আজাদুর রহমান
চোখ বুজলেই ছবিটা ভেসে ওঠে। একদল দামাল ছেলে ঝাঁপ দিচ্ছে নদীতে। ঝপ ঝপ ঝপাং। শ্যামলা উপত্যকার পরানজুড়ে সাদা সাদা হাঁসের পাল। পাড় ধরে থরে থরে সবুজের খাঁজকাটা কারুকাজ নেমে গিয়ে জল ধরেছে। ছাব্বির চোখ বন্ধ রেখেই কল্পনায় ছুঁয়ে দেখছে ছেলেবেলার গ্রামারণ্যকে।... একদিন ঠিকই সে এই পাথু
লাঙলের মুঠো ধরে জর্জরিত হবে ঘামে, মেঠেল গানে। সাদা ভাতের মতো সহজ জীবনের লোভে মনটা প্রায় ভরেই যাচ্ছিল। মারুফ ছবিটা ভেঙে দিল বাবা, বাবা, অ্যাই বাবা, ওঠো। সাব্বির চোখ কচলায়। তারপর বাসি বিছানায় দ্-ুতিনটা মোচড় দিয়ে উঠে পড়ে। সাত বছরের মারুফের খুব বুদ্ধি। সব বুঝতে পারে। ওকে তাই আলাদা বিছানা করে দেয়া হয়েছিল। নার্গিস চলে যাবার পর থেকে সে এখন সাব্বিরের সাথে ঘুমায়। মায়ের সাথে ছেলেটা চলে গেলে সাব্বির যারপরনেই একা আর অসহায় হয়ে যেত। মধ্য বয়সে বান্ধবহীন হলে কেউ থাকে না। চারপাশ ধু-ধু করে। ভাগ্য ভালো যে ছেলেটা বাপ ন্যাওটা।
নার্গিসের সমস্যাটা বিয়ের আগে ঠিক বোঝা যায়নি। দেখেশুনে একটা উচ্ছল তরুণীর সাথেই পরিচয় হয়েছিল সাব্বিরের। একবার অন্তত নার্গিসকে দেখতে না পেলে দিনটাই কানা হতো তখন। প্রথম প্রেমপত্রটা আজও চোখে লেগে আছে। সম্বোধনটাই অন্য রকম ‘জানপাখি নার্গিস’। ‘তোমার জন্য আমি সব করতে পারি। চাইলে আকাশের চাঁদ এনে দিতে পারি।’ তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না এমন হালকা কথাও ছিল চিঠিতে। পাতার ভাঁজে ছিল গোলাপের পাপড়ি। সুগন্ধি চিঠির কথাগুলো ভাবতে গেলে এখন খানিকটা লজ্জাই লাগে সাব্বিরের।
নার্গিসকে বউ করে পেয়ে ষোলোকলায় ভরে গিয়েছিল জীবনটা। ছয় মাস কিছুই বুঝতে পারেনি সে। সমস্যাটা পরিষ্কার হতে শুরু করল বছরখানেক পরে। প্রতিদিনের ছোট ছোট ক্ষয়, পরিবর্তন টের পাওয়া যায় না। একদিন সব শূন্য হয়ে গেলে ফাঁকা মাঠে হতবাক হতে হয় কেবল। গত আট বছর ধরেই ভাঙছে।
পায়ের তলায় শেষ মাটিটুকু নিয়ে যখন কোনোমতে সাব্বির উঠে দাঁড়াতে চাইল, তত দিনে নার্গিসকে ফেরানোর পথ শেষ হয়ে গেছে। মানুষ খুব অসহায় জীব বোধহয়। তলে তলে যা হয়, সে তেমন জানতেই পারে না। জানতে জানতেই মৃত্যু এসে হাজির হয়। কত ধরনের পরিবর্তন যে হয় বোঝাই মুশকিল। কাল-পরকালের চিন্তাও বদলে যায় একসময়। ভবিষ্যৎ জানা গেলে খুব ভালো হতো। কে জানত, নার্গিসের সঙ্গে সে সুখী হবে না। পূর্বাভাস বলেও তো কিছু নেই।
বিয়ের ক’দিন পরেই কলেজ লাইফে ভালোলাগা এক কিশোরীর নাম উদার মনেই বউকে বলেছিল সাব্বির। ভেবেছিল স্ত্রীকে সব কথা আগে থাকতেই বলে নেয়া ভালো। নতুন করে ঝামেলা হবার আর সুযোগ থাকবে না। বলার পর বেশ স্বস্তিও পেয়েছিল সে। কয়েক মাস ঝামেলাও হয়নি। কিন্তু বুঝতে পারেনি যে, কত বড় ভুল সে করেছিল।... সহসা একদিন তাই খামোখাই কাল্পনিক সেই কিশোরীকে জড়িয়ে চোখে সন্দেহ ঢালতে শুরু করল নার্গিস।
