গোলাপ মুনীর
পণ্ডিতবর্গের মধ্যে এক ধরনের মতৈক্য আছে ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্টে জাপানের দখল করা ফরমুজায় (আজকের তাইওয়ানে) এক জাপানি বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষ বসু মারা যান। তা সত্ত্বেও তার অনেক সমর্থক, বিশেষ করে বাংলায় তার সমর্থকদের অনেকেই তখন তা স্বীকার করেননি। কখনো বলা হয়েছে, তিনি মারা যাননি বেঁচে আছে
ন। আবার কখনো বলা হয়েছে, তিনি মারা গেলেও বিমান দুর্ঘটনায় তিনি মারা যাননি। মারা গেছেন অন্যভাবে। ফলে তার মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার মৃত্যু নিয়ে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দানা বাঁধতে শুরু করে। তার মৃত্যুকে ঘিরে জন্ম নেয় নানা সামরিক অতিকথন তথা মিথ।
আইএনএ’র (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির) পুরুষ সদস্য, আইএনএ’র জাঁসির রানী রেজিমেন্টের এক শ’ মহিলা সদস্য সড়ক পথে দক্ষিণ বার্মার মৌলমিন শহরে যাওয়ার জন্য রেঙ্গুন ছেড়ে যায়। তার সাথে ছিলেন জাপানি-আইএনএ লিয়াজোঁ অর্গানাইজেশন প্রধান লে. জেনারেল সাবুরো ইসোদা। ধীরগতিতে হলেও তাদের জাপানি সামরিক বহর সিতাং নদীর ডান তীরে পৌঁছতে সক্ষম হয়। কিন্তু আমেরিকান বোমা ও কামান হামলার মুখে পড়ে খুব কম যানবাহনই নদী পার হতে পেরেছিল। সুভাষ বসু ও তার দল বাকি ৮০ মাইল হেঁটে এর এক সপ্তাহ পর মৌলমিনে গিয়ে পৌঁছেন। মৌলমিন ছিল এর আগে ব্রিটিশ, অস্ট্রেলীয় ও ওলন্দাজ যুদ্ধবন্দীদের দিয়ে নির্মিত ডেথ রেলওয়ের টার্মিনাস বা শেষ প্রান্ত। এই রেলপথ সংযোগ গড়ে তোলে বার্মা ও সিয়ামের (বর্তমান থাইল্যান্ড) মধ্যে।
মৌলমিনে সুভাষ বসুর গ্রুপে যোগ দেয় আইএনএর প্রথম গ্যারিলা রেজিমেন্ট ‘এক্স-রেজিমেন্ট’-এর ৫০০ সদস্য। এরা সেখানে আসে লয়ার বার্মার অন্য এলাকা থেকে। এর দেড় বছর আগে আইএনএ’র ১৬০০ পুরুষ সদস্য ও ১০০ মহিলা সদস্য মালয়া থেকে বার্মায় প্রবেশ করে। এর ১০ শতাংশ মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বার্মা ছেড়ে থাইল্যান্ডে গিয়ে পৌঁছে। বাকি ৯০ শতাংশ ইমপাল ও কোহিমার যুদ্ধক্ষেত্রে ব্রিটিশদের হাতে বন্দী অবস্থায় আহত হয়ে পুষ্টিহীনতা ও নানা দুর্ভোগের শিকার হয়ে মারা যায়। সোজা কথায়, এরা অস্তিত্ব হারায়। সুভাষ বসু আরো এক মাস বার্মায় থাকেন। বার্মায় পৌঁছেই তিনি খবর পেয়েছিলেন, ৮ মে জার্মান আত্মসমর্পণ করেছে। এর পরের দুই মাস ১৯৪৫ সালের জুন ও জুলাই সুভাষ বসু ছিলেন সিঙ্গাপুরে। এই উভয় স্থানেই সুভাষ বসু চেষ্টা করেছেন তহবিল সংগ্রহের, যাতে তার সৈন্যদের থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া যায় কিংবা যারা বেসামরিক জীবনে ফিরে যেতে চায় তাদের পুনর্বাসন করা যায়। বেশির ভাগ নারী সৈনিক ফিরে গিয়েছিল