মুহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান
পুরো নাম ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। নিজ দেশে লৌহমানব হিসেবে পরিচিত। পরিপক্ব কুস্তিগীর হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন এক কূটনীতিক। গণমাধ্যমসহ রাশিয়ার পুরো প্রশাসন তার নিয়ন্ত্রণে। চেষ্টা করছেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন পুনরুদ্ধারে। দুই সপ্তাহে কিয়েভ দখলের
দম্ভোক্তি দেখিয়েছেন পুতিন। কিন্তু এই পুতিনকে শ্রেণিকক্ষের পেছনের বেঞ্চের বিষন্ন বালক বলে মন্তব্য করেছেন বারাক ওবামা।
আর হিলারি বলেছেন, পুতিন পাতলা চামড়ার শক্ত নেতা। কেউ কেউ তুলনা করেছেন হিটলারের সাথে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যাবোট পুতিনকে হটাতে ‘শার্টফ্রন্ট’ কৌশল নেয়ার ঘোষণা দেন।
রাশিয়ার তৃতীয় মেয়াদের রাষ্ট্রপতি পুতিন
১৯৫২ সালের ৭ অক্টোবর এক শ্রমিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন পুতিন। বাল্যকাল থেকেই খেলাধুলা করতে ও গুপ্তচরদের নিয়ে সিনেমা দেখতে ভালোবাসতেন।
রুশ প্রজাতন্ত্র বা রাশিয়ার অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তিনি। ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পুতিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে রুশ প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বরিস ইয়েলৎসিন আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করার প্রেক্ষাপটেই তার এই দায়িত্বভার গ্রহণ।
২০০০ সালের ২৬ মার্চ তিনি রাশিয়ান ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২০০৪ সালের ১৫ মার্চ তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
কিন্তু সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতাজনিত কারণে পুতিন ধারাবাহিকভাবে তৃতীয় মেয়াদের জন্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি।
পরে ২০০৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তার উত্তরসূরি হিসেবে দিমিত্রি মেদভেদেভ জয়লাভ করেন। এতে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেয়ার মাত্র দুই ঘণ্টার মাথায় মেদভেদেভ রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভ্লাদিমির পুতিনকে মনোনীত করেন।
পরে ২০০৮ সালের ৮ মে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দাফতরিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন পুতিন।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে পুতিন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন যে, তিনি তৃতীয় মেয়াদের জন্য নতুন করে ২০১২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
২০১২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি তৃতীয় মেয়াদে জয়লাভ করেন। তার এ মেয়াদকাল ছয় বছর।
পুতিন যখন হারকিউলিস!
গ্রিক পুরাণে জিউসের পুত্র হারকিউলিসকে ১২টি মারাত্মক কঠিন এবং অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছিল। কিন্তু হারকিউলিসের নিয়ামীয় সিংহ বধ করা কিংবা বহু মাথাবিশিষ্ট লারনীয় হাইড্রার সাথে লড়াই করার জায়গায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনকে দেখা যায় এ যুগের হারকিউলিস রূপে। ২০১৪ সালের ৭ অক্টোবর ৬২ বছরে পা দেন পুতিন। পুতিনের জন্মদিনকে ঘিরে মস্কোতে আয়োজিত এক চিত্রপ্রদর্শনীতে এভাবেই পুতিনকে তুলে ধরা হয় জন্মদিনের আগের রাতে।
ফেসবুকে পুতিনের একটা ফ্যানক্লাব এই চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করে। এ প্রদর্শনীর ১২টি ছবি আঁকা হয়েছে গ্রিক পুরাণে হারকিউলিসের ‘১২ কর্মের’ অনুসরণে। রাশিয়া এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাম্প্রতিক সময়ের নানান জটিল পরিস্থিতি এবং সেসব ক্ষেত্রে পুতিনের ‘অর্জন ও কৃতিত্ব’কে তুলে ধরা হয় ওই ১২টি চিত্রকর্মে।
লেখাপড়া আইন বিষয়ে আর চাকরি গোয়েন্দা সংস্থায়
