WHAT'S NEW?
Loading...

শোয়াইব নবীর দেশে

মোহাম্মদ আবদুল মান্নান


রাত শেষ হয় কাহিনী তোমার অশেষ শাহেরজাদী।...
তেমনি এক নতুন কাহিনীর সাথে পরিচিত হওয়ার আবেগ-উত্তেজনার মধ্যে ঊনিশ শ’ সাতানব্বইয়ের সাত জুন শনিবার তাবুকে আমার ভোর হলো। আজ আল-বেদ যাবো। এ সফরে সরদার ভাই ছাড়াও সাথী হচ্ছেন মুঈন ভাই ও মওলানা জাকির।

সরদারজী অভিযাত্রী দলের পরিচয় দিতে দিতে বললেন, তারা সবাই দাঁড়ে আর মাস্তুলে সমান টানেন। তাবুক আর আল- বেদের তারা বিশেষজ্ঞ।




সকালে আমরা তাবুক যুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো আবার দেখতে গেলাম। তাবুকের দুর্গ। আবদুল্লাহ জুলবিজাদাইনের কবর। মসজিদ-ই-আবু বকর। এসব স্থান ঘুরে ঘুরে দেখলাম। সরদারজী আমাদের সফরের জন্য কিছু কেনাকাটা করলেন।
মরুভূমির সফরে দুপুরের খরতাপ এড়িয়ে বিকেলে আল-বেদের উদ্দেশে রওনা হলাম। ইমরান আমাকে এ সফর সম্পর্কে অনর্গল নসিহত করল। আব্বুর সাথে সে ওই সব এলাকা সফর করেছে। সে আমাকে ‘বালুর ব্রিজে’র ছবি তুলে আনতে অনুরোধ জানালো।
তাবুক শহর থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার যাওয়ার পর প্রথম চেকপোস্ট। পুলিশের লোকেরা ডাক্তার নূরুল ইসলামকে খাতির করে পথ ছেড়ে দিলেন। আমরা বীর ইবনে হারম্স পার হয়ে বাঁয়ে মোড় নিলাম। বীর মানে কুয়া। ইবনে হারমসের কুয়া থেকে এই সড়ক আল বেদ এবং হাকলের দিকে গেছে। আর ডানের সড়ক গেছে হেলায়েত আম্মারের  দিকে। 



হেলায়েত আম্মার তাবুক থেকে এক শ’ ছয় কিলোমিটার পথ। তাবুক থেকে আল-বেদের দূরত্ব দুই শে’ চল্লিশ কিলোমিটার। আর দুই শ’ আটত্রিশ কিলোমিটার দূরে একটু ডানে হাকল জর্ডানের আরেক সীমান্তবর্তী শহর। বীর ইব্নে হারম্স থেকে আল-বেদ ও হাকলের পথ হাবাফে গিয়ে আলাদা হয়ে গেছে। হাবাফ থেকে ডানের সড়ক চলে গেছে হাকলের দিকে। বাঁয়ে আমাদের গন্তব্য মাদায়েন বা আল-বেদ।



হাকলের নামফলক দেখে মন খারাপ হলো। এ জায়গার প্রশংসায় ইমরান পাগল। হাকল হলো তার দেখা সবচেয়ে সুন্দর জায়গা। হাকলে ইসরাইলের একটি ভূপাতিত জঙ্গিবিমানের পাশে দাঁড়িয়ে ইমরান ছবি তুলেছে। সে ছবির একটি কপি উপহার দিয়ে ইমরান বলেছে, ‘আপনিও সেখানে যাবেন এবং একটা ছবি তুলবেন। তারপর চাচা-ভাতিজার ছবি একসাথে এক ফ্রেমে বেঁধে রাখব।’ ইসরাইলের ভূপাতিত জঙ্গিবিমানের ছবি নিয়ে ইমরান খুবই গর্বিত। কিন্তু এ সফরে হাকল যাওয়ার কর্মসূচি আমাদের নেই।



আইমা পার হওয়ার পর পর্বত বেষ্টনীর ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলছে আমাদের পথ। পথের ধারে ছোট-বড় নানা ধরনের পাহাড়। কোথাও মরুভূমির বাতাস দুই পাহাড়ের মাঝখানে নতুন নতুন বালুর ঢিবি গড়ে তুলেছে। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ের মাঝখানে এই বালুর স্তূপকে ইমরান নাম দিয়েছে ‘বালুর সেতু’। মরু হাওয়ায় এই বালুর সেতু এক জায়গা থেকে অন্য খানে উড়ে যায়। সেখানে তৈরি হয় নতুন সেতু। তখন আগের জায়গাটি আর চেনা যায় না। মরু প্রকৃতি আর বেদুইনদের চরিত্রের মধ্যে মরুভূমির এই দিকচিহ্ন ভ্রান্ত অবস্থার চমৎকার মিলের কথা বলেছেন মুহাম্মদ আসাদ। তার রোড টু মক্কা বইতে।



এক সময় সাগরের নিচে ছিল পর্বতমালা। কোনো কারণে এখানকার সাগরের পানি সরে গেছে বা শুকিয়ে গেছে। পাহাড়-পর্বতের গায়ে সাগরের ঢেউয়ের মতো চিহ্ন লেগে আছে। সাগরের লবণ-পানির আঘাতে নানা স্থানে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। এসব পাহাড়-পর্বত দূর থেকে মনে হয় যেন প্রাচীনকালের জিনের বাদশাহর তৈরি দরদালানের দেয়ালগাত্র।



সৌদি আরবের অন্য সব এলাকার পাহাড়-পর্বতের সাথে এগুলোর মিল নেই। মদিনার পথে দেখা পাহাড়-পর্বতগুলো কোথাও আমার কাছে মনে হয়েছে সদ্য চাষ দেয়া কালো কাদামাটির জমি। আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোত ঠাণ্ডা হয়ে এই কালো জমি তৈরি হয়েছে। আবার কোথাও যেন গাজর-শসা ফালি ফালি করে সালাদের মতো সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু তাবুক থেকে আল-বেদ যাওয়ার পথের পাহাড়-পর্বতের চেহারা ভিন্ন।



প্রাকৃতিক প্রাচীনতার এক ভয়াল রহস্যময় আবহের মধ্যে আমরা আমাদের শেষ বিকেলের যাত্রা অব্যাহত রাখলাম। পার্বত্য এই সর্পিল পথে আমরা এগোচ্ছি মন্থর গতিতে। আমাদের পথের দুই পাশে কোনো ঘরবাড়ি নেই। জনমানবের বসতি নেই। বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা দু-একটি যান্ত্রিক শকট আমাদেরকে মাঝে মধ্যে শুধু স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে রহস্যময় কোহকাফ পুরি ভেদ করে এ সফর এক সময় কোনো লোকালয়ে গিয়ে শেষ হবে।


 


আল জাইতা পল্লী
এভাবে পাহাড়-পর্বত ভেদ করে চলতে চলতে একটি মসজিদ পেয়ে আমরা মাগরিবের নামাজ আদায়ের জন্য থামলাম। এ জায়গার নাম আল জাইতা। ইতস্তত ছড়ানো ছিটেফোঁটা দু-একটি ঘর ছাড়া ধারেকাছে খুব একটা বসতি মালুম হলো না। তারপরও এ জনবিরল এলাকাটিকে সৌদি সরকার পল্লীর মর্যাদা দিয়েছে। মসজিদের অদূরে একটি হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে এখানে একজন বাংলাদেশী ডাক্তার চাকরি পেয়েছেন। সারা সপ্তাহে ডাক্তার সাহেবকে বড় একটা রোগী-পত্তর দেখতে হয় না। পাহাড়-পর্বতের মাঝখানে কর্মহীন প্রবাস। এ যেন আন্দামান বন্দীর দশা।



নামাজের পর চায়ের পিপাসা অনুভব করলাম। চা খাওয়ার মতো কোনো দোকান চোখে পড়ল না। ফলে জাইতার মেহমানদারির স্বাদ না নিয়েই আমরা আবার গাড়ি স্টার্ট দিলাম। মাইনাস সেভেন চশমা নিয়ে রাতে গাড়ি চালাতে সরদার নূরুল ইসলামের অসুবিধা। তাই এখন স্টিয়ারিং হাতে নিয়েছেন মুঈন ভাই। আমরা এগোচ্ছি মাদায়েনের দিকে।



