ড. ইউসুফ আল কারযাভী
ইসলামের মৌলিক অবশ্যপালনীয় কর্তব্যের মধ্যে সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের প্রতিবিধান উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যে দু’টি মৌলিক উপাদানের কারণে মুসলিম উম্মাহকে শ্রেষ্ঠ ও কল্যাণকামী জাতি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন তন্মধ্যে একটি হচ্ছে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের প
্রতিবিধান। ইরশাদ হয়েছে : ‘তোমরাই তো শ্রেষ্ঠ জাতি। মানুষের কল্যাণে তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎকাজের প্রতিবিধান করবে এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে’ (সূরা আলে ইমরান ৩ : ১১০)। মু’মিনদের মৌলিক গুণাবলি উল্লেখ করতে গিয়ে কুরআন কারীমে বলা হয়েছে : ‘তারা হচ্ছে আল্লাহর দিকে বারবার প্রত্যাগমনকারী, তাঁর ইবাদাতকারী, তাঁর প্রশংসাবাণী উচ্চারণকারী, তাঁর জন্য জমিনে বিচরণকারী, তাঁর সামনে রুকু ও সিজদাকারী, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের প্রতিবিধানকারী এবং আল্লাহর সীমারেখা সংরক্ষণকারী’। (সূরা তাওবা ৯ : ১১২)। মুমিন নারীরা এখানে মুমিন পুরুষদের মতো, এমন গুরুত্বপূর্ণ বিধান পালনে তাদেরও অংশগ্রহণ ও ভূমিকা রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : ‘মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী, তারা সবাই পরস্পরের বন্ধু ও সহযোগী। তারা ভালো কাজের হুকুম দেয় এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে’ (সূরা তাওবা ৯ : ৭১)। ঈমানের দাবি অনুযায়ী প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তির একে অপরের ওপর ভ্রাতৃত্বের অধিকার রয়েছে, এমনিভাবে প্রত্যেক মুমিন নারীরও রয়েছে।
এ বিধান পালনে যারা সচেষ্ট থাকে কুরআন কারীমে তাদেরকে যেমনিভাবে সাধুবাদ জানানো হয়েছে, তেমনিভাবে যারা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের প্রতিবিধানে এগিয়ে আসে না তাদেরকে নিন্দাবাদ জ্ঞাপন করা হয়েছে। আল্লাহর কুরআনে ঘোষণা দিচ্ছে : ‘বনী ইসরাঈল জাতির মধ্য থেকে যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে তাদের ওপর দাউদ ও মরিয়ম পুত্র ঈসার আ: মুখ দিয়ে অভিসম্পাত করা হয়েছে। কারণ তারা বিদ্রোহী হয়ে গিয়েছিল এবং বাড়াবাড়ি করতে শুরু করেছিল। তারা পরস্পরকে খারাপ কাজ করা থেকে বিরত রাখা পরিহার করেছিল, তাদের গৃহীত সেই কর্মপদ্ধতি বড়ই জঘন্য ছিল’ (সূরা মায়েদা ৫ : ৭৮-৭৯)। এভাবে একজন মুসলমানের পরিচয় শুধু এমনটি হতে পারে না যে, সে শুধু নিজেরই কল্যাণ কামনায় ব্যস্ত থাকবে, ভালো কাজ করবে এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকবে। নিজস্ব পরিমণ্ডলেই তার যাবতীয় কর্মতৎপরতা সীমাবদ্ধ থাকবে। অন্য কোনো ভালো ও কল্যাণের প্রতি তার কোনো মনোনিবেশ থাকবে না; যদিও তার চোখের সামনেই তা নিঃশেষ ও ধ্বংস হয়ে যায়। এমনিভাবে তার চতুর্পাশে কোনো খারাপ কিছুর জন্ম ও লালন-পালন দেখলেও সে তা এড়িয়ে গিয়ে নিজের চরকায় তেল ঢালার কাজে ব্যস্ত থাকবে, একজন মুসলিমের ব্যক্তিত্ব কখনো এমনটি হতে পারে না।
বরং একজন মুসলমানের সত্যিকার পরিচয় হচ্ছে সে যেমনিভাবে নিজের কল্যাণ কামনায় রত থাকবে তেমনিভাবে অপরের কল্যাণ কামনাও তার মনোনিবেশের বাইরে থাকবে না। কুরআন কারীমের ছোট একটি সূরায় সংক্ষিপ্ত ভাষায় মুসলিম ব্যক্তিত্বের পরিচয় দেয়া হয়েছে এভাবে : ‘সময়ের কসম! মানুষ আসলেই বড় ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে এবং একজন অন্যজনকে হক থাকার ও সবর করার উপদেশ দেয়’ (সূরা আল আসর)। সুতরাং একে অপরকে হক কথা ও সবরের উপদেশ দেয়ার কাজে মনোনিবেশ ছাড়া দুনিয়া ও আখিরাতের ক্ষতিগ্রস্ততা থেকে মুসলমানদের মুক্তির দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। একেই কুরআনের অপর জায়গায় সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের প্রতিবিধান হিসেবে ব্যক্ত করা হয়েছে। আর এটিই হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ ও মুক্তির একমাত্র জামিনদার।
অন্যায়-অনাচার প্রতিরোধ ও এর স্তর বিন্যাসে বিশুদ্ধ হাদিস
