রুহুল আমিন বাচ্চু
কথাটা স্ত্রীকে বেশ ক’বার বলেছি। মেয়েটিকে বিদেয় করে দাও। মেয়ে বলা ঠিক হবে না। আজকালতো কাজের মেয়েকে বলা হয় বুয়া। একটা সময় বাবার মা, চাচীদের ওই সম্বোধনে ডাকা হতো। একটা পবিত্র বন্ধনের চিড় ধরে শেষে কিনা কাজের মহিলা হয়ে গেল বুয়া। দাদী-নানীরা যেন এ প্রজন্মের কেউ নয়। একটা হেলাফেলা বন্ধনী
র ভেতর আড়ষ্ট হয়ে আছে সে আত্মিক বন্ধন। মেয়েটির বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। স্ত্রীর কথা এ বয়সী কাজের মহিলারা ঘরের পুরুষদের জন্য নিরাপদ। কথাটা পুরুষ অস্তিত্বে একটা তির্যক বাণ হলেও জবাবটা উহ্য থাকা বাঞ্ছনীয়। কম বয়সী মেয়েদের নিয়ে বিপদের ঘনত্ব বেশি। তা ছাড়া কাজের মেয়ে পাওয়া যেন আকজাল কত তপস্যার, বিষয়টি পুরুষের জানার কথা নয়। স্ত্রীর দুই আড়াই যুগের শহুরে বিড়ম্বনার হিসাব-নিকাশ ধর্তব্যে নেয়া যায়।
বললাম, ওর মতিগতি ভালো না। সেদিন দেখলাম কাপড় ভাঁজ করার ভান করে আলমারির চাবিটা কোথায় রেখেছ আড় চোখে আন্দাজ করে নিয়েছে।
স্ত্রীর জবাবটা জুতসই ঠেকল না। ওর আইডি কার্ডের কপি নিয়েছে, সাথে জন্মসনদ। রেফারেন্সটাও মজবুত। আগের বুয়ার পরিচিতজন। কিছু এধার ওধার করে পালাবে কোথায়? কট বিহাইন্ড করে ফেলব। ছেলেদের পাশে বসে ক্রিকেট খেলা দেখে ল্যাংগুয়েজটা ভালোই ধরেছে। ভাবলাম, এককালের ডাণ্ডি কার্ড আজ ন্যাশনাল আইডি কার্ড। বিশ পঞ্চাশ টাকায় জন্মসনদ পাওয়া যায়। তা ছাড়া এ প্রযুক্তির যুগে স্ক্যানিং করে কোনো কিছুই পাওয়া দুর্লভ নয়। সব ঠেকার কাজ সেরে যায় টাকায়।
বেশ বুঝতে পারছি উনার আরাম বেড়েছে। প্রতি মাসে দেড় কেজি মেদ বাড়ছে। ভাবলাম উচ্চতাটা বাড়াতে পারলে না হয় প্রোডাকশন হাইব্রিড হয়ে যেত। শেষাবধি গোলগাল বা নাদুশ-নুদুশ দেহখানাতো টলমলে পলিব্যাগের আকার ধারণ করবে।
দেহটা খাটুনির জন্য খোদাতায়ালা সৃষ্টি করেছেন, আর মস্তিষ্ক উদ্ভাবনের জন্য।
পাতিল মাজতে গা ঘিনঘিন, ঝুটা প্লেটে বমি আসে, সাবানের ফেনা হাত নষ্ট করে, চুলার তাপ গর্মি সর্দি এনে দেয়।
ভাবলাম মস্তিষ্কের চার দিকেও চর্বি জমছে। কালে কালে সব বোধের তারতম্যও বুঁজে যাবে। মেয়েটি কাজ করে বলেই তার ব্রেনও অলস নয়। শেষে ওর ডিজিটাল প্যাঁচে সব হারাবে। আরে আমার তো যাবে একটা মোবাইল আর না হয় দু’চার হাজার টাকা। তোমার আলমিরার লকারে যেদিন চাবি ঘুরাবে সেদিন তোমার বুক চাপড়ানো দেখার অপেক্ষায় থাকব। কথাগুলো যদিও বলা হয়নি, তবু বুকের মধ্যে উল্কি তুলে রেখেছি। ওগুলো যদিও আমার টাকায় কেনা, তবু আমার চেয়ে তোমার স্বত্ব নিশ্চয় অনেক বেশি মজবুত।
আমার সংসারে কোনো কিছুতেই তত্ত্ব নেই, সূত্র নেই। নেই কোনো আবিষ্কার, কোনো বিকাশ। চলছে সাইকেলের চাকার মতো।
এমনকি ভাষা ব্যবহারেও পরনির্ভরতা। তোমার অমুক তোমার তমুক। নিজের ছেলে-মেয়েদেরও বলে যাচ্ছ তোমার ছেলেমেয়ে। উদরে নয় মাস লালন করে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছ, বড় করেছ, কিন্তু অধিকার জন্মাতে পারনি আজো।
আড়াই যুগ তো এই করেই চালিয়ে গেলে। এতদিন তো নিজেই সব কাজ করলে। শরীর স্বাস্থ্য মন কোনটাতেই গতির আড়ষ্টতা ছিল না। মাঝে মধ্যে ছুটা কাজের লোক ছিল কিন্তু ছন্দপতন হয়নি। পাশের ফ্লাটের আপারা কাজ করে না, বুয়া সব কিছু করে দেয়। আপারা যে সাতঘণ্টা চাকরি করে আসা যাওয়ায় তিন ঘণ্টা গলদঘর্ম হয় সেটা কিন্তু তোমার মস্তিষ্কে নেই। এক চোখে দেখো বলেই ধরেছে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, বেড়েছে ক্রিয়েটিনাইন। এবার ধরবে কিডনি, তারপর!
