জাফর তালুকদার
‘নাও, হাত ধরে সাবধানে ওঠো।’
‘না না, আমি পারব না, ভয় করছে।’ মহুয়া কাতর স্বরে কথাটা বলে স্বামীর হাত আঁকড়ে ধরলেন।
‘আরে বাবা, এতে ভয় পাওয়ার কী আছে। আমার তো ভাঙা পা, তোমার তো সে সমস্যা নেই।’ লোকটা
যদিও তাচ্ছিল্যের সাথে কথাটা বললেন, কিন্তু হাঁটুর সমস্যার কথা চিন্তা করে একটু দ্বিধা জাগল মনে। আসলে এই উঁচু পাহাড় তাদের পক্ষে আদৌ অতিক্রম করা সম্ভব হবে কি? কিন্তু এ মুহূর্তে দুর্বল স্ত্রীর সামনে সেটা প্রকাশ করা আত্মহত্যার শামিল। তাতে পুরো ইচ্ছাটাই ভণ্ডুল হয়ে যাবে।
এখন অনেক রাত। পুরো প্রান্তর আলোয় আলোয় হাসছে। চাঁদ নেমে এসেছে পাহাড় চূড়ার কাছে। সবটুকু অন্ধকার শুঁষে নিয়ে সেটা এখন পরিণত হয়েছে আলোর স্তম্ভে। ঘাস-লতাপাতার প্রতিটি রেখা স্পষ্ট। পা ফেলতে অসুবিধা নেই। তবুও একটু অসতর্ক হলে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটা বিচিত্র নয়।
কোয়ান্টাম রিসর্টে ধ্যান-উৎসবে আসার পর সবাই হৈ হৈ করে এই পাহাড়টায় চড়ে এসেছে একবার। পাহাড়ের নাম জাবালে শামস। এলাকার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। বোধিছড়ার অনেকটাই দেখা যায় এই পাহাড় চূড়া থেকে। ওখানে ওঠার পর সবার মুখ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যায়। গল্প আর ফুরোতেই চায় না। ভাবখানা দেখে মনে হয় রাজ্য জয় করে ফেলেছে। দুই অসুস্থ বুড়োবুড়ির সাহস হয়নি ওখানে ওঠার। কেউ তাদের নিয়ে মাথাও ঘামায়নি। অনেকটা করুণার চোখে পাশ কেটে চলে গেছে তারা। আজ বিকেলে যে ঘটনাটা ঘটল সেটাও কী সেই তাচ্ছিল্যের ইঙ্গিত?
দলের এক জোড়া যুবক-যুবতী, যারা অনবরত মিশে আছে একে অন্যের সাথে, কথায় কথায় হেসে লুটিয়ে পড়ছে, কখনো কপট অভিমান, চোখ ছলছল। কিন্তু দুই মুহূর্ত না যেতেই হেসে উঠল রোদের ঝিলিক, তখন আবার সেই গুজগুজ-ফুসফুস, চোখে চোখে ইশারা, জিভ ভ্যাংচানো, এমনকি তাদের উপেক্ষা করে হঠাৎ চুমুও খায় একটা।
মহুয়া চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন অন্য দিকে। যেন পাহাড়ের চূড়াটা খুব দেখার। এমন দৃশ্য তিনি কখনো দেখেননি এর আগে। অপূর্ব এক মুগ্ধতা ভর করে তার দু’চোখের পাতায়।
সেই ছেলেমেয়ে দু’টি লজ্জিত চোখে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো তাদের সামনে ‘ইসকিউজ মি আমি সাকিব আর ও পিউ, আমরা নিউলি ম্যারেড। এখানে এসেছি পাহাড়ের টানে। আমরা একটু আলাদাভাবে দু’জনে পাহাড়ে উঠব বলে সবার সাথে যাইনি। আপনারা গেলেন না কেন?’
প্রফেসর জুলফিকার কায়েসকে সচরাচর কেউ প্রশ্ন করেন না। বছর বিশেক হলো অবসর নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কিন্তু তার ব্যক্তিত্বের দ্যুতি খর্ব হয়নি একটুও। এখনো তিনি যথেষ্ট শ্রদ্ধা আর সমীহের পাত্র। এই ছোকরাটি তার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে দেখে বিস্মিত হলেন।
কিন্তু ছেলেটি তার উত্তর চেয়ে বসে নেই। সে নতুন বউকে এক রকম বগলদাবা করে ছুটে চলল পাহাড়ের দিকে। যেন একটুও সময় নেই তাদের হাতে। এমনই দ্রুত ছোটার ভঙ্গি।
মহুয়া মৃদু হেসে বললেন, ‘পাগল’!
