WHAT'S NEW?
Loading...

এক যে ছিল মারডক

 


[রূপকথা লেখা হয় এভাবে : এক যে ছিল রাজা। তার ছিল হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া...। আধুনিক একটি রূপকথার জন্ম হয়েছে সম্প্রতি। এর নায়ক রুপার্ট মারডক। কী না ছিল তার! ধনাগারে টাকার পাহাড়। আমেরিকা ইউরোপ এশিয়ায় মিডিয়া-সাম্রাজ্য। গোপন ও প্রকাশ্য রাজনৈতিক প্রতিপত্তি। হঠাৎ পা পিছলে গেল এই ‘রাজা’টির। তা নিয়ে হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী লিখেছেন নতুন রূপক

থা ]



১৮৯১ সাল কিংবা তার আরো বছর দুই পরের কথা। লন্ডনের এক ক্লাবে পলমল গেজেট পত্রিকার সম্পাদক ফ্রেডরিক গ্রিনউডের সাথে দেখা জর্জ রিডেল-এর (পরে তিনি লর্ড হন)। এম্স্লে কার তখন নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড পত্রিকার সম্পাদক হলেও পত্রিকার প্রাণপুরুষ বলতে যা বোঝায়, তিনি হলেন রিডেল। দু’জনের আলাপের একপর্যায়ে রিডেল বললেন গ্রিনউডকে, ‘জানেন তো, আমার একটি পত্রিকা আছে।’
‘তাই নাকি, কোন পত্রিকা?’ প্রশ্ন গ্রিনউডের।
‘ওটার নাম নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড। আপনাকে এক কপি পাঠিয়ে দেবো।’



যথাসময়ে জর্জ রিডেল তার পত্রিকার এক কপি পাঠিয়ে দেন গ্রিনউডের কাছে। এর কিছু দিন পর দু’জনায় আবার দেখা ক্লাবে। কথার ফাঁকে রিডেল জানতে চাইলেন গ্রিনউডের কাছে, ‘ভালো কথা, রিডেল। আপনার কেমন মনে হলো আমার পত্রিকাটি?’
‘আমি একটুখানি দেখেছি, তারপরই বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিয়েছি। পরে মনে হলো, ওটা যদি আমি ওখানে রেখে দিই, তাহলে আমার বাবুর্চি সেটা পড়তে পারে। তাই ওটা আমি পুড়িয়ে ফেলেছি।’



১৮৬ বছরের পুরনো যে ব্রিটিশ পত্রিকাটি পুলিশকে ঘুষ দিয়ে তথ্য আদায় এবং ফোন হ্যাকিংয়ের অভিযোগে বন্ধ করে দেয়া হলো, সেই নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এর ইমেজ গোড়াতেই কী রকম ছিল, এ ঘটনা তার একটি জ্বলন্ত সাক্ষ্য। রবিবাসরীয় এ সাপ্তাহিকটি শেষ পর্যন্ত ‘চরিত্র’ অক্ষুণœ রেখেছে এবং এটা রাখতে গিয়ে তাকে যা করতে হয়েছে, সেটাই তার ‘অকালমৃত্যু’র কারণ হয়েছে। পত্রিকাটির পতনের পাশাপাশি বর্তমান বিশ্বের একমাত্র মিডিয়া মোগল রুপার্ট মারডকের সাম্রাজ্যও কেঁপে উঠেছে।


 