দুপুর শেষে স্ত্রীর হাত গলিয়ে বুয়া এক গামলা ভাতের ওপর ডাল তরকারি চাপিয়ে আঁচলে ঢেকে ভো দৌড়। যেন তার ঘরে একপাল হাসের ছানা হা করে বসে আছে। মহিলাটির কাজের যত্ন-আত্তি দেখে-শুনে আবার বাড়তি কাজ বানিয়ে দ্রুত সেরে ফেলার তৎপরতা স্ত্রীকে বশীভূত করেছে। স্ত্রী নিশ্চিন্তে ওকে ঘরে রেখে একা চলে যাচ্ছে পাশের মার্কেটে। দেখছি, শুনছি আর অপেক্ষা করছি তার বুক চাপড়ানো দৃশ্যের জন্য।
ছুটির দিন বসে বই পড়ছি। স্ত্রী বেরিয়েছে শপিংয়ে। ঘরে মেয়েটি আর আমি। আধ বালতি পানিতে সেভলন ঢেলে ঘর পরিষ্কার করছে। হঠাৎ মেয়েটির ভেজা কাপড় আমার বাম পা ঘেঁষে যায়। আমি ধমকে উঠি। মেয়েটি জিবে কামড় দিয়ে মাথায় কাপড় আরেকটু সামনে টেনে বলে, সরি।
অবাক হলাম তার স্পষ্ট সরি উচ্চারণে। একটু ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম। ও মুখ সরিয়ে ফেলল।
দু’মাস ধরে আমার বাসায় কাজ করছে। এটুকু উপলব্ধি করেছি, মেয়েটির গায়ের রঙ কালো। চেহারাও তেমন ভালো নয়।
জিজ্ঞেস করলাম তোমার গ্রামের বাড়ি কোথায়?
ও মেঝে ঘষতে ঘষতে এতক্ষণে প্যাসেজে চলে গেছে। জবাবটা পেলাম না। জাগতিক অনেক বিষয়ের মধ্যে এটাও তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।
সাপ্তাহিক ছুটির দু’দিন ঘরে থাকলে এ-পাশ ও-পাশ যেতে দেখি। সারাক্ষণ ও মাথা নিচু করে কাজে ডুবে থাকে। আমার স্ত্রীও ওকে বিশ্রাম দেয় না, যতক্ষণ ঘরে ততক্ষণ ফরমাশ।
এই, একটু জানালাটা মুছে দেস্নারে। দেখেছিস পাশের ফ্ল্যাটের ধুলো যেন আর জায়গা পেল না। তুই একবার গিয়ে ভালো করে বকে দিয়ে আসবি। ওই বাসার কাজের মেয়েটা কিভাবে পাপোশ ঝেড়ে গেল দেখেছিস? জানালার গ্রিলে সটাং সটাং তিন ঘা, ধুলোগুলো যাবে কোথায়? কতবার বলেছি শোনে না। যেমন বাড়িওলা, তেমন ভাড়াটিয়া, তার চেয়ে বেশি ওই পাজি মাতারিটা।
স্ত্রীর রাগ চড়ে গেলে হাঁপাতে থাকে। একটু জিরিয়ে বলে, ঘরের ভেতর ঘর, এক বাড়ির দেয়ালের সাথে অন্য বাড়ির জানালা। আরে বাবা দু’দশ ফুট ছাড়লে কী হয়। এক ফ্ল্যাটের চুলায় তরকারি চাপালে অন্য ফ্ল্যাটের বেডরুমে তেলচিটে ছিটকে আসে।
এবার একদম সান্ত্বনা পেয়ে বলে, বাড়ি আমরাও বানাব। চার দিকে বিশ ফুট করে খালি রাখব। আলো বাতাস যাবে কোথায়। ঢুকতেই হবে আবার বেরিয়েও যাবে সাঁ সাঁ করে। একদম ফ্রেশ ওয়েদার। উহ্ কি আরাম!