মাদায়েন বা মাগায়েরে শোয়েব প্রাচীন ঐতিহাসিক জনপদ। আধুনিক পৌর নাম আল-বেদ। সৌদি আরবের উত্তর-পশ্চিমের এই আল-বেদ এক সময় হেজাজ ও ইয়ামান-সিরিয়া আর পারস্য উপসাগর থেকে মিসর পর্যন্ত দু’টি রাজপথের মধ্যে যোগাযোগের কেন্দ্র ছিল। আরব উপদ্বীপের এই সমৃদ্ধ এলাকা পরিচিত ছিল মাদায়েন নামে। এ শহরে নানা দেশের কাফেলার মিলন ঘটত। আবার এখান থেকে একে অন্যের কাছে বিদায় নিতেন। এ জন্যই কি এ জায়গার নাম আল-বেদা বা আল-বেদ।



মওলানা জাকির বললেন : মাদায়েনের ইতিহাস বেশ ক’জন নবী-রাসূলের সাথে যুক্ত। ইবরাহিম আ:-এর তৃতীয়া স্ত্রী কাতুরার গর্ভজাত সন্তানরা আরব ও ইসরাইলের ইতিহাসে বনি কাতুরা নামে পরিচিত হয়েছেন। কাতুরার এক ছেলে মাদইয়ান বিন ইবরাহিম। মাদইয়ানের বংশধররা ইতিহাসে পরিচিত হন আসহাবে মাদইয়ান নামে। তারা হেজাজ থেকে ফিলিস্তিনের দক্ষিণ এলাকা পর্যন্ত বসতি স্থাপন করেন। সেখান থেকে সিনাই উপত্যকার শেষভাগে আকাবা উপসাগর ও লৌহিত সাগরের তটরেখা ছুঁয়ে তারা নানা দিকে ছড়িয়ে পড়েন। মাদায়েন শহর ছিল তাদের প্রধান কেন্দ্রভূমি।



কাতুরার অন্য ছেলেরা উত্তর আরবের তাইমা, তাবুক এবং আল উলার মধ্যবর্তী এলাকায় বসতি বিস্তার করেন। বিখ্যাত দিদানি সভ্যতার অধিকারী দিদান জাতি তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। বনু কাতুরার এই অংশের প্রধান কেন্দ্র ছিল তাবুক বা প্রাচীনকালের আইকাহ। মু’জামুল বুলদান নামক বিখ্যাত গ্রন্থেও তাবুকের প্রাচীন নাম আইকাহ বলা হয়েছে।



ডা: সরদার নূরুল ইসলাম যোগ করলেন : মাদায়েন ও আইকার অধিবাসীরা আদিতে ছিলেন একই বংশের লোক। তাদের ভাষাও অভিন্ন ছিল। সম্ভবত কোনো কোনো এলাকায় তারা একসাথে বাস করতেন। বিয়ে-শাদীর মাধ্যমে বনি কাতুরার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার মধ্যে অভিন্ন সমাজও গড়ে উঠেছিল। এ ছাড়া মাদায়েন ও আইকা বাণিজ্যিক যোগাযোগের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাদের ব্যবসায়ে যথেষ্ট প্রসার ঘটেছিল। এই দুই জাতির লোকেরাই পরে নানা দুর্নীতিতে ডুবে যায়। তাদেরকে সঠিক পথে ডাকার জন্য নবীরূপে শোয়েব আ:-এর আবির্ভাব ঘটে।



বনি কাতুরার কাহিনী শুনতে শুনতে প্রাচীন গিরি-কন্দরের আলো-আঁধারের সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়ে চলি। দ্রুত অপসৃয়মান দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে থাকা শৈলশ্রেণীর ভেতর দিয়ে চলতে চলতে মনে হচ্ছিল যেন হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের ভেতর দিয়ে ছুটছি। প্রাচীন ইতিহাসের একটির পর একটি রহস্যময় তোরণ ভেদ করে ইতিহাসের গভীর থেকে আরো গভীরে ডুবে যাচ্ছি।
হজরত আদম (আ:)-এর সময় থেকে যে আদি মানব বংশধারার সূচনা, সে সময় থেকেই অনন্ত এ পথযাত্রা চলছে। পাহাড়-পর্বতের আদিমতা আমার ভেতর এখন এক অতি প্রাচীন চোখের জন্ম দিয়েছে। আমি সে চোখ দিয়ে একই সাথে আমার প্রাচীন অতীতকে এবং অধুনাতম বর্তমানকে দেখতে পাচ্ছি। আদি ও আধুনিকতার মধ্যে যোগসূত্র রচনা করতে করতে অনবরত পথ চলছি...।


 


আল-বেদে স্বাগতম
এরপর স্বপ্ন ভেদ করে হঠাৎ করেই আমরা আল-বেদে প্রবেশ করলাম। শহরের মাঝখানে প্রশস্ত একটি প্রধান সড়ক। দুই পাশে ঘরবাড়ি। আরবের মেহমানদারির প্রাচীন ঐতিহ্য ধারণ করে নগরীর প্রবেশপথে একটি ভাস্কর্য। শোরাহি থেকে পানি ঢেলে অতিথিকে আপ্যায়নের প্রতীক। এ ছাড়া মেহমানদের আহলান-সাহলান জানাতে পথের দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে নানা বিলবোর্ড। আর রয়েছে রাস্তার দুই পাশে সারিবদ্ধ সবুজ গাছ আর ঝলোমলো আলোর ফোয়ারা। আল বেদ শুধু বিদায় জানায় না। স্বাগত জানানোর ঐতিহ্যেও সুদৃঢ়। আমরা নরম আতিথেয়তার মধ্যে প্রাচীন আল- বেদ বা মাদায়েনের আধুনিক ছোট্ট পৌর নগরীতে প্রবেশ করলাম।



একটু আগেই এশার আযান হয়েছে। আমরা মেজবানের বাড়ির কাছের মসজিদে এশার জামাত শেষে আন্তরিক উষ্ণ অভ্যর্থনার বৃত্তে বিগলিত হলাম। আল-বেদের অভিবাসী বাংলাদেশীরা আমাদেরকে পুরো সময় ব্যস্ত রাখার কর্মসূচি পাকা করে রেখেছেন। আমি ঠাট্টা করে বললাম, আপনাদের মধ্যে কেউ কি কলু ছিলেন? একজন মেজবান থতমত খেয়ে বললেন, এরূপ কাউকে জানি না তো। বললাম, ঘানিতে সরিষা পিষে তেল বের করার কায়দাটা আপনাদের মেহমানদারিতে ঠিকমতো ফুটে উঠেছে। অভিজ্ঞ কলু ছাড়া এটা কিভাবে সম্ভব?
মেজবান এবার দ্বিগুণ উৎসাহে বললেন, সৌদি আরবের এক প্রান্তে আল-বেদ নিঝুম প্রত্যন্ত ছোট শহর। এখানে সহজে আমরা মেহমান পাই না। আজ যখন পেলাম, মেহমানদারির পুরো হক আদায় করার সুযোগ তো নিতে হবে।



এশার নামাজের পর আমাদেরকে একটি অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হলো। এরপর রাত সাড়ে দশটায় আরো একটি অনুষ্ঠান। রাত প্রায় একটায় আমরা বিছানায় যাওয়ার অনুমতি পেলাম। অনেক দূর থেকে সফর করে এসেছি। এ বিবেচনায় তারা রাত একটার পর আর কোনো প্রোগ্রাম রাখেননি!