নবি সা: বলেন : ‘তোমাদের কেউ যদি কোনো খারাপ কাজ বা বিষয় দেখে তাহলে সে যেন হাত দিয়ে তা পরিবর্তন করে দেয়, যদি তা করতে অপারগ হয় তাহলে যেন মুখ দিয়ে তার প্রতিবাদ করে, যদি তাও করতে সক্ষম না হয় তাহলে যেন অন্তর দিয়ে তা ঘৃণা করে, আর এটাই হচ্ছে ঈমানের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বলতম স্তর।’ এখানে হাদিসের বক্তব্য সুস্পষ্ট, মুসলমানদের যে কেউই যখনই কোনো খারাপ বা অপছন্দীয় কিছু দেখতে পাবে তা পরিবর্তন করা তার অধিকারভুক্ত হয়ে পড়ে; বরং তার ওপর তা পরিবর্তনে এগিয়ে আসা ওয়াজিব হয়ে পড়ে। যে বা যারাই কোনো খারাপ বা অপছন্দনীয় কিছু দেখতে পাবে সবাইকে তা অন্তর্ভুক্ত করবে; চাই সে শাসকগোষ্ঠী হোক বা জনসাধারণের মধ্য থেকে হোক। রাসূল সা: এখানে সব মুসলিমকে উদ্দেশ বা সম্বোধন করেছেন, সাহাবায়ে কেরামগণ থেকে শুরু করে কেয়ামত পর্যন্ত আগত সব প্রজন্মের কেউ এই সম্বোধনের বহির্ভূত থাকবে না। রাসূল সা: তখন ইমাম, রাষ্ট্রপ্রধান এবং জাতির শাসক ছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর জনসাধারণকে এ মর্মে নির্দেশ দিয়েছেন যে, যখনই তাদের কেউ কোনো খারাপ বা অসৎ কিছু দেখতে পাবে তখন সাধ্যমতো তা পরিবর্তনে যেন এগিয়ে আসে। তার বক্তব্য ছিল : ‘যখনি তোমাদের (শাসিত জনগণ) কেউ কোনো খারাপ কিছু দেখতে পায় ...”।
অসৎকাজের প্রতিবিধানের শর্তাবলি
যে বা যারাই অসৎকাজের প্রতিবিধানে এগিয়ে আসে তাদের উচিত এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় শর্তাবলির প্রতি লক্ষ রাখা, যা হাদিসের ভাষ্য থেকে উৎসারিত।
প্রথম শর্ত :
সন্দেহাতীতভাবে খারাপ বা শরিয়াহ নিষিদ্ধ কাজ
হাদিসে যে খারাপ কাজটিকে প্রথমে পেশিশক্তির মাধ্যমে, অতঃপর মুখের মাধ্যমে, সর্বশেষে নিরুপায় অবস্থায় অন্তর দিয়ে পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে তা সন্দেহাতীতভাবে খারাপ বা শরিয়াহ নিষিদ্ধ কাজের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। এখানে ‘মুনকার’ শব্দ বলতে শরিয়াহ নিষিদ্ধ কাজ বোঝানো হয়েছে, যেগুলোর পরিত্যাগ মানুষের ওপর আবশ্যক করেছে। যে এসব নিষিদ্ধ কাজে জড়িয়ে পড়বে তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি নির্ধারিত হয়ে যায়; চাই তা কোনো খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়া হোক বা কোনো আবশ্যকীয় কাজ ত্যাগ করার কারণে হোক। চাই এ ধরনের হারাম বা নিষিদ্ধ কাজ সগীরা হোক বা কবীরার অন্তর্ভুক্ত হোক। যদিও সগীরা গুনাহের কাজগুলোর ক্ষেত্রে শিথিলতা প্রদর্শন করা হয় যা কবীরা গুনাহের কাজগুলোর ক্ষেত্রে করা হয় না; বিশেষ করে যদি সগীরা গুনাহের কাজের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা পাওয়া না যায় তাহলে বিভিন্ন উপলক্ষে এগুলোর অপরাধ থেকে বান্দাকে নিষ্কৃতি দেয়া হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন : ‘তোমরা যদি বড় বড় গুনাহ থেকে দূরে থাকো, যা থেকে দূরে থাকার জন্য তোমাদের বলা হচ্ছে, তাহলে তোমাদের ছোটখাটো খারাপ কাজগুলো আমি তোমাদের হিসাব থেকে বাদ দিয়ে দেবো এবং তোমাদের সম্মান ও মর্যাদার জায়গায় প্রবেশ করিয়ে দেবো’ (সূরা নিসা ৪ : ৩১)। রাসূল সা: বলেন : ‘পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ, জুমা থেকে জুমা, রমজান থেকে রমজান এগুলোর মধ্যবর্তী সব (সগীরা) গুনাহকে মুছে দেয়, যদি কবীরা গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকা যায়।’ সুতরাং ‘মুনকার’ বলতে এখানে মাকরুহ অথবা সুন্নাত ও মুস্তাহাব ইত্যাদির পরিত্যাগ বোঝাবে না। একাধিক বিশুদ্ধ হাদিসে এসেছে যে, এক ব্যক্তি রাসূলকে সা: ইসলামে তার ওপর পালনীয় আবশ্যক বিষয়গুলো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি তাকে নামাজ, জাকাত, রোজা ইত্যাদির কথা বললেন। প্রশ্নকারী পুনরায় বলল : এগুলো ছাড়া আরো কিছু আছে কি-না? রাসূলে কারীম সা: বললেন : আবশ্যকভাবে নেই; তবে যদি নফল বা অতিরিক্ত হিসেবে কিছু পালন করতে চাও তাহলে আছে। প্রশ্নকারী রাসূলের সা: এ কথা শেষ হতে না হতেই বলে উঠল : আল্লাহর শপথ! আমি আবশ্যকভাবে পালনীয় এ বিষয়গুলো থেকে কম-বেশি পালন করব না। রাসূল সা: বললেন : লোকটি সফল হবে অথবা বেহেশতে প্রবেশ করবে যদি তার কথায় সে সত্যবাদী হয়ে থাকে। অপর এক হাদিসে এসেছে : রাসূল সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো বেহেশতী লোক দেখে আনন্দিত হতে চায় সে যেন এ লোকটিকে দেখে।’ সুতরাং যে ‘মুনকার’ এর প্রতিবিধানের কথা এখানে আলোচিত হচ্ছে তা অবশ্যই শরিয়াহ কর্তৃক ‘হারাম’-এ পর্যায়ের হতে হবে এবং প্রকৃতই শরিয়তে তা অপছন্দনীয় ও নিন্দিত হতে হবে। অর্থাৎ শরিয়তের সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণ ও মূলনীতির ভিত্তিতেই হারাম করা হয়েছে এমন বিষয় হতে হবে। শুধু চিন্তা-গবেষণা বা ইজতিহাদ-ইসতিম্বাত করে হারাম করা হয়েছে এমন হতে পারবে না, যেখানে ভুল-সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং যা স্থান, কাল ও পাত্রভেদে কখনো পরিবর্তন হতে পারে।