‘পাগল না ছাই। বেয়াদব...। এদের কাণ্ডজ্ঞান জীবনে হবে না।’ প্রফেসরের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল।
‘তুমি ওদের তোমার ছাত্র ভেবেছ নাকি!’
‘তা ভাবিনি। কিন্তু মুরব্বিদের সামনে কীরকম আচরণ করতে হয় সেটাও তো শেখেনি অই রাস্কেলটা।’
‘কী মুশকিল, ও আবার এমন কী করল!’
‘করেনি! কিছুই করেনি? ভালগারিটির একটা লিমিট থাকা উচিত।’
‘অ, বুঝতে পেরেছি, তুমি খামোখাই চটছ। ওদের অল্প বয়স। নতুন বিয়ে করে ঘুরতে এসেছে। পাহাড়-জঙ্গলে এলে ওরকম একটু দস্যিপনা সবাই করে। সবাই তো আর তোমার মতো...’ মহুয়া আলগা গলায় কথাটা বললেও তার চোখের বিদ্রƒপটুকু লুকাতে পারলেন না।
প্রফেসর বিস্মিত চোখে তাকালেন স্ত্রীর দিকে ‘সবাই আমার মতো কী, বল?’
‘কিছু না, এবার চলো উঠি।’
কিন্তু আপাতত ওঠার কোনো আগ্রহ তার নেই। দূরবীনটা সরিয়ে রেখে পরিষ্কার চোখে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। সেই কত দিন হলো এই মহিলাটি তার সাথে আছেন। হ্যাঁ, পরিণত বয়সেই তারা বিয়েটা সেরেছেন। এ নিয়ে কোনো আলাদা হই চই, আড়ম্বর ছিল না। বিদেশ থেকে ফিরে একটি গবেষণাকর্মে জড়িয়েছিলেন কিছু দিন। মহুয়া তখন কলেজে পড়াতেন। যোগাযোগটা গড়ে উঠেছিল এই গবেষণার সূত্রে। এক বৃষ্টির দুপুরে এই মহিলার চোখে যে রহস্য আবিষ্কার করলেন তা অত্যন্ত মূল্যবান আর দুর্লভ মনে হলো। আর যেমন স্বভাব তার। দু’দিনেই পাকা বন্দোবস্ত করে বউ তুলে নিয়ে এলেন ঘরে। মধুচন্দ্রিমা মাথায় উঠল। সপ্তাহখানেকের মাথায় তিনি উড়ে গেলেন স্পেনে।
স্ত্রীর কলেজের চাকরি আর তার বিদেশের পড়াশোনা দুটো কখনোই এগোয়নি সমান্তরালভাবে। দুটো ছিঁড়ে ছিঁড়ে জোড় খেয়েছে, আবার ছিঁড়েছে। এক সময় নিরুপায় হয়ে বিদেশেই থিতু হয়েছিলেন দীর্ঘদিন। আবার যখন ফিরে এলেন পুরনো সুতোর টানে তত দিনে ছেলেমেয়ে দু’টি বড় হয়ে গেছে। তারা দু’জন ছিটকে আছে দুই মহাদেশে। ছেলেটি নাইরোবিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। বউবাচ্চা নিয়ে ওখানেই থাকছে। মেয়েটি অক্সফোর্ডে। তুখোড় ছাত্রী। একটি মেক্সিকান ছেলের সাথে লিভ-টুগেদার করছে। পিএইচডি হয়ে গেলেই তারা উপশালায় চলে যাবে।