বেসামরিক জীবনে। সুভাষ বসু তার রাতের রেডিও সম্প্রচারে ক্রমবর্ধমান হারে প্রবল সমালোচনা করতেন গান্ধীর। ১৯৪৪ সালে কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন ব্রিটিশ প্রশাসন ও দূত এবং মুসলিম লীগ নেতাদের সাথে ্আলোচনায়্। কিছু ঊর্ধ্বতন আইএনএ কর্মকর্তা তখন হতাশা বোধ করতে শুরু করেন। নয়তো সুভাষ বসু সম্পর্কে তাদের মোহমুক্তি ঘটতে শুরু হয়। এরা তৈরি হচ্ছিলেন ব্রিটিশদের আগমন ও এর পরিণতি সম্পর্কে।
১৯৪৫ সালের আগস্টের প্রথম দুই সপ্তাহে ঘটনা ঘটতে লাগল দ্রুত। ব্রিটিশরা যখন এগিয়ে আসছিল মালয়া উপদ্বীপ দিয়ে এবং প্রতিদিনই চলছিল আমেরিকার অ্যারিয়াল বম্বিং, তখন মালয়া ও সিঙ্গাপুরে সুভাষ বসুর অবস্থান ক্রমেই বেশি থেকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছিল। তখন তার চিফ অব স্টাফ জে আর ভনস্লে তাকে পরামর্শ দেন তিনি যেন সিঙ্গাপুর ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। ১৯৪৫ সালের ৩ আগস্ট সুভাষ বসু জেনারেল ইসোদার কাছ থেকে একটি তারবার্তা পান। এ তারবার্তায় তাকে পরামর্শ দেয়া হয় আজকের ভিয়েতনাম অর্থাৎ তৎকালীন ফরাসি ইন্দোচীনের সায়গন তথা আজকের হো চি মিন শহরে চলে যাওয়ার জন্য। সেটি তখনো ছিল জাপানি প্রশাসনের অধীনে। ৯ আগস্টে মাঞ্চুরিয়ায় সোভিয়েত আগ্রাসনের শুরু হয়। আর জাপানের কুয়ানতুং আর্মি দ্রুত আক্রমণ করে দক্ষিণ দিকের পুতুল রাষ্ট্র মাঞ্চুকুও। এ সম্পর্কে সুভাষ বসুকে জানানো হয়েছিল ১০ আগস্ট। এর সামান্য আগে তিনি শুনতে পান হিরোশিমা ও নাগাসাকিেেত পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের কথা। শেষ পর্যন্ত ১৬ আগস্ট তাকে জানানো হয় মিত্রবাহিনীর কাছে জাপানি বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের কথা। এর পর বসু তার কয়েকজন সহযোগী নিয়ে সায়গন ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
শেষ দিন
সুভাষ বসুর জীবনের শেষ দিন সম্পর্কে ইতিহাসে নানা বিবরণ পাওয়া যায়। আর এসব বর্ণনায় এই শেষ দিনের মধ্যে পার্থক্য খুবই সামান্য ১৬ আগস্ট ও ১৭ আগস্টের দুপুরের মধ্যবর্তী সময়টা। ১৬ আগস্ট সুভাষ বসু জাপানের আত্মসমর্পণের খবর পান। আর ১৭ আগস্টের দুপুরের পর বসু ও তার দল সায়গন সিটি থেকে সায়গন বিমানবন্দরে পৌঁছেন বিমানে ওঠার জন্য।
একটি বর্ণনা মতে, সুভাষ বসু বিমানে করে ১৬ আগস্টে সিঙ্গাপুর থেকে সায়গন যান, মাঝে স্বল্প সময়ের জন্য থামেন ব্যাংককে। সায়গনে পৌঁছার পরপরই জাপানের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের জাপানি বাহিনীর প্রধান ফিল্ড মার্শাল হিসাইচি তেরাউচির সাথে দেখা করেন। এ সময় তিনি তার কাছে অনুরোধ জানান রাশিয়া যাওয়ার জন্য একটি ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে দিতে। যদিও এই দিনটির