এমনিভাবে এর হারাম ও শরিয়তে বর্জিত হওয়ার বিষয়ে উলামাদের সর্বসম্মত রায় থাকতে হবে। সুতরাং যেখানে বৈধ-অবৈধ হওয়ার ব্যাপারে অতীতে বা সমসাময়িক যুগে উলামাগণের মতানৈক্য রয়েছে, তা এ ধরনের মুনকারের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না যার পরিবর্তন বাহুবলের মাধ্যমে আবশ্যক; বিশেষ করে ব্যক্তিগত পর্যায়ে তা কখনো বৈধ হতে পারে না। সুতরাং যেসব ইস্যুতে অতীত ও সমসাময়িক যুগে আলেম-উলামা ও ফকীহদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে এবং যেসব ইস্যুতে আলেম-উলামা ও ফকীহদের থেকে নানাবিধ মতামত পাওয়া যায়, এসব ক্ষেত্রে কোনো মুসলিম ব্যক্তি, দল, গ্রুপ বা সম্প্রদায়ের জন্য বৈধ হতে পারে না যে নানাবিধ মতামত থেকে একটি মত গ্রহণ করে তা অপরের ওপর জোর করে চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করবে। এমনকি সবার বা বেশির ভাগের মতামত সংখ্যালঘু বা স্বল্পসংখ্যকদের মতকে রহিত বা অনস্তিত্বে পরিণত করে না, যদিও তা একজনের মতামত হয়ে থাকে; তবে তাকে অবশ্যই মতামত প্রদানের যোগ্য মুজতাহিদ বা গবেষক পর্যায়ের হতে হবে। অনেক মতামত বা চিন্তাধারা এমনও রয়েছে যা একযুগে প্রত্যাখ্যাত ছিল, কিন্তু সময়ের আবর্তন-বিবর্তনে অপর এক যুগে তা প্রসিদ্ধ লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। এমনও অনেক ফকীহ রয়েছেন যার মতামতকে দুর্বলতা ইত্যাদি কারণে গ্রহণ করা হয়নি, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের কেউ দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে সমর্থনপুষ্ট করে পেশ করার কারণে পরে তা গ্রহণীয় ও নির্ভরযোগ্য মতামতের রূপ লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়ার কথা উল্লেখযোগ্য।।
যে অন্যায়ের প্রতিবিধানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে বাহুবলের সাহায্য নেয়া আবশ্যক তা অবশ্যই সুস্পষ্ট এবং সুপ্রতিষ্ঠিতভাবে প্রমাণিত অন্যায়-অনাচার বলে পরিগণিত হতে হবে এবং এ বিষয়ে সব আলেম-উলামাগণের ঐকমত্য থাকতে হবে; অন্যথায় এর প্রতিবিধান করতে গিয়ে অপর একটি অন্যায়-অনাচারের জন্ম হতে পারে। প্রত্যেকেই তার পছন্দনীয় মতটুকু অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়ার আগ্রহবোধ করতে পারে, যদিও তা বাহুবলের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে হয়ে থাকে!
কিছু মুসলিম রাষ্ট্রে দেখা যায়, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে চাঁদ দেখা ও রোজা শুরু হয়ে যাওয়ার কারণে কিছু যুবক জোর করে হোটেল, রেস্তোরাঁ, কফিশপ ইত্যাদি বন্ধ করে দেয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এসব উৎসাহী যুবকদের ধারণা হচ্ছে, পার্শ্ববর্তী দেশে রোজা শুরু হয়ে যাওয়ার কারণে এখানেও রোজা শুরু হয়ে গেছে, তাই এখন প্রকাশ্যে দিবালোকে পানাহার করা বৈধ হতে পারে না। যেমনি হয়েছিল মিসরে কোনো এক ঈদুল ফিতরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের কাছে শাওয়ালের চাঁদ উদয় হওয়ার গ্রহণযোগ্য কোনো আলামত বা দলিল-প্রমাণ না পাওয়ার কারণে পরবর্তী দিন রোজা রাখার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু ইত্যবসরে পার্শ¦বর্তী কোনো কোনো দেশের দেখা যাওয়া এবং পরবর্তী দিনে ঈদ হওয়ার ঘোষণা হয়েছিল। তাই আবেগপ্রবণ অতিউৎসাহী যুবকদের একটি দল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে, সরকার, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্তৃপক্ষ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে চ্যালেঞ্জ করে আগামীকাল তারা একাই রোজা রাখা থেকে বিরত থাকবে এবং ঈদের নামাজ আদায় করবে; পরিণামে অনাকাক্সিক্ষতভাবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সাথে সঙ্ঘাত অনিবার্য হয়ে উঠল।
আমি মনে করি এখানে তাদের নানাবিধ ভুল হয়েছিল :
