খাজা আহমদ আব্বাস
অনুবাদ : আন্দালিব রাশদী
আমার নাম শেখ বুরহানউদ্দিন।
দিল্লিতে যখন সহিংসতা আর খুনখারাবি নিত্যকার ব্যাপার, রাস্তার ওপর দিয়ে বইছে
মুসলমানদের রক্তবন্যা, পোড়া কপাল আমার, ব্যাটা এক শিখ তখন আমার প্রতিবেশী। সৎপ্রতিবেশী যেমন বিপদের সময় উদ্ধার করতে এগিয়ে আসে। এই শিখের কাছে তা প্রত্যাশা করা দুরাশা, বরং কখন যে সে তার কৃপাণ আমার পেটে ঢুকিয়ে দেয় সেটাই চিন্তার বিষয়। আসলে তখন পর্যন্ত শিখদের আমার হাস্যকরই মনে হতো। আমি তাদের বড্ড অপছন্দ করতাম, ভয়ও পেতাম।
জীবনে প্রথম যখন একজন শিখকে দেখি আমার ঘৃণাটা তখন থেকেই। আমার বয়স তখন ছয় বছরের বেশি হওয়ার কথা নয়। একজন শিখকে দেখলাম রোদে বসে লম্বা চুল আঁচড়াচ্ছে। দেখে আমার কাছে বাজে প্রতিক্রিয়া হলো। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘দেখ, দাড়িওয়ালা মেয়ে মানুষ।’ বয়স বাড়ার সাথে সাথে গোটা শিখ জাতির প্রতি আমার অপছন্দ বেড়েই চলল।
আমাদের বাড়িতে বুড়িদের কাজই ছিল যত আপদ-মুসিবত সব শত্রুর ওপর নিক্ষেপ করা। যেমন একটা শিশুর নিউমোনিয়া হলো কী পা ভেঙে গেল বুড়িরা বলল, বহু বছর আগে এক শিখের (কিংবা এক ইংরেজের) নিউমোনিয়া হয়েছিল কিংবা এক শিখের(কিংবা এক ইংরেজের) ঠ্যাং ভেঙে গিয়েছিল।
আমি বড় হওয়ার পর আবিষ্কার করলাম, এই ঘৃণার উৎস সেই ১৮৫৭ সালে, যখন স্বাধীনতাযুদ্ধে হিন্দু ও মুসলমানদের হারিয়ে দিতে শিখ রাজকুমাররা ফিরিঙ্গিদের সাথে হাত মিলিয়েছিল। আমি একটি ঐহিতাসিক অভিসন্দর্ভ উপস্থাপনের ইচ্ছে প্রকাশ করছি না, বরং ইংরেজ ও শিখদের প্রতি আমার এই যে আবিষ্টতা, যে সন্দেহ, যে ঘৃণা তার একটা ব্যাখ্যা দিতে চাই। শিখদের চেয়ে ইংরেজদের ব্যাপারে আমার আতঙ্ক ছিল আরো বেশি।
আমার বয়স যখন দশ বছর, আমি দিল্লি থেকে আলিগড় যাচ্ছিলাম। আমি থার্ড ক্লাসেই ভ্রমণ করতাম, খুব বেশি হলে ইন্টার ক্লাস। সেদিন আমি নিজেকে শোনালাম ‘দেখি না একবার সেকেন্ড ক্লাসে ভ্রমণ করে, দেখি কেমন লাগে।’ আমি টিকিট কিনলাম। খালি সেকেন্ড ক্লাস কম্পার্টমেন্টও পেয়ে গেলাম। চমৎকার স্প্রিয়ংয়ের সিটে লাফিয়ে পড়লাম। আমি বাথরুমে ঢুকলাম। লাফিয়ে ওপরে উঠে আয়নায় আমার চেহারা দেখলাম। আমি ফ্যানগুলো চালিয়ে দিলাম। লাইটের সুইচ নিয়ে খেলতে শুরু করলাম।
ট্রেন ছাড়ার মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। তখনই লালমুখো চারজন ‘টমি’ হুড়হুড় করে কম্পার্টমেন্টে ঢুকল। মুখে তাদের অশ্রাব্য গালাগাল সব কিছুই হয় ‘ব্লাডি’ কিংবা ‘ড্যাম’। একবার তাদের দিকে চোখ পড়তেই আমার সেকেন্ড ক্লাসে ভ্রমণ করার বাসনা ভস্মীভূত হয়ে গেল।
আমি আমার স্যুটকেস তুলে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলাম। নেটিভ লোকে বোঝাই একটি থার্ড ক্লাস বগিতে ঢোকার পর নিঃশ্বাস ছাড়লাম। কিন্তু আমার এমনই কপাল, গোটা বগিই শিখে বোঝাই। তাদের দাড়ি নাভি পর্যন্ত নেমে এসেছে। পরনে তাদের বড়জোর আন্ডার প্যান্ট। আমি তাদের কাছ থেকে পালাতে পারলাম না, তবে দূরত্ব বজায় রাখলাম।
যদিও শিখের চেয়ে সাদা মানুষকেই বেশি ভয় পাই, তবুও আমার মনে হয় সাদা মানুষই বেশি সভ্য, তারা আমার মতোই এক ধরনের পোশাক পরে। আমার তখন তাদেরই মতো ‘ড্যাম’ এবং ‘ব্লাডিফুল’ গাল দিতে ইচ্ছে করছিল। সাদাদের মতোই আমিও শাসক গোষ্ঠীর কেউ একজন হতে চেয়েছি। ইংরেজরা তাদের খাবার ছুরি ও কাঁটাচামচ দিয়ে খায়। আমিও ছুরি আর কাঁটাচামচে খেতে শিখেছি, যাতে আমাকে দেখে নেটিভরা বুঝতে পারে আমিও সাদাদের মতো সভ্য মানুষ।
আমার শিখভীতি ভিন্ন ধরনের। শিখদের জন্য আমার ভেতরে একটা ঘৃণা ছিল। যেসব পুরুষ মানুষ মহিলাদের অনুসরণ করত আর তাদের মতো লম্বা চুল রাখত তাদের আহাম্মকি দেখে আমি বিস্মিত হই। আমাকে স্বীকার করতেই হবে, আমার বাবার নির্দেশ মতো চুল খুব ছোট করাটা আমি পছন্দ করতাম না। শুক্রবার যখন চুল কাটাতে যেতাম নাপিতকে সামান্য চুলের বেশি কাটতেও দিতাম না। আমার ঝাঁকড়া চুল বেড়ে ওঠে, যখন আমি হকি কিংবা ফুটবল খেলি, ইংরেজ খোলোয়াড়দের মতো বাতাসে আমার চুল ওড়ে।
আমার বাবা প্রায়ই জিজ্ঞেস করতেন, মেয়ে মানুষের মতো চুল বড় করছিস ক্যান?