আগ পর্যন্ত রাশিয়াকে জাপানের সাথে যুদ্ধমান একটি জাতি হিসেবে দেখা গেছে, একই সাথে অন্তত সুভাষ বসু রাশিয়াকে ক্রমবর্ধমান হারে দেখেছেন ব্রিটিশবিরোধী দেশ হিসেবে। তাই সুভাষ বসু ধরে নেন ভবিষ্যতে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে অপারেশন চালানোয় তার সম্ভাব্য ঘাঁটি হতে পারে রাশিয়া। যা-ই হোক সুভাষ বসুর কাছ থেকে এই অনুরোধ পাওয়ার পর ফিল্ড মার্শাল তেরাউচি অনুমোদন নেয়ার জন্য টোকিওস্থ জাপানের ইম্পেরিয়াল জেনারেলের সদর দফতরে (আইজিএইচকিউ) তারবার্তা পাঠান। দ্রুতই তা প্রত্যাখ্যাত হয়। ইতিহাসবিদ জয়েস চেপম্যান লেব্রার ভাষায়, আইজিএইচকিউ ভেবেছিল ‘জাপানকে বাদ দিয়ে রাশিয়ায় চলে যাওয়া সুভাষ বসুর জন্য যৌক্তিক হবে না, যেখানে জাপান থেকে তাকে প্রচুর সহায়তা দেয়া হয়েছে। ’ তা সত্ত্বেও তেরাউচি ব্যক্তিগতভবে সুভাষ বসুর প্রতি সহমর্মী ছিলেন। এমনটি লক্ষ করা গেছে তাদের মধ্যকার দু-বছর পরস্পরে কাছাকাছি থাকার সময়ে। তেরাউচি সুভাষ বসুকে বললেন, জাপানিরা যেখানে চায় না তিনি রাশিয়া যান, অতএব তার রাশিয়া যাওয়াটা যৌক্তিক হবে না। যা-ই হোক তিনি কোনোমতে ১৯৪৫ সালের ১৭ আগস্টে সায়গন থেকে টোকিওগামী একটি বিমানে করে সুভাষ বসুকে টোকিও যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এই বিমানের যাত্রাবিরতি ছিল তখন পর্যন্ত জাপানের নিয়ন্ত্রণাধীন মাঞ্চুরিয়ার ডাইরেনে। কিন্তু রুশবাহিনী এই ডাইরেনের দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল। সেখানে সুভাষ বসুকে বিমান থেকে নামতে হয়েছিল এবং রুশদের হাতে তার নিয়তির জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
অন্য এক বর্ণনায় উল্লেখ করা হয় সুভাষ বসু তার পার্টি নিয়ে ১৬ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুর ছাড়েন। পথে তাকে ব্যাংককে থামতে হয়। এতে সেখানকার আইএনএ কর্মকর্তা জে আর ভনস্লে বিস্মিত হন। তিনি সেখানে সুভাষ বসুর রাত কাটানোর ব্যবস্থা করেন। সুভাষ বসুর সেখানে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর দ্রুত ইন্ডিয়ার ইন্ডিপেনডেন্স লীগ (আইআইএল), আইএনএর স্থানীয় সদস্যরা ও থাই-ইন্ডিয়ান বিজনেস কমিউনিটির লোকেরা হোটেলে গিয়ে ভিড় জমান। ইতিহাসবিদ পিটার ওয়ার্ড ফ্যার মতে, সুভাষ বসু কোট গায়ে রেখেই সেখানে আঁধারে চলে যান সায়গন। এ সময় তার সাথে জেনারেল ইসোদা ছিলেন। সকালের শেষ দিকটায় সায়গনে পৌঁছে তার হাতে কম সময় ছিল ফিল্ড মার্শাল তেরাউচির সাথে দেখা করার। তেরাউচি তখন ছিলেন ফরাসি ইসেদাচীনের মধ্য উঁচুভূমি ডালাতে। সায়গন থেকে সেখানে যেতে বিমানের এক ঘণ্টার পথ। এর ফলে ইসোদা নিজে ঊর্ধ্বতন কারো সাথে পরামর্শ না করেই দুপুরের দিকে সুভাষ বসুর বিমানে করে সায়গন ছেড়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