নারী যত বড় মাপের মুক্তমনাই হোক না কেন, জীবনের কোনো এক বাঁকে এসে সে মহিলারি ভাঁজ খুলে বসে। যেমন কালামের স্ত্রীর কথাই ধরা যাক। ভার্সিটিতে পড়ার সময় সে প্রায় নাস্তিক মতোন ছিল। সব কিছুতেই মুক্তচিন্তা। আলাদা করে মহিলার কোনো আদিখ্যেতা ওর মধ্যে ছিল না। ক্লাসমেট হিসেবে কালামকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হতো তখন। কিন্তু দু’বছর পর একদিনের ঘটনা দেখে তাজ্জব হয়ে গেল সাব্বির। হিংসা, পরচর্চা আর সন্দেহের তীরের মুখে স্বামীকে রেখে মেয়েটি সেদিন ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল। অন্তত সেসব অভিজ্ঞতা থেকেই সে নার্গিসের ব্যাপারটা খানিক মেনে নিয়েছিল বটে। কিন্তু নার্গিস যেন বাস্তবের মুখে দাঁড়িয়ে ঝগড়াটে মহিলার মতো ঝগড়া শুরু করে দিলো। তারপর দিনে দিনে ক্রমেই খিটকেল হয়ে গেল।
প্রথম দিকে কথা কাটাকাটি হতো। সাব্বিরের মন খারাপ হয়ে যেত, কোনো কোনো রাতে তাই না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ত সে। পেটের ক্ষুধার কাছে অভিমানটা বড় ছিল তখন। নার্গিস থামল না, পরে আক্রমণটা আরো বেড়ে গেল। বাপ-মা তুলে গালাগালি করলে কার রাগ সামালে থাকে। মাথায় রক্ত উঠে গেলে সাব্বির অগত্যা নিজের হাত কামড়ে দিত। রুটিন ওয়ার্ক মনে করলে কেমন হয়! সাব্বির ধরেই নিলো, নার্গিস চুলকানির মতো ঝামেলা করতেই থাকবে। এটাকে নিয়তির বোঝা মেনে নিলেই তো হলো। কত লোকের তো পা নেই, হাত নেই, কারও বা মাজায় ব্যথা! তাই বলে তো তারা জীবন থেকে বাতিল হয়ে যায় না, বরং যন্ত্রণাকে সাথে নিয়েই তো তারা বেঁচে থাকে, স্বপ্ন দেখে।
রুটিনও কাজ করল না। নার্গিস অন্য সাবজেক্ট বেছে নিলো। পাড়ার দু-একজনকে নিয়ে চরিত্রের সাথে লাগিয়ে দিতে লাগল।
বলতে গেলে সাব্বিরের চোখের সামনেই সংসারের শরীরটা ধীরে ধীরে তিতে হয়ে যাচ্ছিল। একমাত্র সন্তান মারুফ হয়তো ক্রমঅগ্রসরমান দুটো দেয়ালকে কিছুটা ঠেলে রেখেছিল। কিন্তু কত দিন! বেশি দিন টিকল না। পাড়ার মাহেলার সাথে এমনিতেই সাব্বির মাঝে মধ্যে কথা বলত। এটা দেখে নার্গিস পুরোপুরি ধরে নিলো যে, তার সাথে মাহেলার নিশ্চয়ই শারীরিক সম্পর্ক আছে। যথারীতি নার্গিস বাড়াবাড়ি করতে লাগল। একপর্যায়ে ব্যাপারটা পাড়াসুুদ্ধ রটে গেল। সালিস হলো। নার্গিস মাফও চাইল। কিন্তু পরিবর্তন হলো না। সন্দেহের লতা থামল না, আরো ছড়িয়ে পড়ল। নার্গিস এবার রীতিমতো পাহারা বসাল। পরকীয়ায় যাবার সময় সে যাতে টের পায়, এ জন্য সে বিছানা বাদ দিয়ে দরজার পাশে গিয়ে শুতে শুরু করল। মাহেলা পর্যন্ত আর থাকল না। পাড়ার অন্যান্য মেয়েদের জড়িয়েও সে কান কামড়াতে লাগল। সাব্বিরের জীবনটা ক্রমে বিষাক্ত হয়ে গেল।
দেহ-মন কিভাবে যেন আলগা হয়ে একপথে থাকতে চায় না। দু’জনের সম্পর্ক যা একটু ছিল, তাও একদিন পরোপুরি নিভে গেল।
কোনো মানে নেই। অথচ নার্গিস সন্দেহ করে চলেছে। একপর্যায়ে যখন সে কিছুই পেল না তখন তার ধারণা হলো, সাব্বির নিশ্চয়ই জানালা দিয়ে রাতের বেলা বের হয়ে যায়। জানালায় গ্রিল বসাল সে। প্রতিবাদ করতে গেলে আরো বেড়ে গেল। শেষ পর্যন্ত যা হবার তাই হলো। এক ভোরে দু-এক কথায় মহাগণ্ডগোল বেধে গেল। হাতহাতি হলো। নার্গিস ব্যাগপত্র গুছিয়ে চিরদিনের জন্য আর ফিরবে না বলে চলে গেল।
