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষ নেয়ার কারনে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধেও চলমান মামলার মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে। জানুয়ারি থেকে সাত হাজার বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী গ্রেফতার করা হয়েছে। রাজপথে সংঘাতে শতাধিক নিহত হয়েছে এবং ২০ জন বিরোধী নেতাকর্মীকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের সুশীল সমাজ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সর্বশেষ ২০০৭ সালে এ ধরনের রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় এবং ফলস্বরূপ সামরিক হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটে। নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক নুরুল আমিন বলেন, দুই পক্ষই যে কঠোর অবস্থানে রয়েছে তাতে সমঝোতার কোন সম্ভাবনা নেই। একইভাবে সুশাসন নিয়ে যারা কথা বলেন, তাদের মতে দুই নেত্রী দুই দলে কর্তৃত্ববাদী অবস্থানে রয়েছেন এবং তারা দেশকে দুই যুদ্ধ শিবিরে বিভক্ত করেছেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, কিছু কিছু বিরোধী লোকজন কর্তৃক সংঘটিত সন্ত্রাসকে সরকারের ভুল গ্রেফতার এবং হত্যাকান্ডের দোহাই দিয়ে চালানো যাবেনা।
অর্থনীতি এবং সরকারের সামনে আপদ
চলমান রাজনৈতিক হাঙ্গামা, অবরোধ, সহিংসতা এবং বিদ্যমান নিরাপত্তাহীনতার কারনে বাংলাদেশের অর্থনীতি নড়বড়ে হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে বার্ষিক ২৪ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক শিল্প। এ শিল্পের সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। এফবিসিসিআই’র তথ্য মতে চলমান অচলাবস্থার কারনে তৈরি পোশক খাত তিন দশমিক নয় বিলিয়ন ডলার ক্ষতির শিকার হয়েছে। আর খুচরা খাত লোকশানের শিকার হয়েছে দুই দশমিক এক বিলিয়ন ডলার । অবরোধের কারনে কৃষকরা তাদের কৃষি পন্য পরিবহন করতে পারছেনা এবং এর ফলে সম্প্রতিক কয়েক সপ্তায় কৃষি খাত ৫শ ৩৩ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চলমান রাজনৈতিক হাঙ্গামার কারনে দেশটির সুনাম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশটির অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি নস্যাতের ঝুকির মধ্যে রয়েছে। এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক সতর্ক করে বলেছে রাজনৈতিক অচলাবস্থা চলতে থাকলে প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে । হরতাল অবরোধের কারনে বিনিয়োগ এবং রপ্তানী কার্যক্রম বাধার মুখে পড়েছে।
গত দুই যুগ ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক খাতে অগ্রগতি সত্তেও দেশটির শাসন ব্যবস্থা অশান্ত এবং কর্তৃত্ববাদী, বংশগত ও ব্যক্তিত্ব চালিত অবস্থায় রয়ে গেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই গণতন্ত্রের মূল প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন সংসদ এবং বিচারবিভাগ দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। বিরোধী দলের অভিযোগ গত ছয় বছরে বিচার বিভাগ আওয়ামী লীগের প্রতি অনুগতদের দিয়ে ভরে ফেলা হয়েছে। আসল কথা হল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয়ই যে যখন ক্ষমতায় ছিল দলীয় অনুগতদের দিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ভরে ফেলেছে এবং প্রশাসনে দলাদলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক এবং শাসন ব্যবস্থায় সংস্কার খুবই অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নতুন পদক্ষেপ প্রবর্তন করা দরকার।
এরপর কী
রাজনৈতিক উদ্দেশ হাসিলের জন্য সন্ত্রাসের আশ্রয় নেয়া বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট গত মাসে এদ্বগ প্রকাশ করেছে।
দুই নেত্রীর ইগো এবং তাদের বিপুল সংখ্যক অনুসারীদের কাছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা জিম্মি হয়ে আছে। মূল আরেকটি পক্ষ তথা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কোন হস্তক্ষেপ ছাড়া নিরবে এ অবস্থা অবলোকন করা হিসেবে বেছে নিয়েছে। শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে সংবিধান নিরপেক্ষ করা হয়েছে এবং বিপুলসংখ্যক সেনাকর্মকর্তার বিচার করা হয়েছে। পাকিস্তানের মত সেনাবাহিনীর প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা কম নয় ।
রাজনৈতিক সহিংসতার ধরন এখানে পরিষ্কার। নির্বাচনের আগে এ ধরনের অচলাবস্থা সাধারণত ঘটে। কিন্তু বর্তমানে সংঘাতের ঢেউ সীমা অতিক্রম করেছে এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা হুমকির মুখে। শেখ হাসিনা সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন যে, বেগম জিয়া সেনা সহায়তায় ক্ষমতায় আসতে চায়। কিন্তু তিনি দৃঢ়ভাবে সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। অপরদিকে বিরোধী পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দেয়ার জন্য ভয়াবহ কৌশলে আশ্রয় নিয়েছে।
এ অবস্থায় সরকারের সামনে একটি মাত্রই পথ খোলা আছে আর তাহল রাজনৈতিক সংলাপের আয়োজন করা এবং বিরোধীদের সাথে একটি সমঝোতায় আসা। বাংলাদেশে শাসকদলের ঘণিষ্ঠ মিত্র ভারতের উচিত বিরোধীদের সাথে সমঝোতায় আসার জন্য ঢাকাকে পরামর্শ দেয়া। বাংলাদেশের প্রধান বানিজ্যিক অংশীদার ইউরোপীয় ইনিয়নেরও অবকাশ রয়েছে ঢাকার কর্তৃপক্ষকে একথা বলা যে, রাজপথে সহিংসতার বদলে সমঝোতায় আসা উচিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের। এসব না হলে বা অন্য কোন রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে বাংলাদেশ রাজনৈতিক অচলাবস্থার প্রান্তসীমায় থেকে যাবে।
0 comments:
Post a Comment