ভ্লাদিমির পুতিন ১৯৭৫ সালে লেনিনগ্রাদ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের আন্তর্জাতিক শাখা থেকে উত্তীর্ণ হন। তাকে সেই সময়ের নিয়ম মেনে দেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিভাগে কাজ করতে পাঠানো হয়।
১৯৮৪ সালে তিনি মস্কো শহরের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পরিষদের উচ্চ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হন ও জার্মান ভাষায় দক্ষ হয়ে এই ভাষার দেশগুলোতে কাজের জন্য বিশেষভাবে তৈরি হন।
১৯৮৫ সালে তাকে তৎকালীন পূর্ব জার্মানিতে পাঠানো হয়। যেখানে তিনি ১৯৮৯ সালের শেষ পর্যন্ত ড্রেসডেন শহরের সোভিয়েত জার্মান মৈত্রী ভবনের ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেন।
সেন্ট পিটার্সবার্গ ফিরে আসার পর তিনি শহরের বিধানসভার সভাপতি আনাতোলি সবচাকের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অবস্থা থেকেই তাকে চিনতেন পুতিন। ১৯৯৪ সালে পুতিন সেন্ট পিটার্সবার্গের প্রশাসনের প্রধানের প্রথম ডেপুটি হিসেবে কাজ শুরু করেন। এই পদে তিনি এলাকায় বিনিয়োগ, বিদেশী কোম্পানিগুলোর সাথে সহযোগিতা ও যৌথ উদ্যোগ তৈরিসংক্রান্ত প্রশ্নাবলি বিষয়ে দায়িত্ব নেন।
১৯৯২ সালে তিনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পরিষদ থেকে অবসর নেন। সেই সময়ে তিনি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল। ১৯৯৬ সালে মস্কো আসার পর তিনি রাশিয়ার রাষ্ট্রপতির কার্যভার নিরসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত পাভেল বরোদিনের ডেপুটি হিসেবে কাজ নেন। পরে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতির প্রধান নিয়ন্ত্রণ বিভাগের কর্তা হিসেবে আলেক্সেই কুদরিনের জায়গায় কাজ নেন।
১৯৯৮ সালে তাকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পরিষেবার ডিরেক্টর পদ দেয়া হয়। আর ১৯৯৯ সালের মার্চ মাস থেকে রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের সচিব নিযুক্ত করা হয়। ১৯৯৯ সালের আগস্ট মাসে তিনি মন্ত্রিসভার সভাপতি হন।
১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি বরিস ইয়েলৎসিনের পক্ষ থেকে সময়ের আগেই নিজের ওপর থেকে দায়িত্বভার প্রত্যাবর্তনের পর তিনি কার্যকরভাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
রাশিয়ায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনেন
পুতিন তার সময়কালে রাশিয়ায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এনেছেন। এ ছাড়াও তিনি রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন চেচনিয়ায় দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধের মাধ্যমে অঙ্গরাজ্যগুলোর অখণ্ডতা বজায় রাখতে সক্ষম হন। পুতিনের রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন রাশিয়ায় জিডিপি ৭২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। দারিদ্র্য কমপক্ষে ৫০ শতাংশ কমে যায়। গড় মাসিক বেতন ৮০ ডলার থেকে ৬৪০ ডলারে বৃদ্ধি পায়।
প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় পুতিন লভ্যাংশের ওপর কর হ্রাসসহ ১৩ শতাংশ হারে আয়কর ধার্যের বিষয়ে আইন পাস করেন। জ্বালানি নীতি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করার ফলে রাশিয়া জ্বালানি খাতে বৃহৎ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
বৃহৎ জ্বালানি প্রকল্প হিসেবে রাশিয়ার আণবিক শক্তিতে নবজাগরণের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়াও অনেকগুলো বৃহৎ রফতানিসহায়ক পাইপলাইনের মাধ্যমে পরিবহন ব্যবস্থার অবকাঠামো নির্মাণেরও সূচনা হয়। এর মধ্যে ইস্টার্ন সাইবেরিয়া-প্যাসিফিক ওশেন অয়েল পাইপলাইন বা এসপো এবং নর্ড স্ট্রিম প্রকল্প অন্যতম।
ইংরেজি ভাষায় দুর্বল
রুশভাষী হিসেবে ভ্লাদিমির পুতিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে জার্মান ভাষায়ও কথা বলতে পারেন। বাড়িতে তিনি ও তার পরিবার জার্মান ভাষায় কথা বলেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর জানা যায়, তিনি ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাগ্রহণ করছেন।