 


শোয়াইব নবীর ঘরবাড়ি
আট জুন ভোরে আমরা মাগায়েরে শোয়াইব দেখতে রওনা হলাম। আমার অনেক দিনের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। এ জন্য মনে মনে আমি ভীষণ উত্তেজিত।



মরুভূমির মাঝখানে মরূদ্যান ও বৃক্ষলতা পরিবেষ্টিত এক প্রাচীন পথ বেয়ে আমরা চলছি। একসাথে আমাদের ক’টি গাড়ি। পথ চলতে চলতে মওলানা জাকিরের কাছে হজরত শোয়াইব আ: আর তাঁর কওমের কাহিনী শুনছিলাম। আল-কুরআনে সূরা আল আ’রাফে আল্লাহ তাঁর এই নবী সম্পর্কে বলেছেন :
‘আমি মাদইয়ানবাসীর কাছে তাদের ভাই শোয়াইবকে পাঠালাম। তিনি বললেন : হে আমার কাওম! আল্লাহর দাসত্ব করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো ইলাহ নেই। তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের ওপর স্পষ্ট দলিল এসে গেছে। তাই ওজন ও দাঁড়িপাল্লা পুরা করো। মানুষকে তাদের জিনিস কম দিয়ো না এবং সংশোধনের পর তোমরা দুনিয়াতে ফাসাদ সৃষ্টি করো না। তোমরা যদি সত্যি মুমিন হও তাহলে এর মধ্যেই তোমাদের মঙ্গল রয়েছে।’



‘যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে ভয় দেখানোর জন্য, তাদেরকে আল্লাহর রাস্তা থেকে ফিরিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে এবং সরল পথকে বাঁকা করার নিয়তে (জীবনের) প্রতিটি পথে ডাকাত সেজে বসো না। ওই সময়ের কথা মনে করে দেখো, যখন তোমরা (সংখ্যায়) কম ছিলে, তারপর আল্লাহ তোমাদের (সংখ্যা) বেশি করে দিলেন। চোখ খুলে দেখো যে, দুনিয়াতে ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের পরিণাম কেমন হয়েছে।’
‘আমাকে যে শিক্ষাসহ পাঠানো হয়েছে এর প্রতি যদি তোমাদের একদল ঈমান আনে এবং আর একদল ঈমান না আনে তাহলে সবরের সাথে দেখতে থাকো, যে পর্যন্ত না আল্লাহ আমাদের মাঝে ফায়সালা করে দেন। আর তিনিই সবচেয়ে ভালো ফায়সালাকারী।’
‘(শোয়াইবের) কাওমের সরদারদের যারা বড়াই করত, তারা বলল : ‘হে শোয়াইব! আমরা তোমাকে এবং যারা তোমার সাথে ঈমান এনেছে তাদেরকে আমাদের এলাকা থেকে বের করে দেবো। অথবা তোমাদেরকে আমাদের মিল্লাতে ফিরে আসতে হবে। জওয়াবে শোয়াইব বললেন : আমরা রাজি না হলেও (আমাদেরকে কি জোর করে ফিরিয়ে নেয়া হবে)’?



‘ (শোয়াইব আরো বলেন) : আল্লাহ আমাদেরকে (তোমাদের মিল্লাত থেকে) নাজাত দেয়ার পরও যদি আমরা তোমাদের মিল্লাতে ফিরে যাই তাহলে আমরা আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরোপকারী হয়ে যাবো। আমাদের রব আল্লাহ যদি (তা-ই) চান তাহলে আলাদা কথা। তা না হলে আমাদের পক্ষে ওদিকে ফিরে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। প্রতিটি জিনিসের ব্যাপারেই আমাদের রবের ইলম আছে। আল্লাহর ওপরই আমরা ভরসা করে আছি। হে আমাদের রব! আমাদের ও আমাদের কাওমের মাঝে ঠিক ঠিক ফায়সালা করে দিন। আর আপনিই তো সবচেয়ে ভালো ফয়সালাকারী।’



‘তার কাওমের ওসব সরদার, যারা তার কথা মানতে অস্বীকার করেছিল তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল : তোমরা যদি শোআইবে মেনে চলো তাহলে তোমরা বরবাদ হয়ে যাবে।’



‘(তারপর যা ঘটল তা এই যে,) এক প্রচণ্ড ভূমিকম্প তাদেরকে পাকড়াও করল। ফলে তারা নিজেদের ঘরেই মুখ থুবড়ে পড়ে রইল।’
‘‘যারা শোয়াইবকে মানতে অস্বীকার করল, তারা এমনভাবে মিটে গেল, যেন তারা (তাদের ঘরে) ছিলই না। যারা শোয়াইবকে মিথ্যা মনে করল তারাই (শেষ পর্যন্ত) বরবাদ হয়ে গেল।’



‘তারপর (শোয়াইব ) একথা বলে ওই এলাকা থেকে চলে গেলেন : হে আমার কাওম! আমি তোমাদের নিকট আমার রবের বাণী পৌঁছিয়ে দিয়েছি এবং তোমাদের মঙ্গল কামনার হকও আদায় করেছি। এখন যে কাওম সত্য কবুল করতেই অস্বীকার করে তার জন্য আমি কী করে আফসোস করি?
(সূরা আরাফ, আয়াত ৮৫-৯৩)


মাওলানা জাকির এরপর সূরা হুদ থেকে তেলাওয়াত করলেন। শোয়েব আ: ও তাঁর জাতি সম্পর্কে সূরা হুদে বলা হয়েছে :
‘আর মাদইয়ানবাসীদের নিকট তাদের ভাই শোয়াইবকে পাঠালাম। শোয়াইব বললেন, ‘হে আমার কাওম! এক আল্লাহর দাসত্ব করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো মাবুদ নেই। ওজনে ও দাঁড়িপাল্লায় মাপে কম দিও না। আজ আমি তোমাদেরকে ভালো অবস্থায় দেখছি। কিন্তু আমার ভয় হয় যে, তোমাদের ওপর এমন দিন আসবে, যার আজাব তোমাদেরকে ঘিরে ফেলবে।’



‘হে আমার কাওম! ঠিক ঠিক ইনসাফের সাথে ওজন ও পরিমাপ করো। মানুষকে জিনিসের মধ্যে মাপে কম দিও না এবং পৃথিবীতে ফাসাদি হয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করো না।’



‘যদি তোমরা মুমিন হও তাহলে আল্লাহর দেয়া উদ্বৃত্ত তোমাদের জন্য ভালো। আমি তো তোমাদের ওপর হেফাজতকারী নই।’
‘‘তারা জওয়াবে বলল, ‘হে শোয়াইব! তোমার নামাজ কি তোমাকে এ কথাই শেখায় যে, আমাদের বাপ-দাদারা যেসব মাবুদের পূজা করত তা আমরা ত্যাগ করব? অথবা আমাদের মাল আমাদের মর্জি মতো ব্যবহার করতে পারব না? তুমিই কি একমাত্র উঁচু মনের ও সৎ মানুষ?’



‘শোয়াইব বললেন, ‘হে আমার কাওম! তোমরা ভেবে দেখো, আমি যদি আমার রবের পক্ষ থেকে এক সাক্ষ্যের ওপর থেকে থাকি এবং তিনি যদি আমাকে তার কাছ থেকে ভালো রিজক দিয়ে থাকেন (তাহলে এরপর তোমাদের পথভ্রষ্টতা ও হারাম খাওয়ার মধ্যে আমি কিভাবে শরিক হতে পারি?)। আমি চাই না যে, যেসব বিষয় থেকে আমি তোমাদেরকে নিষেধ করি তা আমি নিজেই করে বসি। আমার সাধ্যে যতটুকু কুলায় আমি তো সংশোধন করতে চাই। আমি যা কিছু করতে চাই তা আল্লাহর তাওফিকের ওপর নির্ভর করে। আমি তাঁরই ওপর ভরসা করে আছি এবং সব ব্যাপারে তাঁরই দিকে ফিরে আসি।



‘‘হে আমার কাওম? আমার বিরুদ্ধে তোমাদের হঠকারিতা যেন এত দূর না পৌঁছে যে, শেষ পর্যন্ত তোমাদের ওপরও ওই আযাবই এসে যায়, যা নূহ, হুদ বা সালেহের কাওমের ওপর এসেছিল। আর লুতের কাওম তো তোমাদের থেকে বেশি দূরে নয়।
‘‘তোমাদের রবের কাছে মাফ চাও। তাঁর দিকে ফিরে আসো। নিশ্চয়ই আমার রব বড়ই দয়ালু এবং তাঁর সৃষ্টিকে তিনি ভালোবাসেন।
‘‘তারা জওয়াব দিলো : ‘হে শোয়াইব! তোমার অনেক কথাই তো আমাদের বুঝেই আসে না। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আমাদের মধ্যে তুমি একজন দুর্বল মানুষ। তুমি যদি আমাদের বংশের লোক না হতে তাহলে কবেই তোমাকে পাথর মেরে শেষ করে দিতাম। তোমার এমন শক্তি নেই যে, আমাদের ওপর ক্ষমতা দেখাতে পারো।’