পেছন ফিরে দেখা
নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড আত্মপ্রকাশ করে ১৮৪৩ সালের ১ অক্টোবর। তখন এটি ট্যাবলয়েড আকারে বের হতো না; ছিল ব্রডশিট পত্রিকা। পত্রিকাটি প্রকাশ করেন জন ব্রাউন বেল। ১৮৯১ সালে পত্রিকাটি কিনে নেন লেসেলস কার। ১৯৬৯ সালে রুপার্ট মারডকের মিডিয়া সংস্থা নিউজ লিমিটেড (পরে নিউজ ইন্টারন্যাশনাল) কিনে নেয় পত্রিকাটি। ১৯৮৪ সালে তারা পত্রিকাটিকে ট্যাবলয়েড আকারে ছাপাতে শুরু করে। এ সময় পত্রিকাটি গণ্যমান্য ব্যক্তিদের (সেলেব্রিটি) গোপন খবর এবং হালকা খবর ছাপানোর দিকে বেশি মনোযোগী হয়। যৌন কেলেঙ্কারির খবর ছাপানোর ব্যাপারে পত্রিকাটির অতি আগ্রহের কারণে এর ডাকনাম ছড়িয়ে পড়ে ‘... এর খবর’, ‘বিশ্বের...’।
শুরুতেই নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডের লক্ষ্য ছিল নব্যশিক্ষিত কর্মজীবী সম্প্রদায়। দাম রাখা হয়েছিল প্রতি কপি মাত্র তিন পেন্স (এখনকার ১.০৪ পাউন্ড), যা সে সময়ও সবচেয়ে সস্তা। আর খবরের ক্ষেত্রেও তারা বেছে নেয় যৌন সুড়সুড়িপূর্ণ ও অপরাধের ঘটনাকে। পতিতালয়ের খবর, এ সংক্রান্ত পুলিশ রিপোর্ট, নষ্ট মেয়ের কাণ্ডকীর্তি এ সবই মহাসমারোহে ছাপা হতে থাকে নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডে। ফলে দ্রুত পরিচিত ও সর্বাধিক বিক্রিত পত্রিকা হয়ে ওঠে। গোড়ার দিকে ১২ হাজার প্রচারসংখ্যা ছিল পত্রিকাটির, যা সে যুগের হিসাবে বিশাল। একপর্যায়ে ব্রিটিশ সরকার সংবাদপত্রের ওপর থেকে ট্যাক্স প্রত্যাহার করলে অন্যান্য পত্রিকা দাম কমায়, কিন্তু নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এর দাম আগের মতোই থেকে যায়। ফলে প্রচারসংখ্যার দৌড়ে তারা পিছিয়ে পড়ে। তার পরও ১৮৮০ সালে এর প্রচারসংখ্যা দাঁড়ায় ৩০ হাজারে। ১৯১২ সালের দিকে এর প্রচারসংখ্যা পৌঁছে যায় ৩০ লাখের কাছাকাছি, ১৯৩৯ সালে হয় ৪০ লাখ। ১৯৫০ সালের মধ্যে নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রীত সংবাদপত্রে পরিণত হয়। তখন বিক্রি দাঁড়ায় ৯০ লাখ কপিতে।



  চীনা তৃতীয় স্ত্রী ওয়েনদি দেং এর সাথে


মারডক সাম্রাজ্যে
১৯৬৯ সালে মারডক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড। অর্থাৎ রুপার্ট মারডকের নিউজ লিমিটেড কিনে নেয় পত্রিকাটি। অবশ্য কেনাটা সহজে হয়নি। দীর্ঘ এক বছরব্যাপী তিক্ত লড়াই শেষে জয় হয় মারডকের। তখন পত্রিকাটি প্রকাশ হতো রবার্ট ম্যাক্সওয়েলের প্রেস থেকে। ম্যাক্সওয়েল একে তো বিদেশী বংশোদ্ভূত, তার ওপর তার রাজনৈতিক মতামত পছন্দ ছিল না সম্পাদক স্ট্যাফোর্ড সমারফিল্ডের। তিনি একপর্যায়ে ঘোষণা দিলেন, এ পত্রিকা আগে যেমন ছিল, এখনো তেমন ব্রিটিশ পত্রিকাই থাকবে।



নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড দখলের লক্ষ্যে মারডকের নিউজ লিমিটেড এ সময় পত্রিকাটির ছোটখাটো শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার কিনে নিতে থাকল। ডিসেম্বরের মধ্যেই দেখা গেল তারা পত্রিকার ৪০ ভাগ শেয়ারের মালিক হয়ে গেছে। এ সময় ম্যাক্সওয়েলকে সমর্থন দেয় জ্যাকসন পরিবার (২৫ ভাগ শেয়ারের মালিক), আর মারডক পান পত্রিকার তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান উইলিয়াম কারের পরিবারের (৩০ ভাগ শেয়ারের মালিক) সমর্থন। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে শেয়ারহোল্ডারদের এক মিটিংয়ে ম্যাক্সওয়েল হেরে যান। ওই সভায় উপস্থিতদের অর্ধেকই ছিল কোম্পানির স্টাফ, যাদেরকে সাময়িকভাবে ভোটাধিকার দেয়া হয়েছিল। ম্যাক্সওয়েল অভিযোগ করেন, জঙ্গলের আইন প্রয়োগ করে মারডক পত্রিকাটি দখল করেছেন। জবাবে মারডক বলেন, অস্ট্রেলিয়ায় পত্রিকা পরিচালনার রেকর্ড দেখে শেয়ারহোল্ডাররা আমাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।



একই বছর জুন মাসে অসুস্থতার কারণে উইলিয়াম কারকে চেয়ারম্যান পদ থেকে অপসারণ করা হয়। তার স্থলাভিষিক্ত হন রুপার্ট মারডক।
এ সময় পত্রিকাটির বিরুদ্ধে একের পর এক আদালতে মানহানি মামলা কিংবা প্রেস কমিশনে নানা অভিযোগ উঠতে থাকে; সংবাদ সংগ্রহের জন্য কাউকে ফাঁদে ফেলা কিংবা কারো বিরুদ্ধে বিতর্কিত প্রচারণা চালানোর অভিযোগ। এসব মামলার মধ্যে দু’টি বিখ্যাত মামলা হলো রিপোর্টার নেভিল টার্নবেক ও সাংবাদিক মাজহার মাহমুদের করা।



তবে যত মামলাই হোক না কেন, নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড তার ‘ঐতিহ্য’ থেকে কখনো সরে আসেনি। এ পত্রিকার রিপোর্টাররা ইরাক ও আফগানিস্তানে নিহত ব্রিটিশ সৈন্যদের পরিবারের সেলফোন থেকে মেসেজ চুরি করেছে। নিহত এক তরুণীর ভয়েস মেইল বক্স চুরি করতেও বাধেনি তাদের। করেছে রাজকুমারদের ফোন হ্যাকিংও। রাজনীতিবিদ ও খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ফাঁসে তো তাদের জুড়ি মেলা ভার। আর এই কাজটি (পড়–ন : কুকাজ) করতে গিয়ে তারা কখনো কাউকে ফাঁদে ফেলেছে, কখনো পুলিশকে ঘুষ দিয়েছে।
এভাবে পত্রিকাকে ব্যবহার করে রুপার্ট মারডক ব্রিটেনে হয়ে ওঠেন এক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তার ‘সুনজর’ পেতে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতারাও ছিলেন ব্যগ্র। তবে সে কাহিনীতে পরে আসছি। আসুন দেখি, কে এই রুপার্ট মারডক।


 


রুপার্ট মারডকের আদ্যোপান্ত
রুপার্ট মারডকের জন্ম অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে; ১৯৩১ সালের ১১ মার্চ। পিতা কেইথ মারডক। মা এলিজাবেথ জয়। মারডক তিনটি বিয়ে করেছেন। সন্তানসংখ্যা ছয়। রোমান ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী এই ব্যক্তি ১৯৮৫ সালে আমেরিকান নাগরিকত্ব লাভ করেন।