তাকে অনানুষ্ঠানিকভাবে সরাসরি বুশ ও ইংরেজভাষীদের সাথে ইংরেজিতে কথা বলতে দেখা যায়। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে আলাপ-আলোচনার সময় তিনি এখনো অনুবাদকের সহায়তা নেন।
পুতিনকে প্রকাশ্যে ইংরেজিতে প্রথমবারের মতো কথা বলতে দেখা যায় ২০০৩ সালে।
তখন তিনি বাকিংহাম প্যালেসে ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মা এলিজাবেথ বোজ-লিওনের মৃত্যুতে ইংরেজিতে অল্প কিছু শব্দ প্রয়োগ করেন।
তিনি সোচিতে অনুষ্ঠিতব্য ২০১৪ সালের শীতকালীন অলিম্পিকের নিলাম ডাকের অনুষ্ঠানে খুবই স্পষ্ট ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইংরেজি ভাষা প্রয়োগ করেন। গুয়াতেমালা সিটিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির অধিবেশনে তার এ ভূমিকা সবাইকে আকৃষ্ট ও চমৎকৃত করেছিল।
পুতিনের কিছু অজানা কাহিনী
১৯৯৯ সাল থেকে রুশ রাজনীতিতে এই নামটি উচ্চারিত হয়ে আসছে। তবে গত পাঁচ বছরে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক উচ্চারিত হয়ে আসছে পুতিনের নাম। সিরিয়া-ইরান নিয়ে মার্কিন রাজনীতির বিপরীতে রাশিয়ার সক্রিয় তৎপরতা এবং সম্প্রতি ইউক্রেন থেকে ক্রিমিয়ার আলাদা হওয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বরাজনীতিতে পুতিনের অবস্থান শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এসবই জানা কথা। কিন্তু রুশ এই নেতার আরো অনেক একান্ত কাহিনী আছে যা অনেকেই জানে না। এমনই কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হলো এখানে।
ছোটবেলায় ইঁদুর মারতেন পুতিন : যে ভবন থেকে রাশিয়ার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত হয় সেই সেন্ট পিটার্সবার্গ এলাকাতেই এক সময় পুতিনের শৈশব কেটেছিল। রিচার্ড সাকভা তার ‘পুতিন : রাশিয়ান চয়েস’ নামের বইতে দাবি করেছেন, সেন্ট পিটার্সবার্গের সেই সব ভবনের সিঁড়িতে দৌড়াদৌড়ি করে এক সময় ইঁদুর মারতেন পুতিন।
শেফের কাজ করতেন পুতিনের দাদা : বিশ্বের দ্বিতীয় পরাশক্তি রাশিয়া। কিন্তু এর পেছনে যাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে তাদের প্রধান পথিকৃৎ হলেন ভøাদিমির ইলিচ লেনিন। সেই মহান লেনিনের বাড়িতে দীর্ঘ দিন শেফের কাজ করতেন পুতিনের দাদা। পরে যখন স্টালিন রাশিয়ার ক্ষমতায় আসেন তখন তারও রান্নার কাজ করতেন তিনি।
জুডোতে ব্ল্যাক বেল্ট অর্জন করেন পুতিন : নিয়মিত ব্যায়াম করে শরীরের ফিটনেস রক্ষা করেন সাবেক সেনাকর্মকর্তা পুতিন। কারণ তিনি যে জুডো ও কারাতের কৌশল জানা একজন দক্ষ পুরুষ। আঠারো বছর বয়সেই পুতিন জুডোতে ব্ল্যাক বেল্ট অর্জন করেন। এখনো তিনি প্রায় প্রতিদিন মার্শাল আর্ট অনুশীলন করেন। ২০০৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর, সেন্ট পিটার্সবার্গে জুডো প্র্যাকটিস করছেন।
পুতিন বেশি পড়তেন গোয়েন্দা কাহিনী : অবসর পেলেই বই পড়েন পুতিন। তবে গোয়েন্দা কাহিনী পড়তে বেশি পছন্দ করেন। এ সম্পর্কে পুতিনের বিখ্যাত একটি উক্তিও আছেÑ ‘আমাকে সবচেয়ে বেশি বিস্মিত ও মুগ্ধ করে ওই বিষয়টি, যখন কোনো একটি কাজ পুরো সেনাবাহিনী মিলে করতে পারে না, অথচ সেই কাজই করে ফেলে গুটি কয়েকজন ব্যক্তি।’
সফরসঙ্গী কুকুর : রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে প্রতিদিনই কোনো না কোনো আলোচনা সভা, বৈঠক ও কনফারেন্সে যান পুতিন। যেখানেই যান তবে সাথে তার দেহরক্ষী থাকলেও একজন সঙ্গী কিন্তু থাকবেই। আর সেই সঙ্গী হলো তার প্রিয় পোষা কুকুর কনি।
পুতিনের সবচেয়ে গোপন দুনিয়া ছিল দুই কন্যার জীবন : পুতিনের সবচেয়ে গোপন দুনিয়া ছিল তার দুই কন্যা মারিয়া ও ইয়াকেতেরিনার জীবন। কন্যাদ্বয়ের পড়ালেখা, ঘোরাফেরা সবই ছিল খুবই গোপন ও অত্যন্ত সুরক্ষিত। কলেজে ছদ্মনামে তারা পরিচিত ছিল। এমনকি বসবাসের ঠিকানা ছিল একেবারে অজ্ঞাত। তবে স্ত্রীকে ডিভোর্স দেয়ার পর পুতিনের এই গোপন জগৎ ভেঙে পড়ে।
৩০ বছর সংসার করার পর বিচ্ছেদ
ত্রিশ বছর সংসার করার পর আলাদা হয়ে যান ভ্লাদিমির পুতিন ও তার দীর্ঘ দিনের সঙ্গী লুদমিলা। কেন এই বিচ্ছেদ তা নিয়ে আছে নানা জল্পনা-কল্পনা।
