শাহনওয়াজ আলি রায়হান
মেয়েটির নাম তো 'মিসবাহ কাদরি'! এ কে কি আর নতুন ফ্ল্যাটে ঢুকতে দেওয়া যায়? মুম্বইয়ের এক আবাসনে ঘর পাকা করে ফেলার পরও ঢুকতে পারলেন না বছর পঁচিশের মিসবাহ৷ পাঁচ বছর ধরে কর্মসূত্রে মুম্বইয়ে বসবাসকারী গুজরাতের এই যুবতী জানিয়েছেন, ধর্মপরিচয়ের কারণে পূর্বেও তাঁর এহেন অভিজ্ঞতা হয়েছে৷
সংবাদমাধ্যমে এ খবর বেরোনোর কিছু আগেই সামনে এসেছিল মুম্বইয়ের জিশান আলি খান-এর ধর্ম পরিচয়ের দরুণ চাকরির ইন্টারভিউয়ে ডাক না পাওয়ার খবরটি৷ সংস্থাটির তরফে জিশানের ইনবক্সে উত্তর ছিল- 'Thanks for your application. We regret to inform you that we hire only non-Muslim candidates.' হয়তো কাকতালীয়, কিন্তু ঘটনাগুলি ঘটেছে গত
মোদী ক্ষমতায় আসার ফলেই যে এহেন বিদ্বেষমূলক ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, এমনটাও নয়৷ এর আগে ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী গুলি চালিয়েছে স্বর্ণমন্দিরে, রাজীব বাবরি মসজিদের তালা খুলেছেন৷ নরসিমা রাও তা বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছেন৷ জ্যোতি বসু-বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা উন্নয়নের ময়দানে বঙ্গের সংখ্যালঘুদের দলিতদের চেয়েও নিচে নামিয়েছেন৷ মমতা তাঁদের নিয়ে প্রতীকী উন্নয়ন বা তোষণে মেতেছেন৷ কিন্তু এত সবের পরও প্রকাশ্যে সংবিধানের নৈতিক ভিত্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জাতি-কে কোনও নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীর সমার্থকে পরিণত করার প্রচেষ্টা, তাও আবার ক্ষমতাসীন দলের নেতা-মন্ত্রীদের তরফে- এই প্রথম৷ বাজপেয়ি শাসন আমলেও ছবিটা এত দ্রুত তিক্তরূপ নেয়নি৷
দেশের বহুত্ববাদী ঐতিহ্যের বিকাশে মোদী সরকারের গত এক বছরের পারফরম্যান্স চরম হতাশাজনক৷ আশঙ্কারও৷ লোকসভায় ২৮২ বিজেপি সাংসদের এক জনও মুসলিম নন৷ রাজ্যসভায় যে দু'জন আছেন তাঁরাই দলের 'মুসলিম মুখ'৷ তাঁদের এক জন সংখ্যালঘু উন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পরই জানিয়ে দেন, মুসলিমদের তিনি সংখ্যালঘু ভাবতেই নারাজ! অপর জনের ফতোয়া- গোমাংস ভক্ষণ করতে হলে পাকিস্তান বা কোনও আরবদেশে যান!
এই প্রথম দেশ দেখল ব্যক্তির রান্নাঘরে ঢুকে মুখের গ্রাসকেও আইন করে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে রাষ্ট্র৷ এটাও দেশ প্রথম বার দেখল যে, শাসক গোষ্ঠীর তরফ থেকে কী করে এ দেশে থাকার শর্ত হিসেবে অহিন্দুদের সামনে ঘরওয়াপসি, সূর্য নমস্কার, যোগ প্রভৃতি আরোপ করা হচ্ছে৷ কোনও নেতা বলছেন, মসজিদগুলো গুঁড়িয়ে ফেলা উচিত, একটি লাভ-জিহাদের বিনিময়ে একশো মুসলিমকে হিন্দু করা দরকার, তো অন্য কেউ বলছে মুসলিমদের হিন্দু ধর্মস্থানের নিকটে আসতে দেওয়া উচিত নয়, ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া উচিত৷ এই উচিত/
অনুচিতের তালিকাটি কিন্তু দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে৷মিসবাহ কাদরি
