মোদির সফর ও চীনের আকাঙ্খা

আলফাজ আনাম
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দুই দিনের সফরে বাংলাদেশ ও ভারতের অর্জন নিয়ে কিছুটা হলেও আলোচনা শুরু হয়েছে। এই আলোচনা নরেন্দ্র মোদির সফরের আগে হওয়া উচিত ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতের সাথে যেকোনো ধরনের চুক্তির ক্ষেত্রে কঠোর গোপনীয়তা বজায় রাখা হচ্ছে। ফলে এসব চুক্তি নিয়ে খোলামেলা বিতর্ক যেমন হয়নি, তেমনি মানুষের মনে সন্দেহ ও অবিশ্বাসও বাড়ছে। নরেন্দ্র মোদির সফর নিয়ে সরকারসমর্থক একটি সংবাদপত্র শিরোনাম করেছে এলেন দেখলেন জয় করলেন। সত্যি মোদি ঢাকা সফরে এসে জয়ী হয়েছেন। এই সফরে ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক এবং ৬৫ দফা রূপকল্প ঘোষণা করা হয়েছে।
নরেন্দ্র মোদির সফরে দীর্ঘ দিন থেকে ঝুলে থাকা স্থল সীমান্তচুক্তিকে বাংলাদেশের জন্য একটি বড়
কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা যায়। ভারতের পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে নরেন্দ্র মোদি কোনো বাধা ছাড়াই সংবিধান সংশোধনের মতো জটিল ও দুরূহ কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় আকাক্সক্ষা ছিল তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি। এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। কংগ্রেসের শাসনামলে তিস্তাচুক্তি না হওয়ার জন্য মমতা ব্যানার্জিকে দায়ী করা হলেও এবার নরেন্দ্র মোদির সাথে মমতা সফরসঙ্গী হওয়া সত্ত্বেও তিস্তা নিয়ে কোনো অগ্রগতি হলো না। তিস্তাচুক্তি না হওয়া বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের ব্যর্থতা হিসেবে দেখতে হবে। অন্যভাবে দেখলে তিস্তা প্রশ্নে মমতার নীতিকে মোদি সমর্থন জানিয়ে গেলেন, যাতে সাক্ষী হয়ে রইলেন শেখ হাসিনা নিজেই। ভারতীয় গণমাধ্যমে এমন খবর এসেছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের দায়িত্বটি মমতা কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিস্তাচুক্তির ব্যাপারে আশ্বাস মিললেও তা আদৌ বাস্তবায়ন হবে বাংলাদেশের মানুষের আশা করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।
কংগ্রেসের শাসনামলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল তিস্তাচুক্তি না হলে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেবে না বাংলাদেশ। কিন্তু তিস্তাচুক্তি ছাড়াই মোদি সে সুবিধা অর্জন করতে পেরেছেন। বর্তমান সরকার ভারতকে বড় ধরনের দু’টি বিষয়ে সুবিধা দিলো প্রথমত চট্টগ্রাম ও মাংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ। দ্বিতীয়ত কলকাতা-আগরতলা বাস চলাচলের সুযোগ। নৌ ও স্থল উভয় ক্ষেত্রেই ট্রানজিট সুবিধা পেল ভারত। এর আগে নৌ-প্রটোকলের আওতায় বাংলাদেশের আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহারের যে সুযোগ ভারতকে দেয়া হয়েছিল তা স্থায়ী রূপ পেতে যাচ্ছে। নৌ-ট্রানজিটের আওতায় ভারতের জাহাজগুলো বাংলাদেশের যেকোনো বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। মূলত ভারতের আগ্রহ ছিল নৌ-ট্রানজিট এবং মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুযোগ লাভ করা। ভারত কোনো প্রকার কাঠখড় পোড়ানো ছাড়াই এই সুযোগ পেয়ে গেল। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করে সহজেই উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য সরবরাহ করতে পারবে।
pan>
প্রশ্ন হচ্ছে ভারতকে নৌ ও সড়ক ট্রানজিট দেয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশ কী পেল। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কী হারে মাশুল নির্ধারণ করা হচ্ছে বা আদৌ নেয়া হবে কি না তা এখন পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি। আশুগঞ্জ বন্দর ভারতের পণ্য পরিবহনের জন্য এখন অনেকটা নিয়মিতভাবেই ব্যবহার হলেও কোনো মাশুল দিচ্ছে না। ভারতের পণ্য পরিবহনের জন্য যে সড়ক ব্যবহার করা হবে তার অবকাঠামো ব্যয়ে ভারতের কোনো অংশগ্রহণ থাকবে কি না তার কোনো উল্লেখ নেই। এমনকি কলকাতা-আগরতলা সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে অবকাঠামো খাতে ভারতের বিনিয়োগ থাকছে কি না তা-ও স্পষ্ট নয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে বাংলাদেশের মানুষের করের টাকায় যে রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হয়েছে তা ভারতের ব্যবহারের যৌক্তিক ভিত্তি কী? বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে ভারত যে সুবিধা পাবে তাতে বাংলাদেশ কিভাবে লাভবান হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর এ দেশের মানুষকে দিতে হবে।