মারডক বিশ্বব্যাপী ১৭৫টি সংবাদপত্রের মালিক। সংবাদমাধ্যমের প্রতি এই নেশা তার রক্তেই ছিল। তার পিতা ছিলেন মেলবোর্নের একটি আঞ্চলিক সংবাদপত্রের মালিক। সেই সূত্রে ছোটবেলা থেকেই এ জগতের সাথে মারডকের পরিচয় ও প্রীতি।



রুপার্ট মারডকের বয়স যখন ২২, তখন তার পিতার মৃত্যু হয়। ফলে অক্সফোর্ডে পড়াশোনা বাদ দিয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং নিউজ লিমিটেডের হাল ধরেন। এ সময় তিনি পুরনো পত্রিকা কিনে নেয়ার প্রতি মনোনিবেশ করেন এবং পার্থ থেকে প্রকাশিত সানডে টাইমস পত্রিকাটি কিনে নেন। সে-ই শুরু। এর পরবর্তী কয়েক বছরে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের অনেকগুলো পত্রিকা কিনে ফেলেন তিনি।
১৯৬৪ সালে নিউজিল্যান্ড ভ্রমণে যান রুপার্ট মারডক। বন্ধুদের নিয়ে একটি ভাড়া-করা মরিস মাইনর গাড়িতে করে ঘুরে বেড়ানোর সময় জানতে পারেন, ব্রিটেনভিত্তিক কানাডিয়ান নিউজপেপার ম্যাগনেট লর্ড থমসন অব ফ্লিট নিউজিল্যান্ডের দি ডোমিনিয়ন পত্রিকা কিনে নিতে চাচ্ছে। মারডকও এ দৌড়ে অংশ নেন। চতুর্মুখী লড়াইয়ে জয়ী হন মারডক। তখন তার বয়স মাত্র ৩২।



১৯৬৪ সালেরই শেষের দিকে মারডক প্রকাশ করেন অস্ট্রেলিয়ার প্রথম জাতীয় দৈনিক দ্য অস্ট্রেলিয়ান; প্রথমে ক্যানবেরা, পরে সিডনি থেকে। এই ব্রডশিট দৈনিকটি প্রকাশের উদ্দেশ্য ছিল নিজেকে ‘কোয়ালিটি’ পত্রিকা প্রকাশকের নতুন সম্মান এনে দেয়া এবং পাশাপাশি অধিকতর রাজনৈতিক প্রভাব অর্জন।



১৯৭২ সালে মারডক সিডনির প্রভাতী ট্যাবলয়েড ডেইলি টেলিগ্রাফ হস্তগত করেন। পত্রিকাটির মালিক ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া মোগল স্যার ফ্রাংক পেকার। পরে তিনি পত্রিকাটি মারডকের কাছে বিক্রি করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।



১৯৬৯ সালে মিরর গ্রুপের কাছ থেকে মারডক কিনে নেন ব্রডশিট দৈনিক দ্য সান এবং এটিকে ট্যাবলয়েডে রূপান্তর করেন। ২০০৬ সাল নাগাদ এর দৈনিক প্রচারসংখ্যা দাঁড়ায় ৩০ লাখ কপি। ১৯৮১ সালে দ্য টাইমস ও দ্য সানডে টাইমস  এ দু’টি পত্রিকাও কিনে নেন মারডক।



ব্রিটেনের পাশাপাশি আমেরিকায়ও মিডিয়া সাম্রাজ্যবিস্তারে মনোযোগী হন মারডক। সেখানে তিনি প্রথম কিনে নেন সান অ্যানটনি ও এক্সপ্রেস-নিউজ পত্রিকাটি; ১৯৭৩ সালে। ১৯৭৬ সালে আমেরিকা থেকে প্রকাশ করেন ট্যাবলয়েড পত্রিকা স্টার। ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে কিনে নেন নিউ ইয়র্ক পোস্ট। ১৯৮৫ সালে টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স মুভি স্টুডিও কেনেন মারডক। পরের বছর কিনে নেন ছয়টি টেলিভিশন স্টেশন। এগুলো নিয়ে ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে গঠন করেন ফক্স ব্রডকাস্টিং কোম্পানি। ১৯৮৭ সালে তিনি কেনেন অস্ট্রেলিয়ার দ্য হেরাল্ড অ্যান্ড উইকলি টাইমস লিমিটেড। এক সময় মারডকের পিতা এ কোম্পানি চালাতেন।