আমার বাবার দৃষ্টিভঙ্গি প্রাচীন, আমি তার মতামতের তোয়াক্কাও করতাম না। তার যদি করার ক্ষমতা থাকত তিনি ক্ষুর দিয়ে পুরো মাথা চেঁছে সব মানুষের থুঁতনিতে কৃত্রিম দাড়ি লাগিয়ে দিতেন। ... শিখদের অপছন্দ করার দ্বিতীয় কারণটি এখান থেকেই বেরিয়ে এসেছে, তা হচ্ছে তাদের দাড়ি, তাদের বন্য দেখায়।
কত ধরনের দাড়িই তো আছে। আমার বাবার দাড়ি সুচারু ছাঁটের ফ্রেঞ্চকাট কিংবা আমার চাচার দাড়ি থুঁতনির কাছে সুচালো। কিন্তু যে চুলে কখনো কাঁচি চালানো হয়নি, বুনো জঙ্গলের মতো যে দাড়িকে কেবল বাড়তেই দেয়া আর তেল, দই আর খোদাই জানেন আর কী সব মিশিয়ে সেই চুলে সার দেয়া হয় তার ব্যাপারে কী করা? কয়েক ফুট বেড়ে ওঠার পর মেয়েদের মাথার চুলের মতো আঁচড়াতে হয়। আমার দাদারও লম্বা দাড়ি ছিল। তিনি চিরুনি দিয়ে সে দাড়ি আঁচড়াতেন... তা হোক, আমার দাদা তো আমারই দাদা, কিন্তু শিখ কেবলই শিখ।
ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাসের পর আমাকে পাঠানো হয় আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমরা যেসব ছেলে দিল্লি কিংবা ইউপি থেকে এসেছি, আমরা পাঞ্জাব থেকে আসা ছেলেদের হীন চোখে দেখতাম। তারা অমার্জিত ও গ্রাম্য, কেমন করে আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে হয়, টেবিলে আচরণ কেমন হবে কিংবা সভ্যজনের সঙ্গ থেকে কেমন করে নীরবে বেরিয়ে যেতে হবে কিছুই তাদের জানা নেই। জানে কেবল বড় হাঁড়ি থেকে ঘোল খাওয়া। কেওড়ার সুঘ্রাণ ছড়ানো খান্দানি সেমাইয়ের স্বাদ কিংবা লিপটন চায়ের মনকাড়া গন্ধ তাদের অজানা। তাদের ভাষা চরম অপরিশীলিত। তারা পরস্পরের সাথে যে আলাপই করুন, শুনলে মনে হবে ঝগড়া করছে। কথার মধ্যে শুধু ‘উসি, টুসি, সাদি, তৌহিদী’ খোদা না করুন!
