দীর্ঘ দিন সোভিয়েত শাসনে থাকার পর স্বাধীনতা পেয়ে ফের আত্মকলহে লিপ্ত হয়ে যে দেশটি পৌঁছে গিয়েছিল ধ্বংসমুখে সে দেশটির নাম তাজিকিস্তান। এরপর যখন আবারো নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাইছে তখন হাজারো সমস্যার পাশাপাশি মাদক উৎপাদন ও পাচারের রুট হিসেবে পরিচিতি দেশটিকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে কঠিন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি।
সেই তাজিকিস্
তানকে নিয়েই এবার লিখেছেন মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ
রিপাবলিকান অব তাজিকিস্তান। মধ্য এশিয়ার পর্বতবেষ্টিত একটি দেশ। দেশটির দক্ষিণে আফগানিস্তান, পশ্চিমে উজবেকিস্তান, উত্তরে কিরগিজস্তান এবং পূর্বে চীনের অবস্থান। সামান্য একটি করিডোরের মাধ্যমে পাকিস্তানেরও প্রতিবেশী তাজিকিস্তান। ৯০ শতাংশ ভূখণ্ডজুড়ে থাকা পর্বতময় এ দেশটির বেশির ভাগ নাগরিকই প্রাচীন তাজিক গোষ্ঠীর। এ সম্প্রদায়টি আফগানিস্তান এবং ইরানের সাথে ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভাগীদার। অসংখ্য সম্রাটের শাসনাধীনে থাকা এই তাজিকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৯১ সালে। এরপরই নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বে ধ্বংসাত্মক এক গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি হয় দেশটি, যা চলে কয়েক বছর। এ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দেশটি আবারো ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে, যদিও এর গতি খুবই মন্থর।
নামকরণ
তাজিকিস্তানের শাব্দিক অর্থ তাজিকদের আবাসস্থল। বিংশ শতাব্দীর শেষ কয়েকটি দশকে সোভিয়েত প্রশাসনের অধীনে চলে যাওয়ার পরই এ নামটি তাজিকদের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। এর আগে কখনো ইরানের কোনো অংশের জন্য অথবা ইরানি ভাষাভাষী লোকদের জন্য এ শব্দটি ব্যবহৃত হতো। সোভিয়েত প্রশাসনই মধ্য এশিয়ার তাজিক জনগণের জন্য এ শব্দটি নির্বাচন করে।
ইতিহাস
তাজাকিস্তান নামে যে স্থানটি বর্তমানে পরিচিত তার পত্তন হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ বছর আগে। তখন থেকে এ ভূখণ্ডটি বিভিন্ন সম্রাটের শাসনাধীনে ছিল। বিশেষ করে পারস্য সম্রাটদের অধীনে এ ভূখণ্ডটি থাকে দীর্ঘ সময় ধরে। বুদ্ধ-পূর্ব যুগে আধুনিক তাজিকিস্তান জারাভশান ভ্যালির অন্তর্ভুক্ত হয়ে কামবোজার অংশ ছিল। আর তখন কামবোজা সাম্রাজ্যটি শাসন করত পারস্য আচেহমানিদ সম্রাটরা। আলেক্সান্ডারের হাতে পারস্য সম্রাটদের পরাজিত হওয়ার পর এ অঞ্চলটি গ্রেসো-ব্যাকট্রিয়ান সাম্রাজ্যের উত্তরাংশ হিসেবে পরিগণিত হয়।
খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর শেষাংশ থেকে শুরু করে দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথমাংশ পর্যন্ত এটি ব্যাকট্রিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবেই থাকে। এরপর এটা হয়ে যায় তুর্কিস্তানের অংশ। তারপর কিছু দিন এটি চীন সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে গণ্য হয়।
সপ্তম খ্রিষ্টাব্দে আরবরা এ অঞ্চলে ইসলাম নিয়ে আসেন। সম্রাট সামানিড তখন আরবদের উচ্ছেদ করেন। সে সময় তিনি সমরকন্দ ও বোখারাকে আরো বড় ও সমৃদ্ধ করে তোলেন। এর পর থেকে উভয় শহর তাজিকদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গণ্য হতে থাকে (উভয় শহরই এখন উজবেকিস্তানের অন্তর্গত)। এরপর মঙ্গোলরাও কিছু সময়ের জন্য এর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। এমনিভাবে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের অধীনে কখনো এই অংশের সাথে কখনো ওই অংশের সাথে যুক্ত হয়ে এগিয়ে গেছে তাজিকিস্তানের ইতিহাস।