নরেন্দ্র মোদির এই সফরে অবশ্য বাংলাদেশকে দুই বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। যার বড় অংশ অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় হবে। এর আগে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় যে এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল, সেই অর্থ বাংলাদেশ পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারেনি ভারতের নানাবিধ শর্তের কারণে। এবারের ঋণের শেষ পর্যন্ত কত অংশ বাংলাদেশ খরচ করতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা হচ্ছে ভারতের ঋণের ক্ষেত্রে যেসব শর্ত আরোপ করা হয় তা অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। ইতোমধ্যে ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশকে ২০০ কোটি ডলার ঋণ দেয়া হবে, তাতে ভারতে ৫০ হাজার চাকরি সৃষ্টি হবে। এতে বলা হয়েছে ঋণের অর্থ যেসব প্রকল্পে খরচ করা হবে তার কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও সেবা ভারত থেকে কিনতে হবে। অর্থাৎ ঋণের দায় বাংলাদেশের আর সুদ-আসল ছাড়াও রফতানি ব্যবসায় হবে ভারতের। এই ঋণের ফলে অনেক খাতে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য রফতানি করতে পারবে। এর মধ্যে অবকাঠামো খাতের ইস্পাত (স্টিল) ও সিমেন্ট উল্লেখযোগ্য। চুক্তির শর্তানুযায়ী ঋণের অর্থে নেয়া প্রকল্পগুলোর অন্তত ৭৫ শতাংশ যন্ত্রপাতি ও সেবা ভারত থেকে নিতে হবে। এসব পণ্য ও সেবার উৎপাদনপ্রক্রিয়া হবে ভারতেই। ভারতের সাথে এই ঋণ চুক্তি ও ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার কারণে উত্তর-পূর্ব ভারতের বাংলাদেশী পণ্যের রফতানি বিশেষ করে সিমেন্ট ও ইস্পাত রফতানি কার্যত বন্ধ হয়ে যাবে।
বেসরকারি খাতে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে ভারতের দু’টি কোম্পানির সাথে চুক্তি হয়েছে। ইতোমধ্যে এ নিয়ে দেশের বিনিয়োগকারীরা প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ যৌথ বিনিয়োগে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে না। হচ্ছে একক বিনিয়োগে। এই কোম্পানি দু’টি ভারতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে অনেক ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করতে পারেনি। সেখানে বাংলাদেশে এই কোম্পানির আগমনে দেশের বিনিয়োগকারীরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। এ ছাড়া দেশীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের যে আইনি সুবিধা নিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে, একই সুবিধা এই দু’টি কোম্পানি পেতে যাচ্ছে। ফলে দেশীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলো বড় ধরনের চাপের মুখে পড়তে পারে। এমনকি ভারতীয় কোম্পানি দু’টির ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির ডাম্পিং স্টেশনে পরিণত হতে পারে বাংলাদেশ। একই সাথে বাংলাদেশের জ্বালানি খাত পুরোপুরি ভারতের নিয়ন্ত্রণে যেতে পারে। আদানি ও রিলায়েন্স এই দুটো কোম্পানির মালিকেরা নরেন্দ্র মোদির খুবই ঘনিষ্ঠ। এই দুটো কোম্পানিকে বিশেষ সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে আসলে ব্যক্তিগত পর্যায়ে মোদিকে খুশি করার প্রবণতা আছে।