তৃতীয় আরেক বর্ণনা মতে, সুভাষ বসু সিঙ্গাপুর ছাড়েন ১৭ আগস্ট। ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার ব্যায়েলি এবং টিম হার্পারের বর্ণনা হচ্ছে ১৭ আগস্ট তিনি আইএনএর বিলুপ্তি ঘোষণা করে ‘ফাইনাল অর্ডার অব দ্য ডে’ জারি করেন। এরপর তিনি ফরাসি ইন্দোচীন হয়ে বিমানে করে চলে যান চীন। যদি সবকিছু ব্যর্থ হয়, তবে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের একজন বন্দী হতে চেয়েছিলেন ।
১৭ আগস্টের দুপুরের দিকে সায়গন বিমানবন্দরে একটি মিতসুবিশি কেআই-২ ভারী বোমারু বিমান (এগুলো মিত্রদের কাছে ঝধষষু কোড নামে অভিহিত হতো) সুভাষ বসু ও তার দলের জন্য অপেক্ষা করছিল। সুভাষ বসু ছাড়াও আইএনএ গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন তার সেক্রেটারি কর্নেল হাবিবুর রহমান, তার ক্যাবিনেটের মেন্বার এস এ আয়ার, মেজর আবিদ হাসান ও অন্য আরো তিনজন। মেজর আবিদ হাসান ছিলেন সুভাষ বসুর পুরনো সহযোগী, যিনি ১৯৪৩ সালে জার্মানি থেকে সুমাত্রা পর্যন্ত ভয়ঙ্কর সাবমেরিন জার্নি সম্পন্ন করেছিলেন। এরা হতাশায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, যখন বিমানবন্দরে পৌঁছে এরা জানতে পারেন বিমানে আইএনএ প্যাসেঞ্জারের জন্য একটিমাত্র আসন রাখা হয়েছে। সুভাষ বসু অভিযোগের প্রেক্ষাপটে অবরুদ্ধ জেনালের ইসোদা বিষয়টি হস্তক্ষেপ করে দ্বিতীয় আরেকটি আসনের ব্যবস্থা করেন। সুভাষ বসু তার সাথে যাওয়ার জন্য হাবিবুর রহমানকে বেছে নিলেন। তখন ধরে নেয়া হয় আইএনএ পার্টির বাকিরা পরবর্তী ফ্লাইটে যাবেন। সায়গন বিমানবন্দরে আরো বিলম্ব ঘটে। ইতিহাসবিদ জয়েস চেপম্যান লেব্রার ভাষ্যমতে, সুভাষ বসু যখন বিমানে উঠতে যাচ্ছিলেন তখন ইন্ডিয়ানেরা তাকে ‘গিফট অব ট্রেজার’ উপহার দেন। দু’টি ভারী শক্ত বাক্স ফুল লোডেড বিমানটির জন্য অতিরিক্ত বোঝা হয়ে উঠেছিল। দুপুর ১২টা থেকে ২টার মাঝের কোনো এক সময়ে দুই ইঞ্জিনের এই বিমানটি আকাশে ওড়ে। এতে যাত্রী ছিল ১২-১৩ জন। বিমানের ক্রুর সংখ্যা তিন থেকে চারজন, একজন কুয়ানতুং আর্মি এবং সুভাষ বসু ও হাবিবুর রহমান। সুভাষ বসু বসেছিলেন পোর্টসাইড উইং থেকে একটু দূরে। স্বাভাবিক অবস্থায় এ ধরনের বোমারু বিমানে পাঁচজন ক্রু বহন করে।
জাপানিদের আত্মসমর্পণের কিছুদিন পরও এসব ফ্লাইট চলা সম্ভব ছিল। কারণ তখনো কী ঘটেছে এবং কী ঘটে চলেছে সে ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা কারো জানা ছিল না। জাপান সম্রাট বেতারে আত্মসমর্পণের ঘোষণা দিলেও তিনি বুদ্ধিমত্তার সাথে এ ঘোষণায় জাপানি ভাষায় ‘সারেন্ডার’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। এর ফলে অনেক লোক, বিশেষ করে অধিকৃত জাপানি টেরিটরিতে থাকা উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটার ব্যাপারে নিশ্চিত করে জানত না। এর ফলে জাপানের সারেন্ডারের কয়েক দিন পরও জাপানি বিমানবাহিনীর ফ্লাইটগুলো চালু থাকে। সুভাষ বসু ও জাপানিরা এই বোমারু বিমানের গন্তব্য সম্পর্কে কিছু বলতে না চাইলেও সায়গন বিমানবন্দরের টারমাকে রয়ে যাওয়া সুভাষ বসুর স্টাফেরা জোরালোভাবে ধরেই নিয়েছিলেন বিমানটির গন্তব্য মাঞ্চুরীয় উপদ্বীপের ডেইরেন শহর। আগেই বলা হয়েছে, এটি তখনো জাপানের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সুভাষ বসু এক বছর ধরেই বলে আসছিলেন রুশ ও চীনা কমিউনিস্টদের সাথে যোগযোগের গুরুত্বের কথা। ১৯৪৪ সালে তার মন্ত্রিসভার সদস্য আনন্দ মোহন সাহেকে বলেছিলেন এ উদ্দেশ্যে টোকিও সফর করতে এবং সেখানে নিয়োজিত সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত জ্যাকব মালিকের সাথে সাক্ষাৎ করতে। তা সত্ত্বেও জাপানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেমোরো সিগেমেটসুর সাথে পরামর্শের পর আনন্দ মোহন সাহে এর বিপরীত সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪৫ সালের মে মাসে সাহে আবার সিগেমেটসুর কাছে চিঠি দেন সুভাষ বসুর পক্ষে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগের অনুরোধ জানিয়ে। এবারো এর নেতিবাচক জবাবই আসে। সুভাষ বসু এক বছর ধরে অব্যাহতভাবে জেনারেল ইসোদার কাছে জানতে চাচ্ছিলেন মাঞ্চুরিয়ায় জাপানি সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি সম্পর্কে। যুদ্ধের পর ব্রিটিশ তদন্তকারী ও পরবর্তী সময়ের ভারতীয় তদন্ত কমিশনকে জাপানিরা নিশ্চিত করেছে বিমানটির গন্তব্য অবশ্যই ছিল ডেইরেন। আর সহযোগী যাত্রী কুয়ানতাং আর্মির জেনারেল শিদিয়াকে সুভাষ বসুর সাথে ডেইরেনে নামতে হয়েছিল। তাকে কাজ করতে হয়েছে সুভাষ বসুকে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত মাঞ্চুরিয়ার কাছে হস্তান্তর করার ক্ষেত্রে মূল লিয়াজোঁ ও নিগোশিয়েটর হিসেবে।
বিমানটি চলে যায় উত্তর দিকে। এটি যখন উত্তর ইন্দোচীনে উপকূল বরাবর উড়ছিল, তখন অন্ধকার নেমে আসতে শুরু করে। পাইলট সিদ্ধান্ত নেন অনির্ধারিতভাবে টউরেনে (ভিয়েতনামের বর্তমান ডা নাং) যাত্রাবিরতির। যাত্রীরা রাত কাটান একটি হেটেলে। ক্রুরা উদ্বিগ্ন ছিলেন এই ভেবে যে, বিমানটি অতিরিক্ত মাত্রায় বোঝাই। নামিয়ে দেয়া হলো ৫০০ পাউন্ড সাজসরঞ্জাম ও লাগেজ। বিমানে আবার জ্বালানি নেয়া হলো। পরদিন ভোর হওয়ার আগেই এই গ্রুপ আবারো আকাশে উড়ে। এবার গেল পুব দিকের ফরমুজার তাইহোকুর (বর্তমান তাইওয়ানের তাইপের) দিকে। সেখানে বিমানটির নির্ধারিত বিরতি ছিল। তাইহোকুতে বিমানটি পৌঁছে ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্টের দুপুরে। সেখানে ২ ঘণ্টার যাত্রাবিরতির সময় আবার বিমানে জ্বালানি নেয়া হয়। যাত্রীরা