এ ক ন জ রে
দেশের নাম
তাজিকিস্তান
অফিসিয়াল নাম
রিপাবলিক অব তাজিকিস্তান
রাজধানী
দুশানবে
ভাষা
তাজিক
সরকারব্যবস্থা
এককেন্দ্রিক আধা প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির প্রজাতন্ত্র
স্বাধীনতা ঘোষণা
৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯১
স্বাধীনতা বাস্তবায়ন
২৫ ডিসেম্বর ১৯৯১
আয়তন
১,৪৩,১০০ বর্গকিলোমিটার
লোকসংখ্যা
২,৩৪৯,১৪৫ জন (২০১০ সালের হিসাবে)
ঘনত্ব
প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৮.৬ জন।
মাথাপিছু আয়
২,১০৩ ডলার।
মুদ্রা
সোমোনি
রাশিয়ার উপস্থিতি
ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাশিয়ার সম্রাটরা মধ্য এশিয়ায় তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে থাকেন। ১৮৬৪ এবং ১৮৮৫ সালের মধ্যে রাশিয়া উত্তরে বর্তমান কাজাখস্তান, পশ্চিমে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত এবং দক্ষিণে আফগানিস্তান সীমান্ত পর্যন্ত নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। ১৯১৭ সালে এ অঞ্চলে যখন রাশিয়ার ক্ষমতা কমিউনিস্টদের হাতে চলে যায়, তখন এ অঞ্চলের তুর্কিস্তানের অংশের ক্ষমতা দখল করে নেয় বলশেভিকরা। এরা মুসলমানদের খুব ঘৃণা ও হেয় করত। এ ক্ষোভ থেকেই বাসমাচি গোষ্ঠী গেরিলা কার্যক্রম শুরু করে। পরে তারা বলশেভিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং সোভিয়েত শাসনাধীন খিবা ও বোখারা জয় করে নেয়। কিন্তু এরপর বিভিন্ন কারণে তাদের এই স্বাধীনতা আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে পড়ে। চার বছরব্যাপী এ যুদ্ধের পর বলশেভিক সৈন্যরা তাজিকিস্তানের গ্রাম ও মসজিদগুলো পুড়িয়ে দেয় এবং লোকজনকে ব্যাপক হারে গ্রেফতার করে। এর পর থেকে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ সেকুলারবাদের প্রচারণা শুরু করে। এ সময় তারা ধর্মপ্রাণ মুসলমান, ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের নির্যাতন করতে থাকে। একই সময় মসজিদ, চার্চ ও সিনাগগগুলোও বন্ধ করে দেয়া হয়।
সোভিয়েত তাজিকিস্তান
১৯২২ সালেই বাসমাচি আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে গেলেও সোভিয়েত সরকার প্রতিবিপ্লব দমন করার জন্য মধ্য এশিয়াকে জাতিভিত্তিক পুনর্গঠন করার লক্ষ্যে উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান নামে দু’টি ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্র স্থাপন করে। এ সময় তাজিক ও কিরগিজ নামের দুইটি স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হলেও এগুলো ছিল উজবেক ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের অংশ। ১৯২৯ সালে তাজিকিস্তানকে পূর্ণাঙ্গ ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত করা হয়।
এ সময়ে জীবনযাত্রার মান, শিক্ষা এবং শিল্প সব দিক দিয়েই তাজিকিস্তান সোভিয়েতের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর পেছনে পড়ে যায়। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এ অবস্থাই চলতে থাকে। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাজিকিস্তান থেকে তার নিয়ন্ত্রণ গুটিয়ে নেয় এবং তাজিকিস্তান নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯৯১ সালে ইরান সর্বপ্রথম তাজিকিস্তানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তারাই প্রথম তাজিক রাজধানী দুশানবেতে তাদের দূতাবাস স্থাপন করে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী অবস্থা