মোদির এই সফরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষিত হোক বা না হোক বর্তমান ক্ষমতাসীন মহল ভারতের রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করতে পেরেছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের নীলনকশা কংগ্রেস সরকারের আমলে দিল্লিতে প্রণয়ন করা হয়েছিল। ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং নিজেই ঢাকা সফরে এসে তা বাস্তবায়নে প্রকাশ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ক্ষমতাসীনদের মনে এই শঙ্কা সৃষ্টি হয় যে কংগ্রেসের মতো সমর্থন তারা দিল্লি থেকে না-ও পেতে পারেন। ফলে দিল্লিকে খুশি করার নীতি আরো প্রকটভাবে প্রদর্শন করা হয়। এই সফরে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন যে মুখ্য ছিল তা নানাভাবে ফুটে উঠেছে। শুধু ক্ষমতাসীন দল নয়, বিএনপি এমন একটা বাতাবরণ তৈরির চেষ্টা করছে ভারতের স্বার্থের দিকটি তারাও সংরক্ষণ করতে পারেন। মোদি এই রাজনৈতিক সুযোগটি নিয়েছেন। তিনি যা অর্জন করলেন তাতে মনে হচ্ছে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন রয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে ভারতকে যেসব সুবিধা দেয়া হলো তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটা রক্ষিত হলো তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে মোদি যে আঞ্চলিক নেতা হিসেবে নিজেকে হাজির করতে চাইছেন বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে তার সে গ্রহণযোগ্যতা কতখানি অর্জন হলো? বাংলাদেশের মানুষের বুঝতে কষ্ট হয়নি যে, জনসমর্থনহীন একটি দুর্বল সরকারকে সমর্থনের লোভ দেখিয়ে কিংবা হাত মুচড়িয়ে মোদি এই সুবিধার কাগজগুলো নিয়েছেন।
২.
নরেন্দ্র মোদি এমন একসময় ঢাকা সফরে আসেন যখন আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে ভারত চাপের মধ্যে রয়েছে। কার্যত এশিয়ায় বাংলাদেশ এখন ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র। ভারতের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকটাই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। ভারতের জন্য এই মুহূর্তে মাথাব্যথার কারণ পাকিস্তানের সাথে চীনের অর্থনৈতিক করিডোর স্থাপনে সহযোগিতা চুক্তি, যার পেছনে চীনের কৌশলগত নিরাপত্তা স্বার্থ রয়েছে। নরেন্দ্র মোদি চীন সফরে গিয়ে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর নিয়ে আপত্তি ও উদ্বেগ প্রকাশ করলেও চীন তা আমলে নেয়নি বরং একই সময় দক্ষিণ চীন সাগরে ভিয়েতনামের সমুদ্রসীমায় ভারতের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী সংস্থা ওএনজিসির রিগগুলো সরিয়ে নিতে বলেছে চীন। এ নিয়ে ভারত ক্ষোভ প্রকাশ করলেও চীনা সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া ছাড়া ভারতের সামনে কোনো পথ খোলা নেই। কারণ দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ভারতের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে চীন। অপর দিকে ভারতের অপর দুই প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা ও নেপালে চীনের প্রভাব অব্যাহতভাবে বাড়ছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর নিয়ে যখন ব্যাপক প্রস্তুতি চলছিল সে সময়ে অনেকটা নীরবে সফর করে গেছেন চীনের একজন মন্ত্রী। তিনি কী বার্তা দিয়ে গেছেন তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে নরেন্দ্র মোদির সফরের আগে বার্তা সংস্থা রয়টার্স নয়াদিল্লি থেকে একটি বিশ্লেষণে জানিয়েছিল চীনের কথা মাথায় রেখে মোদি বাংলাদেশ সফরে আসছেন। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশে কি তবে চীন ও ভারতের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা রয়েছে? থাকলে তা কতখানি? বাংলাদেশ বিশ্বের ১ নম্বর অর্থনৈতিক পরাশক্তি আর ভারতের মতো আঞ্চলিক শক্তির সাথে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক স্থাপনে যে ব্যর্থ হচ্ছে তার প্রভাব কতটা পড়তে পারে? বাংলাদেশে চীনের স্বার্থ কতখানি তা বিবেচনার বিষয়।
অর্থনৈতিক কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশেগুলোর ওপর চীনের প্রভাব বাড়ছে। গত মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জেন পেং পাকিস্তান সফরে গিয়ে চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক করিডোর স্থাপনের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্পে ৪৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে। এই বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ যদি সঠিকভাবে সম্পন্ন হয় তাহলে দেশটির চেহারা অনেকটা পাল্টে যাওয়ার কথা। এই বিনিয়োগের বড় একটি অংশ ব্যয় হবে বেলুচিস্তানের গোয়াদরে সমুদ্রবন্দরের সাথে চীনের সীমান্তবর্তী জিনজিয়াং প্রদেশের সাথে তিন হাজার কিলোমিটারের সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপনের কাজে। এই রাস্তাটি যাবে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের ভেতর দিয়ে। চীনের এই সহায়তার মধ্যে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে পাকিস্তানের জ্বালানি খাতে বিশেষ করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় হবে। এসব প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ বছর।
চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় নির্মিত গোয়াদর বন্দরের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ইতোমধ্যে ৪০ বছরের জন্য চীনের হাতে ছেড়ে দিয়েছে পাকিস্তান। পশ্চিমা নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা মনে করছেন চীন এখানে একটি নৌঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনা করছে। এই বন্দরের মাধ্যমে চীন আরব সাগরে ঢোকার পুরো সুযোগ পাচ্ছে। হরমুজ প্রণালীর কাছাকাছি এই বন্দরের মাধ্যমে খুব সহজেই চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ভূখণ্ডে জ্বালানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে। হরমুজ প্রণালী দিয়ে বিশ্বের জ্বালানি চাহিদার ২০ শতাংশ বিভিন্ন দেশে সরবরাহ করা হয়। গোয়াদর বন্দর হবে চীনের জ্বালানি চাহিদার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। চীনের সহায়তায় শ্রীলঙ্কার হাম্বানতাতো গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পর পাকিস্তানের এই গভীর সমুদ্রবন্দর এশিয়ার সমুদ্র অঞ্চলে চীনের আধিপত্য আরো শক্তিশালী করছে। এখন গোয়াদর বন্দর থেকে রেল ও সড়ক যোগাযোগ স্থাপন হলে চীনে খুব কম সময় ও খরচে জ্বালানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
(Economic corridor : Pakistan, china to set up work on framework accord, The Express Tribune, march 13, 2015)
শুধু অর্থনৈতিক দিক দিয়ে চীন রাজনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়েও যে আগামী দিনে এ অঞ্চলে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে তার আরো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের কাশগড়ে আফগানিস্তানের তালেবান নেতাদের সাথে পাকিস্তান ও চীনের কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়েছে। আফগানিস্তানের ব্যাপারে চীন এত দিন প্রকাশ্য কোনো ভূমিকা নেয়নি। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণার পর থেকে দেশটিতে ভারতের প্রভাব কমে যাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। ভারত চায়নি আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা হোক। আফগানিস্তানের সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দাদের ভারত প্রশিক্ষণ দিয়েছে। কিন্তু কিছু দিন থেকে আফগানিস্তানের বিপরীত অবস্থান লক্ষ করা যাচ্ছে। আফগান সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দাদের পাকিস্তান প্রশিক্ষণ দেবে এমন চুক্তি হওয়ার পর একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় আফগানিস্তানে ভারতের প্রভাব এখন শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এখন আফগানিস্তানে পাকিস্তানের পাশাপাশি চীনও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ পাকিস্তান-চীন অর্থনৈতিক করিডোরকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রভাবের বাইরে কূটনৈতিক ও সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে চীন, যা ভারতের জন্য দুঃসংবাদ।
(Taliban and Afghan Peace Officials Have Secret Talks in China, New york times may 25 , 2015)