‘‘শোয়াইব বললেন, ‘হে আমার কাওম! তোমাদের সাথে আমার বংশগত সম্পর্ক কি আল্লাহর চেয়ে বেশি সম্মানের বিষয় যে, তোমরা (বংশকে ভয় করলে, আর) আল্লাহকে একেবারেই পেছনে ফেলে রাখলে? জেনে রাখো যে, তোমরা যা কিছু করছ, আমার রব এসবই ঘিরে রেখেছেন।



‘‘হে আমার কাওম! তোমাদের নিয়মে তোমরা কাজ করতে থাকো। আমিও আমার কাজ করে যাবো। শিগগিরই তোমরা জানতে পারবে যে, কার ওপর অপমানকর আযাব আসে, আর কে মিথ্যাবাদী। তোমরাও অপেক্ষা করো আমি তোমাদের সাথে অপেক্ষায় রইলাম।
‘‘শেষ পর্যন্ত যখন আমার হুকুম এসে গেল, আমার রহমত দিয়ে শোয়াইবকে ও তাঁর সাথে যারা ঈমান এনেছে, তাদেরকে বাঁচিয়ে দিলাম। আর যারা জুলুম করেছিল তাদের ওপর এমন কঠিন এক আওয়াজ এসে তাদেরকে পাকড়াও করল যে, তারা নিজেদের বাড়িঘরেই উপুড় হয়ে পড়ে রইল, যেন তারা কখনো সেখানে বসবাসই করত না। জেনে রাখো, মাদইয়ানবাসীদেরকেও দূরে ফেলে দেয়া হলো যেমন সামুদ জাতিকে ফেলে দেয়া হয়েছিলো।’’
(সূরা হুদ, আয়াত ৮৪-৯৫)


 


সরদার নূরুল ইসলাম ব্যাখ্যা করে বললেন : মাদায়েনবাসীর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল আল্লাহকে অমান্য করা, মিথ্যা বলা ও ওজনে কম দেয়া। মাদায়েনবাসীর মধ্যে শিরক ও ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়েছিল। নানাভাবে লোক ঠকানো তাদের জাতীয় ব্যাধিতে পরিণত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ রাজপথের ওপর বসতি হওয়ার সুযোগ নিয়ে তারা ব্যাপক আকারে ডাকাতি ও রাহাজানিতে লিপ্ত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর নিজেদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তারা অন্যান্য জাতির লোকদের নিরাপত্তা বিপন্ন করে তুলেছিল।
শোয়েব আ: তাঁর জাতিকে এ অবস্থা থেকে ফিরে আসার জন্য আহ্বান জানান। তারা সঠিক পথে প্রত্যাবর্তন না করার কারণে তাদের ওপর আল্লাহর গজব নেমে আসে। ভয়ানক বিস্ফোরণ ও ভূমিকম্পের শাস্তি তাদেরকে ইতিহাসের শিক্ষার বস্তুতে পরিণত করে।
আমরা একটি পাহাড়ি উপত্যকায় পৌঁছলাম। চার দিকে পাহাড়-পর্বত। মাঝখানে সমতল ভূমি। স্থানটি দেয়ালঘেরা। বিরাট প্রবেশ দরোজায় বড় তালা ঝুলছে। আল-বেদ পৌরসভার বাংলাদেশী কর্মকর্তা আবু সাইদের অনুরোধে কেয়ারটেকার দরজা খুলে দিলেন। তবে তিনি আমাদেরকে এখানকার আচরণরীতি সম্পর্কেও সতর্ক করে দিলেন। আমরা শোয়েব আ:-এর নগরীতে প্রবেশ করলাম। কেয়ারটেকার ‘মা-ফি’ উচ্চারণ করলে আমাদের ফেরত যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।



শোয়েব আ:-এর জাতির লোকেরা এখানে এবং তার আশপাশের এলাকায় বাস করতেন। ঘেরাও দেয়া স্থানটিতে কওমে শোয়েবের ঘরবাড়ির কিছু বিশেষ নিদর্শন সংরক্ষিত।


 


মাগায়েরে শোয়াইবের পাহাড়ি বসতি
আমরা একটি পাহাড়ের গুহায় প্রবেশ করলাম। গুহার ভেতর একটির পর একটি আলাদা আলাদা ঘর। একটি ঘরের ভেতর চারটি ছোট খোপ। আর সামনে একটি বড় অলিন্দ।



আমরা আরেকটি পাহাড়ে গেলাম। পাহাড়ের ওপর কিছু দূর উঠে তারপর সেখান থেকে একটি বড় সুড়ঙ্গ বা গর্তের মতো পথ। সে পথ দিয়ে নেমে গিয়ে পেলাম আরো বেশ কিছু ঘরবাড়ির সন্ধান। সবখানে সহজে বাতাস চলাচলের সুবিধার্থে পাথর কেটে ফোকর বা জানালার ব্যবস্থা করা হয়েছে।



আরেকটি পাহাড়ে পাথর কেটে একটি বড় ঘরের মতো। সে ঘরে সারিবদ্ধভাবে দশটি কবর বা বাংকারের মতো। একেকটি বাংকারে একেকজন মানুষ শুতে পারে। অনুমান করলাম, এগুলো ছিল কবর। পাথর খোদাই করে কবর বানানো হয়েছে।
এ ধরনের সমাধি এর আগে আমি ইরানে দেখেছি। তিরানব্বই সালে ইরান সফরের সময় পারস্যের চার হাজার বছরের পুরনো রাজধানী পার্সেপোলিস বা ‘তাখতে জামশিদ’ দেখতে যাই। শেখ সাদী ও হাফিজের শহর শিরাজ। শিরাজে আমরা এই দুই মনীষীর কবর জিয়ারত করি। এরপর শিরাজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে তাখতে জামশিদ ঘুরে দেখি। ইরানের শেষ রাজা রেজা শাহ পাহলভি তার পতনের কিছুদিন আগে এখানে এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার পূর্বপুরুষদের হাজার বছরের রাজকীয় ঐতিহ্য স্মরণ করেন।
পার্সেপোলিসের কয়েক মাইল দূরে ‘নকশে রোস্তম’ নামে আরেকটি প্রাচীন এলাকা। সেখানে রয়েছে প্রায় আঠারো শ’ বছরের পুরনো একটি অগ্নিকুণ্ড। জনশ্রুতি হলো, রাসূল সা:-এর জন্মের দিনে অগ্নিপূজারীদের এ পুরনো পূজামণ্ডপের আগুন নিভে যায়। নাকশে রোস্তম নামক পর্বতের গায়ে ঘোড়সওয়ার রোস্তমের এক প্রাচীন নকশা আঁকা। তার পাশে অন্য ক’টি পর্বতের গায়ে বেশ খানিকটা উঁচুতে প্রাচীন আমলের কয়েকজন রাজার কবর। ইরানের বড় বড় সম্রাটকে এ ধরনের সুরক্ষিত উঁচু স্থানে কবর দেয়ার রীতি প্রাচীন আমল থেকে চালু ছিল। সৌদি আরবের আল উলায় মাদায়েন সালেহ এলাকাতেও সামুদি যুগের এ ধরনের কবর রয়েছে।



আমরা শোয়াইব নবীর শহরে বিভিন্ন পাহাড়ের ভেতর গুহার মতো ঘরবাড়ি দেখলাম। কোনো কোনো বাড়িতে সামনের দেয়ালে শিল্পীর হাতের কিছু প্রাচীন নকশা ও কারুকাজের চিহ্ন। এগুলোর পাঠোদ্ধার হয়েছে কি না জানি না। কালের সাক্ষী হয়ে আছে এসব চিত্রকর্ম। সরদারজি এসব প্রাচীন ঘরবাড়ির অনেকগুলো ছবি তুললেন।



হজরত শোয়াইব (আ:)-এর কওমের বাড়িঘর। মাগায়েরে শোয়াইব। এখানে সফর করার এবং নিজ চোখে এসব নিদর্শন দেখার সুযোগ পেয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। সেই সাথে ডা: সরদার নূরুল ইসলামকেও ধন্যবাদ দিলাম।


 