এখন বলতে গেলে তার অখণ্ড অবসর। আগে বিদেশ থেকে নানা উপলক্ষে ডাক আসত। যতটা পেরেছেন সাড়াও দিয়েছেন। কিন্তু এখন মন চাইলেও শরীর সায় দেয় না। স্ট্রোকের ধকলটা মুড়ে ফেলেছেন বিশ্রামের চাদরে। তবে ডান পা-টা দুর্বল হয়েই থাকল। এই সুযোগে জমে ওঠা বইগুলোর সদ্ব্যবহার হচ্ছে। লেখালেখির জন্য সময় দিতে পারছেন টেবিলে। রুটিন করে হাঁটাহাঁটি, বাগান তদারকি, স্নান, খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রাম, গল্প, লেখাপড়া, ঘুম সব কিছুতেই ঘড়ির কাঁটার শাসন। এ দিক থেকে মহুয়ার মাস্টারি-জীবনটা ঘরে-বাইরে পুরোপুরি সফল হয়েছে বলা যেতে পারে।
মাঝে মধ্যে তারা লং ড্রাইভে চলে যান গাজীপুরে। এখানে তাদের একটি বাগানবাড়ি আছে। বিঘাপাঁচেক জমিতে কাঁঠাল, মেহগনি, জারুল, পেয়ারা, লেবু ইত্যাদি মিলিয়ে এক বারোভাজা বাগান। পুকুরটি বেশ বড়সড়। কোণের দিকে একটি মাটির ঘর। সেখানে মতি নামে একটা উটকো লোক থাকে। পাগলাটে স্বভাব। হয়তো মাটি-কামড়ে বসে থাকল মাসের পর মাস। আবার উধাও হলে তার দেখা মেলে না সহজে। যে কারণে এ বাগানের ফলফলারি কখনোই পোক্ত হওয়ার সুযোগ পায় না। মাছশূন্য পুকুরটা নিষফলা মাঠের মতো ফকফকা। জঙ্গল আর লতাগুল্ম সেখানে এমনই বাড়ন্ত যে কালনাগিনী প্রকাশ্যে বসে থাকে ফণা দুলিয়ে। হালে আশপাশের চেহারা বদলে যাওয়ায় লোকজন উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করেছে জায়গাটার দিকে। মোটা টাকার অফার আসছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু সেটা কানে তোলেননি এখনো। বরং নতুন একটা চিন্তা ভর করেছে কিছু দিন থেকে। ভিনদেশী দম্পতি বনি ও ফ্রেড কাপুচিনি চট্টগ্রামের হালিশহরে অনাথ শিশুদের জন্য যে স্বপ্নের শিশুস্বর্গ গড়ে তুলেছেন, সেটা কেবলই উঁকি দিচ্ছে মাথায়। এ রকম একটা কিছু এখানেও করা যেতে পারে। কোয়ান্টামের শিশুকাননও ঘুরে দেখতে এসেছেন একই উদ্দেশ্যে। মোটামুটি একটা ধারণা তিনি পেয়ে গেছেন। এখন নেমে পড়লেই হলো।
তবে এটি সত্য, তড়িঘড়ি করে মহৎ কোনো কাজে হাত দেয়া ঠিক নয়। দেরি একটু হয়ে গেছে, হোক না। তিনি একটু ভেবেচিন্তে মাঠে নামতে চান। এখানের লেখাপড়ার সিস্টেমটা আগাগোড়া তাকে পোড়াচ্ছে। স্কুলগুলো মনে হয় তোতাপাখি তৈরির কারখানা। গাদা গাদা সিলেবাসের যে হজমিবটিকা তাদের প্রতিদিন গেলানো হয়, তাতে উপশমের বদলে বদহজমের সম্ভাবনাই বেশি। আর শিক্ষকরা এই সুযোগে নিরাময়ের ফাঁদ পেতে রোগীকে নিয়ে তোলেন কোচিং হাসপাতালে। এতে রোগী কতটা সুস্থ হলো, সেটা বড় কথা নয়, বাণিজ্য বসতে লক্ষ্মী কতটা সদয় হলো শিক্ষকের অদৃষ্টে সেটাই মুখ্য বিষয়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো বেশির ভাগই অপ্রয়োজনীয় খোঁয়াড়। এই শিক্ষা বাস্তবে ছাত্রদের খুব বেশি কাজে আসে না। শুধুই টাকার শ্রাদ্ধ!