এক : চন্দ্রোদয় প্রমাণিত হওয়ার গ্রহণযোগ্য উপায় নিয়ে আলেম-উলামা ও ফকীহদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে : তাদের কেউ এ ক্ষেত্রে একজনের সাক্ষ্যকে যথেষ্ট মনে করেছেন, আবার কেউ দু’জন সাক্ষীর প্রয়োজনীয়তা দাবি করেছেন। আবার অনেকে আকাশ মেঘমুক্ত থাকা অবস্থায় বিশাল এক সংখ্যক দর্শক হওয়ার শর্তারোপ করেছেন। প্রত্যেকেই এ ক্ষেত্রে দলিল-প্রমাণ ও স্বীয় যৌক্তিকতা পেশ করেছেন। সুতরাং মানুষকে নির্দিষ্ট একটি মত গ্রহণ করতে বাধ্য করা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও রাষ্ট্রক্ষমতা ছাড়া অন্য কারো জন্য বৈধ হতে পারে না।
দুই : চন্দ্রোদয় প্রমাণিত হওয়ার জন্য উদয়স্থলের অভিন্নতা বা পার্থক্য গ্রহণীয় হবে কি না? এ বিষয়ে ফকীহদের মতানৈক্য রয়েছে। একাধিক মাজহাব ও অর্ধিক সংখ্যক ফকিহ এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক দেশের জন্য স্বীয় আকাশে চাঁদ দেখা যাওয়ার শর্তারোপ করেছেন এবং এক দেশে চাঁদ দেখা গেলে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে তা গ্রহণীয় হবে না বলে তারা মত প্রকাশ করেছেন। ইবনে আব্বাস ও তার অনুসারীরাও এ মত প্রকাশ করেন। কুরাইব বর্ণিত হাদিস যা সহিহ মুসলিমে উল্লেখ করা হয়েছে এ ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট দলিল।
তিন : ইসলামি আইনের মৌলিক একটি ধারা হচ্ছে : মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে সরকার বা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে এবং জাতির প্রত্যেক সদস্যকে তা অবশ্যই মানতে হবে।
তাই রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ যদি কোনো ইস্যুতে সুনির্দিষ্ট কোনো ইমাম বা কোনো মাজহাবের মতামত গ্রহণ করে থাকে তাহলে সবাইকে তা মেনে চলতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করে উম্মতের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করা যাবে না। ফতোয়া প্রদানসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গে আমি এটাই বলতে চেয়েছি যে, রোজা রাখা এবং রোজা ভাঙার বিষয়ে আমরা মুসলমানরা সবাই যদিওবা একই কাতারে দাঁড়াতে সক্ষম না হই, তাহলে কমপক্ষে একই দেশের বসবাসরত নাগরিক হিসেবে সে দেশের মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত। একই দেশের অধিবাসী মুসলমানরা দুই ভাগে বিভক্ত হবে, কেউ রোজা রাখবে আবার কেউ রোজা ভাঙবে, এমনটি কখনো কাম্য ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এখানে লক্ষণীয় যে, আবেগপ্রবণ ও উৎসাহী যুবকদের ওই ভুল চিন্তাধারাগুলো বুলেটের সাহায্যে নয়; বরং সঠিক ও গ্রহণযোগ্য যুক্তি-তর্ক ও বুঝ প্রদানের মাধ্যমে সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে।
দ্বিতীয় শর্ত :
অন্যায়-অনাচার প্রকাশ্য রূপ ধারণ করা
অর্থাৎ যে ‘মুনকার’ তথা অন্যায় অনাচারের প্রতিবিধানে পেশিশক্তি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে তা অবশ্যই প্রকাশ্য ও দৃশ্যমান হতে হবে। সুতরাং যা মানুষের দৃষ্টির আড়ালে বা বদ্ধ দরজার অন্তরালে সংঘটিত হয়ে থাকে সে ব্যাপারে গুপ্তচরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া এবং গোপনে খোঁজ-খবর সংগ্রহ করতে তৎপর হওয়া বৈধ হবে না। বিভিন্ন মনিটরিং সেল, গোপন ভিডিও ক্যামেরা ইত্যাদির ব্যবহার, অথবা জোর করে গৃহে প্রবেশ করে কাউকে অপরাধকর্মে রত অবস্থায় ধরতে সচেষ্ট থাকা ইসলামি শরিয়তে বৈধ নয়। অসৎকাজের প্রতিবিধানসংক্রান্ত ওই হাদিসে অন্যায় অনাচারের প্রতিরোধ ও পরিবর্তনকে তা দেখতে পাওয়ার সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে : ‘তোমাদের কেউ যখন কোনো অপরাধকর্ম দেখতে পায়...।’ সুতরাং নিছক জানতে পারা বা শুনতে পাওয়ার ওপর এ ধরনের কাজ সম্পৃক্ত হতে পারে না। তাই কোনো ব্যক্তি যদি গোপনে কোনো পাপাচারে লিপ্ত হয় এবং তা প্রকাশ্যে বলে না বেড়ায় ইসলামি শরিয়াহ তাকে শাস্তি প্রদানের জন্য কোনো উপায়-উপকরণ অবলম্বন করে না; বরং তার শাস্তির বিষয়টি আখিরাতে আল্লাহর জন্য ছেড়ে দেয়। ইসলামি আইন অনুযায়ী দুনিয়াতে তাকে পাকড়াও করার কোনো অজুহাতের আশ্রয় নেয়া যাবে না; যতক্ষণ না তার অপরাধের খবর প্রকাশ হয়ে পড়ে।
এমনকি যে ব্যক্তি কোনো অপরাধ করার পর তা প্রকাশ না করে গোপনে আল্লাহর সাথে বোঝাপড়া করে নেয় এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে, আখিরাতের শাস্তিও এমতাবস্থায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হালকা করে দেন। যেমন বিশুদ্ধ হাদিসে এসেছে : ‘অপরাধকর্ম করার পর যারা তা প্রকাশ করে বেড়ায় তারা ছাড়া আমার উম্মতের প্রত্যেক ব্যক্তিই ক্ষমা পাওয়ার উপযুক্ত।’ এ জন্যই গোপনে সংঘটিত অপরাধকর্মের ওপর কারো কোনো ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব নেই। এর অগ্রভাগে রয়েছে অভ্যন্তরীণ ও অন্তরের রোগগুলো যেমন লৌকিকতা, কপটতা, মুনাফিকী, গর্ব-অহঙ্কার, হিংসা-বিদ্বেষ, কৃপণতা ও দ্বিমুখিতা ইত্যাদি। এসব অপরাধকর্ম বাহ্যিক আকৃতিতে রূপ ধারণ না করা পর্যন্ত এগুলোর জন্য কাউকে পাকড়াও করা যাবে না যদিও এগুলো ইসলামি শরিয়তের সর্বোচ্চ কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত; কারণ আমাদেরকে বাহ্যিকতার ওপর ভিত্তি করে ফায়সালা দিতে বলা হয়েছে এবং অন্তরের ফায়সালা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্যই নির্দিষ্ট।
উপর্যুক্ত কথার ওপর দলিল হিসেবে সর্বাগ্রে চমৎকার ও অদ্ভুত যে ঘটনাটি উল্লেখ করার দাবি রাখে, তা হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা: সংশ্লিষ্ট এবং ইমাম গাজ্জালী তাঁর ইহয়ায়ে উলুমুদ্দীন গ্রন্থের ‘সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের প্রতিবিধান’ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন : হজরত উমর রা: একদা দেয়াল টপকে এক ব্যক্তির গৃহে প্রবেশ করে তাকে অপছন্দনীয় ও খারাপ অবস্থায় দেখতে পেয়ে তিরস্কার করতে লাগলেন। লোকটি বলল, হে আমিরুল মুমেনিন! আমি হয়তো একটি অপরাধ করতে পারি; কিন্তু আপনি তো এখানে তিনটি অপরাধ করলেন। উমর বললেন, সেগুলো কি? লোকটি বলল, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন ‘তোমরা গুপ্তচরবৃত্তি করো না’ (সূরা হুজরাত ৪৯ : ১২), অথচ আপনি এখানে তা করলেন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন ‘সদর দরজা দিয়ে তোমরা গৃহে প্রবেশ করো’ (সূরা বাকারা ২ : ১৮৯), অথচ আপনি তা না করে ছাদের কার্নিশ বেয়ে প্রবেশ করলেন। এরপর আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেন : ‘তোমরা অপরের গৃহে প্রবেশ করো না যতক্ষণ না গৃহবাসীদের অন্তরঙ্গ হবে অর্থাৎ তাদের সম্মতি জেনে নেবে এবং তাদেরকে সালাম করবে।’ অথচ আপনি তা করেননি। হজরত উমর রা: তাকে ছেড়ে দিলেন এবং নিজের ওপর তাওবা করার বাধ্যবাধতকা আরোপ করলেন।
বাহুবলের সাহায্যে অসৎকাজ প্রতিধানের তৃতীয় শর্ত :
কার্যত ক্ষমতা ও শক্তির অধিকারী হওয়া
অন্যায়-অনাচারের প্রতিরোধ ও পরিবর্তন যারা করতে চায় তাদেরকে অবশ্যই তা করতে সক্ষমতার অধিকারী হতে হবে। এ ক্ষেত্রে বৈষয়িক অথবা আত্মিক শক্তির অধিকারী হতে হবে, যাতে বড় কোনো ক্ষতির শিকার হওয়া ছাড়া সহজেই কার্যোদ্ধারে সক্ষম হতে পারে। রাসূল সা: বলেন : যারা শক্তির সাহায্যে পরিবর্তন করতে সক্ষম হবে না তারা যেন মুখ তথা বর্ণনা-বিবৃতি দিয়ে তা পরিবর্তন করতে সচেষ্ট থাকে। অর্থাৎ যার বাহুবল তথা বৈষয়িক শক্তি নেই সে যেন এ পথ ছেড়ে দিয়ে বর্ণনা-বিবৃতি, প্রতিবাদ মিছিল বা প্রতিবাদ সভা ইত্যাদি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে, যদি সে তা করতে সক্ষম হয়।
শক্তির ব্যবহার সাধারণত ক্ষমতাবানদের জন্য সম্ভব। ক্ষমতাবান ব্যক্তি তার ক্ষমতার পরিধিতে তা ব্যবহার করে অসৎকাজের প্রতিবিধানে সচেষ্ট হতে পারে। যেমন : স্বামী তার স্ত্রীর সাথে, বাবা তার সন্তান-সন্তুতি ও পরিবারের সাথে যারা তার ভরণপোষণে লালিতপালিত, কোনো সংস্থার অধিকারী তার সংস্থার অভ্যন্তরে এবং সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান তার রাষ্ট্রসীমা বা কর্মসীমার পরিধিতে সাধ্য ও সক্ষমতার আওতায় থাকলে... ইত্যাদি। আমরা এখানে বৈষয়িক অথবা আত্মিক শক্তির কথা এ জন্য উল্লেখ করলাম; কারণ স্ত্রীর ওপর স্বামীর এবং পরিবারের ওপর গৃহকর্তার কর্তৃত্ব বৈষয়িক শক্তির বলে হয় না, বরং তা আদর-সোহাগ, মান-সম্মান, ভক্তি-শ্রদ্ধা ইত্যাদি আত্মিক শক্তির বলেই হয়ে থাকে।
অসৎকাজ বা পাপাচার যদি সরকারের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে
তখনই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় যখন অন্যায়-অনাচার সরকার বা রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় হয়ে থাকে, যার হাতেই বৈষয়িক ও সামরিক থেকে শুরু করে যাবতীয় শক্তির চাবিকাঠি। রাষ্ট্র বা সরকার যেখানে অপরাধী বা অপরাধের ধারক-বাহক হয়ে থাকে সেখানে অন্যায়-অনাচারের প্রতিবিধানে ব্যক্তি ও দলের কি করার আছে?
জবাব : তাদেরকে তার প্রতিবিধান ও পরিবর্তনের শক্তি ও সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। বর্তমান সময়ে তা তিন উপায়ে করা যেতে পারে :
এক. সশস্ত্রবাহিনীর মাধ্যমে : বর্তমান সময়ের বেশির ভাগ রাষ্ট্র, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো তাদের শাসনকার্য পরিচালনায়, পলিসি বাস্তবায়নে, বিরোধী দলকে দমন-নিপীড়ন ইত্যাদি কাজে সশস্ত্রবাহিনীর ওপর নির্ভরশীল। বিবেক-বুদ্ধির শক্তি নয়, বরং শক্তির বিবেক-বুদ্ধি হচ্ছে এসব সরকারের মূল ভিত্তি। যেসব সরকারের সাথে সশস্ত্রবাহিনীর একাত্মতা থাকবে তারা পরিবর্তনেচ্ছুক সব জাতীয় স্পন্দনকে নিমিষেই গুঁড়িয়ে দিতে পারবে। যেমনিভাবে বিভিন্ন রাষ্ট্র আমরা দেখে থাকি, বিশেষ করে সর্বশেষে যা ঘটেছে চীনে, সেখানে সশস্ত্রবাহিনীর সহায়তায় স্বাধীনতার দাবিদার ছাত্রবিপ্লবকে ঠাণ্ডা করে দেয়া হয়েছে।
দুই. পার্লামেন্ট, সিন্ডিকেট, সিনেট বা আইনসভা ইত্যাদির মাধ্যমে : গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে যে আইন প্রণয়ন করতে বা সংশোধন ও পরিবর্তন কিংবা রহিত করতে সক্ষমতা অর্জন করে থাকে। সত্যিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে এ ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সক্ষম হয় সে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করার মাধ্যমে যাবতীয় অন্যায়-অনাচারের প্রতিবিধান করতে এবং মানুষের ওপর তা চাপিয়ে দিতে সক্ষম হয়ে থাকে, যেখানে মন্ত্রিসভা থেকে শুরু করে সরকারপ্রধান কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানেরও বিরোধিতা করার কোনো সুযোগ থাকে না।
তিন. বিশাল আকারের জনশক্তি ও জনসমর্থন যা ‘ইজমা’র সাথে সামঞ্জস্যশীল এরূপ জনমত গঠনের মাধ্যমে। এ জনশক্তি কখনো আন্দোলিত হলে কোনো শক্তিই তার সামনে দাঁড়াতে কিংবা এর গতিরোধ করতে সক্ষম হবে না। উত্তাল বিক্ষুব্ধ সাগরের পাগলা ডেউ কিংবা বাঁধভাঙা বন্যার মতো এর গতি, যার সামনে কোনো কিছুই স্থির থাকতে পারে না। এমনকি স্বয়ং সশস্ত্র বাহিনীও এর সামনে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে না; কারণ সর্বোপরি তারাও এ জনশক্তির একটি অংশ। তাদেরই বাপ-চাচা, সন্তান-সন্তুতি, ভাই-ভ্রাতা কিংবা আত্মীয়স্বজনের সমষ্টি হচ্ছে এ বিশাল জনশক্তি। ইরানের বিপ্লবে তো এমনটিই ঘটেছে।
যে বা যারা এ তিন শক্তির কোনো একটিও অর্জন করতে পারেনি তাদের উচিত ধৈর্যধারণ করে তা অর্জনে কাজ চালিয়ে যাওয়া এবং পাশাপাশি মুখ ও কলম তথা বর্ণনা-বিবৃতি, লেখালেখি, দিকনির্দেশনা, দাওয়াতি তৎপরতা ইত্যাদির সাহায্যে অন্যায়ের প্রতিবিধান করতে সচেষ্ট থাকা, যাতে এ ক্ষেত্রে এমন এক বিশাল জনমত অর্জন করা সম্ভবপর হয় যারা অন্যায়ের প্রতিবিধানে সংকল্পবদ্ধ হবে। এর পাশাপাশি যাবতীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে এমন এক প্রজন্ম গঠন করতে আগ্রহী হওয়া যারা সানন্দে সমাজ পরিবর্তনের দায়দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবে এবং এ লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যাবে। আবু সা’লাবা আল খাশানী বর্ণিত হাদিসে এমনটিই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যখন তিনি রাসূলকে সা: এ আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘হে ঈমানদারগণ! নিজেদের কথা চিন্তা করো, অন্য কারোর গোমরাহিতে তোমাদের কোনো ক্ষতি নেই যদি তোমরা নিজেরা সত্য সঠিক পথে থাকো’ (সূরা মায়েদা ৫ : ১০৫)।
রাসূল সা: তাকে বললেন, বরং তোমরা সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের প্রতিবিধান করো যতক্ষণ না তোমরা দেখতে পাও যে, স্বার্থ, কৃপণতা ও কুপ্রবৃত্তি ইত্যাদির অনুসরণ ও অনুকরণ করা হচ্ছে, মানুষ দুনিয়ার গোলাম হয়ে যাচ্ছে এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ মতামত বাস্তবায়নে আগ্রহী হয়ে উঠছে। যদি এমনটি দেখতে পাও তাহলে অন্য মানুষের চিন্তা বাদ দিয়ে নিজের চরকায় তেল দেয়ার কাজে মনোনিবেশ করতে থাকো। তোমাদের পশ্চাতে এমন দিবস অপেক্ষা করছে, এ দিবসগুলোতে যারা ধৈর্যের পরিচয় দিতে পারবে তারা মূলত জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর দাঁড়িয়েও ধৈর্যের পরিচয় দিতে সক্ষম হবে। যারা এ দিবসগুলোতে তোমাদের ন্যায়কাজ করতে সক্ষম হবে তারা তোমাদের থেকে পঞ্চাশ গুণ বেশি প্রতিদানের অধিকারী হবে। কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে : ‘তুমি যখন দেখতে পাবে যে, অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যেখানে কিছু করার তোমার কোনো সাধ্য নেই।’