‘বীরে শোয়াইব’ : মুসা নবীর স্মৃতির কূয়া
মাগায়েরে শোয়েব থেকে পাঁচ-ছয় শ’ মিটার দূরে একটি প্রাচীন কুয়া। এ কূয়ার পানি হজরত শোয়াইবের আমলে মাদায়েনবাসী ব্যবহার করতেন। আমরা মুসা নবীর স্মৃতিবিজড়িত সেই ঐতিহাসিক কুয়া দেখতে গেলাম। ‘বীরে শোয়েব’ বা শোয়েব নবীর কুয়াটি এখন কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। মওলানা জাকির তারের বেড়ার মধ্যে একটি ফোকর খুঁজে বের করলেন। এর ভেতর দিয়ে আমরা সেই কূপের কাছে পৌঁছে গেলাম।



অতীতে বেদুইনরা তাদের উট ও ছাগলের জন্য পানি সংগ্রহ করতে এখানে জড়ো হতো। এই কূয়ার সাথে মুসা আ:-এর একটি বিখ্যাত কাহিনী রয়েছে। এ সম্পর্কে মওলানা জাকির আমাদেরকে আল-কুরআনের সূরা কাসাস থেকে তেলাওয়াত করে শুনালেন :
‘‘(মিসর থেকে বের হয়ে) যখন মূসা মাদইয়ানের দিকে রওনা হলেন, তখন তিনি বললেন, ‘আশা করি আমার রব আমাকে সঠিক পথে চালাবেন’।
‘‘যখন তিনি মাদইয়ানের কূয়ার কাছে পৌঁছলেন, তখন দেখতে পেলেন যে, অনেক লোক তাদের পশুকে পানি খাওয়াচ্ছে। আর তাদের থেকে আলাদা হয়ে এক দিকে দু’জন মহিলা তাদের পশুকে আটকে রেখেছে। মূসা তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের অবস্থা কী?’ তারা দু’জন বলল, ‘এ রাখালেরা তাদের পশুগুলোকে সরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের পশুকে পানি খাওয়াতে পারছি না। আর আমাদের পিতা একজন অতি বুড়ো মানুষ’।



‘‘এ কথা শুনে মুসা তাদের পশুগুলোকে পানি পান করিয়ে দিলেন। তারপর একটি ছায়ায় গিয়ে বসে দোয়া করলেন, ‘হে আমার রব! তুমি আমার প্রতি যে মঙ্গলই নাজিল করো আমি এরই কাঙাল’।
‘‘অল্পক্ষণ পরেই ওই দু’জন মহিলার একজন লাজনম্রভাবে এসে মুসাকে বলল, ‘আপনি আমাদের পশুগুলোকে যে পানি পান করিয়েছেন এর বদলা দেয়ার জন্য আমার পিতা আপনাকে ডেকেছেন’। যখন মূসা তার কাছে পৌঁছলেন, তখন তাঁর সব কাহিনী তাকে শোনালেন। ওই লোকটি বলল, ‘তুমি কোনো ভয় করো না। এখন তুমি জালিম কাওমের হাত থেকে বেঁচে গেছো।’



‘‘মেয়ে দুটোর একজন তার পিতাকে বলল, ‘আব্বাজান! এ লোকটিকে চাকরিতে নিয়োগ করুন। সবচেয়ে ভালো লোক, যাকে আপনি কর্মচারী হিসেবে রাখতে পারেন, সে এমনই হতে পারে, যে সবল ও আমানতদার’।



‘‘তার পিতা (মুসাকে) বলল, ‘আমার এ দুই মেয়ের একজনকে তোমার কাছে বিয়ে দিতে চাই, এ শর্তে যে, তোমাকে আমার এখানে আট বছর চাকরি করতে হবে। আর যদি দশ বছর পুরা করো, তাহলে তা তোমার ইচ্ছা। আমি তোমার সাথে কড়াকড়ি করতে চাই না। ইনশাআল্লাহ তুমি আমাকে সৎ লোক হিসেবেই পাবে’।



‘‘মূসা জবাবে বললেন, ‘আমার ও আপনার মধ্যে এ কথা ঠিক হয়ে গেল। এ দুটো মেয়ার মধ্যে যেটাই আমি পুরা করে দেই, এরপর আমার ওপর কোনো চাপ যেন দেয়া না হয়। আমরা যা কিছু বলছি আল্লাহই এর রক্ষক।’’
(সূরা কাসাস, আয়াত ২২-২৮)
শোয়াইব (আ:)-এর নগরী মাদায়েন বা মাগায়েরে শোয়াইবের এই কাহিনী।


জাকির ভাই দ্রুত কূপের কয়েকটি ছবি তুলে নিলেন। আমরা যখন কূপ দেখছি তখন বীরে শোয়েবের কেয়ারটেকার সেখানে এসে হাজির হলেন। তার নাম সালেম সুলেমান মাসউদি। তাকে এই কুয়া আর তার আশপাশের এলাকার গুরুত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তারের বেড়া ডিঙিয়ে আমরা কুয়ার কাছে গেছি। এটা তার পছন্দ হয়নি। হয়তো এ কারণে তিনি কোনো জবাব দিলেন না। কিংবা এই চিনির বলদ এ কুয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে বেখবর।


 


মাকনার মাজরায়
মাগায়েরে শোয়াইব ও বীর-ই শোয়েব দেখে ফেরার পথে সাইদ ভাইকে বললাম, বিকেলে ‘ইস’না আশারা আ‘ইন’ দেখতে যাবো। ব্যবস্থা করতে হবে।
দুপুরের পরপরই আমরা মাকনার উদ্দেশে রওনা হলাম। লৌহিত সাগর থেকে ইংরেজি ‘ভি’ হরফের মতো দু’টি পানির ধারা প্রবাহিত। তার মধ্যে আমাদের কাছেরটা হলো খালিজ আকাবা বা আকাবা উপসাগর। আর অন্যটি সুয়েজ খাল। প্রথমটি প্রাকৃতিক। অন্যটি মানুষের তৈরি। আকাবার কোলে তার বেলাভূমিতেই মাকনার অবস্থান।



আল-বেদ থেকে মাকনার দূরত্ব মাত্র বত্রিশ কিলোমিটার। কিন্তু রাস্তা অত্যন্ত দুর্গম। সেই দুর্গম পথের দুই পাশের ঘন সবুজ আমরা প্রাণভরে উপভোগ করলাম। পথের দুই ধারে বেশ কিছু মাজরা বা কৃষি খামার দেখলাম। মাজরার মালিকদের প্রায় সবার সাথে সাইদ ভাইর খাতির-পরিচয়। একটি মাজরার বাংলাদেশী কর্মীরা আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে পথে অপেক্ষা করেন। তাদের আন্তরিক অনুরোধে সাড়া দিয়ে আমরা পথের ধারের এই মাজরায় প্রবেশ করলাম।



বাগানে ছোট ছোট খেজুর গাছের সারি। হাত বাড়ালেই ঢাসা ঢাসা সোনালি রঙ খেজুর ছোঁয়া যায়। সবুজ নারাঙ্গি বনে মাল্টার সমারোহ। মাচায় ঝুলছে থোকা থোকা কাঁচা-পাকা আঙ্গুর। ডুমুরগাছে ম ম পাকা ডুমুর। ডালিম গাছের ডালিম ফুলের মনকাড়া রক্তিম শুভেচ্ছা। ছোট ছোট আমগাছে ঝুলে আছে থোকা থোকা আম। গোটা পরিবেশ আমাদেরকে আমোদিত করে তুলল।



বাংলাদেশী যুবকেরাও আমাদেরকে সহজে বিদায় দিতে রাজি না। তারা আমাদের জন্য দেশী কায়দায় রান্না করবেন। তাদের সাথে খাওয়া-দাওয়া করতে হবে। মেহমানদারির এমন মরূদ্যান ছেড়ে যেতে মন চায় না। তবু চলে যেতে হয়। আমরা তাদের কাছ থেকে বলে-কয়ে ছুটি নিলাম। মুঈন ভাইর হাতে তারা বাগানের কিছু তাজা কলমিশাক তুলে দিলেন। আমরা ফিরে যাচ্ছি। এ সময় মাজরার মালিক একটি বড় তরমুজ হাতে দৌড়াতে দৌড়াতে ছুটে এলেন। তার সোজা কথা, এই মেহমানদারি গ্রহণ না করে বাগান থেকে বেরোনো যাবে না।