এ সময় মারডকের খানিকটা বিপর্যয় নেমে আসে। তার নিউজ করপোরেশন হঠাৎ বিপুল ঋণের জালে আটকে যায়। ফলে আমেরিকায় অনেকগুলো ম্যাগাজিনের স্বত্ব বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন মারডক।



১৯৯৬ সালে মারডক ক্যাবল নিউজ মার্কেটে ঢোকার সিদ্ধান্ত নেন এবং চালু করেন ফক্স নিউজ চ্যানেল। এটি ছিল সিএনএন-এর মতোই ২৪ ঘণ্টার নিউজ টিভি। এটি চালুর সাথে সাথে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। দর্শক হারাতে থাকে সিএনএন।



অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও ব্রিটেন ‘বিজয়ের’ পর মারডক এশিয়ায় তার মিডিয়া সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হন। ১৯৯৩ সালে তিনি এক শ’ কোটি ডলারে কিনে নেন হংকংয়ের স্টার টিভি (প্রতিষ্ঠাতা রিচার্ড লি)। এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে এর অফিস খোলেন। এটি এখন এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ টিভি নেটওয়ার্ক। তবে এখানেও কিছুটা হোঁচট খেতে হয় মারডককে। চীন সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করায় চ্যানেলটি চীনের বেশির ভাগ অঞ্চলেই দেখা যায় না।



মারডক সম্প্রতি কিনে নিয়েছেন তুরস্কের টিভি চ্যানেল টিজিআরডি। পত্রপত্রিকার খবরে বলা হয়, তুরস্কের ‘রেকর্ডিং মোগল’ নামে খ্যাত আহমদ এরগুনের অংশীদারিত্বে মারডক চ্যানেলটি কিনে নেন।


 


বিতর্কিত কর্মকাণ্ড
আগেই বলা হয়েছে, মারডকের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের ধরণই হচ্ছে আগ্রাসী। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী তারা দেখতে চায় না। প্রতিদ্বন্দ্বীকে দমিয়ে রাখতে কিংবা নির্মূল করতে ন্যায়-অন্যায় যেকোনো ধরনের কাজ করতে পিছপা হয় না মারডক গ্রুপ। অস্ট্রেলিয়ান টিভি চ্যানেল সেভেন নেটওয়ার্কের একটি মামলা থেকেই নিউজ করপোরেশনের আগ্রাসী ব্যবসায়ের চেহারাটি ধরা পড়ে। মামলায় সেভেন নেটওয়ার্ক অভিযোগ করে যে ন্যাশনাল রাগবি লিগের মালিকানার সূত্রে নিউজ করপোরেশন ও তার দুই সহযোগী অন্য কোনো চ্যানেলকে লিগের খেলা সম্প্রচারের সুযোগ দিচ্ছে না।



মামলায় যদিও সেভেন নেটওয়ার্ক হেরে যায়, কিন্তু নিউজ করপোরেশনের আগ্রাসী চেহারাটি তাতে ঢাকা পড়ে না।
এরও আগে, ১৯৮৬ সালে, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন ও আমেরিকায় নিজের পত্রিকাগুলোতে মারডক ইলেকট্রনিক প্রডাকশন প্রসেস চালু করেন। এই উচ্চমাত্রার অটোমেশন প্রক্রিয়ার কারণে, বিশেষ করে প্রেস শাখার ছয় হাজার কর্মীর কাজ চলে যায়। ব্রিটেনের প্রেস শ্রমিক ইউনিয়নগুলোতে এটা তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। লন্ডনের শ্রমিক অধ্যূষিত এলাকা ওয়াপিংয়ে সহিংস বিক্ষোভ করে শ্রমিকেরা। রাস্তায় রাস্তায় খণ্ডযুদ্ধ হয়। গ্রেফতার হয় অনেকে।