আমি পাঞ্জাবিদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছি।
কিন্তু আমাদের হোস্টেলের ওয়ার্ডেন (খোদা তাকে মাফ করুন) আমার রুমমেট করে দিলেন এক পাঞ্জাবিকে। যখন বুঝতে পারলাম আমার কোনো রেহাই নেই, বাজে অবস্থার মধ্যে যতটা ভালো ব্যবহার করা যায় তাই করলাম, সেও ভদ্রতার শীর্ষে। এই মানুষটির নাম গুলাম রসুল, রাওয়ালপিন্ডি থেকে এসেছে। সঙ্গী হিসেবে গুলাম রসুল আসলে চমৎকার আর তার মজার গল্পের কোনো শেষ নেই।
জিজ্ঞেস করতেই পারেন শিখের গল্পের মধ্যে গুলাম রসুল কেমন করে ঢুকে পড়ল। আসল ঘটনা হচ্ছে গুলাম রসুলের ছোট ছোট গল্পগুলো শিখদের নিয়েই। তার এসব গল্প শুনেই শিখদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য, এই অদ্ভুত সম্প্রদায়ের অভ্যাস ও রীতিনীতি সম্পর্কে অনেকটা ওয়াকিবহাল হয়ে উঠি।
গুলাম রসুলের মতে, শিখদের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : শিখরা সবাই গর্দভ ও জড়বুদ্ধিসম্পন্ন। দুপুরে তাদের সামান্য যেটুকু জ্ঞান তাও পুরোপুরি লোপ পায়। এটা প্রমাণ করার মতো অনেক ঘটনা আছে। যেমন, একদিন দুপুর বারোটায় এক শিখ অমৃতসরের হল বাজারে সাইকেল চালিয়ে আসছিল। আরেক পুলিশ কনস্টেবল, সেও শিখ, সাইকেল থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোর সাইকেলের বাতি কোথায়? হতবুদ্ধি সাইকেলচালক জবাব দিল, জমাদার সাহেব আমি তো বাতি জ্বালিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছিলাম। হয়তো এখনই নিভে গেছে। কনস্টেবল তাকে জেলে ঢোকানোর হুমকি দিলো। অপর এক পথচারী সেও শিখ, লম্বা দাড়ি, হস্তক্ষেপ করল, ‘শোন ভাই সব, এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া করার কোনো মানে নেই। বাতি নিভে থাকলে আবার জ্বালিয়ে নিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।’
এরকম শত শত গল্প গুলাম রসুলের জানা। আর তার নিজস্ব পাঞ্জাবি উচ্চারণে যখন এসব শোনাত, তার শ্রোতারা হাসতে হাসতে অসহায় হয়ে পড়ত। পাঞ্জাবিতে শোনালেই জমতো দারুন, কারণ অভব্য শিখদের অদ্ভুত ও দুর্বোধ্য আচরণ তার অমার্জিত ভাষাতেই সবচেয়ে ভালো ফুটে উঠত। শিখরা যে শুধু আহাম্মক তাই নয়, অবিশ্বাস্য রকম নোংরাও। গুলাম রসুল শত শত শিখকে চিন কিভাবে চুল না কেটে এত দিন থাকে আমাদের তাই শোনাত। আর আমরা মুসলমানরা ভালো করে নিয়মিত চুল ধুই, নিদেনপক্ষে শুক্রবারে তো অবশ্যই। আর শিখরা জনসমক্ষে আন্ডারপ্যান্ট পরে গোসল করে আর মাথায় ঢালে রাজ্যের যত নোংরা আবর্জনা, এমনকি দইও। আমি আমার মাথার চাঁদিতে লেবুর রস ও গ্লিসারিন ঘষি। যদিও গ্লিসারিন দইয়ের মতোই গাঢ়, এটা তো ভিন্ন জিনিস ইউরোপের সুপরিচিত পারফিউম কোম্পানি এটা তৈরি করে। আমার গ্লিসারিন আসে চমৎকার বোতল আর শিখের দই আসে নোংরা মিস্টিওয়ালার দোকান থেকে।
শিখরা কিভাবে জীবনধারণ করে-না-করে আমি তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হতাম না একটা বিষয় আমাকে জ্বালা ধরিয়ে দেয় এরকম উদ্ধত ও অমার্জিত মানুষকে তো মুসলমানদের মতো ভালো যোদ্ধা মনে করা যায় না। পৃথিবীজুড়ে সবাই জানে, একজন মুসলমান দশজন হিন্দু কিংবা দশজন শিখের চেয়ে বেশি কিছু করতে পারে। কিন্তু এই শিখেরা তো মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেবে না, বরং লড়াকু মোরগের মতো সদর্পে ঘুরঘুর করবে, দাড়ি হাতাবে, গোঁফে পাক দেবে। গুলাম রসুল বলত, এমন একদিন আসবে যেদিন মুসলমানরা শিখদের জনমের শিক্ষা দেবে, যে শিক্ষা তারা জীবনে কোনো দিন ভুলবে না।
এভাবে বছর কেটে গেল।
আমি কলেজ ছাড়লাম। আমার ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গেল। আমি কেরানির চাকরি পেয়ে গেলাম। তারপর হেড ক্লার্ক। আমি আলীগড় ছেড়ে বসবাস করতে দিল্লি চলে এলাম।
আমি সরকারি কোয়ার্টার পেলাম। বিয়ে করলাম। আমার বাচ্চাকাচ্চা হলো।