ভারতের পশ্চিম ফ্রন্ট অর্থাৎ আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে শুধু নয় পূর্ব দিকেও চীন যে যথেষ্ট সক্রিয় হয়ে উঠেছে তা এখন স্পষ্ট। নেপালে ভূমিকম্পের পর দ্রুততার সাথে চীন সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। ভূমিকম্পের ছয় ঘণ্টার মধ্যে চীন জরুরি টাস্কফোর্স গঠন করে। চীনা সেনাসদস্য ও সাহায্যকারীদের কাঠমান্ডু ও পাশের এলাকায় পাঠানো হয়। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের উদ্ধারে নেপাল অনেকটাই চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ সময় তাইওয়ান ভূমিকম্পে উদ্ধার অভিযানে অংশগ্রহণ ও চিকিৎসাসামগ্রী দেয়ার আগ্রহ দেখালেও নেপাল সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে। চীনের মনোভাবের কথা বিবেচনা করে এ সিদ্ধান্ত নেয় নেপাল। চীন সীমান্তের কাছাকাছি এলাকাগুলোতে ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তা সত্ত্বেও ভারতের সেনাবাহিনীকে চীন সীমান্ত এলাকায় আকাশসীমা ব্যবহারে নেপাল নিষেধ করে। অপর দিকে ভারতের উদ্ধারতৎপরতা ও সাহায্যর চেয়েও মিডিয়া ক্যাম্পেইন ছিল অনেক বেশি। নেপালের অনেক মানুষ এতে ছিল বিরক্ত। ভারতের গণমাধ্যমেও এ ধরনের কৌশলের সমালোচনা হয়েছে। বিশে^র একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র নেপালের বহু মানুষ ভারতের আধা ঔপনেবিশিক ও আধিপত্যবাদী নীতির কঠোর সমালোচক। ভূমিকম্পের চীনের সহায়তাকে নেপালিরা যতটা স্বাগত জানিয়েছে ভারতের ব্যাপারে তাদের ছিল বিরক্তি। এ ছাড়া নেপালের অবকাঠামো নির্মাণে চীনের উপস্থিতি রয়েছে। এবার মানবিক সাহায্যে অনেক নেপালি ছিল অভিভূত। ইতোমধ্যে নেপালে বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভারত ছিল ১ নম্বর দেশ। গত বছর ভারতকে পেছনে ফেলে চীন এখন প্রধান বিনিয়োগকারী।
(Was Nepal a Soft Power Victory for China? foreignpolicy.com may 1, 2015)
এবার আমরা বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের আগে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, চীনের কথা মাথায় রেখে বাংলাদেশে সফরে আসেন মোদি। এতে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়া থেকে চীনের প্রভাব দূর করার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সফরে যাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যদিও সামরিক সরঞ্জামের ব্যাপারে ঢাকা বেইজিংয়ের ওপরই নির্ভরশীল থাকছে। কয়েক দশক ধরে চীনের সাথে ভারতের একটি অস্বস্তিকর সম্পর্ক বিরাজমান। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী, বিশেষ করে পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা দেয়ায় এ সম্পর্ক দীর্ঘ দিন ধরে অস্থির হয়ে আছে। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের বন্দর উন্নয়ন করে ভারত মহাসাগরজুড়ে চীন যে ‘মুক্তোর মালা’ (স্ট্রিং অব পার্লস) তৈরি করছে, সেটা নিয়েও উদ্বিগ্ন ভারত।
নয়াদিল্লির জওয়াহেরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির চীনা বিশেষজ্ঞ শ্রীকান্ত কোণ্ডাপালিস্ত বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় কূটনৈতিক তৎপরতার অংশ হিসেবে চীন বাংলাদেশের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছে এবং এটাই ভারতের উদ্বেগের বিষয়। তিনি জানান, চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি যতবার বাংলাদেশ সফর করেছে, তা ভারতের সেনাবাহিনীর সমান। বছরখানেক আগে ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তান ছাড়া সব প্রতিবেশী দেশের সাথে যোগাযোগ করেন মোদি।
বাংলাদেশের সাবেক এক সামরিক কর্মকর্তা ও ভারত বিশেষজ্ঞ বলেন, চীনের সাথে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান সামরিক সম্পর্ক নিয়ে প্রত্যেক ভারতীয় উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের কাছে সাবমেরিন বিক্রির পরিকল্পনা রয়েছে চীনের। ভারতের উদ্বেগের বিষয়টিতে ঢাকায় প্রভাব পড়বে না বলেই তিনি জানান। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) জানায়, ২০০৯-১৩ পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট অস্ত্র ক্রয়ের ৮২ শতাংশই আসে চীন থেকে। বিশ্বের চীনের অস্ত্র বিক্রির তৃতীয় বৃহত্তম ক্রেতা বাংলাদেশ।
এসআইপিআরআইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ ও ২০১২-এর মধ্যে চীনের কাছ থেকে জাহাজবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, ট্যাঙ্ক, জঙ্গিবিমান ও অন্যান্য অস্ত্র ক্রয় করে বাংলাদেশ। সরকারি এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে রয়টার্স বলছে, বাংলাদেশের প্রথম সাবমেরিন দু’টির খরচ পড়ছে ২০ কোটি ৬০ লাখ ডলার (প্রায় ১৬০০ কোটি টাকা)। ২০১৯ সালের আগেই এগুলো সরবরাহ করবে চীন। ভারতের সামরিক পরিকল্পনাকারীদের যে বিষয়টি উদ্বিগ্ন করে সেটা হচ্ছে যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন ভেড়ানোর জন্য বাংলাদেশকে আদর্শ জায়গা বিবেচনা করতে পারে চীন।
বাংলাদেশের সরকারি এক কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানান, দেশটি কখনো চীনের নৌজাহাজকে স্বাগত জানায়নি, এ বিষয়ে কোনো পরিকল্পনাও নেই। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর উন্নয়নের কাজ করছে চীন। আর বঙ্গোপসাগরে কক্সবাজার উপকূলে সোনাদিয়া সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ঠিকাদারি পেতে এগিয়ে চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। বন্দরটি নির্মাণে খরচ হবে ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার। ভারতের আদানি গ্রুপও প্রকল্পের কাজ পেতে লড়াই করছে। বাংলাদেশের এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, সোনাদিয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত কবে হবে, এখনই বলা যাচ্ছে না। তিনি জানান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও নেদারল্যান্ডসের সমুদ্রবন্দর অপারেটররাও আগ্রহী। চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুনশী ফয়েজ আহমাদ বলেন, ‘কাজটি চীন পেলে সবচেয়ে ভালো হবে।’ তিনি জানান, ‘চীনের বিভিন্ন কোম্পানি বাংলাদেশের বিদ্যুৎকেন্দ্র, সেতু, সড়কসহ অবকাঠামো নির্মাণে কাজ করেছে। ভারতের নৌবাহিনী চীন-বাংলাদেশের সামরিক সম্পর্ক গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ঢাকায় ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ‘উদ্বেগটা বাংলাদেশের সামরিক সামর্থ্য নিয়ে নয়। পাশের দরজায় চীনের প্রভাব নিয়েই উদ্বেগ।’
রয়টার্সের এই রিপোর্টটিতে বাংলাদেশের সাথে নানা ক্ষেত্রে চীনের সম্পর্কের দিকটি তুলে ধরা হয়েছে। এ বছরের শেষের দিকে চীনের প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে। চীন যে বাংলাদেশে বড় ধরনের বিনিয়োগে আগ্রহী দেশটির পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে তা জানানো হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের দরকার ছিল ভারসাম্যমূলক নীতি গ্রহণ করা। নেপালের মতো অর্থনৈতিকভাবে দূর্বল ও ছোট দেশ এ ধরনের অবস্থান নিতে পেরেছে।
বাংলাদেশে সামরিক সহযোগিতার পাশাপাশি চীনের বড় ধরনের অবকাঠামোগত সহযোগিতা রয়েছে। এ দেশের কয়েকটি বড় ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে চীনের আর্থিক সহায়তায়। এর মধ্যে চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম সেতু পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগ করছে। অবশ্যই চীনের দৃষ্টি রয়েছে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের দিকে। গভীর সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্র করে চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড পলিসি বাস্তবায়ন হতে পারে। অর্থাৎ কক্সবাজার থেকে চীন পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করা যেতে পারে। বাংলাদেশ যে কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে তা এখন যথাযথভাবে কাজে লাগানোর সময়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার জন্য ভারতের রাজনৈতিক সমর্থনের আশায় বাংলাদেশ এই কৌশলগত সুবিধা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারছে না। ভারতের জন্য সুবিধা হচ্ছে বাংলাদেশে একটি দুর্বল সরকার ক্ষমতাসীন। অনেকটাই ম্যান্ডেটবিহীন এ সরকারের টিকে থাকার জন্য ভারতের রাজনৈতিক সমর্থন খুবই জরুরি। ভারত এই সুযোগটিকে কাজে লাগাতে চাইছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশে ভারত এই প্রভাব বিস্তারের কৌশল কাজে লাগাতে পারছে। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য চীনের সাথে সহযোগিতা বাড়ানো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
alfazanamdbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment