সিঙ্গাপুর নগররাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, তথা এই ক্ষুদ্রজাতির জনকতুল্য ব্যক্তিত্ব লি কুয়ান ইউ (৯০) বেশ কিছুদিন গুরুতর অসুস্থতায় ভুগে গত ২৩ মার্চ মৃত্যুবরণ করেছেন। সিঙ্গাপুর যে বিশ্বের অন্যতম প্রধান নৌ ও বিমানবন্দর, অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন নগর এবং অর্থনৈতিকভাবে খুব সমৃদ্ধ, এসব সবার জানা। তবে সিঙ্গাপুরের স্বাধীনতা এবং এ রাষ্ট্
রকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে লি কুয়ান ইউর কত বড় অবদান এবং কত বাধার মোকাবেলা তাকে করতে হয়েছে, সেটা জানা নেই অনেকেরই।
অনেকের মতে, লি চীনের মডেলকে অনুসরণ করেছেন যদিও তিনি চীনের মতো কমিউনিস্ট নন, বরং ক্যাপিটালিস্ট। চীনে মুক্ত অর্থনীতির পাশাপাশি, রুদ্ধ রাজনীতি প্রত্যক্ষভাবে বজায় রয়েছে সমাজতন্ত্রের নামে। আর লি কুয়ান ইউ অর্থনীতিকে মুক্ত রেখে রাজনীতিকে পরোক্ষভাবে রুদ্ধ করে রেখেছিলেন গণতন্ত্রের নামে। তার দীর্ঘ অসুস্থতাকালে তিনি সরকারি ক্ষমতায় না থাকলেও দেশ শাসনের পাদপীঠ কখনো তার ছায়ামুক্ত ছিল না, এখনো নয়। তার পথই সিঙ্গাপুরি সরকার নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করে এসেছে। লি পরিবারতন্ত্রের প্রবক্তা নন, তবুও তার উত্তরাধিকারী হিসেবে সরকারের শীর্ষে অধিষ্ঠান হয়েছে আর কারো নয়, তার ছেলের। তিনি বাবার গুণাবলি অনেকাংশে ধারণ করা অসম্ভব নয়। তবে বাবার পর ছেলের এই আগমন নিছক কাকতালীয়, না পরিকল্পিত, সেটা এক গুরুত্ববহ প্রশ্ন বটে।
লি কুয়ান নিঃসন্দহে এক বিশাল ব্যক্তিত্ব। তিনি যে দেশটির প্রতিষ্ঠাপুরুষ এবং কয়েক দশকব্যাপী কাণ্ডারী, সেটি ক্ষুদ্র হলেও তার কাছ থেকে সবার শিক্ষণীয় আছে বিরাট কিছু। তিনি বিভিন্ন ভাষা, ধর্ম ও নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের জনগোষ্ঠীকে এক করে সাফল্যের সাথে নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতীয় অগ্রযাত্রায়। তিনি সিঙ্গাপুরকে বানিয়েছেন অর্থনীতির মডেল। এ ক্ষেত্রে ছোট নগর দেশটা যেন ক্ষুদ্রাকার টাট্টু ঘোড়ার মতো প্রাণবন্ত ও উদ্যমী, যে সামনে ছুটে চলে দুর্বার গতিতে। লি কুয়ান ইউ জনগণকে অশেষ ঋণের বন্ধনে আবদ্ধ করে গেছেন। সিঙ্গাপুরের সবাই তার কৃতিত্ব, সাফল্য, অবদান ও গুণগুলোর স্বীকৃতি দেন, প্রশংসা করেন।
তবে মৃত্যুর পর লির ভূয়সী প্রশংসা অবিমিশ্রিত নয়। সঙ্গত কারণেই তার সফলতার মতো ব্যর্থতা, উজ্জ্বল দিকের মতো অন্ধকার দিক থেকেও সবার শিক্ষা নেয়া উচিত। লি মানুষ; তাই দোষগুণে মেশানো নেতা। তিনি স্বদেশকে উন্নয়ন দিয়েছেন যতটা, গণতন্ত্র তেমন দিতে পারেননি। অর্থনীতিতে তার অনবদ্য অবদান কুণ্ঠাহীনভাবে স্বীকার করতে হয়। কিন্তু জনগণের মৌলিক ও মানবাধিকার, তথা সার্বিক গণতন্ত্রের বিষয়ে তার সাফল্য কতটা, তা বলতে গিয়ে ওয়াকেবহাল ব্যক্তি হবেন কুণ্ঠিত।
লি দুর্নীতি ও দূষণের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেয়ায় তার দমন-পীড়ন অনেকের কাছে গৌণ। একই কারণে মনে করা হয়, অবাধ গণতন্ত্র না দিলেও এক ধরনের সুশাসন এসেছে লির হাত দিয়ে। আমাদের দেশে ক্ষমতালোভী কোনো মহল গণতন্ত্রের আগে উন্নয়নের ধুয়া তুললে তা সিঙ্গাপুরের চেয়ে অনেক খারাপ ফল বয়ে আনবে দেশের জন্য। কারণ বাংলাদেশে ‘উন্নয়নবাদী’ এই গোষ্ঠী দুর্নীতিমুক্ত নয়, পরিবেশবান্ধবও নয়। লি কুয়ান ইউর মতো দেশপ্রেমও তাদের নেই। যা হোক, সিঙ্গাপুরে যদি অর্থনীতির সমৃদ্ধির মতো রাজনীতিতে গণতন্ত্র অবারিত হতো, শক্তিশালী বিরোধী দল থাকত, তা হলে এর পার্লামেন্ট যেমন পুরো গণতান্ত্রিক চেহারা পেত, তেমনি দেশটির (সেই সাথে লি কুয়ান ইউর) ইমেজ অনেকটা উন্নত হতো।