প্রেসিডেন্ট পুতিন স্ত্রী লুদমিলার সাথে বিচ্ছেদ প্রসঙ্গে ২০১৩ সালের জুনে বলেছিলেন, ‘এটা আমাদের যৌথ সিদ্ধান্ত’। এরপর লুদমিলা বলেছিলেন, ‘আমাদের বিচ্ছেদ হচ্ছে। কারণ আমরা প্রায় কখনোই কেউ কাউকে বুঝিনি।’ লুদমিলা তাদের আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্তকে ‘মার্জিত বিচ্ছেদ’ বলে আখ্যা দেন।
ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ শক্ত করছেন
পুতিন তার ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ আরো শক্ত করছেন। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যবসায়ী মিখাইল খোদোরকোভস্কির মুক্তি, ইউক্রেনকে দেড় হাজার কোটি ডলার ঋণ প্রদান, আরআইএ-নভোস্তি সংবাদ সংস্থা পুনর্গঠনের ঘোষণা সেই কার্যক্রমেরই অংশ।
চরমভাবে অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে পড়া ইউরোপীয় দেশ ইউক্রেনকে দেড় হাজার কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন পুতিন। এর মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কৌশলকে পরাস্ত করতেও সক্ষম হন তিনি। ইইউর প্রস্তাবিত সহায়তা প্যাকেজ গ্রহণ না করে মস্কোর সহায়তা নিতে ইউক্রেনকে রাজি করানো পুতিনের কূটনৈতিক বড় সাফল্যই বলা যায়।
ওই ডিসেম্বরেই পুতিনের নির্দেশনায় রাশিয়ার পার্লামেন্টে সাধারণ ক্ষমাসংক্রান্ত একটি বিল পাস হয়। যার আওতায় হাজার হাজার বন্দী মুক্তি পায়। এরপর ব্যবসায়ী খোদোরকোভস্কিকে ক্ষমা করে দিয়ে তাকে মুক্তি দেন পুতিন। এই খোদোরকোভস্কি প্রেসিডেন্ট পুতিনের কঠোর সমালোচক ছিলেন।
একই মাসের শুরুর দিকে আধা স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আরআইএ-নভোস্তি পুনর্গঠন করার বিষয়ে পুতিনের ঘোষণা মস্কোর রাজনীতিক ও গণমাধ্যম-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিস্মিত করে।
রুশ প্রেসিডেন্টের এসব কার্যক্রম শুধু তার নির্বাহী ক্ষমতাগুলো একক কর্তৃত্বে করার সামর্থ্যরে ইঙ্গিত দেয় না বরং আইনি ও বিচার বিভাগে সরকারের ইচ্ছা বাস্তবায়ন এবং রাশিয়ার গণমাধ্যমে সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ইচ্ছার ইঙ্গিত দেয়।
রাশিয়ার সরকার-নিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন স্টেশন চ্যানেল ওয়ানের একটি অনুষ্ঠানে টিভি সাংবাদিক ভ্লাদিমির পোসনার বলেন, ‘আমরা কী দেখছি? দেখছি, প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার কোনো সীমাবদ্ধতা নেই, ক্ষমতার ভারসাম্য বলতে কিছু নেই। ফোর্থ স্টেট (গণমাধ্যম) বলে কিছু নেই, এমনকি থার্ড স্টেট বা সেকেন্ড স্টেট বলেও কিছু নেই। আছে শুধু ফার্স্ট স্টেট, তা হলো প্রেসিডেন্সি।’
সংবাদমাধ্যমের ওপর কঠোর
রাশিয়ার প্রধান রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা রিয়া নভোস্তি বিলুপ্ত করেন পুতিন। এর মধ্য দিয়ে সংবাদমাধ্যমের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ আরো দৃঢ় করেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, রিয়া নভোস্তিকে বেশি উদারপন্থী বিবেচনা করেই পুতিন তা বিলুপ্ত করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। পরে আরো রক্ষণশীল একজন সম্পাদকের অধীনে রসিয়া সেগোদনিয়া (রাশিয়া টুডে) নামের একটি নতুন বার্তা সংস্থা চালু করা হয়।
প্রেসিডেন্টের প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা সার্গেই ইভানভ বলেন, ব্যয়সঙ্কোচন ও রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের মানোন্নয়নের লক্ষ্যে এই পরিবর্তন আনা হয়েছে।
রাশিয়ার বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যম ইতোমধ্যে পুতিনের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েই কাজ করছে। সংবাদমাধ্যমে বিরোধীদের সংবাদ প্রচারের খুব কম সময় দেয়া হচ্ছে। নতুন বার্তা সংস্থাটির প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান রক্ষণশীল সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে পরিচিত দিমিত্রি কিসেলিওভ।
বৃহত্তর রাশিয়া গড়ার পথে পুতিন