চতুর্থ শর্ত :
বড় কোনো ক্ষতির আশঙ্কা না থাকা
শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অন্যায়ের প্রতিবিধান করতে গিয়ে এর থেকে বড় কোনো ক্ষতির আশঙ্কামুক্ত থাকা। যেমন এমন কোনো ফিতনা-ফাসাদের সূচনা হওয়ার আশঙ্কা না থাকা যেখানে নিরপরাধ রক্তপাত ঘটে থাকে, ইজ্জত-আব্রুর শ্লীলতাহানি হয়ে থাকে এবং জনগণের ধন-সম্পদ লুণ্ঠিত হয়ে থাকে। এর পরিণামে অন্যায়-অনাচার আরো শক্ত করে গেড়ে বসতে সক্ষম হয় এবং জালিমদের জুলুম আরো বেগবান হতে সক্ষম হয়। তাই আলেম-উলামারা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন অন্যায়ের প্রতিবিধান করতে গিয়ে যদি এর থেকেও বড় অন্যায়ের সূচনা হওয়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে এ ক্ষেত্রে নীরব ভূমিকা পালন করা বৈধ হবে। এমতাবস্থায় সম্ভাব্য দু’টি ক্ষতির অপেক্ষাকৃত বড় ক্ষতি থেকে বাঁচার লক্ষ্যে স্বল্প ক্ষতিকে আলিঙ্গন করে নিতে হবে। এ মর্মে বিশুদ্ধ হাদিস রয়েছে। রাসূল সা: হজরত আয়েশাকে রা: বলেছেন : ‘তোমার জাতির সদস্যদের ইসলামের বয়স যদি স্বল্প না হতো তাহলে আমি ক্বাবা শরিফকে ভেঙে ইব্রাহীমের ভিত্তির ওপর নির্মাণ করতাম।’
কুরআন কারীমেও এর সমর্থনে বিভিন্ন ঘটনাবলি উল্লেখ রয়েছে। মুসার আ: সাথে নবী ইসরাঈলের ঘটনায় মুসা আ: যখন তাঁর প্রভুর সাথে নির্ধারিত সাক্ষাৎ করতে গেলেন, যা চল্লিশ রাতে গিয়ে পৌঁছল। তাঁর এ সময়কার অনুপস্থিতির সুযোগ সামেরি তার সোনালি গো-বাছুর দিয়ে জাতির লোকদের ফিতনাগ্রস্ত করে ফেলল এবং তারা তার ইবাদতে লিপ্ত হয়ে গেল। তার ভাই হারুন আ: জাতির লোকদের ওয়াজ-নসিহত করতে লাগলেন, কিন্তু তারা তার নসিহতে কান দিলো না; বরং তারা বলল ‘মুসা না আসা পর্যন্ত আমরা তো এরই পূজা করতে থাকব’ (সূরা ত্বহা ২০ : ৯১)। মুসা আ: ফিরে এসে তাঁর জাতিকে এ খারাপ অবস্থা তথা গো-বৎস পূজারত দেখে তাঁর ভাইয়ের ওপর খুব রাগ করলেন এবং রাগতস্বরে ভাইয়ের দাড়ি ধরে তাকে নিজের দিকে টেনে আনলেন এবং বললেন ‘হে হারুন! তুমি যখন দেখলে এরা পথভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে তখন আমার পথে চলা থেকে কিসে তোমাকে বিরত রেখেছিল? তুমি কি আমার হুকুম অমান্য করেছ? হারুন জবাব দিলো : হে আমার সহোদর ভাই! আমার দাড়ি ও মাথার চুল ধরে টেনো না। আমার আশঙ্কা ছিল, তুমি এসে বলবে যে, তুমি বনী ইসরাঈলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছ এবং আমার কথা রক্ষা করোনি’ (সূরা ত্বহা ২০ : ৯২-৯৪)। অর্থাৎ হারুন আ: তাঁর বড় ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে জাতির মধ্যস্থ ঐক্যবদ্ধতার সংরক্ষণকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন যাতে তার ভাইয়ের আগমনের পর দু’জনে পরামর্শ করে এ ভয়ানক ও বিপজ্জনক পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে সক্ষম হন, যা সুচিন্তিত চিন্তাধারা ও সঠিক কৌশল অবলম্বনের দাবি করছিল।
এ হচ্ছে চারটি শর্ত। যে বা যারা শক্তি প্রয়োগে অন্যায়ের প্রতিবিধানে এগিয়ে আসতে চায় তাদেরকে অবশ্যই উক্ত চারটি শর্তের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
আংশিক পরিবর্তন সঠিক চিকিৎসা নয়
মুসলিম উম্মাহর অবস্থার পরিবর্তনের লক্ষ্যে যারা কাজ করতে চান এবং ঘুণে ধরা এ সমাজের সংস্কার সাধনে এগিয়ে আসতে আগ্রহ পোষণ করেন এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। তা হচ্ছে পাশ্চাৎপদ যুগ থেকে শুরু করে উপনিবেশিকতার যুগ, ধর্মনিরপেক্ষতার শাসন এবং জালেম শাসকদের শোষণ ইত্যাদি সময়ে মুসলিম উম্মাহর দেহে যে ক্ষত ও আঘাত সৃষ্টি হয়েছে তার ক্ষতি অনেক গভীরে এবং তার শেকড় অনেক সুদূরে প্রোথিত। এ সমাজে প্রচলিত অন্যায়-অনাচারের আংশিক পরিবর্তন এর প্রতিবিধান ও চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট নয়। অশ্লীল নাচ-গান থেকে শুরু করে রাস্তাঘাটের বেলেল্লাপনা, উলঙ্গ বেহায়াপনা, অশ্লীল