আমার কোয়ার্টারের পাশেরটাই এক শিখের দখলে। সে রাওয়ালপিন্ডি থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে এখানে এসেছে। অনেক বছর পার হলেও আমি শিখদের সম্পর্কে গুলাম রসুল আমাকে কী বলেছে ভুলিনি। গুলাম রসুলের ভবিষ্যদ্বাণীর কিছুটা রাওয়ালপিন্ডিতে শিখদের আচ্ছামতো শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে বাস্তবায়ন হয়েছে। মুসলমানরা তাদের উৎখাত করে ছেড়েছে। শিখরা অহঙ্কার করে থাকে তারা মস্ত বড় বীর। তারা তাদের লম্বা কৃপাণ জাহির করে বেড়ায়। কিন্তু কোথাও তারা সাহসী মুসলমানদের সাথে পেরে ওঠেনি। জোর করে তাদের দাড়ি শেভ করে দেয়া হয়েছে, তাদের ধরে খৎনা করিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের ইসলাম ধম্য গ্রহণ করানো হয়েছে। হিন্দুদের সংবাদপত্রে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে খবর বেরিয়েছে। তারা লিখেছে, মুসলমানরা শিখ নারী ও শিশুদের হত্যা করেছে। কিন্তু এটা তো মুসলিম ঐতিহ্যের সম্পূর্ণ বিরোধী। কোনো মুসলিম যোদ্ধা নারী কিংবা শিশুর বিরুদ্ধে হাত তুলেছে এমন কথা কেউ শোনেনি। হিন্দুদের পত্রিকায় নারী ও শিশুর মৃতদেহের যে ছবি দেখানো হয়েছে তা স্পষ্টতই ভুয়া। মুসলমানদের কলঙ্কিত করার জন্যই শিখরা নিজেদের নারী ও শিশুদের হত্যা করেছে। এ ছাড়া অন্য কিছু আমি ভাবতে পারছি না।
মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দু ও শিখ নারী অপহরণের অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু আসল ঘটনা হচ্ছে মুসলমানদের বীরত্বের কাহিনীর প্রভাবে হিন্দু ও শিখ মেয়েরা তরুণ মুসলমান ছেলেদের প্রেমে পড়েছে এবং তাদের উঠিয়ে নেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেছে। এই মেয়েদের আশ্রয় দেয়া এবং ইসলামের পথে তাদের টেনে আনা ছাড়া এই মহান হৃদয় যুবকদের আর কিছু করার ছিল না।
শিখদের বীরত্বের বুদবুদ ফেটে গেছে। শিখদের নেতারা তাদের কৃপাণ দেখিয়ে কিভাবে মুসলমানদের হুমকি দিয়েছে, তাতে কিছুই আসে-যায় না, বরং রাওয়ালপিন্ডি থেকে শিখদের পালানোর দৃশ্য থেকে ইসলামের মহত্ত্বে আমার অন্তর গর্বে ভরে ওঠে।
আমার প্রতিবেশী শিখের বয়স প্রায় ষাট বছর। তার দাড়ি সবই পেকে গেছে। যদিও লোকটি কোনোভাবে মৃত্যুর চোয়াল থেকে ছুটে বেরিয়ে এসেছে, হাসছে সারাক্ষণই; অত্যন্ত অশ্লীলভাবে তার দাঁত দেখিয়ে হাসছে। সে যে আহাম্মক এটা তো স্পষ্ট। প্রথম দিকে বন্ধুত্বের ভড়ং-এ আমাকে তার জালে আটকাতে চেষ্টা করেছে। যখনই আমি তার পাশ দিয়ে যেতাম আমার সাথে কথা বলার জন্য মুখিয়ে থাকত। তখন শিখদের কী উৎসব ঠিক বলতে পারব না, আমার সাথে ভাব জমিয়ে তোলার জন্য আমার বাড়িতে কিছু মিষ্টি মাখন পাঠিয়ে দিলো। আমার স্ত্রী একেবারে সাথে সাথে এগুলো আমাদের মেথরানীকে দিয়ে দিলো। তার সান্নিধ্যে যতটা সম্ভব কম এসে আমি আমার কাজ চালিয়ে যেতাম। যখনই সুযোগ পেতাম তাকে উপেক্ষাই করতাম। আমি জানতাম, একবার তার সাথে কথা বললে, তাকে ঘাড় থেকে নামানো কঠিন হয়ে পড়বে। সৌজন্য আলাপ তাকে অন্তরঙ্গ হতে প্ররোচনা দিতো বলেই আমি দূরে থাকতাম। তা ছাড়া আমি তো জানিই। শিখরা নোংরা ভাষার শক্তি থেকে তাদের জীবনীশক্তি আহরণ করে। এ রকম মানুষের সাথে মিশে আমি আমার ঠোঁট দুটো কেন নোংরা করব!
রোববারের এক সন্ধ্যায় আমি আমার স্ত্রীর কাছে শিখদের গাধামির গল্প করছিলাম। শিখদের সম্পর্কে যা বলছি তা যে সঠিক তা প্রমাণ করার জন্য ঠিক দুপুর বারোটায় আমার বাসার কাজের ছেলেটাকে বললাম, আমাদের প্রতিবেশী ওই শিখটার কাছ থেকে সময় কত জেনে আয়।
ফিরে এসে বলল, বারোটা বেজে দুই মিনিট। আমি আমার স্ত্রীর কাছে মন্তব্য করলাম ‘দেখলে তো বারোটা বাজে বলতেও ওরা ভয় পায়।’ তারপর আমরা দু’জনই প্রাণভরে কিছুক্ষণ হাসলাম। এই ঘটনার পর আমি যে কতবার আমার শিখ প্রতিবেশীকে গাধা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি তার শেষ নেই। আমি তাকে জিজ্ঞেস করতাম ‘সর্দারজি বারোটা বেজেছে?’ সব দাঁত বের করে নির্লজ্জ এই মানুষটি বলত, সাহেব, কবেই তো আমাদের বারোটা বেজে গেছে।’ তারপর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ত, যেন আমি তাকে একটি হাসির কৌতুক শুনিয়েছি।