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বেশ কিছু বিষয়ে চ্যালেঞ্জে গেছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। বিশেষ করে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) সাবেক চুক্তিভিত্তিক কর্মী এডওয়ার্ড স্নোডেনকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে সরাসরি ওয়াশিংটনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। আর সিরিয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়ে একটি যুদ্ধ ঠেকিয়ে দেন। মূলত মস্কোর কারণেই প্রায় সামরিক অভিযানকে আপাতত পাশ কাটিয়ে সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংসের পরিকল্পনায় রাজি হতে হয়েছে ওয়াশিংটনকে। পুতিনের সমর্থকেরা বলছেন, বৃহত্তর রাশিয়া গড়ার পথে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। শচি অলিম্পিকের সফল আয়োজন তার একটি বড় প্রমাণ।
ইউরোপের সীমানা বদলাতে চান
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপের সীমানা আবার নির্ধারণ করতে চান বলে অভিযোগ রয়েছে পুতিনের বিরুদ্ধে।
২০১৪ সালের ১৮ মার্চ কানাডার মনট্রিলে এক সম্মেলনে এ কথা মার্কিন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এ অভিযোগ করেন। বোর্ড অব ট্রেড অব মেট্রোপলিটান মনট্রিল এ সম্মেলনের আয়োজন করে।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার সাথে যুক্ত করার লক্ষ্যে একটি বিলে সই করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। গণভোটে ক্রিমিয়ার অধিবাসীরা বিপুল ভোটে রাশিয়ায় যোগ দেয়ার পক্ষে রায় দেয়ার পরদিন এ বিলে সই করেন তিনি। এরপরই পুতিনের বিরুদ্ধে ইউরোপের সীমানা নতুন করে লিখতে চাওয়ার অভিযোগ আনেন হিলারি।
ক্রিমিয়া নিয়ে রাশিয়ার ভূমিকা প্রসঙ্গে ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক দলের সম্ভাব্য প্রার্থী হিলারি বলেন, ‘পুতিনের এই পদক্ষেপের লক্ষ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপের সীমানা নতুন করে লেখা। আরেকটি স্নায়ুযুদ্ধ বাধবে না বলেই আমার আশা। নিশ্চয়ই কেউ তা দেখতে চান না। এখন এটা পুতিনের ওপর নির্ভর করছে।’
বহুমেরুর বিশ্ব চান
রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ও আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিনা কির্চনার ২০১৪ সালের ১২ জুলাই শনিবার বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বের আহ্বান জানান। পাশাপাশি পূর্ব-পশ্চিম উত্তেজনা প্রশমন ও লাতিন আমেরিকার সাথে সম্পর্কোন্নয়নের তাগিদ দেয় মস্কো।
বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়, লাতিন আমেরিকায় ছয় দিনের সফরের অংশ হিসেবে পুতিন শনিবার (১২ জুলাই ২০১৪) আর্জেন্টিনায় যান। সেখানে তার সম্মানে কির্চনারের দেয়া এক নৈশভোজে রুশ প্রেসিডেন্ট এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা মনেপ্রাণে বহুমেরুর বিশ্ব চাই, যেখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না।’
আর্জেন্টিনা থেকে পুতিন ব্রাজিল যান। সেখানে তিনি ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে গঠিত বিআরআইসিএস সম্মেলনে যোগ দেন।
রাশিয়ার সাথে লাগতে এসো না
গত বছরের আগস্টে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পারমাণবিক শক্তিধর রাশিয়ার সামরিক বাহিনী যেকোনো ধরনের আগ্রাসন রুখতে প্রস্তুত। বিভিন্ন দেশকে এটা বুঝতে হবে যে, রাশিয়ার সাথে লাগতে যাওয়া ঠিক হবে না। ‘লৌহমানব’ হিসেবে পরিচিত রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন করেছেন এ মন্তব্য।
প্রেসিডেন্ট পুতিন ২০১৪ সালের ২৯ আগস্ট শুক্রবার রাজধানী মস্কোর কাছের সেলিগার হ্রদের তীরে ক্রেমলিনপন্থী একটি যুব সম্মেলনে ভাষণ দেন। এ সময় তিনি বলেন, গত মার্চ মাসে ইউক্রেনের স্বায়ত্তশাসিত এলাকা ক্রিমিয়াকে নিজেদের অংশ করে নেয়ার দরকার ছিল রাশিয়ার। ইউক্রেন সরকারের সহিংসতার হাত থেকে সেখানকার রুশ ভাষাভাষী মানুষকে রক্ষার স্বার্থেই সেটার দরকার ছিল।