পাশের রুম থেকে ওর উচ্চারণের পরশ আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করি। লেখার কারুময়তার জন্য ব্রেনের স্থিতাবস্থা দরকার। ওর স্বাগত ভাষণে খেই হারিয়ে ফেলেছি।
সারা জীবনের সঞ্চয় নিয়ে সাভারে আড়াই কাঠা জমি কিনেছি। স্ত্রীর হিসাব মতো চার দিকে বিশ ফুট করে ছাড়লে অঙ্ক আর ডায়গ্রাম কষে যা পেলাম জমির মাঝখানে একটা খাড়া দেয়াল ছাড়া কিছুই হবে না।
ওর বেহিসেবী ভাবনার গোড়ায় জল না ঢেলে নিজের কাজে মন দিলাম। তবে তার আলস মস্তিষ্কের একটা অনুর্বর ফলাফল হাতে পেলাম।
রান্না ঘরে কাপ-পিরিচ মাজা ঘষার শব্দ পেলাম। এর মধ্যে কিছু একটা ভাঙার শব্দও হলো। হাতের কলম ফেলে ছুটে গেলাম রান্নাঘরে। মেয়েটি ভাঙা কাচ কুড়াচ্ছে। স্ত্রীর উদ্দেশে বললাম কত দিন বলেছি এটাকে বাদ দিতে। কোথা না কোথা থেকে এসেছে? কখন কী সর্বনাশ করে।
রান্নাঘরে মেয়েটির মুখোমুখি হলাম। ওর ড্যাব ড্যাবে চোখের দৃষ্টিতে একটা ধাক্কা খেলাম। মেয়েটি স্পষ্ট উচ্চারণে বলল, সরি দামটা কেটে নিবেন। ম্যাডাম মার্কেটে গেছেন। আমাকে বললেন, আপনার গোসল হলে টেবিলে ভাত দিতে।
আমাকে বাথরুমে রেখে তিনি গেছেন শপিংয়ে। মনের মধ্যে জেদ চেপে গেল, বললাম, না, খাবো না।
আমি কাল চলে যাবো।
ওর কথায় ভাবান্তর হলো না।
ফিরে এলাম লেখার টেবিলে। মনের মধ্যে কিছু একটা বারবার ঠোক্কর মেরে যাচ্ছে। উঠে গিয়ে খাবার টেবিলে বসলাম।
মেয়েটা রান্নাঘরের ফ্লোর ঘষে পরিষ্কার করছে। বললাম, তোমার বাড়ি কোথায়?
ভেতর থেকে স্পষ্ট একটা শব্দ এলো চিনবেন আমাকে। আপনাকে আমি প্রথম দিনেই চিনেছি। যদিও চল্লিশ বছর আগের দেখা, তবুও। আপনিও পালপাড়া স্কুলে পড়তেন, আমিও। ক্লাসে প্রথম ছিলাম বরাবর, খুব হিংসে করতেন আপনিও।
একবার রচনা প্রতিযোগিতায় প্রথম হলে আপনি একটা মাটির ঢিল ছুড়েছিলেন আমার গায়ে।
ডাইনিং চেয়ার ছেড়ে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়ালাম।
ও বলল, আপনি ওখানেই থাকুন। গায়ের রঙ কালো, চেহারা ভীষণ রকমের বাজে। তাই বিয়ে আমার হলো না। বান্ধবীরা স্বামীর ঘরে চলে গেল কলেজের প্রথম বর্ষে। লেখাপড়া হলো না আর্থিক অনটনে। বাবা মারা গেলেন।
বিয়ে হলো শেষাবধি এক অশিক্ষিত লোকের সাথে। এগারো বছরের শিক্ষা জীবনে যে মেয়েটি কোথাও কোনো কিছুতেই দ্বিতীয় হয়নি, সে মেয়েটি হলো অবরুদ্ধ। স্বামীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে শেষে ওকে খুন করলাম। বিশ বছরের সাজা চৌদ্দ বছর খেটে ওরা আমাকে বের করে দিলো। আমিও ছাড় চাইনি। কার কাছে যাবো? আমি যে খুনি। আমার মেয়ে দুটি ও কান্না থামাতে পারেনি। ওরাও যে কালো, বিশ্রী আমারই মতো। কোথায় আছে কেমন আছে জানি না। কী হবে ওদের! ওদের ভাগ্য কি আমারই মতো! না করিনি, আত্মহত্যাও করিনি। আমি দেখতে চাই আমার এককালের শাণিত বিদ্যা আমাকে কতটুকু কাটাকুটি করতে পারে, ছিড়তে পারে, ভাঙতে পারে। কলিং বেলের শব্দ শুনে ও চোখ মুছে এগিয়ে এলো। আমি ঝটপট একটা প্লেট নিয়ে খাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকি।
পর দিন অফিসে স্ত্রীর ফোন পেলাম, আজ কাজের বুয়া আসেনি। একটা চিরকূট রেখে গেছে। ও আর আসবে না। বললাম, কী করছ? ও হতাশ হয়ে বলল, এটা ওটা নিয়ে গেল কিনা দেখছি। তুমি জলদি এসো। মনে হয় কিছু একটা, না না, অনেক কিছু খোয়া গেছে। টেলিফোন ছেড়ে দিলাম। অনেক ভাবনার নেপথ্যে চল্লিশ বছর আগের দু’টি চোখের দৃষ্টি আমার হৃদয়তন্ত্রীতে ঘা মেরে চলছে। কোনো দিন আমি প্রথম হতে পারিনি।
0 comments:
Post a Comment