আমরা আবার গন্তব্যের দিকে ছুটলাম। দেশ থেকে দূরে এই বাংলাদেশী অভিবাসীদের জন্য সাঈদ ভাই লেখাপড়া এবং বিভিন্ন নৈতিক প্রশিক্ষণের কর্মসূচি চালু করেছেন। অবসর সময়ে তারা একসাথে বসে বা আলাদাভাবে জ্ঞানের চর্চা করেন। তাদের মধ্যে ইলম ও ইবাদতের প্রতিযোগিতা চলে। সাঈদ ভাই এই প্রবাসে তাদের পিতৃতুল্য অভিভাবক।



আল-বেদ থেকে মাকনা পর্যন্ত নতুন পথঘাট তৈরি হচ্ছে। নতুন এসে পুরনো চিহ্ন দ্রুত মুছে দিচ্ছে। আমাদের গন্তব্যের আসল পথ খুঁজে নিতে সাঈদ ভাইর মতো রাহবারকেও বেগ পেতে হলো।


 


মুসা নবীর বারো ঝর্ণা
আমরা ঘন সবুজ একটি প্রাচীন মরূদ্যানের খেজুর বাগিচার কাছে পৌঁছলাম। বাগানের কিছুটা ভেতরের দিকে একটু নিচু জায়গা। সেখানে কয়েকটি স্থানে মাটি ফুঁড়ে ঝিরঝির পানি উঠছে।



ছোটবেলা আমাদের গ্রামের ধারে খালের পাড়ে বালিয়াড়ি ভেদ করে পানি ঠিকরে বেরুতে দেখেছি। সে পানি বন্ধ করতে হাত দিয়ে চেপে ধরেছি। পানি তখন অন্য পথ তৈরি করে বেরিয়ে এসেছে। খুব মজার ছিল সে খেলা।



এখানে পাঁচ-ছয়টি উৎস থেকে ঝিরঝির করে অনবরত পানি উঠছে। স্ফটিক স্বচ্ছ ঠাণ্ডা মিষ্টি পানি। এই পানি একটি নহর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে আকাবা উপসাগরের দিকে।



এই পুরনো ঝর্ণা নিয়ে নানা কথা চালু আছে। সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে মনে হয় পানি নিচের দিক থেকে ওপরের দিকে গড়াচ্ছে। এ কি দৃষ্টিভ্রম? সব চোখ একই দৃশ্য দেখছে। পানি গড়াচ্ছে ওপরের দিকে। সাঈদ ভাই বললেন, আমরাও তাই দেখি। কিন্তু যন্ত্রপাতি দিয়ে মেপে দেখেছি পানি ওপরের দিকে যাচ্ছে না। সমতল পথেই গড়াচ্ছে।



স্থানীয় প্রবীণ আরবেরা যুগ যুগ ধরে সাক্ষ্য দিচ্ছেন, এটিই হজরত মুসা আ:-এর ইসনে আশারা আইন। মুসা আ:-এর লাঠির আঘাতে এখানে সৃষ্টি হয় তাঁর সাথী বারো কওমের লোকদের জন্য বারোটি ঝর্ণা।



আল-কুরআনে আল্লাহ বলেছেন :
‘‘আর মুসা যখন নিজ জাতির জন্য পানি চাইল, তখন আমি বললাম, নিজ লাঠি দিয়ে আঘাত করো। তারপর তা থেকে বেরিয়ে এলো বারোটি ঝর্ণধারা।’’


এখন সেই ঝর্ণধারার গতিবেগ স্তিমিত হয়ে এসেছে। পাঁচ-ছয়টি ধারা প্রাচীন সে অলৌকিক ইতিহাসের সাক্ষ্য বয়ে চলেছে।
আমার সাথীরা কেউ কেউ এই পানি পান করলেন। কেউ বা অজু করলেন। কিছু লোক এখানকার পানি বোতলে করে নিয়ে যায় নানা রোগ-বালাই ভালো হওয়ার নিয়তে। বাংলাদেশী, ভারতীয় ও পাকিস্তানিরা ফায়দা আর ফজিলতের এমনি সহজ পথ বেশি চেনেন।
এই বারো ঝর্ণার স্থানটির অদূরে লৌহিত থেকে বেরিয়ে আসা আকাবা উপসাগর। এই লৌহিতের পানির নুনের খ্যাতি জগতজোড়া। অথচ তার কয়েক গজ দূরে এই ঝর্ণার মিঠা পানি বড়ই বিস্ময়কর।


 


মুসা নবীর স্মৃতির পাথর
ইসনে আশারা আইনের কাছেই একটি দেয়ালঘেরা জায়গা। সেখানে একটি বড় পাথর। মুসা আ: মিসর থেকে এসে এখানে এই পাথরে বসে বিশ্রাম নেন। সেই স্মৃতির নিদর্শন। লোকেরা এই পাথর ঘিরে বিদাত কাজে লিপ্ত হতে পারে। সে জন্য সতর্কতা হিসেবে পাথরটি দেয়াল দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছে।



সাঈদ ভাই জানালেন এই জায়গাটিতে এক সময় কিছু খননকাজ করা হয়। খননের সময় লম্বা পা ও মাথার খুলিসহ প্রাচীন আমলের মানুষের কঙ্কাল-করোটি বেরিয়ে আসে। এসব নিদর্শন প্রতœতাত্ত্বিকভাবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বেদাতের ভয়ে খননের কাজ সেখানেই থেমে গেছে। সে কারণেও এই স্থানটি ঘিরে রাখা হয়েছে।



ইসনে আশারা আইন ও মুসা নবীর স্মৃতি বিজড়িত পাথর দেখে আমরা আকাবা উপসাগরের তীরে গেলাম। উপসাগর তীরে সৌদি কোস্টগার্ডদের ঘরবাড়ি, অফিস-আদালত। এ পাড়ের ছোট শহর মাকনা। আর ওপারে জর্ডানের মুনতাকা-তুজ জিহাব। মুনতাকা মানে প্রদেশ বা অঞ্চল। জিহাব মানে সোনা। মুনতাকা-তুজ জিহাব মানে সোনার শহর। আকাবা উপসাগরের বেলাভূমিতে অনেকক্ষণ গাড়ি হাঁকালাম। এপাড়ের সাগরতীরে দাঁড়িয়ে আমরা ওপারের সোনার শহরকে ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দী করতে চাইলাম।


 


সোনারগাঁওয়ের সোনার ছেলে
মাকনা শহরের একটি দোকানে এক বাংলাদেশী দোকানকর্মীর সাথে পরিচয় হলো। সোনারগাঁওয়ের ফুটফুটে এক সোনার গড়ন ছেলে। বয়স উনিশ-কুড়ি। তার দোকানে তাকের ওপর কিছু বাংলা বই। আল-কুরআনের তাফসিরসহ কিছু বইপত্র। ছেলেটি মাকনা শহরে বাংলাদেশীদের মধ্যে এবং সৌদিদের কাছেও বেশ পরিচিত। দেশে মাদরাসায় কিছু দূর পড়াশোনা করেছে। প্রবাস জীবনে তার লেখাপড়ার চর্চা আছে। দোকানের কাজের ফাঁকে সে তার প্রবাসী স্বজনকে কুরআনের তাফসির, হাদিসের বাণী এবং ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা শোনায়।
আমাদের মেঘনা, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, গোমতি, কর্ণফুলী পাড়ের ছেলেরা আকাবা তীরে এসেও শুধু চাকরিতে ডুবে নেই। নিজেদের সংগঠিত সুন্দর জীবন গড়ার চেষ্টা করছে। ভিন দেশের লোকদেরকেও আলোকিত পথে উৎসাহিত করছে।



এক সময় আরবের লোকেরা আমাদের দেশে এসেছেন বণিক হিসেবে। তারা সেই সাথে প্রচার করেছেন ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বাণী। এখন আমাদের ছেলেরা আরব যাচ্ছে। সেখানে তারা জারি করেছে দ্বীনের চর্চা। পুরনো আর নতুনে এ যেন এক যোগসূত্র।
আকাবা উপসাগরের তীরে মাকনায় সূর্যাস্ত হলো। সাগরপাড়ের একটি সুন্দর মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় কবে আমরা আল্লাহকে ধন্যবাদ জানালাম। আজ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়টিকে তিনি আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রশস্ত আর বরকতময় করেছেন।
আমরা মাকনাকে বিদায় জানিয়ে আল-বেদের উদ্দেশে রওনা হলাম। ফেরার পথে আবার মুসা আ:-এর স্মৃতির পাথর ঘেরা দেয়ালটির কাছে ক্ষণিকের জন্য দাঁড়ালাম। 