পূর্ব ইউক্রেনে অব্যাহত সহিংসতার জন্য আলোচনায় বসার ক্ষেত্রে কিয়েভের ‘আন্তরিকতার অভাবকে’ দায়ী করেন পুতিন। তিনি বলেন, ‘যেকোনো আগ্রাসন রুখতে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে, সেটাই স্বাভাবিক। রাশিয়ার সহযোগীদের...বুঝতে হবে যে, আমাদের সাথে লাগতে না যাওয়াই সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত।’
পুতিন বলেন, ‘আমি আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে, রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র।’
আসেম শীর্ষ সম্মেলনে আলোচনার কেন্দ্রে
গত বছরের ১৫ ও ১৬ অক্টোবর বুধ ও বৃহস্পতিবার দুই দিনের এশিয়া-ইউরোপ মিটিং বা আসেম শীর্ষ সম্মেলনে আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রাশিয়ার টানাপড়েনের মধ্যে এ সম্মেলন শুরু হয়।
এএফপির খবরে বলা হয়, বিশ্বের ৫০টির বেশি দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্ক জোরদার করা আসেম সম্মেলনের মূল লক্ষ্য।
আসেমের এই সম্মেলনের আলোচ্যসূচির সামনে চলে আসে ইউক্রেন সঙ্কটসহ বড় ধরনের কিছু সমস্যা। ইউরোপের অর্থনৈতিক সঙ্কট এর একটি। কেননা সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপ তার অর্থনৈতিক মন্দা যেভাবে কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছিল, তা আবারো থমকে গেছে। আরেকটি সমস্যা চীনকে নিয়ে। বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির শীর্ষ চালিকাশক্তি হয়ে ওঠা দেশটির অর্থনীতিও যেন তার গতি হারাচ্ছে।
এসব সমস্যার মধ্যে সম্মেলনে অনেকটাই মনোযোগ পায় পুতিন-পোরোশেঙ্কোর বৈঠক। এ বৈঠকের পরিবেশ আন্তরিক রাখার চেষ্টাতে ওই সপ্তাহের শুরুতে পুতিন রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র ওই ঘোষণাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও পুতিনকে স্মরণ করিয়ে তারা বলে, ইউক্রেনে ‘হস্তক্ষেপ’ পুরোপুরি বন্ধ না করা পর্যন্ত মস্কোর ওপর থেকে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠবে না।
সম্মেলনের আন্তরিকতার সুরে প্রথম দিনই এক দফা ভাটা পড়ে। সেদিন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে তীর্যক ভাষায় আক্রমণ করেন। রাশিয়ার প্রতি ওবামা বৈরী মনোভাব পোষণ করেন এ অভিযোগ তুলে পুতিন ওই দিন মস্কোকে ‘ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টার’ বিষয়ে হুঁশিয়ার করে দেন যুক্তরাষ্ট্রকে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পুতিন তার দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর অভিযোগও করেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে সঙ্কট উসকে দিয়ে দায় রাশিয়ার ওপর চাপিয়েছে। ওয়াশিংটন যদি মস্কোর স্বার্থকে প্রকৃতই বিবেচনা করে তাহলে মস্কো ওয়াশিংটনের সাথে সম্পর্ক মেরামতে প্রস্তুত।
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক চান
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক চান পুতিন। গত বছর জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সে দেশের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে এক বিবৃতিতে পুতিন এ কথা বলেন।
ইউক্রেন ও সিরিয়া সঙ্কট নিয়ে স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে বেশ তিক্ততার পর্যায়ে পৌঁছেছে। পুতিন আশা করেন, বিরোধ ও মতভেদ থাকা সত্ত্বেও বিশ্বাস এবং সমতার ওপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বন্ধন আরো সুদৃঢ় হবে। আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা বিধানে এ দু’টি দেশ ব্যতিক্রমী ভূমিকা পালন করছে। তাই শুধু নিজেদের স্বার্থের কথা না ভেবে সারা পৃথিবীর কথা ভাবতে হবে এ দু’টি দেশকে।
ক্ষমতাধর তালিকার শীর্ষে
ফোর্বস ম্যাগাজিনের জরিপে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে টপকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে নির্বাচিত হন পুতিন। ২০১৩ সালেও ক্ষমতাশালীর তালিকায় এক নম্বরে ছিলেন পুতিন। তার পরের অবস্থানেই রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