নার্গিস চলে যাবার পর সাব্বির যেন অন্ধকারে পড়ে গেল। মাথাটাও খানিক এলোমেলো হয়ে গেল। একমাত্র অবলম্বন মারুফ। ওকে নিয়ে কোনোমতে টিমটিম করে দিন পার করতে লাগল সে।... তিন মাসের মাথায় একদিন হঠাৎ করেই নার্গিস চলে এল। ক’মাসেই শরীরটা ভেঙে আধখ্যাঁচড়া হয়ে গেছে ওর। যে হাসিতে গালে টোল পড়ত, সে হাসিতেই এখন দু’পাশের হলুদ দাঁত বেরিয়ে আসে। মনটা খারাপ হয়ে গেল সাব্বিরের। স্ত্রী তো! এত দিন পর নার্গিসকে পেয়ে সব ভুলে গেল সে। কয়েক দিন খুব স্বাভাবিক গেল। এত দিন পর সাব্বিরও যেন নতুন করে চলতে শুরু করল। কিন্তু হঠাৎ এক রাতে সে দেখতে পেল নার্গিস বিছানায় নেই। অস্থির হয়ে খুঁজতে লাগল সে। কোথাও নেই।
নার্গিস ফিরে এলো ভোর রাতে। চেহারা এলোমেলো। সাব্বির জিজ্ঞাসা করল, কোথায় ছিলে তুমি? প্রশ্ন শুনে নার্গিস ঝাঁঝিয়ে উঠল, নাগরের কাছে গেছিলাম। তুমি যদি যার-তার সাথে শুতে পারো, আমি পারি না? কথাগুলো কানে ঢোকা মাত্র সাব্বিরের পায়ের সব রক্ত এক দাগে মাথায় উঠে গেল। আর সহ্য করতে পারল না। হাতের কাছে চেলাকাঠ ছিল। তাই দিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করে দিলো। জখম থেকে বাঁচতেই বোধহয় নার্গিস দমাদম কয়েকটা ঘুষি মেরে চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে গেল। একটু পর পাড়ার লোকজন ঘিরে ফেলল সাব্বিরকে। খোঁজাখুঁজির পর নার্গিসকে কোথাও পাওয়া গেল না। সাব্বিরকে ধরতে তিন দিন পর পুলিশ এলে কোনোমতে পালিয়ে বাঁচল সে।
কিভাবে পার হবে সাব্বিরের জীবন? বউকে তালাক দিতে গেলে আরেক মামলায় পড়তে হবে।
নার্গিসের পাগলামিটা এমন যে, লোকসমাজ, আত্মীয়স্বজন কেউ-ই তাকে ঠিক পুরোপুরি পাগলী সাব্যস্ত করবে না। বদ্ধ পাগলীও সে নয়। সারা জীবন ধরে সাব্বিরকে কুরে কুরে নিঃশেষ করে দেবে সে! আহা, নার্গিস যদি নিজেই তালাক দিয়ে মুক্তি দিত তাকে। তবুও তো একটা মন্দের ভালো হতো। তা সে করবে না। অথচ সাব্বিরেরও তো একজন মেয়েমানুষের দরকার। আবোল-তাবোল ভাবতে গিয়ে ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল। অঙ্কে কাঁচা ছিল সাব্বির। সরল অঙ্ক করতে গিয়ে প্রথমেই মাথাটা বিগড়ে যেত। পরের অঙ্কগুলো আর মেলাতে পারত না সে। ক্লাস এইট পর্যন্ত এ রকম ভুল হবার পর সে সিদ্ধান্ত নিলো, আর যাই হোক সবশেষে করবে সরল অঙ্ক। গ্রাজুয়েশন পর্যন্ত আর ভুল হয়নি। এমনকি বেসরকারি হাইস্কুলে বিএসসি টিচার হিসেবে যোগ দিতে গিয়েও ভুল হয়নি। কিন্তু নার্গিসের সাথে বিয়েটা বোধ হয় ভুল হয়ে গেছে। জীবনটা তো আর পাটীগণিতের খাতা নয় যে বারবার কেটে ঠিক করা যাবে। বিবাহিত জীবনটা সরল অঙ্ক নাকি!
সব কিছু আসলে উল্টোভাবে চলে। যেমন সবচেয়ে কঠিন অঙ্কটাকেই লোকে বলে সরল অঙ্ক। জীবনটা অঙ্কের মতো না। হলে ভালো হতো। বিয়ের আগে অন্তত দু-একবার এ ধরনের খসড়া সরল অঙ্ক করে হাতটা পাকা করা যেত। বান্ধবীও জুটেছিল। কিন্তু সাব্বির তো গুডবয়, ভালো ছাত্র। ইন্নোসেন্ট। মেয়েগুলোকে মনে ঠাঁই না দিয়ে সে যে কত বড় ভুল করেছে, আজ তাই গচ্ছিত জীবনকে বেহিসেবি হাতে ব্যয় করেও ফল মেলানো যাচ্ছে না।
সাব্বিরের মানব জনমটাই বৃথা। বাঘবন্দীর মতো আটকে গেছে তার জীবন।
0 comments:
Post a Comment