তখন দুপুরের খাবার সেরে নেয়। প্রধান পাইলট ও গ্রাউন্ড ইঞ্জনিয়ার এবং মেজর কনোকে মনে হয়েছিল পোর্টসাইড ইঞ্জিন নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতে। সব যাত্রী বিমানে ওঠার পর আরেকবার ইঞ্জিন পরীক্ষা করে নেয়া হলো ইঞ্জিনের ধোঁয়া নির্গমন বার বার কমিয়ে-বাড়িয়ে। গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারের উদ্বেগের অবসান ঘটিয়ে বেলা ২টা থেকে আড়াইটার দিকে বিমানটি আবার আকাশে উড়ল।
বিমান দুঘর্টনা ও মৃত্যু
বিমানটি টেকঅফের সময় ঠিক যে সময়টায় বিমানের ভেতরের যাত্রীরা একটি বড় শব্দ শুনতে পান। শব্দটা যেন ছিল ইঞ্জিনের ব্যাকফায়ারিংয়ের শব্দ। টারমাকে থাকা মেকানিকেরা বিমানের বাইরে একটা কিছু ছিটকে পড়তে দেখলেন। এটি ছিল পোর্টসাইড ইঞ্জিন, অথবা এর অংশবিশেষ। অন্যটি ছিল একটি প্রপেলার। বিমানটি ডান দিকে ব্যাপক দুলতে দুলতে মাটিতে পড়ে যায়। বিমানটি ভেঙে দু-টুকরা হয়ে জ্বলতে লাগল। ভেতরে প্রধান পাইলট, সহপাইলট ও জেনারেল শিদিয়া তাৎক্ষণিক নিহত হন। হাবিবুর রহমান বেরিয়ে এসে অবাক হয়ে যান। সুভাষ বসু যদিও মারাত্মক আহত হননি এবং জ্ঞানও হারাননি, তবু গ্যাসোলিনে ভিজে যান। সুভাষ বসু পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু দেখলেন এটি লাগেজ দিয়ে ব্লকড হয়ে আছে। তারা তখন সিদ্ধান্ত নেন আগুনের ভেতর দিয়ে দৌড়ে গিয়ে সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসবেন। গ্রাউন্ড স্টাফরা তখন বিমানটির দিকে এগিয়ে যান। তারা দেখলেন দু’জন লোক টলতে টলতে তাদের দিকে আসছেন। তাদের একজন যেন হয়ে উঠেছেন মানব মশাল তথা হিউম্যান টর্চ। এই হিউম্যান টর্চই হচ্ছেন সুভাষ বসু, যার গ্যাসোলিনে ভেজা পোশাক তাৎক্ষণিকভাবে পুড়ে শেষ। হাবিবুর রহমান ও আর কয়েকজন কিছুটা আগুন নেভাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তারা লক্ষ করেন সুভাষ বসুর মুখ ও মাথা ব্যাপকভাবে পুড়ে গেছে। জয়েস চেপম্যান লেব্রার মতে, অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে ব্যবহৃত একটি ট্রাক সুভাষ বসু ও অন্য যাত্রীদের নিয়ে যায় তাইহোকুর দক্ষিণের নানমন সামরিক হাতপাতালে।
বিমানবন্দরের লোকেরা বেলা ৩টার দিকে ডেকে আনে এই হাসপাতালের সার্জন-ইনচার্জ ড. তানেউশি যুশিমিকে। হাসপাতালে পৌঁছার সময় সুভাষ বসুর জ্ঞান ছিল। আচরণ ছিল বেশ সঙ্গতিপূর্ণ। এরপরও বেশ কিছু সময় তার অবস্থা এমনই ছিল। তিনি ছিলেন উলঙ্গ। একটা কম্বল দিয়ে তার শরীর ঢেকে রাখা হয়েছিল। ড. যুশিমি দেখলেন তার দেহের অনেক অংশেই থার্র্ড ডিগ্রির বার্ন রয়েছে। তিনি ধরে নিলেন, তাকে বাঁচানো সম্ভব নয়। তিনি দ্রুত সুভাষ বসুর চিকিৎসা শুরু করেন। তাকে সহায়তা করেন ড. সুরুতা। ইতিহাসবিদ লিওনার্দ এ গর্ডন পরবর্তী সময়ে হাসপাতালেল সব লোকের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। তাদের কাছ থেকে কিছু তথ্য জানা যায়।