২০১৪ সালের তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে রয়েছেন যথাক্রমে ভ্যাটিকানের পোপ ফ্রান্সিস এবং জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা ম্যার্কেল। ধনকুবের বিল গেটস রয়েছেন সাত নম্বরে। ১০ ও ১১ নম্বরে রয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ও সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ। তালিকায় ১৫ নম্বরে রয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ১৯ নম্বরে স্থান পেয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলী হোসাইনি খোমেনি।
কেন ক্রিমিয়া দখল
যেমনটি চেয়েছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ঠিক তা-ই হয়েছে। অবশেষে ক্রিমিয়া অন্তর্ভুক্ত হয়েছে রুশ ফেডারেশনে। পশ্চিমা দেশগুলোর হুমকিধমকি থামাতে পারেনি পুতিনকে। রাশিয়ার প্রত্যক্ষ মদদে অনুষ্ঠিত গণভোটে ক্রিমিয়ার প্রায় ৯৭ শতাংশ মানুষ রাশিয়ার সাথে যুক্ত হওয়ার পক্ষে রায় দেয়।
প্রশ্ন হচ্ছে কেন পুতিন ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন? পুতিন যেমনটি বলেছিলেন, ক্রিমিয়ার রুশভাষী জনগণকে রক্ষার জন্য তিনি এমন পদক্ষেপ নিচ্ছেন। কিন্তু আসলেই কি তা-ই? রুশ শাসকেরা যেখানে নিজেদের জনগণকে নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামান না, সেখানে হঠাৎ ক্রিমিয়ায় থাকা আত্মীয়স্বজনের জন্য পুতিনের হঠাৎ দরদ উথলে ওঠাটা একটু অস্বাভাবিক নয় কি? ক্রিমিয়ায় রুশভাষী জনগণ মোটেও খারাপ অবস্থায় নেই বা কখনো ছিলও না। তারা সেখানে প্রথম শ্রেণীর নাগরিক। ক্রিমিয়ার সরকারি ভাষা হচ্ছে রুশ। কাজেই এটা পরিষ্কার যে, ক্রিমিয়া দখলের পেছনে সেখানকার রুশভাষীর জনগণের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি কাজ করছে না।
রাশিয়ার ইতিহাসবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আন্দ্রে জুবভ পুতিনের ক্রিমিয়া দখলের পেছনে কয়েকটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, ইউক্রেনে রয়েছে গ্যাস ও তেলের বিশাল ভাণ্ডার। ক্রিমিয়া রাশিয়ার সাথে যুক্ত হলে স্বাভাবিকভাবে এই গ্যাস ও তেলের ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হবে। ফলে দেশটি আরো তেল ও গ্যাস রফতানি করতে পারবে।
দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, ইউক্রেনের সরকারবিরোধী বিক্ষোভে মস্কোর শাসকেরা সম্ভবত ভয় পেয়েছেন। ইউক্রেনের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের পরিণতি তাদের আতঙ্কিত করে তোলে। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলার সময় বিক্ষোভকারীরা সোভিয়েত নেতা ভøাদিমির লেনিন, কিরভ ও দেরঝিনস্কির ভাস্কর্য ভেঙে ফেলেন। প্রবল কমিউনিস্টবিরোধী এই মনোভাবও রুশ শাসকদের ভয় পাইয়ে দেয়। তাদের মনে এই আশঙ্কা সৃষ্টি হয় যে, এই একই ধরনের বিক্ষোভ রাশিয়াতেও হতে পারে। সে কারণেই ক্রিমিয়া দখল। এর মধ্য দিয়ে পুতিন নিজ দেশের ভেতরে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে কোণঠাসা করতে পেরেছেন। সেই সাথে বেড়েছে তার জনপ্রিয়তা।
পুতিনের ক্রিমিয়া দখলের আরেকটি কারণ হতে পারে তার সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব। এক সময় ক্রিমিয়া রাশিয়ারই অংশ ছিল। আঠারো শতকের শেষে ক্রিমিয়া রাশিয়ার দখলে আসে। ৬০ বছর আগে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট নিকিতা খরুশ্চভ ইউক্রেনকে দিয়ে দেন। পুতিনের মতে, খরুশ্চভের ওই সিদ্ধান্ত ছিল ‘ঐতিহাসিক ভুল’। তাই সুযোগ পেয়ে এত দিন পর তিনি ক্রিমিয়াকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন।
তবে কারণ যা-ই হোক না কেন, পুতিনের এই উদ্যোগ সারা বিশ্ব থেকে রাশিয়াকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন করেছে। ক্রিমিয়া দখলের মাধ্যমে পুতিন গোটা ইউক্রেন দখলের পাঁয়তারা করছেন, এমনটাও মনে করছেন অনেকে। তবে পুতিন আসলে কতটুকু অগ্রসর হবেন, সেটা এখন দেখার অপেক্ষা।
আরো দেশ ‘জয়’ করতে চান
ক্রিমিয়ায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং ইউক্রেইন সীমান্তে প্রায় ৪০ হাজার সেনা মোতায়েন করে পশ্চিমা বিশ্বকে উদ্বিগ্ন করে তোলা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন আরো দেশ ‘জয়’ না করে থামবেন না বলে জানিয়েছেন তার সাবেক এক ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা।