আমি আমার বাচ্চাদের নিরাপত্তা নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলাম। একজন শিখকে কখনো বিশ্বাস করা যায় না। তা ছাড়া এই শিখ রাওয়ালপিন্ডি থেকে পালিয়েছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে তার নিশ্চয়ই অনেক আক্রোশ, আর এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। আমি আমার স্ত্রীকে বলেছি, কখনো আমাদের ছেলেমেয়েদের শিখের বাসার ধারেকাছেও যেতে দেবে না। কিন্তু শিশুরা তো শিশুই। ক’দিন পরই দেখলাম আমার বাচ্চারা ছোট্ট মোহিনী এবং বুড়ো শিখের অন্য নাতি-নাতনিদের সাথে খেলছে। মেয়েটির নাম থেকে যেমন মনে হচ্ছে বড়জোর দশ বছর বয়সী মেয়েটি সত্যিই সুন্দর। ফর্সা গায়ের রঙ, চমৎকার দেহ গঠন। এই বদমাশ শিখগুলোর মহিলারা দারুণ চমৎকার। আমার মনে আছে, গুলাম রসুল আমাকে বলেছে, সবগুলো শিখ পুরুষ পাঞ্জাবে তাদের মহিলাদের রেখে যদি একবারে বেরিয়ে যেত, তাহলে হুরির সন্ধানে মুসলমানদের বেহেশতে যাওয়ার দরকার হতো না।
শিখদের ব্যাপারে সত্যটা বেরিয়ে এলো অচিরেই। শিখরা রাওয়ালপিন্ডিতে আচ্ছারকম মার খেয়ে ভীরুর মতো পূর্ব পাঞ্জাবে পালিয়ে এসেছে। এখানে তারা দেখল মুসলমানরা দুর্বল। সুতরাং তাদের হত্যা করতে শুরু করল। শত শত মুসলমানকে মেরে ফেলল। বিশ্বাসী মানুষের রক্তের বন্যা রয়ে গেল। হাজার হাজার মুসলমান মহিলাকে নগ্ন করে তাদের রাস্তা দিয়ে হাঁটানো হলো। পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে পালিয়ে বিপুলসংখ্যক শিখ যখন দিল্লিতে এলো, এটা তো স্পষ্ট রাজধানীতে তারা ঝামেলা সৃষ্টি করবেই। তখন আমার পক্ষে পাকিস্তান চলে যাওয়া সম্ভব ছিল না। একসময় আমার বড় ভাইয়ের সাথে আমার স্ত্রী ও সন্তানদের আকাশপথে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিই। আর আমার ভাগ্য সঁপে দিই খোদার হাতে। উড়োজাহাজে তো আর তেমন মালামাল পাঠানো সম্ভব ছিল না। আমার ঘরের আসবাব ও অন্যান্য জিনিসপত্র পাঠানোর জন্য পুরো একটা রেলওয়ে ওয়াগান ভাড়া করি। যেদিন ওয়াগনে মাল তুলব, খবর পাই শিখ গুণ্ডারা পাকিস্তানগামী ট্রেন আক্রমণ করছে। শেষ পর্যন্ত আমার মালামাল দিল্লিতে আমার কোয়ার্টারেই রয়ে গেল।
১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতার উৎসব করল। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতায় আমার কিসের স্বার্থ! আমি সারা দিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে ডন আর পাকিস্তান টাইমস পড়েছি। দুটো পত্রিকাই বেশ কড়া ভাষায় ভারতকে যেভাবে তাদের স্বাধীনতা লাভের অপকীর্তির সমালোচনা করেছে এখান থেকেই উপসংহার টানা যায়। মুসলমানদের ধ্বংস করার জন্য হিন্দুরা কেমন করে ব্রিটিশদের সাথে ষড়যন্ত্র করছে। একমাত্র আমাদের মহান নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাদের ষড়যন্ত্র ও নকশা নস্যাৎ করে দিয়ে মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান হাসিল করেছেন। হিন্দু ও শিখের চাপে পরাস্ত হয়ে ইংরেজরা অমৃতসর ভারতকে দিয়ে দিয়েছে। দুনিয়াশুদ্ধ সবাই জানে, অমৃতসর হচ্ছে মুসলমানদের একটি শহর। এই শহর সোনা মসজিদের জন্য বিখ্যাত নাকি আমি এটাকে স্বর্ণমন্দিরের সাথে গুলিয়ে ফেলেছি! হ্যাঁ, তাই হবে, সোনা মসজিদ তো দিল্লিতে। এই সোনা মসজিদ ছাড়াও দিল্লিতে রয়েছে জামে মসজিদ, লাল কেল্লা, হজরত নিজামউদ্দিন ও বাদশাহ হুমায়ুনের সমাধি, সফদর জংয়ের কবর ও স্কুল সবই ইসলামি শাসনের উপযুক্ত স্বাক্ষর। এমনকি দিল্লি (আসলে মুসলমান বাদশাহ শাহজাহানের নামে শহরটির নাম হওয়ার কথা শাহজাহানাবাদ) শহরকেও কম অসম্মানিত হতে হয়নি দিল্লির দুর্গের ওপর উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে হিন্দু সাম্রাজ্যবাদের পতাকা।