রাজনৈতিক প্রভাব
রাজনীতিতে প্রভাব রাখতে মারডকের উদগ্র আগ্রহ সর্বজনবিদিত। নিজে রাজনীতি করেন না, কিন্তু রাজনীতিকে চালাতে চান নিজের মতো করে। এ ক্ষেত্রে জনপ্রিয় পত্রিকা তার বড় হাতিয়ার। আর এই হাতিয়ারকে তিনি ব্যবহারও করেছেন যথেচ্ছ।



আশির দশক এবং নব্বইর দশকের গোড়ার দিক পর্যন্ত মারডকের পত্রিকাগুলো ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। ১৯৯২ সালের নির্বাচনে জন মেজরের অপ্রত্যাশিত বিজয়ে দ্য সান-এর বিশাল ভূমিকা রয়েছে বলে পত্রিকাটি প্রকাশ্যে দাবি করে। থ্যাচার-মেজর যুগের সমাপ্তি ঘটলে মারডকও পাল্টে যান। তিনি সমর্থনের হাওয়া ঘুরিয়ে দেন লেবার পার্টি ও এর নেতা টনি ব্লেয়ারের দিকে। ১৯৯৭, ২০০১ ও ২০০৫ সালের নির্বাচনে মারডকের পত্রিকাগুলো হয় নিরপেক্ষ, নতুবা টনি ব্লেয়ারের পক্ষে ছিল। এ সময় বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে ব্লেয়ারের সাথে তার গোপন বৈঠকের কথাবার্তা ফাঁস হয়ে গেলে রাজনীতিতে বিতর্ক শুরু হয়।



একপর্যায়ে আবার পাল ঘুরিয়ে দেন মারডক। এবার তার দ্য সান পত্রিকা প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির নিন্দা করতে থাকে। তারা সমর্থন দেয় ডেভিড ক্যামেরনের কনজারভেটিভ পার্টিকে। শিগগিরই কনজারভেটিভ পার্টি নির্বাচনে জয়ী হয়ে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করে, ডেভিড ক্যামেরন হন প্রধানমন্ত্রী। অথচ ২০০৬ সালের জুলাই মাসে এক সাক্ষাৎকারে মারডককে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল রক্ষণশীল দলের নেতা (ক্যামেরন) সম্পর্কে তিনি কী ভাবেন। জবাবে মারডক বলেছিলেন, তেমন কিছু নয়। কিন্তু ২০০৯ সালে নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এর ফোন হ্যাকিং কেলেঙ্কারি ফাঁস হতে শুরু করলে মারডক সিদ্ধান্ত নেন পরবর্তী নির্বাচনে ক্যামেরনকে সমর্থন দেবে তার পত্রপত্রিকা। এর মাধ্যমে সমালোচকদের এ কথাই নতুন করে সত্য প্রমাণিত হলো যে, যখন যে দল ক্ষমতায় আসবে বলে মনে হয়, মারডক সেই দলকেই তখন সমর্থন দেন। উদ্দেশ্য : নিজ ব্যবসায়ের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো সিদ্ধান্ত এলে তা ঠেকানো।



রাজনীতিকদের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ
সব দলের রাজনীতিকদের সাথে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত যোগাযোগ রয়েছে রুপার্ট মারডকের। মারডক নিজে এবং সংশ্লিষ্ট রাজনীতিকেরা প্রত্যেকে আপন-আপন স্বার্থে এ যোগাযোগ বজায় রেখেছেন। এ যোগাযোগ এতটাই নিয়মিত যে, ২০০৯ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের সরকারি মুখপাত্র বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সাথে রুপার্ট মারডকের নিয়মিত আলাপ-আলোচনা হয়, এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। 