আর এই তালিকা প্রণয়নকারী সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতি, সাধ্বী প্রাচী যোগী আদিত্য নাথ, সঞ্জয় রাউত, সুব্রহ্মণিয়ম স্বামীরা কিন্ত্ত সাধারণ মানুষ নন বরং সরকার পক্ষের নেতা-মন্ত্রী বা সাংসদ৷ ফলে, ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ যে শুধু বয়ানবাজিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে, তা নয় উপনির্বাচনের আগে যেমন উত্তরপ্রদেশে ছোটো ছোটো দাঙ্গা হচ্ছে, তেমনই বিধানসভা ভোটের আগে, দিল্লিতে চার্চ পুড়ছে, খ্রিস্টান নানদের ধর্ষণ, গির্জা আক্রমণ থেকে দাড়িওলা মুসলিম যুবককে পিটিয়ে হত্যা, রোজা অবস্থায় জোর করে মুখে রুটি ঢোকানোর চেষ্টা, মোদী সরকারের প্রথম এক বছর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভারতের নানা প্রান্তে তবে এত কিছুর পরও দেশের অভিভাবক কিন্তু লাগাম টানতে ব্যর্থ৷
তাঁর নীরবতা অসংখ্যের গর্জনের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে৷
ঘুরে ফিরে চলেই আসে সেই অপ্রিয় প্রশ্নটি, ভারতে মুসলমানরা কি তবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক? যারা এমন এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে, যখন অবস্থানগত শ্রেষ্ঠতার নিরিখে দেশের 'স্বীকৃত' রাজনৈতিক/সাংস্কতিক/অর্থনৈতিক/সামাজিক বিন্যাস বাতিল করতে চায় তাঁদের ঐতিহ্য, সত্তা ও অধিকারগুলিকে? কর্তৃত্বকামীতে আচ্ছন্ন সংখ্যাগরিষ্ঠের সংস্কৃতি প্রভাবিত 'জাতীয়তাবাদ' এক স্পর্ধিত উন্নাসিকতায় বিচার করে সংখ্যালঘুর চাওয়াপাওয়া তথা প্রাত্যহিক জীবনযাত্রাকে৷
মিসবাহ-র খবরটি পড়ার সময় মনে হয়েছে, এ আর নতুন কী? এ তো আমার, আমার বন্ধুবান্ধবদের নিত্যনৈমিত্তিক অভিজ্ঞতা৷ এই কলকাতা শহরেই অতীতে বাড়ি ভাড়া খুঁজতে গিয়ে একাধিক বার শুনতে হয়েছে- শুধু বাঙালিদেরই দেওয়া হয়! আমি বাঙালি নই? মুম্বইয়ের সেই হাউজিংয়ের 'নো-মুসলিম' বিজ্ঞাপনটির বিতর্ক অনেকেরই জানা৷ সমগ্র বিশ্বের মুসলিম জনসংখ্যার মোট কত শতাংশ সুইসাইড বোম্বিং-তালিবান-আইসিস প্রভৃতি কর্মকাণ্ডকে ইসলাম সম্মত বলে মনে করেন বা সমর্থন করেন, সেই পরিসংখ্যানে যাওয়ার দরকার নেই- দাড়ি থাকলে মৌলবাদী, হিজাব পরলেই গোঁড়া, মুসলিম যুবক হলেই উগ্র!
হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্নে বিভোর সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যেকার একটি সংখ্যালঘু হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য জাতীয় ঐক্যকে হিন্দু ঐক্যে পরিণত করতে অতি তত্পর৷ পরিণত রাজনীতিবিদ নরেন্দ্র মোদী আর দাঙ্গা বা এনকাউন্টারের মুখাপেক্ষী হতে যাবেন কোন দুঃখে? যাঁরা এখনও অপরিণত রাজনীতিবিদ, চঞ্চলমতি- সেই হিন্দুত্ববাদী নেতা-মন্ত্রীরাই বরং রাতারাতি সমাজের স্বাভাবিক অভিব্যক্তি বদলে দিতে, সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে আত্মপরিচয়ের সঙ্কট তৈরি করে হিন্দু ভোট সুসংহত করতে হেট স্পিচ-এর শরণাপন্ন হচ্ছেন৷ এই একই যুক্তিতে এই রাজ্যেও খাগড়াগড় কাণ্ডের পর তাই 'নুরানি কায়েদা' (যেটা পড়ে বাচ্চারা আরবি বর্ণমালা শেখে) গণমাধ্যমের কৃপায় দিব্যি চালানো হচ্ছে 'আল কায়দা' বলে!
পুনশ্চ: জিশানের সঙ্গে ওই হিরা রন্তানিকারী সংস্থায় চাকরির আবেদন করা ওঁঙ্কার ও মুকুন্দ নামের তাঁর দুই বন্ধু ইন্টারভিউ কল পাওয়ার পরও সেখানে চাকরি করতে সম্মত হননি৷ অর্থাত্, দেশের ঐতিহ্যগত সহনশীলতা এখনও বহমান৷
লেখক : অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক
সূত্র : এই সময়
0 comments:
Post a Comment