আমার হৃদয় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। আমার চোখ দিয়ে তখন রক্ত ঝরাতে পারতাম। আমার দুঃখের পেয়ালা তখন কানায় কানায় পূর্ণ, যখন টের পেলাম যে জায়গাটিতে মুসলিম রাজত্বের গোড়াপত্তন, যা ইসলামি সংস্কৃতি ও সভ্যতার কেন্দ্র তা আমাদের হাত থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। বিনিময়ে আমাদের দিতে হয়েছে পশ্চিম পাঞ্জাব সিন্ধু ও বালুচিস্তানের পরিত্যক্ত মরুভূমি, যেখানে কেবল কিছু অমার্জিত ও অসভ্য লোকের বসবাস। আমাদের এমন এক দেশে যেতে হচ্ছে যেখানে লোকজন সহি উর্দু উচ্চারণ করতে পারে না। যেখানে পুরুষরা তাদের মহিলাদের মতো ব্যাগঝোলা মাল ভরার পরে, যেখানে আমরা ঘরে সুস্বাদু ও চ্যাপ্টা বিস্কুট খাই, ওরা খায় চার পাউন্ড ওজনের পুরু রুটি।
আমি নিজেকে ঠাণ্ডা করি। আমার মহান নেতা জিন্নাহ এবং আমার নতুন দেশ পাকিস্তানের জন্য এটুকু উৎসর্গতো আমাকেই করতেই হবে। সবকিছুর পরও আমাকে যে দিল্লি ছাড়তে হবে এই চিন্তাটা আমাকে বিষন্ন করে রাখলো। সন্ধ্যায় আমি যখন রুম থেকে বের হলাম, আমার শিখ প্রতিবেশী তার ছেদন দন্ত বের করে জিজ্ঞেস করল? কী ব্যাপার ভাই, উৎসব দেখতে বের হলেন না? আমার ইচ্ছে হলো তখনই তার দাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিই।
এক সকালে খবর ছড়িয়ে পড়ল দিল্লিতে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। ক্যারলবাগে মুসলমানদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। চাঁদনি চকে মুসলমানদের দোকান লুট করা হয়েছে। আর তখন এটাই হচ্ছে হিন্দু শাসনের নমুনা! আমি নিজেকেই শোনালান নয়া দিল্লিতো ইংরেজদের শহরের মতো। এখানে লর্ড মাউন্টব্যাটেন বসবাস করেন, কমান্ডার ইন চিফও থাকেন এখানে। অন্তত নয়া দিল্লিতে কেউ মুসলমানদের বিরুদ্ধে আঙুল তুলতে পারবে না।
নিজেকে এভাবে আশ্বস্ত করে আমি অফিসের দিকে রওয়ানা হলাম। আমার প্রভিডেন্ড ফান্ডের সমস্যা মেটাতে হলো। এসব সারতে সারতে আমার পাকিস্তান যাওয়া পিছিয়ে গেল। কেবল গোলে মার্কেট পর্যন্ত পৌঁছেছি, তারপর এক দৌড়ে হিন্দু কলেজে। কেউ বলল, মাথা খারাপ তোমার যাচ্ছ কোথায়? বাসা থেকে বের হয় না। দাঙ্গাবাজরা কনট সার্কাসে মুসলমানদের ধরে ধরে হত্যা করছে। আমি দ্রুত বাড়ি ফিরে আসি।
আমি কেবল আমার বাসার কাছাকাছি আসতে পেরেছি। সামনে আমার শিখ প্রতিবেশী। আমাকে আশ্বস্ত করতে শুরু করে, শেখ সাহেব দুশ্চিন্তা করবেন না। যতক্ষণ আমি জীবিত আছি, কেউ আপনার ওপর হাত তুলতে পারবে না।
আমি নিজে নিজে বললাম, ব্যাটার দাড়ির পেছনে কত প্রতারণা যে লুকিয়ে আছে। মুসলমানদের যে ধরে ধরে খুন করছে এতে তো সে খুশিই, অথচ আমার আস্থা অর্জনের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করছে; নাকি আমাকে টিটকারি মারছে?’ এই ব্লকে বসবাসকারী আমি একমাত্র মুসলমান। সম্ভবত আমি এই রাস্তারও একমাত্র মুসলমান।
এসব মানুষের দয়া কিংবা সহানুভূতির প্রয়োজন আমার নেই। আমি আমার ঘরের ভেতর ঢুকে গিয়ে নিজেকে বলি, আমাকে যদি মারতেই হয়, আমাকে ধরার আগেই তাদের দশ কিংবা বিশজনকে আমি হত্যা করব। আমি বেডরুমে ঢুকে বিছানার নিচেই রেখেছি আমার দু’নলা বন্দুক। আমার সংগ্রহে রয়েছে বেশ কিছু কার্তুজ।
আমি ঘরটা তল্লাশি করলাম, কিন্তু বন্দুকটা পেলাম না।
আমার বিশ্বস্ত ভৃত্য মোহাম্মদ জিজ্ঞেস করল, হুজুর আপনি কি খুঁজছেন?
আমার বন্দুকের কি হলো? ওটা কোথায়?
মোহাম্মদ জবাব দিলো না। কিন্তু যেভাবে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আমি বলে দিতে পারি হয় সে আমার বন্দুকটা লুকিয়ে রেখেছে, কিংবা চুরি করেছে।
ক্ষুব্ধ হয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, জবাব দিচ্ছিস না কেন?
তারপর সত্যটা বেরিয়ে এলো। আমার বন্দুকটা সে চুরি করে তার কোনো বন্ধুকে দিয়েছে। সে বন্ধু দায়রাগঞ্জের মুসলমানদের প্রতিরক্ষার জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করছে।
আমাদের শত শত বন্দুক আছে কয়েকটা মেশিন গান আছে, দশটা রিভলবার আর একটা কামান। আমরা এসব কাফেরদের জবাই করব। জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবো।
কোনো সন্দেহ নেই, আমার বন্দুক দিয়ে তুই দায়রাগঞ্জের কাফেরদের হত্যা করতে পারবি; কিন্তু আমার প্রতিরক্ষার কী হবে? এই জংলিদের মাঝখানে আমিই একমাত্র মুসলমান। এখানে আমাকে যদি হত্যা করে তার জবাব কে দেবে?