স্বাধীনতা পাওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই তাজিকিস্তানের গোত্রগত দলাদলির কারণে দেশটি গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এ সময় অমুসলিম নাগরিক বিশেষ করে ইহুদি এবং রাশানরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। নির্যাতন ও দারিদ্র্যের আশঙ্কা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির আশায় তারা পাশের অন্য সোভিয়েত দেশে পালিয়ে যায়।
১৯৯৪ সালের নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এমোমালি রেহমান তার পূর্বসূরি আব্দুল মালিক আব্দুল্লাহ জানবকে পরাজিত করে ক্ষমতায় আসেন। ১৯৯৯ সালের নির্বাচনে রেহমান ৯৮ শতাংশ ভোটে এবং ২০০৬ সালের নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো ৭৯ শতাংশ ভোট নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন।
সরকার ও রাজনীতি
স্বাধীনতা পাওয়ার পরপরই জড়িয়ে পড়া এ গৃহযুদ্ধে এক লাখের ওপর মানুষ মারা যায় এবং দেশের ভেতরে ও বাইরে কমপক্ষে ১২ লাখ লোক উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। এ যুদ্ধে তাজিকিস্তান পুরোপুরি একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। রাশিয়া ও ইরানের সমর্থন নিয়ে পক্ষ দু’টি দীর্ঘ দিন সংঘর্ষে লিপ্ত থাকে। এ সময় প্রচুর দক্ষ কর্মী দেশটি ছেড়ে পালিয়ে যায়। ১৯৯৭ সালে রেহমান এবং বিরোধী দলগুলোর মধ্যে এক অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে সম্মত হয়। এরপর একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার দেশটির দায়িত্ব গ্রহণ করে।
তাজিকিস্তান সরকারিভাবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানে প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দেশটিতে দলশাসিত রাজনীতি প্রচলিত রয়েছে। পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব তাজিকিস্তান বা পিপিপিটি ধারাবাহিকভাবে দেশটির সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে আসছে। তবে ২০০৫ সালের নির্বাচন সম্পর্কে বিরোধীদের দাবি ছিল এতে প্রেসিডেন্ট এমোমালি রেহমান নির্বাচনে তার ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করেছেন। সর্বশেষ নির্বাচনে ২০১০ সালের ফেব্র“য়ারিতে ক্ষমতাসীন পিপিপিটি সংসদে চারটি আসন হারালেও এখনো তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রেখেছে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহলও দাবি করছে এ নির্বাচনটি একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের সব শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। তবে সরকারের দাবি, নির্বাচনে সামান্য কিছু সমস্যা হলেও তা তাজিক জনগণকে তেমন একটা সমস্যায় ফেলবে না। এর বাইরে রেহমান সরকারকে অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড কোঅপারেশন ইন ইউরোপ বা ওএসসিই’র পক্ষ থেকে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তারা দাবি করছে তাজিক সরকার দেশ-বিদেশের ওয়েবসাইটগুলোতে সেন্সর আরোপ করেছে এবং বিভিন্নভাবে সংবাদমাধ্যমগুলোর কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে।
ভূপ্রকৃতি
চার পাশে ভূমিবেষ্টিত তাজিকিস্তান মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে ছোট দেশ। পর্বতশ্রেণী দ্বারা এর বেশির ভাগ স্থান আবৃত। এসব পর্বতমালার কারণে দেশটির ৫০ শতাংশ এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিন হাজার মিটার উঁচু। একমাত্র বড় ধরনের নিম্নভূমি রয়েছে উত্তরে ফারগানা ভ্যালিতে। এ ছাড়া দক্ষিণের কোফারনিহান এবং ভাখন নদী উপত্যকায়ও কিছু সমতল স্থান রয়েছে। আমু দরিয়ার ফলেই এ স্থানগুলো সৃষ্টি হয়েছে। দেশটির রাজধানী দুশানবে দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত।