জানা যায়, সুভাষ বসুর শরীরের বেশির ভাগ অংশের ওপর একটি ডিজইনফেকটেড রিমুভাল ব্যবহার করা হয়। এরপর তার দেহে প্রয়োগ করা হয় একটি সাদা মলম। এরপর শরীরজুড়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়া হয়। ড. যুশিমি সুভাষ বসুকে চারটি ভাইটা ক্যামফর ও দু’টি ডিজিটামাইন ইনজেকশন দেন তার হার্ট দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে। এই ইনজেকশনগুলো দেয়া হয় প্রতি ৩০ মিনিট পরপর। যেহেতু পুড়ে গিয়ে তার শরীর পানিশূন্য হয়ে পড়ে, তাই তার শিরার মধ্যে ঢোকানো হয় রিঙ্গার সলিউশন। ইশি নামের তৃতীয় আরেক ডাক্তার তাকে একটি ব্লাড ট্রান্সফিউশন দেন। কাজুও মিটশুই নামের একজন আর্মি প্রাইভেট আর্দালি এই চিকিৎসাকক্ষে ছিলেন। বেশ কয়েকজন নার্সও সেখানে তার সহায়তায় নিয়োজিত ছিলেন। সুভাষ বসুর মাথা তখনো বেশ কাজ করছিল। বিষযটি ড. যুশিমিকে অবাক করে। কারণ এ ধরনের আগুনে পুড়ে যাওয়া আঘাত নিয়ে এমন হওয়াটা খুবই ব্যতিক্রমী। চিকিৎসা পুরোদমে চলা সত্ত্বেও শিগগিরই তিনি কোমায় চলে যান। এর কয়েক ঘণ্টা পর ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট শনিবাব স্থানীয় সময় রাত ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে ৪৮ বছর বয়সে সুভাষ চন্দ্র বসু মারা যান।
এর দুই দিন পর ১৯৪৫ সালের ২০ আগস্ট সুভাষ বসুর দেহ দাহ করা হয় তাইহোকুর মূল ক্রিমেটরিয়াম বা শবচুল্লিতে। ২৩ আগস্ট জাপানি সংবাদ সংস্থা উড় ঞৎুবর সুভাষ বসু আর শিদিয়ার মৃত্যুর খবর জানায়। ৭ সেপ্টেম্বর জাপানি কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট টাটসুও হায়াশিদা সুভাষ বসুর চিতাভস্ম টোকিওতে বহন করে নিয়ে যান। এর পরদিন সকালে টোকিও ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লীগের প্রেসিডেন্টের কাছে তা হস্তান্তর করেন। ১৪ সেপ্টেম্বর টোকিওতে সুভাষ বসুর এক স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। এর কয়েক দিন পর চিতাভস্ম টোকিওর নিচিরেন বুদ্ধিজমের রেঙ্কুজি মন্দিরের ধর্মগুরুর কাছে দেয়া হয়। সেখানে আজো তা সংরক্ষিত আছে।
সুভাষ বসুর মৃত্যু আইএনএ লোকজনের মধ্যে এক ধরনের ব্যাপক শোকাঘাত ও মানসিক আঘাত হিসেবে কাজ করে। তারা যেন এ মৃত্যু বিশ্বাস করতে পারছিল না, মেনে নিতে পারছিল না। সবচেয়ে বেশি আঘাত পায় সিঙ্গাপুর ও মালয়ার ভারতীয় তামিল তরুণেরা। এর মধ্যে ছিল আইএনএ তালিকাভুক্ত বিপুল সংখ্যক বেসামরিক লোক। আইএনএর পেশাজীবী সৈন্যদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিল পাঞ্জাবি। তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। তারা ভাবছিল ব্রিটিশেরা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবে। ভারতে ইন্ডিয়ান কংগ্রেসের অফিসিয়াল লাইন সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করা হয় রাজকুমারী অমৃত কাউরের কাছে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর লেখা চিঠিতে।