আমি তাকে চুপিচুপি দায়রাগঞ্জ গিয়ে আমার বন্দুক এবং কয়েক শ’ কার্তুজ আনতে রাজি করলাম। আবদুল্লাহ যখন বেরিয়ে গেল, আমি প্রায় নিশ্চিত তার সাথে আমার আর দেখা হচ্ছে না। আমি তখন সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ। আমার বাড়ির ফায়ারপ্লেসের উপরের তাকে একটি পারিবারিক ফটোগ্রাফ। আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা নীরবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের সাথে আমার আর কখনো দেখা হবে না ভাবতেই আমার চোখ কান্নায় ভারী হয়ে এলো। আমার পরিবারের সদস্যরা পাকিস্তানে অন্তত নিরাপদ আছে এই চিন্তা আমাকে কিছুটা সান্ত্বনা দিলো। আমি কেন তুচ্ছ প্রভিডেন্ট ফান্ডের জন্য রয়ে গেলাম? তাদের সাথে চলে গেলেই হতো। আমি তখন জনতার চিৎকার শুনলাম :
‘সাত শ্রী আকাল...’
‘হর হর মহাদেব।
চিৎকার ক্রমেই নিকট থেকে নিকটতর হচ্ছে। তাদের সবাই দাঙ্গাবাজ আমার মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে এসেছে। আমি আহত হরিণের মতো একবার এ দিক একবার ও দিক ছুটছি আর শিকারি কুকুরগুলো পুরোদমে তেড়ে আসছে। আমার পালানোর কোনো পথ নেই। ঘরের দরজা পাতলা কাঠের; তাতে কাচ লাগানো। দাঙ্গাবাজরা দরজা গুঁড়িয়ে দিয়ে ভেতরে চলে আসবে।
‘সাত শ্রী আকাল...’
‘হর হর মহাদেব।’
তারা যত নিকট থেকে নিকটতর হচ্ছে মৃত্যুও তত কাছে এগিয়ে আসছে। তখন হঠাৎ দরজায় ধাক্কা। আমার শিখ প্রতিবেশী চলে এসেছে, ‘শেখ সাহেব তাড়াতাড়ি আমার কোয়ার্টারে চলে আসুন।’ এক মুহূর্তের চিন্তা না করে আমি দ্রুত শিখের বারান্দায় এসে খাম্বার পেছনে লুকোলাম। আমার মাথার ওপর পেছনের দেয়ালে একটা গুলি লাগলো।
একটা ট্রাক চলে এলো, এক ডজন যুবক গাড়ি থেকে নামলো। তাদের দলনেতার হাতে একটি তালিকা ৮ নম্বর কোয়ার্টার : শেখ বুরহানউদ্দিন। আমার নামটা জোরে পাঠ করে তার দলকে এগোনোর নির্দেশ দিলো। তারা আমার বাড়ি আক্রমণ করল এবং আমার চোখের সামনে বাড়িটা ধ্বংস করতে এগোলো। আমার আসবাব, বাক্সপেটরা, ছবি, বই, কার্পেট, মেঝের পশমী চাদর এমনকি নোংরা পর্দা সব এনে ট্রাকে তুলল। শালারা ডাকাত! বদমাস! গলাকাটা চামার।
কিন্তু আমার প্রতিবেশী যে শিখ আমার সাথে সহানুভূতি দেখানোর যে ভান করে যাচ্ছে সেও তাদের চোখে কম বড় দস্যু নয়। এক শিখ দাঙ্গাকারীদের সাথে তর্ক জুড়ে দিয়েছে। বলছে, শোন সাহেবরা, থাম! আমাদের প্রতিবেশীর সম্পদের ওপর অগ্রাধিকার দাবি তো আমাদেরই। লুটের ভাগ আমাদের দিতে হবে।
সে তার ছেলেমেয়েদের ইশারা দিলো। সবাই ট্রাকের ওপর থেকে যে যা পারে তুলে নিয়ে এলো। একজন আনল আমার পাজামা, অন্যজন স্যুটকেস।
এমনকি আমাদের পারিবারিক ছবিটাও নিয়ে এলো। লুটের মাল এনে জড়ো করল তাদের কোয়ার্টারে।
শালার বদমাস শিখ! আল্লাহ যদি আমাকে বাঁচিয়ে রাখেন, শালা তোকে একদিন দেখে নেবো। কিন্তু এ সময় তো আমি প্রতিবাদও করতে পারছি না। দাঙ্গাকারীরা সশস্ত্র এবং আমার কাছ থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে। তারা যদি আমার উপস্থিতি টের পায়...।
‘দয়া করে ভেতরে আসুন।’
শিখের হাতে খাপ থেকে বের করা কৃপাণের ওপর আমার নজর পড়লো। আমার সম্পদ লুট করার পর দাড়িওয়ারা দানবটাকে আগের চেয়ে বেশি ভযঙ্কর মনে হচ্ছিল। কৃপাণের ঝকঝকে ধারালো অংশ আমাকে মৃত্যুর আহ্বান জানাচ্ছে। আমার সামনে কেবল দুটো পছন্দ, হয় দাঙ্গাকারীদের বন্দুকের গুলিতে মৃত্যু কিংবা শিখের ধারালো তরবারিতে।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, দশ গুণ্ডার গুলিতে মরার চেয়ে বরং বুড়ো শিখের কৃপাণের আঘাতই নেবো। আমি নীরবে ইতস্ত করে রুমে ঢুকলাম।
‘এখানে নয়, আরো ভেতরে আসুন। কসাইকে ছাগল যেভাবে অনুসরণ করে আমি শিখের পেছন পেছন ভেতরে গেলাম। শিখের কৃপাণের ঝলক চোখ প্রায় ধাঁধিয়ে দেয়।
শিখ বলল, আপনি এখানে আসুন। এই নিন আপনার জিনিসপত্র।
সে এবং তার ছেলেমেয়েরা আমার সামনে লুটের ভান করে যা যা এনেছে সবই সামনে রাখলো। বুড়ি বলল, আমি খুবই দুঃখিত বাবা, আমরা এর বেশি রাখতে পারিনি।
আমি বোবা হয়ে গেলাম।
দাঙ্গাবাজ গুণ্ডারা আমার স্টিলের আলমারি টেনে বের করে ভাঙতে চেষ্টা করল। তাদের একজন বলল, চাবিটা পেলে কাজটা সহজ হতো। অন্য জন বলল, এই আলমারির চাবি পাবে পাকিস্তানে। শালা ভিতু আর নোংরা মুসলমানের বাচ্চা চাবি নিয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে গেছে।
ছোট্ট মোহিনী জবাব দিলো, শেখ সাহেব ভিতু নন, তিনি পাকিস্তানে পালিয়ে যাননি।
তাহলে মুখ কালি করে কোথায় লুকিয়ে আছে?