এই জায়গাটায় তিনি একটু হাত দিতে চান। এ দেশের বাস্তবতায় যে শিক্ষা যথার্থই ছাত্রছাত্রীদের কাজে আসবে সে প্রস্তুতিটা শুরু থেকেই নেয়া দরকার। এর পাশাপাশি নৈতিক ও মানসিক উৎকর্ষের চর্চাও জোরদার করতে হবে। শুধু চারা লাগালেই হবে না, তার উপযুক্ত পরিচর্যাও জরুরি। এই বিশ্বাসটুকু সম্বল করে তিনি এগিয়ে যেতে চান। কতদূর পারবেন সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু কাউকে না কাউকে তো সেই কর্মস্বপ্নের বীজটা পুঁততে হবে। না হলে অঙ্কুরোদগম হবে কী করে?
এ ব্যাপারে মহুয়ারও কিছু চিন্তাভাবনা আছে। ওর মতে, এখানের পুরো আয়োজনটাই হবে প্রকৃতির সাথে সঙ্গতি রেখে। বাগানের কোনো গাছপালাই নষ্ট করা যাবে না। জায়জঙ্গলের চেহারাটাও অক্ষুন্ন থাকবে। এখানের পুরো কাঠামো হবে মাটির। ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘরগুলো তৈরি হবে। সম্ভব হলে প্রতিটি ক্লাসের জন্য আলাদা ঘর। সামনে থাকবে সবজি ও ফলফলারির বাগান। ডেয়ারি, পোলট্রি, ফিশিংÑ সব ব্যবস্থাই গড়ে তোলা হবে। এর পরিচর্যা আর রক্ষণাবেক্ষণ ছাত্রছাত্রীরাই করবে শিক্ষকদের সাথে হাত মিলিয়ে। এর সুফলও ভোগ করবে তারা। হাতেনাতে শিক্ষা ও সুস্বাস্থ্য দু’টিই জীবনের জন্য জরুরি।
প্রফেসর দ্বিধার চোখে তাকান স্ত্রীর দিকে, ‘ওদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা কী হবে! সেটাও কি মাটির ঘরে করতে চাও নাকি?’
‘অবশ্যই। ছাত্র আর শিক্ষকদের জন্য আমরা অনেকগুলো থাকার ঘর করে দেবো। এগুলোর কাঠামো মাটির হলেও এখানের সব ব্যবস্থাই হবে যুগোপযোগী। রাস্তাঘাট, পয়ঃপ্রণালী, বিশুদ্ধ পানি, বিদ্যুৎ এসব ক্ষেত্রে কোনো আপস করা হবে না। আমরা এ ব্যাপারে কোয়ান্টাম রিসর্টের ফর্মুলা নিতে পারি।’
‘সেটা ঠিক আছে, তবে কোয়ান্টাম শিশুকাননের সাথে আমাদের কিছু পার্থক্য থাকবে। ওদের স্টুডেন্টদের বেশির ভাগই ট্রাইবল। এ ক্ষেত্রে আমরা কী করব? এ ব্যাপারে আমার একটা চিন্তা আছে, জানি না তুমি একমত হবে কি না। কাপুচিনি দম্পতি তো কেবল অনাথ শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। আমিও সেটা চাই। তবে অনাথ শিশুদের পাশাপাশি গরিব শিশুরাও আমাদের হোমে ঠাঁই পাবে। এ জন্য তাদের কোনো খরচ দিতে হবে না। তাদের ভরণপোষণ-শিক্ষা-স্বাস্থ্য সব দায়িত্বই হোম নেবে। এ জন্য কারো কাছে হাত পাতব না আমরা। শিক্ষার পাশাপাশি উৎপাদনমুখী পরিবেশ থাকবে আমাদের। প্রতিটি শিশু হবে আত্মনির্ভর। ওরাই বড় হয়ে হবে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের বড় কারিগর...।’ অবিশ্বাস্য প্রত্যয়ে প্রফেসরের চোখ চকচক করে ওঠে।
মহুয়া সপ্রশংস চোখে তাকান তেজি মানুষটির দিকে। বয়স তাকে কিছুটা গ্রাস করেছে সত্য, কিন্তু মনের শক্তিতে এখনো যথেষ্ট বলীয়ান। পরিবারের প্রতি একটু নির্মোহ আর উদাসীন হলেও আপন কর্মে ১০০ ভাগ নিষ্ঠাবান। সপ্তাহের একটি দিন লাইব্রেরিতে গিয়ে নিয়ে আসেন গুচ্ছের বই। বইয়ের দোকানগুলো থেকেও নিয়মিত খোঁজখবর আসে। বিদেশী পাবলিশার আর নানারকম সংস্থা ক্লান্তিহীনভাবে পাঠাচ্ছেন এন্তার কাগজপত্র। ছেলেমেয়েরাও পছন্দের কোনো বই পেলে দ্রুত পৌঁছে দেন বাবাকে। পড়া, লেখালেখির বাইরে ইন্টারনেটেও বসছেন পালা করে। দৈনন্দিন রুটিন কাজগুলো তো আছেই। মহুয়া অতশত পারেন না। একটুকুতেই হাঁফ ধরে যায়। অথচ গাজীপুরে শিশুদের হোম নিয়ে যেভাবে মেতে উঠেছেন মানুষটা শরীরটরির আবার বিগড়ে না যায় শেষ পর্যন্ত।
এই দুশ্চিন্তার ভাবনাটা মহুয়া চাইলেই লুকোতে পারেন না, ‘হোম করবে ভালো কথা। কিন্তু মাথায় অত চাপ নিলে নতুন কোনো সমস্যা না হয় আবার।’
প্রফেসরের গোঁফের ফাঁকে হাসি ছড়িয়ে পড়ে, ‘তাই মনে হয় নাকি তোমার! এই পুরনো মেশিন দিয়ে আর কত দিন চলবে বলো! এক সময় তো বিগড়ে যাবেই। আর একান্ত যদি অচল হয়েই পড়ে, তুমি তো আছ। তুমিই দেখবে সব। আমার ভাবনা কী।’
‘বেশ, তাই যদি মনে করো, তাহলে আমার ওপর তোমার অই হোম ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।’
প্রফেসর খুশি মনে ভ্র ভঙ্গি করে তাকালেন স্ত্রীর দিকে, ‘নিশ্চিন্ত হলাম। তুমি যে পারবে সে বিশ্বাস আমার আছে। আসলে পারার ইচ্ছাটাই বড় কথা। বয়স কোনো ব্যাপার নয়...।’
রাত কত হলো কে জানে।
চাঁদটা হেঁটে হেঁটে উঠে এসেছে মাথার ওপর। এখন দিনের মতো স্পষ্ট চার দিক। দিনের বেলা পাহাড়টাকে যত দূর অতিক্রম্য মনে হয়েছিল, এখন আর তা হচ্ছে না। মহুয়া খুব হিসাব করে করে পা ফেলছিলেন। একটু অসতর্ক হলেই পা ফস্কে গড়িয়ে পড়বেন নিচে।
প্রফেসর যেন তরুণের মতো চঞ্চল। প্রশস্ত থাবা বাগিয়ে তিনি ধরে আছেন স্ত্রীর হাত ‘আরে, ভয়ের কী আছে, এই তো বেশ হচ্ছে, ধীরে ধীরে উঠে এসো...।’
মহুয়া ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘আর তো পারছি না। পা টনটন করছে। চূড়াটা কত দূর...।’
প্রফেসর ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন, ‘আর একটু সামনে হবে হয়তো। এটা কী একটা পাহাড় হলো! এ তো উইয়ের ডিবি।’ মহুয়া চমকে তাকালেন স্বামীর দিকে। দুর্বল বাঁকা পা নিয়ে দাঁতে দাঁত কামড়ে ধরে আছেন তার হাতখানা।
মহুয়া ভীত গলায় আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘অনেক হয়েছে, আর থাক। তুমি কী চাও এখান থেকে গড়িয়ে পড়ে আমি হাত-পা ভেঙে মরি...।’
এ কথায় হো হো করে হেসে উঠলেন মানুষটি। তারপর সেই ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে প্রবল আকর্ষণে স্ত্রীকে কাছে টেনে বললেন, ‘মহুয়া, অই তো চূড়াটা দেখা যাচ্ছে। ওখানে জাফরং ফুলে ফুলে লাল হয়ে আছে গাছগুলো। আমরা একবার সেখানে গিয়ে দাঁড়াবই দাঁড়াব। ওরা যদি পারে, আমরা কেন পারব না?’
মহুয়া গভীর আছন্নের মতো তাকিয়ে আছেন সেই কল্পিত লাল চূড়াটার দিকে।
0 comments:
Post a Comment