মাকনা থেকে ফিরে আল-বেদ শহরে রাত দশটার এক সমাবেশে যোগ দিলাম। গভীর রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। অনেক সময় ধরে শোয়েব নবীর ঘরবাড়ি, মুসা নবীর কুয়া, ঝর্ণা ও তাঁর স্মৃতির পাথর, আর মাকনার বেলাভূমির স্মৃতিরা অনবরত আমার সাথে কথা কয়ে চলল।


 


বিদায় আল-বেদ
আল-বেদে আরেকটি সূর্যোদয় দেখলাম। নিজাম ভাইদের সাথে নাশতা সেরে আল-বেদ শহরটি পাখির চোখে ঘুরে দেখলাম। সৌদি আরবের উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত সীমানার এই ইতিহাস-প্রাচীন জনপদে আর কোনো দিন ফিরে আসার সুযোগ পাবো কি? মনের ভেতর অতৃপ্ত এক শুকপাখির ডানা ঝাপটানির আওয়াজ টের পাচ্ছি।



আমার সাথে আছেন আলম সাহেব। এক সময় লেখালেখি ও সাংবাদিকতায় ঝোঁক ছিল। এক কথা দু’কথায় জানালেন বাহাত্তর-পঁচাত্তরে আমি যখন ‘সোনার বাংলা’ সাপ্তাহিকটির সাথে যুক্ত তখন তিনি কখনো কখনো দু-চারটি লেখা নিয়ে আমার সাথে দেখা করেছেন। এখন তার সাথে বহু বছর পর আবার দেখা হলো মাদায়েনে এসে।



আলম সাহেব দেখালেন, বর্তমান আল-বেদ শহরের অদূরে বালিয়াড়ির স্তূপের ওপর তৈরি করা হচ্ছে এক নতুন উপশহর। এখনো এ উপশহরের কোনো নাম দেয়া হয়নি। মরুভূমির মাঝখানে একটি বিরাট ন্যাচারাল পার্ক গড়ে তোলারও আয়োজন চলছে। এ যেন আলদীনের আশ্চর্য প্রদীপের তেলেসমাতি। প্রদীপের ঘষায় দ্রুত বদলে যাচ্ছে মরুভূমির দৃশ্যপট। এই শহর এক সময় নতুন নামে পরিচিত হবে। অতীতের মাদায়েন এখন যেমন আল-বেদ। তেমনি আল-বেদ কখনো ইতিহাস হয়ে যাবে।



এভাবেই মানুষেরা নির্মাণ করে তাদের সময়কে। সে যুগ বাসি হয়ে আসে নবযুগ। নবযুগও এক সময় পুরনো হয়ে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেয়। আধুনিকতার পর আসে উত্তর আধুনিকতা। এ হলো ইতিহাসের ঘূর্ণাবর্ত। যুগান্তরের ঘূর্ণিপাক। ইতিহাসের শহর মাদায়েনে দাঁড়িয়ে আমি যুগান্তরের ঘূর্ণিপাক উপলব্ধি করতে করতে আল-বেদকে বিদায়ী সালাম বললাম।


 


দুবার পথে কিয়াল ও শাওয়ার্মা
আল-বেদ বা মাদায়েন পেছনে রেখে আমরা দুবার উদ্দেশে রওনা হলাম। মাদায়েন থেকে দুবা নগরীর দূরত্ব এক শ’ ষাট কিলোমিটার। বিশ কিলোমিটার পথ যাওয়ার পর বাঁয়ে মোড়। সোজা রাস্তা চলে গেছে ‘শেখ আল হামিদ’-এর দিকে। শেখ আল হামিদের পরই অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল। আমরা বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে না গিয়ে ছুটছি ভিন্ন দিকে। আমাদের প্রথম কাবা বায়তুল মুকাদ্দাস। ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ পবিত্র স্থান। কবে সে মসজিদ আবার আমাদের হবে?



আমরা কিয়াল নামে একটি ছোট জনপদ অতিক্রম করলাম। স্থানীয় লোকেরা কিয়ালকে উচ্চারণ করে গিয়াল। ‘লৌহিত’ শব্দের সাথে ‘গিয়ালে’র একটা সম্পর্ক আছে বলে কেউ কেউ বলেন। তবে খতিয়ে দেখার সুযোগ পাইনি। গিয়ালের ওপারে লৌহিত সাগরের তীরে মিসর ভূমি আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে।



কিয়াল থেকে আমরা শাওয়ার্মা পৌঁছলাম। শাওয়ার্মা লৌহিতের তীরে এক গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বন্দর। সামুদ্রিক জাহাজে করে আনা মালপত্র এখান থেকে সৌদি আরবের বিভিন্ন শহরে যায়। বন্দরের মালামাল সহজে সেসব শহরে পৌঁছানোর জন্য তাবুক পর্যন্ত সরাসরি প্রশস্ত সড়ক নির্মাণের তোড়জোড় চলছে। এ জন্য পাহাড়-পর্বত কেটে বা ডিনামাইট ফাটিয়ে নতুন সড়ক নির্মাণের প্রাথমিক কাজ চলছে।
আমাদের দীর্ঘ পথের বাম ধারে বিস্তীর্ণ পাহাড়-পর্বতশ্রেণী। আর ডান পাশে লৌহিতের স্রোতধারা। এমন চমৎকার দীর্ঘ সড়ক যাত্রার সুযোগ কমই পাওয়া যায়। শৈলশ্রেণীকে এক পাশে রেখে আমরা সমুদ্রের বেলাভূমিতে বিচরণ করছি। লৌহিতের নীল স্রোতধারা নিয়ে ভাবছি। মনে হলো এই সাগরের নাম ‘নীল সাগর’ না রেখে লাল সাগর রাখল কে?



আল-বেদ থেকে লৌহিতের তীর ঘেঁষে এই পথ চলে গেছে জেদ্দা পর্যন্ত। এ হলো ইতিহাসের এক অতি প্রাচীন পথ। এই পথ আরবদের সুপ্রাচীনকাল থেকে ব্যবহার করা বাণিজ্যপথ। হাজার হাজার উট নিয়ে বাণিজ্যের বিশাল কাফেলা চলেছে এই তিহামার পথে। আমি যেন এখনো সে উটের কারাভার একটানা মিষ্টি-মধুর ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পাচ্ছি।


 


আল মুইলা ও দুবা বন্দর
আল মুইলা নামে একটি ছোট শহরে পৌঁছলাম। নামফলকে ‘আল মুইলা’ দেখে চমকে উঠলাম। ডা: নূরুল হুদা থাকতেন মুইলাতে। ঢাকার মৌচাকে তার সাথে পরিচয়। আমি সৌদি আরব আসার সময় নূরুল হুদা সাহেব শিশু বিশেষজ্ঞ সরদার নূরুল ইসলামের ঠিকানা দিয়ে বলেছিলেন, তাবুক সফরের সময় সরদার সাহেবকে আপনার সাথী ও সহযোগী হিসেবে পাবেন। নূরুল হুদা সাহেবের সে ভবিষ্যদ্বাণী অনুসরণ করে আমি এখন সরদারজীর সাথী হয়ে আল মুইলা পাড়ি দিচ্ছি।



আল মুইলা হয়ে আমরা পৌঁছলাম দুবা বন্দর। এ সময় যাত্রীবাহী একটি মিসরি সামুদ্রিক জাহাজ এসে বন্দরে ভিড়ল। যাত্রীদেরকে এখানে আনা-নেয়ার কাজ করছে সৌদি অ্যারাবিয়ান ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির বাস। এই বন্দরটি এখনো যাত্রী পারাপারের জন্যই ব্যবহার হচ্ছে। এ পথে নামমাত্র খরচে মাত্র চার-পাঁচ ঘণ্টায় মিসর ও সৌদি আরবের মধ্যে যাতায়াত করা যায়। মিসর ও সৌদি আরবের মধ্যে এ সামুদ্রিক অভিসার অনেকটা আমাদের যমুনা নদীতে আরিচা-নগরবাড়ী ফেরি পারাপারের মতো ব্যাপার। ছোট্ট এই সমুদ্র বন্দরটি মাল খালাসের উপযোগী আরো বড় বন্দরে পরিণত করার জন্যও আয়োজন চলছে।