তবে উভয় পক্ষই তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও যোগাযোগকে অরাজনৈতিক, সামাজিক অনুষ্ঠান, নৈশভোজ ও পানের আসর বলে এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। কিন্তু সমালোচকেরা এসব যুক্তিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন। তাদের কথা : ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া ম্যাগনেট হিসেবে মারডকের বিশাল ও ব্যতিক্রমী গুরুত্ব আছে। তার ওপর আছে ব্রিটিশ রাজনৈতিক ইস্যুতে নাক গলাতে তার অদম্য আগ্রহ। কাজেই তাদের যেকোনো বৈঠককে কেবল পান-ভোজনের সামাজিক অনুষ্ঠান বললে তো হবে না!



প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে, ২০০৮ সালের আগস্টে ডেভিড রুপার্ট মারডকের আমন্ত্রণে তারই ইয়াকে (নৌযান) এক ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে যোগ দেন ডেভিড ক্যামেরন। ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ক্যামেরনকে বিনা ভাড়ায় বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হয়। যে ব্যক্তিগত বিমানে করে তাকে ওখানে নিয়ে যাওয়া হয় তা ছিল মারডকের জামাতা ‘পাবলিক রিলেশন গুরু’ নামে খ্যাত ম্যাথু ফ্রিউড-এর। সে দিন মারডকের সাথে কী কথা হয়েছিল, তা কখনো প্রকাশ করেননি ক্যামেরন। ওই ‘সামাজিক অনুষ্ঠানে’ আরো উপস্থিত ছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের ট্রেড কমিশনার লর্ড ম্যান্ডেলসন, রাশিয়ার প্রভাবশালী ব্যক্তি ওলেগ দেরিপাসকা এবং এনবিসি’র কো-চেয়ারম্যান বেন সিলভারম্যান।
গত মাসে ফাঁস হয়ে যায় যে, নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডের সাবেক সম্পাদক এন্ডি কুলসনকে কনজারভেটিভ পার্টির জনসংযোগ পরিচালক করলে কোনোই অসুবিধা হবে না বলে ক্যামেরনকে ব্যক্তিগতভাবে নিশ্চয়তা দেন মারডক। তখন ২০০৭ সাল। এক রিপোর্টারের ফোন হ্যাকিং কেলেঙ্কারির দায়িত্ব নিয়ে নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এর সম্পাদক পদ থেকে তখন ইস্তফা দিয়েছেন কুলসন। তাকে দলের এত বড় দায়িত্বে বসানো! ক্যামেরনকে এর পরিণতি সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দেন নিক ক্লেগ, লর্ড অ্যাশডাউন এবং গার্ডিয়ান পত্রিকা। কিন্তু কারো নিষেধই শোনেননি ক্যামেরন, তিনি তখন মারডক-প্রেমে মশগুল!



কুলসনকে  সেই পদ ছাড়তে হয়। তিনি এখন জেলখানায় এবং ফোন হ্যাকিং ও অন্যান্য অপরাধ নিয়ে জেরার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাকে। আর ক্যামেরনকেও  এ নিয়োগ নিয়ে পার্লামেন্টের জেরার জবাব দিতে হয়েছে। বলতে হয়েছে, ‘স্যরি!’
২০০৭ সালের ২১ এপ্রিল অস্ট্রেলিয়ার ভাবী প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাডের সাথে নিউ ইয়র্কের নিউজ করপোরেশন ভবনে ঘণ্টাব্যাপী একান্ত বৈঠক করেন রুপার্ট মারডক। অথচ এর আগে এই রাড সম্পর্কে অনেক বিরূপ মন্তব্য করেছেন মারডক। ‘রক্ষণশীল’, ‘কেবল নিজের স্বার্থটাই বোঝেন’, ‘শুধু অস্ট্রেলিয়া নয়, গোটা বিশ্বকে শাসন করতে চান, এমন উচ্চাভিলাষী’ ইত্যাদি মন্তব্য করেছেন রাড সম্পর্কে। রাডের অর্থনৈতিক নীতিকে তুলোধুনা করেছেন।