অডিও ভিডিও ক্যাসেটের ছড়াছড়ি ইত্যাদি যাবতীয় অবৈধ ও অনুচিত কার্যাবলি এ সমাজের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। বরং বাস্তব অবস্থা এর থেকেও বিপজ্জনক। এর প্রতিবিধান অবশ্যই বিরাট, ব্যাপক ও সুগভীর পরিবর্তনের দাবি রাখে। এমন পরিবর্তন যা যাবতীয় চিন্তাধারা ও নিয়ম-নীতিকে অন্তর্ভুক্ত করবে। এমন পরিবর্তন যাতে যাবতীয় মূল্যবোধ ও সব মাপকাঠি অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এমন পরিবর্তন যার আওতায় আখলাক তথা আচার-আচরণ এবং সব কাজকর্মও থাকবে। এমন পরিবর্তন, যাবতীয়-নীতি, কৃষ্টি-কালচার, যার আওতা বহির্ভূত হবে না। এমন পরিবর্তন যেখানে অবশ্যই যাবতীয় ব্যবস্থাপনা ও আইনকানুনও শামিল থাকবে। এর আগে অবশ্যই ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ, শিক্ষা, দিকনির্দেশনা এবং নমুনা উত্তর ইত্যাদি পেশ করার মাধ্যমে মানুষের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন সাধন করতে হবে। মানুষ যখনই নিজেরা নিজেদেরকে পরিবর্তনের যোগ্য করতে পারবে তখনই আল্লাহ তায়ালা তাদের অবস্থা পরিবর্তন করে দেবেন, এটাই হচ্ছে সৃষ্টিজগতের আল্লাহর চিরাচরিত রীতি। ‘আসলে আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো জাতির অবস্থা বদলান না যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের গুণাবলি বদলে ফেলে’ (সূরা আর রা’দ ১৩ : ১১)।
অসৎকাজের প্রতিবিধানে নম্রতা অবলম্বন আবশ্যক
আরেকটি বিষয় এখানে ভুলে গেলে চলবে না, তা হচ্ছে অসৎকাজের প্রতিবিধানে এবং পাপাচারীকে তার পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে অবশ্যই নম্রতা ও কোমলতা অবলম্বন করা এবং সহানুভূতিশীল হওয়া আবশ্যক। রাসূল সা: আমাদেরকে নম্রতা অবলম্বন করতে এবং সহানুভূতিশীল হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রতিটি কাজেই নম্রতা ও কোমলতাকে পছন্দ করেন। নম্রতা ও কোমলতার উপস্থিতি প্রতিটি কাজের শোভা বর্ধন করে থাকে এবং এর অনুপস্থিতি প্রতিটি কাজকে অসুন্দর করে। ইমাম গাজ্জালী ‘এহইয়া উলুম’ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে যে ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন তা হচ্ছে এক ব্যক্তি খলিফা মামুনের মজলিসে প্রবেশ করে খুবই কঠোর ভাষায় তাকে আদেশ-নিষেধ করতে লাগল এবং তাকে বলল, হে জালেম, হে পাপাচারী... ইত্যাদি। মামুন ছিল বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান এবং ধৈর্যশীল, সে অপরাপর রাজা-বাদশাহদের মতো তাকে শাস্তি দিতে অগ্রসর হয়নি; বরং তাকে বলল, একটু নম্র ও কোমলস্বরে কথা বলো, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তোমার চেয়েও উত্তম ব্যক্তিকে আমার চেয়েও খারাপ ও পাপাচারীর কাছে পাঠিয়েছিলেন এবং সাথে সাথে তাকে নম্রতা ও কোমলতার নসিহত করেছিলেন। আল্লাহ তায়ালা মুসা ও হারুনকে আ: পাঠিয়েছিলেন, তারা নিশ্চয়ই তোমার থেকে উত্তম; তাদেরকে ফেরাউনের কাছে পাঠিয়েছিলেন, সে নিশ্চয়ই আমার থেকেও খারাপ ও নিকৃষ্ট ছিল; অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তাদের উভয়কে বলেছিলেন ‘যাও তোমরা দু’জন ফেরাউনের কাছে, সে বিদ্রোহী হয়ে গেছে। তার সাথে কোমলভাবে কথা বলো, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভীত হবে’ (সুরা ত্বহা ২০ : ৪৩-৪৪)।
ফেরাউনের মতো পাপাচারী ও সীমা লঙ্ঘনকারী যার পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘সে সীমা লঙ্ঘন করেছে’ এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রেও আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আশাব্যঞ্জক শব্দ ব্যবহার করে বলেন ‘হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভীত হবে।’ এটা এ কথারই প্রমাণ বহন করে যে, কোনো অবস্থাতেই দাওয়াতি তৎপরতা থেকে আল্লাহর পথের আহ্বায়কদের নিরাশ হতে নেই। যার প্রতি দাওয়াত পেশ করা হচ্ছে সে যত বড় পাপাচারী ও অপরাধী হোক না কেন, দাওয়াতের ক্ষেত্রে যদি কঠোরতা ও সহিংসতা পরিত্যাগ করে নম্রতা, কোমলতা, সুকৌশল ও উত্তম সময় ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় তাহলে এমতাবস্থায় ইতিবাচক ফলাফলের ব্যাপারে নিরাশ না হয়ে আশাবাদী হওয়া উচিত।
0 comments:
Post a Comment