আমু দরিয়া এবং পাঞ্জ নদী আফগানিস্তানের সাথে সীমান্ত রেখা হিসেবে কাজ করছে। এ ছাড়া তাজাকিস্তানের পাহাড় থেকে নেমে আসা হিমবাহগুলো আরল সাগরের অন্যতম উৎস হিসেবে কাজ করে থাকে। তাজিকিস্তানে এমন ৯০০টির বেশি নদী রয়েছে যেগুলোর বিস্তৃতি ১০ কিলোমিটারের বেশি। ৫৮টি জেলা এবং গ্রাম পর্যায়ের স্বায়ত্তশাসিত ৩৬৭টি জামোট নিয়ে গঠিত তাজিকিস্তানকে শাসনকার্যের সুবিধার্থে চারটি প্রশাসনিক এলাকায় ভাগ করা হয়েছে।
জনপ্রকৃতি
৭,৩৪৯,১৪৫ জনসংখ্যার দেশ তাজিকিস্তানে তাজিক ভাষাভাষী লোকরাই মূলত দেশটির মূল অধিবাসী। দেশের জনসংখ্যার বেশির ভাগটাই তাদের দখলে। এ ছাড়া দেশটিতে রাশান ও উজবেকও রয়েছে যৎসামান্য। তবে তাজিকিস্তানে বসবাসকারী সবাইকেই তাজিক বলেই পরিচয় দেয়া হয়। দেশটির দশ লাখ লোক বর্তমানে অন্য দেশে কর্মরত রয়েছে।
ভাষা
তাজিকিস্তানের মাতৃভাষা ও সরকারি ভাষা হচ্ছে তাজিক। তবে ব্যবসায়-বাণিজ্য ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে রাশান ভাষাও বেশ প্রচলিত। দীর্ঘ দিন সোভিয়েত শাসনাধীনে থাকার কারণে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। কিছু দিন আগে অবশ্য সারিকারিভাবে এ ভাষার ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও সংবিধান অনুসারে এখনো সেটি উপজাতীয় গোষ্ঠীগুলোর যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত।
অর্থনীতি
মধ্য এশিয়ার দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর অন্যতম হচ্ছে তাজিকিস্তান। দেশটির বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থানও তেমন একটা সুবিধাজনক স্থানে নেই। অর্থনৈতিক খাতে ব্যাপক দুর্নীতি, সংস্কারের ক্ষেত্রে অপূর্ণতা এবং অব্যবস্থাপনাকেই এর জন্য মূল দায়ী হিসেবে ধারণা করা হয়। ২০০১ সালে দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা এতটাই খারাপের দিকে চলে যায় যে, সে বছরের ২১ আগস্ট রেড ক্রস দেশটিকে দুর্ভিক্ষ আক্রান্ত দেশ বলে ঘোষণা করে দেশটির জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য প্রার্থনা করে। পরবর্তী বছরগুলোতে তাজিকিস্তান কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে এবং পার্শ্ববর্তী তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থানে পৌঁছে যায়।
সম্প্রতি দেশটিতে আনজাব টানেল নির্মাণ শেষ হয়েছে, যা পর্বতময় দেশটির উত্তরাঞ্চলের সাথে রাজধানীর যোগাযোগকে সহজ করবে। এ টানেলটি ইরান ও আফগানিস্তানের সাথে দেশটির যোগাযোগের জন্য রাস্তার অংশ হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। আর এ বিষয়টি দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থাকে আরো সমৃদ্ধ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় তাজিকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে একটি ব্রিজ নির্মিত হয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার সাথে তাজিকিস্তানের বাণিজ্যিক সম্পর্ককে মজবুত করতে সাহায্য করবে।
দেশটির অর্থ খাতের প্রধান ভূমিকা পালনকারী বিষয়গুলো হচ্ছে অ্যালুমিনিয়াম ও তুলা এবং প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স। রাষ্ট্র পরিচালিত অ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরি ট্যালকো মধ্য এশিয়ার বৃহত্তম অ্যালুমিনিয়াম কোম্পানি। এ ছাড়া দেশটি হাইড্রোইলেকট্রিক শক্তি উৎপাদনে বিশ্বে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। এ খাতে দেশটিতে রাশিয়া, চীন ও ইরান অর্থ বিনিয়োগ করছে।
তাজিকিস্তানের অর্থনীতিতে প্রবাসী বিশেষ করে রাশিয়াতে বসবাসকারী তাজিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স বড় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। গত কয়েক বছরের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে এর অবদান অসামান্য।