কানাডার কনজারভেটিভ প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারকে ২০০৯ সালের মার্চে মধ্যাহ্নভোজের দাওয়াত দেন মারডক। সেটা এতই গোপনে হয়েছিল যে, এক বছর পর্যন্ত কেউ বিষয়টি জানতেই পারেনি।



২০০৮ সালের অক্টোবরে নিউ ইয়র্কের এক হোটেলে ওবামার সাথে বৈঠক হয় মারডকের। ওবামা প্রথমে মারডকের সাথে বসতেই রাজি ছিলেন না। চতুর মারডক বিষয়টি জেনে কেনেডি পরিবারের সদস্যদের কাজে লাগান। তাতে কাজ হয়। বৈঠকে ওবামা তার বিরুদ্ধে মারডকের ফক্স নিউজের অপপ্রচারের প্রসঙ্গটি তোলেন। ফক্স নিউজে ওবামাকে বলা হয়, ‘সন্দেহজনক, বিদেশী এবং সন্ত্রাসবাদীর মতো ভীতিকর’ মানুষ। বৈঠকে এ বিষয়ে ওবামাকে বলা হয়, আসলে শুরু থেকে ওবামা যদি ফক্স নিউজের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে না রাখতেন, তাহলে হয়তো এমনটি হতো না। অবশেষে বৈঠকে উভয়ের মধ্যে ‘সমঝোতা’ হয়।



বারাক ওবামার জীবনীকার মাইকেল উল্ফ্ বলেন, শুধু ওবামা নন, হ্যারি ট্রুম্যান থেকে পরবর্তী প্রত্যেক আমেরিকান প্রেসিডেন্টের সাথে বৈঠক করেছেন মারডক।



মারডক কখনো প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যোগ দেননি, কিন্তু রাজনীতি নিয়ে এবং রাজনীতিকে প্রভাবিত করায় তার ছিল উদগ্র আগ্রহ। ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি গভীর বিদ্বেষ পোষণকারী এই ব্যক্তি অনুরক্ত ছিলেন ইসরাইল ও ইহুদিদের। ইরাক আক্রমণে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তিকে তার পত্রিকাগুলো বিরামহীন উস্কানি দিয়ে গেছে। সে উস্কানি ব্যর্থ হয়নি। সোনার ইরাক আজ ছারখার হয়ে গেছে। কিন্তু মারডক? তিনিও কি খুব স্বস্তিতে আছেন? গত ১৯ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টের শুনানিতে অংশ নিতে হয়েছে তাকে। বলতে হয়েছে, স্যরি! শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায় নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড ।


 



রুপার্ট মারডক, যার বয়স এখন ৮০, চীনা তৃতীয় স্ত্রী ওয়েনদি দেং ও ছয় পুত্র-কন্যা নিয়ে যার সংসার, যার সম্পদের পরিমাণ ৭৬০ কোটি মার্কিন ডলার এবং যার মিডিয়াসাম্রাজ্য অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা এমনকি চীন পর্যন্ত বিস্তৃত, পর্দার পেছন থেকে যিনি রাজনীতিতেও কলকাঠি নাড়িয়েছেন প্রধানত অস্ট্রেলিয়া ও ব্রিটেনে সেই তিনি এখন অনেকটা অসহায়। তার সাম্রাজ্য আছে, কিন্তু প্রতিপত্তি ক্ষীয়মান। মঞ্চে আছেন, কিন্তু নায়ক নন, ভিলেন হয়ে।



এক যে ছিল মারডক কিসসা আজকের মতো এখানেই ইতি।
humayunsc@yahoo.com


 

0 comments:

Post a Comment