মুখ কালি করে লুকিয়ে থাকবে কেন? তিনি এখন ...।
মোহিনী তার ভুল বুঝতে পারলো এবং বাক্যের মাঝপথে থেমে গেল। এ অবস্থায় তার বাবার মুখে যেন রক্ত উঠে গেল। আমাকে ভেতরের রুমে তালা মেরে, কৃপাণটা ছেলের হাতে দিয়ে বুড়ো শিখ দাঙ্গাকারীদের মোকাবেলা করতে বাইরে গেল।
বাইরে আসলে কি ঘটেছে আমি বলতে পারব না। আমি গুলির শব্দ শুনেছি, মোহিনীর কান্না শুনেছি। তারপর পাঞ্জাবি ভাষায় শিখের মুখভরা অশ্রাব্য গালাগাল। তারপর একটা গুলির শব্দ এবং শিখের আত্মচিৎকার ওহ।
ট্রাকের ইঞ্জিন চালুর শব্দ শুনলাম। তারপর এক প্রস্তুরীভূত নীরবতা।
আমাকে যখন বন্দিদশা থেকে বের করা হলো। দেখলাম শিখ চারপায়ার উপর শুয়ে, পাশে ছেঁড়া রক্তাক্ত শার্ট। নতুন শার্টও রক্তে ভেজা। তার ছেলে ডাক্তারের জন্য টেলিফোন করতে গেছে।
সর্দার জি আপনি এ কী করলেন? কেমন করে শব্দগুলো আমার মুখ থেকে বের হলো বলতে পারবো না। ঘৃণার যে জগতে আমি এতদিন বসবাস করছি। সে জগৎ আমার সামনে ধ্বংস হয়ে পড়ে আছে।
আমি তাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম সর্দারজি, আপনি এ কী করলেন?
বাবা আমার একটা ঋণ শোধ করার ব্যাপার ছিল।
কিসের ঋণ?
রাওয়ালপিন্ডিতে তোমার মতো একজন মুসলমান ছিল। সে তার জীবন দিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছে আমার পরিবারের ইজ্জত রক্ষা করেছে।
তার নাম কি সর্দারজি?
গুলাম রসুল।
নিয়তি আমার সাথে নির্মম চাতুরি করেছে। ঘড়ির কাঁটা ১... ২... ৩... ৪... ৫... করে বাজতে শুরু করেছে। শিখ ঘড়ির দিকে তাকায়। ঠোঁটে তার হাসি। শিখ আমাকে গাল ভর্তি বার ইঞ্চি সাদা দাড়ির মানুষ আমার দাদার কথা মনে করিয়ে দেয়। দুইজনের মধ্যে কী নিবিড় মিল। ৬... ৭... ৮... ৯... আমরা নীরবে গুনতে থাকি। সে আবার হাসে। তার সাদা দাড়ি ও লম্বা সাদা চুল জ্যোতিচক্রের প্রজ্বলন্ত স্বর্গীয় আলোকের মতো দেখাচ্ছে ১০... ১১... ১২... ঘড়ি থেমে গেল।
আমি যেন তাকে বলতে শুনেছি : আমাদের শিখদের তো কবেই বারোটা বেজে গেছে। মুখে দাড়ি, ঠোঁটে তখনও হাসি নীরব হয়ে গেছে। আমি জানি ততক্ষণে সে দূরের কোনো পৃথিবীতে চলে গেছে যেখানে ঘড়ির টিকটিক গণনাতে কিছুই এসে যায় না, যেখানে সহিংসতা ও ঠাট্টার এমন কোনো ক্ষমতা নেই যে তাকে আঘাত করবে।
[খাজা আহমদ আব্বাস (১৯১৪-১৯৮৭) ভারতীয় উর্দু ঔপন্যাসিক ও চলচ্চিত্রকার তার বিখ্যাত দু’টি উপন্যাস ইনকিলাব এবং ব্লাড অ্যান্ড স্টোন আত্মজীবনী আই অ্যাম নট এ্যান আইল্যান্ড তার হাতে সৃষ্টি হয়েছে স্মরণীয় কিছু ছোটগল্প। বর্তমান গল্পটি ভাষান্তরিত হয়েছে খুশবন্ত সিংহের ইংরেজি অনুবাদ থেকে। বলাই বাহুল্য খুশবন্ত সিংও একজন শিখ সর্দারজি।]
0 comments:
Post a Comment