দেশের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় লি প্রশংসা পেয়েছেন। আর মানবাধিকার কায়েমের ব্যর্থতায় পেয়েছেন সমালোচনা। তবুও এত বেশি অবদান, এত বড় ভাবমূর্তি যে, জনগণ তার ইতিবাচক পরিচয়টিকেই মুখ্য মনে করে। তাদের মনে আমৃত্যু ছিল তার জন্য বিশেষ শ্রদ্ধার আসন। তার ছেলে বা আর কোনো উত্তরসূরি জনপ্রিয়তা ও সাফল্য মিলিয়ে তুলনীয় কোনো ইমেজ গড়তে পারবেন না।
লি কুয়ান ইউর শেষকৃত্য তার জন্য দেশবাসীর ভালোবাসার অনন্য নজির। কর্তৃত্ববাদী মানুষটির রাজনীতি অস্বস্তিকর হলে তার পরিচালিত অর্থনীতি ছোট সিঙ্গাপুরকে বিশ্বের বুকে বিরাট মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। এটা জনগণ প্রতিনিয়ত উপলব্ধি করে থাকে। ‘যে আলো আমাদের এত দিন ধরে দিয়েছে পথের দিশা তা আজ নিভে গেছে এটা প্রধানমন্ত্রী লি সেইন লুংয়ের শোকগাথা। তবে তা বাবার জন্য ছেলের নিছক ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়। ২৯ মার্চ লির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে শত শত মানুষ অশ্রুসজল হয়ে তাকে চিরবিদায় জানিয়েছে। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দেশের নেতাদের অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
আবাদি জমি ও প্রাকৃতিক সম্পদহীন সিঙ্গাপুরকে একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত রাষ্ট্র করার রূপকার লি কুয়ান ইউ কর্তৃত্ববাদী শাসনের জন্য সমালোচিত হয়েছেন। কিন্তু অসংখ্য মানুষ তাকে হারিয়ে যেভাবে শোক জ্ঞাপন করেছে, তাতে মনে হতে পারে কর্তৃত্ববাদী শাসক নন, পরিবারের স্নেহশীল বড় কর্তার তিরোধান ঘটেছে।
লি কুয়ান ইউর মৃত্যুর পর জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিত কফিনে লাখো মানুষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। এভাবে ছয় দিন অতিবাহিত হলে ২৯ মার্চ মরদেহ পার্লামেন্ট ভবন থেকে ন্যাশনাল ভার্সিটি নিয়ে যাওয়া হয়। ১৫ কিলোমিটার পথের এই শোকমিছিলে বহু মানুষ অংশ নিয়েছে প্রবল বর্ষণের মধ্যেই। ২১ বার তোপধ্বনি আর কয়েকটি যুদ্ধবিমানের ফ্লাইপাস্টের মধ্য দিয়ে নেতাকে বিদায় জানানো হয়। ‘দেশের জনক’ রূপে লি গণ্য হওয়ায় নিয়মের ব্যতিক্রম করে ২১ বার তোপধ্বনি দেয়া হয় তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। বিদায়লগ্নে আবেগপ্রবণ কেউ কেউ বলে ওঠেন, ‘লি অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ, সব সময়ে সব মানুষের পিতা।’ সরকারি হিসাবে সাড়ে চার লাখ মানুষ তার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। ছোট দেশটির জনসংখ্যা মাত্র ৩৪ লাখ। জাপান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার সরকারপ্রধানরা এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন লির শেষ বিদায়কালে উপস্থিত ছিলেন।
৩৬ বছর বয়সে লি কুয়ান ইউ সিঙ্গাপুরের সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন থেকে ৩১ বছর একটানা ক্ষমতায় থেকে ১৯৯০ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেন। এর মধ্যে দেশটি ব্রিটিশের শাসনমুক্ত হয়ে স্বাধীন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। পরে মালয়েশিয়ার সাথে ফেডারেশন গঠন ও বাতিল করেছে। ‘তিনি শক্ত হাতে একসময় অনগ্রসর ও ক্ষুদ্র এই ব্রিটিশ উপনিবেশকে অত্যাধুনিক নগররাষ্ট্রে পরিণত করেন। অন্য দিকে, স্বৈরতান্ত্রিক কায়দায় দেশ চালানোর কারণে তার সমালোচনাও হয়েছে।’
0 comments:
Post a Comment