দুবা পোর্ট থেকে সাতাশ কিলোমিটার দূরে আমাদের গন্তব্য দুবা শহর। শহরের তিন মাইল দূরে একটি চেকপোস্ট অতিক্রম করলাম। সেখানে আমাদেরকে চেক করা হলো না। কেউ কোনো কিছু জিজ্ঞাসাও করল না। সরদার ভাই বললেন, এর আগে যতবার এসেছি এখানে কড়া চেকিংয়ের কবলে পড়িছি। কাগজপত্রে সামান্য এদিক-ওদিক হলে আর রক্ষা নেই। ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন। আরেকটু বেশি হলে নির্ঘাত গ্রেফতার।


 


দুবা শহরে দিন-রাত
দুবা শহরে প্রবেশের আগে আমরা দুবা পাওয়ার প্লান্ট ও ডিস্যালাইনেশন প্লান্ট দেখলাম। এরপর আমরা শহরে আমাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে ইঞ্জিনিয়ার রহমতউল্লাহ ভাইর বাসায় পৌঁছলাম।



দুপুরে আমাদের খাওয়ার দাওয়াত নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লাহর আবদুল আজিজ ভাইর বাসায়। আমাদের আগমন উপলক্ষে আরো বেশ কিছু মেহমানকে দাওয়াত করা হয়েছে। সেখানে নানা প্রকার ভর্তা, ভাজি ও শাকের ব্যঞ্জন আর লাউপাতার স্যুপ পরিবেশন করা হলো। মেইন কোর্স শেষে যশোরের খাজুরার খেজুর গুড়ের পায়েস। মেহমানদের রুচি ও চাহিদা সম্পর্কে সরদারজি মেজবানকে আগাম নোটিশ দিয়ে রেখেছিলেন।



আবদুল আজিজ ভাইর ছোট ছোট দুই মেয়ে রাহিমা ও মারইয়াম আর এক ছেলে ইছহাক। তারা আমাদের বিশ্রামের সময়টা নানাভাবে আনন্দে ও তৃপ্তিতে ভরিয়ে তুলল।



দুবা শহরে আমার বিকেল কাটল একটি বাংলাদেশী হোটেলে। সেখানে রাত দশটা অবধি অভিবাসী বাংলাদেশীদের সাথে আমার নানা ধরনের মানসিক লেনদেন চলল।



রাত দশটায় আমরা মিলিত হলাম আলোচনা অনুষ্ঠানে। বঙ্গোপসাগরের তীরের কক্সবাজার শহরের মতোই লৌহিতের তীরে ছোট সুন্দর ঝকঝকে পরিকল্পিত শহর দুবা। আলোচনা অনুষ্ঠানে লোকসমাগম দেখে মনে হলো যেন সারা শহরের অভিবাসী বাংলাদেশীরা ভেঙে পড়েছেন এখানে। শ্রোতাদের মধ্যে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারসহ নানাস্তরের পেশাজীবী রয়েছেন। এ ছাড়া অন্য সবাইকেও শিক্ষিত বলে মনে হলো।
ইঞ্জিনিয়ার রহমত ভাই তার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পুরো অনুষ্ঠানটি অডিও ও ভিডিও রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা করেছেন। মনে হলো কোনো স্টুডিওতে বসে অনুষ্ঠান করছি। আজকের আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর তিনি ক্যাসেট-বন্দী করে সমগ্র তাবুক এলাকায় ছড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করবেন। সেভাবেই সামগ্রিক আয়োজন।



রাত দশটা থেকে একটা অবধি তিন ঘণ্টা ধরে অনুষ্ঠান চলল। এরপর খাওয়া-দাওয়া ও বিশ্রাম।


 


নতুন পথে তাবুক ফেরা
পরদিন সকাল দশটায় দুবা থেকে তাবুকের উদ্দেশে রওনা হলাম। আমাদেরকে এখন নতুন সড়কে তাবুক ফিরতে হবে। আগে তাবুক থেকে প্রায় আড়াই শ’ কিলোমিটার সফর করে মাদায়েন এসেছি। আল-বেদ থেকে দুবার দূরত্ব এক শ’ ষাট কিলোমিটার। নতুন পথে দুবা থেকে তাবুকে আমাদের সফর হবে এক শ’ বিরানব্বই কিলোমিটার।



মুঈন ভাই জানালেন, সাপের মতো আঁকাবাঁকা এই পথ। ডিনামাইট দিয়ে পাহাড়-পর্বত গুঁড়িয়ে বিস্তর রিয়াল খরচে নির্মাণ করা হয়েছে দুবা-তাবুক এই সড়ক পথ। মনে মনে রোমাঞ্চিত হলাম। নতুন সড়কে সফর এবার হে পথিক সিন্দবাদ!



যাত্রার শুরুতে আমরা দুবা শহরের সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় আবারো একটা চক্কর দিলাম। লৌহিতের এ বেলাভূমি কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতের মতো তত বিস্তৃত বা সুন্দর নয়। কক্সবাজারে রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম সামুদ্রিক বেলাভূমি। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত সমুদ্র সৈকত। কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে মানবিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে দুবায় পর্যটকদের জন্য এক অসামান্য আকর্ষণ সৃষ্টি করা হয়েছে। আমাদের সৈকতে এর সামান্য ছিটেফোঁটা ছোঁয়া লাগলে কক্সবাজার সারা পৃথিবীর সব সাগরপ্রেমী মানুষকে বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের ডগায় নাচাতে পারত।



দুবা ছেড়ে আমরা তাবুকের পথে সমুদ্দুরের পিঠ থেকে পার্বত্য পথে ক্রমশ ওপরে উঠতে থাকলাম। সাগরের পিঠ থেকে দুই হাজার দুই শ’ ফুট উঁচুতে তাবুক শহর আমাদের গন্তব্য। আমাদের পথের দুই ধারে দুর্গম পর্বতশ্রেণী। এর মাঝখানটায় কিভাবে এই পথ তৈরি করা হয়েছে তা ভেবে অবাক হলাম।



এ পাহাড়ি এলাকায় শত শত কিলোমিটারজুড়ে কোনো মানববসতি নেই। কালচে লাল রঙের নাঙ্গা পর্বতসারি বিশালকায় দৈত্যের মতো মাথা উঁচিয়ে তাদের কর্তৃত্বের পাহারাদারি করেছে। পাহাড়-পর্বত থেকে নেমে আসা ঢল যাতে সড়কের ক্ষতি করতে না পারে সে জন্য নানা জায়গায় পাথর দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। পানির গতিকে ভিন্ন খাতে বয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাস্তার পাশে জনমানবশূন্য স্থানে সড়কযাত্রীদের জন্য ছোট ছোট কয়েকটি মসজিদও নির্মাণ করা হয়েছে।



দুবা থেকে ষাট কিলোমিটার সফর করার পর আমরা তাম্বায় পৌঁছলাম। এখানকার সড়কপথ তৈরি হয়েছে পর্বতের চূড়ার ওপর দিয়ে। আমরা যেন পৃথিবীর ছাদের ওপর দিয়ে গাড়ি হাঁকাচ্ছি। চার দিকে তাকিয়ে দেখি জনমানবহীন এই পার্বত্য বিস্তারের মধ্যে অনির্বচনীয় এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রাজ্যে আমরা প্রবেশ করেছি। মনে হলো, একান্ত একা হয়ে এই গহিন পর্বত কন্দরে হারিয়ে যেতে পারলেই কোহকাফ পুরির বানেছা পরীর সন্ধান পাওয়া যাবে। যার তালাশে আমাদের পুঁথি-কাব্যের সয়ফল মুলক সাত সাগর তের নদী পাড়ি দিয়েছিলেন।
কিন্তু সে সুযোগ কই? এই সফর শেষে ফিরতে হবে তাবুক শহরে। সেখানে ইমরানের ইন্টারভিউর মুখোমুখি হবো। তারপর যেতে হবে টাডকো সফরে।



আশি কিলোমিটার দীর্ঘ ও ষাট কিলোমিটার প্রস্থ তাবুক অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি।
সৌদি আরবের বৃহত্তম কৃষিখামার। সেখানে কয়েক শ’ বাংলাদেশী তাদের হৃদয়কে তোরণ বানিয়ে অপেক্ষা করছেন। এরপর হাইল। তা’য়িপুত্র হাতেমের ঘরবাড়ি। হাইলের হাতছানি কিভাবে প্রত্যাখ্যান করি?


 

0 comments:

Post a Comment