বৈধ আয়ের পাশাপাশি তাজিকিস্তানে অবৈধ অর্থের আমদানিও রয়েছে বেশ। মাদক উৎপাদন ও পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে তাজিকিস্তান এ খাতে প্রচুর অর্থ আয় করে থাকে। এ অর্থ তাজিকিস্তানের সরকার প্রশাসনকেও প্রভাবিত করে থাকে। সরকারের প্রভাবশালী কয়েকজন সদস্য এর সাথে জড়িত থাকায় দেশটি মাদকচক্র থেকে মুক্ত হতে পারছে না। তার পরও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টায় সাম্প্রতিক সময়ে এ প্রবণতা কিছুটা কমেছে বলে দাবি করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য
তাজিকিস্তানের সরকারের অব্যাহত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দেশটি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে বেশ দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। ২০০০ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশটিতে প্রতি এক লাখ লোকের জন্য চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ২০৩ জন। দেশটিতে মৃত্যুহার হাজারে ৫৯ জন। পুরো বিশ^ থেকে পোলিও প্রায় নির্মূল হলেও তাজাকিস্তানে এ রোগটি বাড়ছেই। ২০০৮-০৯ সালে শূন্যের কোঠায় থাকলেও ২০১০ সালে দেশটিতে পোলিও রোগীর পরিমাণ ছিল ১৪১ জন, যখন পুরো বিশ্বে এ রোগীর পরিমাণ ছিল ২৩৭ জন।
সংস্কৃতি
ঐতিহাসিকভাবেই তাজিক এবং পার্সিয়ানরা একই ভাবধারার। তাদের ভাষাও কাছাকাছি পর্যায়ের। দেশটির ৮০ শতাংশ লোকেরই মাতৃভাষা তাজিক। বর্তমানে দেশটির রাজধানী দুশানবে, খুজান্দ, দুলব, পাঞ্জাকেন্ট এবং ইস্তারভশান প্রধান এলাকা হিসেবে পরিচিত। উত্তর তাজিকিস্তানে ২৫ হাজার লোক রয়েছে ইয়াগনোবি সম্প্রদায়ের। তারা ইয়াগনোবি ভাষাতেই কথা বলে থাকে।
শিক্ষা
দেশটি ২০০২ সাল থেকে তার জিডিপি’র ৩.৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে খরচ করে আসছে। তবে এর পরও সার্বিকভাবে দেশটির শিক্ষা খাতকে তেমন উন্নত বলা যায় না। ইউনিসেফের দেয়া এক তথ্যমতে দারিদ্র্য এবং লিঙ্গবৈষম্যের কারণে প্রতি বছর ২৫ শতাংশ মেয়েশিশু প্রাইমারি শিক্ষা সমাপ্ত করতে পারে না। তার আগেই তারা ঝরে যায়। তবে সব কিছু ছাপিয়েও তাজিকদের যে বিষয়টি গর্ব করার মতো তা হলো দেশটির ৯৯.৫ শতাংশ লোক লিখতে ও পড়তে পারে।
ধর্ম
তাজিকিস্তানে ২০০৯ সালে ইসলামকে সরকারি ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ বিষয়টি সাবেক সোভিয়েত দেশগুলোর মধ্যে তাজিকিস্তানকে আলাদা করে তুলেছে। তবে তাজিকিস্তানে অন্য যেকোনো ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। ২০০৯ সালের তথ্যানুসারে দেশটির ৯৮ শতাংশ লোক মুসলমান। এদের মধ্যে ৯৫ শতাংশ সুন্নি এবং ৩ শতাংশ শিয়া মুসলমান। আর বাকি দুই শতাংশের মধ্যে অর্থোডক্স, প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ও ইহুদি রয়েছে।
তাজিকিস্তানের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগ করতে ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোকে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। এই রেজিস্ট্রেশন ছাড়া কোনো দল উপসনার জন্য একত্রিত হতে পারবে না। এর ব্যতিক্রম করলে বড় অঙ্কের জরিমানার পাশাপাশি তাদের উপাসনাস্থল বন্ধ করে দেয়া হয়।
খেলাধুলা
পর্বতময় তাজিকিস্তানের খেলাধুলাও পাহাড়পর্বতকেন্দ্রিক। পাহাড়ে হাঁটা, উঁচু পাহাড়ে আরোহণ করা ইত্যাদিই এখানকার প্রধান খেলা হিসেবে পরিচিত। প্রতি মৌসুমে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্বত এজেন্সিগুলো বিভিন্ন খেলার আয়োজন করে থাকে। এর পাশাপাশি দেশটিতে ফুটবলও একটি জনপ্রিয় খেলা। তারা ফিফা ও এএফসি আয়োজিত বিভিন্ন খেলায় অংশ নিয়ে থাকে।
0 comments:
Post a Comment