অনেক কংগ্রেসি সুভাষ বসুকে ভুলতে পারেননি গান্ধীর সাথে ঝগড়া করার জন্য এবং জাপানিদের সাথে সহযোগিতার কারণে। কারণ তারা মনে করত এ সহযোগিতার অর্থ জাপানি ফ্যাসিবাদকে সহযোগিতা করা। ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান আর্মির ২০ থেকে ২৫ লাখ ভারতীয় সৈন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষ হয়ে লড়াই করেছে। তাদের সাথে আইএনএর দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। কেউ কেউ আইএনএ-কে মনে করে বিশ্বাসঘাতক। তারা চেয়েছিল তাদের শাস্তি হোক। অন্যরা ছিল তাদের প্রতি সহমর্মী। ব্রিটিশরাজ যদিও কখনো আইএনএর কাছ থেকে তেমন কোনো হুমকির মুখে পড়েনি, তবুও আইএনএ বিচারে ৩০০ আইএনএ কর্মকর্তাকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে বিচারের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ বিচার আর শেষ হতে পারেনি। কারণ এরই মধ্যে ব্রিটিশ রাজের অবসানের মধ্য দিয়ে ভারত উপমহাদেশও স্বাধীনতা অর্জন করে।
এখানেই শেষ নয়
১৯৪৫ সালের আগস্টে সুভাষ বসুর দৈহিক মৃত্যু হলেও এখানেই তার কাহিনী শেষ হয়ে যায়নি। বরং এখান থেকে শুরু হয় তাকে ঘিরে নানা লৌকিক উপাখ্যান, যার সত্যতা নিরূপণ আজো দুরূহ। ১৯৪০ সালে গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় তার পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে ভারতীয়দের মনে প্রশ্ন জাগে তিনি বেঁচে আছেন না মারা গেছেন? বেঁচে থাকলে তিনি আছেন কোথায়? আর করছেনটাই বা কী? ১৯৪১ সালে জার্মানিতে তার আবির্ভাব তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জন্ম দেয় নানা রহস্য। তার মৃত্যুর পর সুভাষ বসুর অন্য সাথীরা যারা পরবর্তী ফ্লাইটের অপেক্ষায় বিমানবন্দরের টারমাকে অবস্থান করছিলেন, তাদেরও সুভাষ বসুর মরদেহ দেখানো হয়নি। বিমান দুর্ঘটনায় আহত-নিহতদের কোনো ছবিরও অস্তিত্ব নেই কেন? কেন ইস্যু করা হয়নি কোনো ডেথ সার্টিফিকেট? ভারত সরকার কিংবা ব্রিটেনও কোনো সরকারি ভাষ্য প্রকাশ করেনি তার মৃত্যু সম্পর্কে? এমন হাজারও প্রশ্ন তার জীবন ও মৃত্যুকে ঘিরে যেমন অতীতে ছিল, আজো আছে। তার মৃত্যুরহস্য উন্মোচনে অনেক তদন্ত হয়েছে। সে ফিরিস্তি সুদীর্ঘ, যার বিস্তারিতে যাওয়ার সুযোগ এখানে একদম নেই। তার মৃত্যুরহস্য নিয়ে অসংখ্য বই লেখা হয়েছে, এখনো লেখা হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু আমরা জানি না, সে রহস্যের উন্মোচন কোনো দিন হবে কি না?
0 comments:
Post a Comment