পুতিনের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ইন্দ্রেজ ইলারিওনোভের বরাত দিয়ে ২০১৪ সালের মার্চে ব্রিটেনের ‘দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ পত্রিকা বলেছে, ইউক্রেনের ক্রিমিয়ার পর পুতিন বেলারুশ, বাল্টিক স্টেইটস (লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া) ও ফিনল্যান্ডকে রাশিয়ান ফেডারেশনে ফিরিয়ে আনতে চান।
পুতিনের কাছে এ উদ্যোগটি রুশ জার সাম্রাজ্যের সর্বশেষ শাসক দ্বিতীয় নিকোলাস ও স্ট্যালিনের শাসনাধীন সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত এলাকাগুলো উদ্ধার করে ‘ঐতিহাসিক ন্যায়বিচার’ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা।
ইলারিওনোভ ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত পুতিনের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। সম্প্রতি একটি সুইডিশ পত্রিকা ‘স্যানেস্কা ডগব্লডাট’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি পুতিনের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে যুক্তি তুলে ধরেন।
ইলারিওনোভ বলেন, রাশিয়া মনে করে ১৯১৭ সালে ফিনল্যান্ডকে স্বাধীনতা মঞ্জুর করাটা ছিল ‘জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে প্রতারণা’। আর পুতিনের ভাবনা হলো, তার ও তার পূর্বসূরিদের জিনিসই তিনি রক্ষা করছেন।
পাতলা চামড়ার শক্ত মানুষ
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনকে সবসময়ই কড়া ভাষায় আক্রমণ করেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। ২০১৪ সালের মার্চে রুশ প্রেসিডেন্টকে ‘পাতলা চামড়ার শক্ত নেতা’ বলে অভিহিত করেন তিনি। এর মাত্র এক দিন আগে পুতিনকে নাৎসি নেতা হিটলারের সাথে তুলনা করেন হিলারি। তিনি বলেন, নাৎসি আমলে চেকোস্লোভাকিয়া ও রোমানিয়ায় যে ঘটনা ঘটেছিল, ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চলের পুতিনের সামরিক হস্তক্ষেপও একই ধরনের।
হিলারিকে ২০১৬ সালের সম্ভাব্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চলে রুশ হস্তক্ষেপের প্রসঙ্গ টেনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় রুশ প্রেসিডেন্টের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে হিলারি বলেন, ‘আমি জানি, আমরা একজন পাতলা চামড়ার শক্ত মানুষের সাথে কাজ করছি।’
হিলারিকে ‘দুর্বল’ নারী মনে করেন
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ফার্স্ট লেডি হিলারি রডহাম ক্লিনটন একজন ‘দুর্বল’ নারী বলে মনে করেন ভদিমির পুতিন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ওবামার ডেমক্র্যাট পার্টির সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারির কাছ থেকে এখন পর্যন্ত আকর্ষণীয় কোনো বক্তব্য পাননি বলে দাবি করেছেন তিনি। গত বছরের মার্চে ইউক্রেইনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার তীব্র বাগযুদ্ধ চলার সময় পুতিনকে জার্মানির হিটলারের সাথে তুলনা করেছিলেন হিলারি।
‘ব্রিটেনের দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ পত্রিকায় বলা হয়, সম্প্রতি হিলারির ওই মন্তব্য নিয়ে পুতিনের মন্তব্য জানতে চান ফ্রান্সের কিছু সাংবাদিক। জবাবে পুতিন বলেন, ‘মেয়েদের সাথে যুক্তিতর্কে না যাওয়াই ভালো। তবে হিলারির বক্তব্যে আকর্ষণীয় তেমন কিছু নেই। মানুষ যখন তার সীমানা অনেক দূর বিস্তৃত করে, সেটা তার বলিষ্ঠতার কারণে করে এমন নয়, দুর্বলতার কারণেও করে। তবে সম্ভবত দুর্বলতা একজন নারীর সবচেয়ে নেতিবাচক গুণ নয়।’
চীনা ফার্স্টলেডির গায়ে শাল জড়িয়ে বিতর্কে
চীনা ফার্স্টলেডির গায়ে শাল জড়িয়ে বিতর্কে জড়ান পুতিন। গত বছরের নভেম্বরে বেইজিংয়ে এপেক শীর্ষ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আলোচনা চলছে। শীতের রাত। কনকনে ঠাণ্ডা। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একটা শাল জড়িয়ে দিলেন চীনের ফার্স্টলেডি পেনং লিইউয়ানের গায়ে। কিন্তু পুতিনের এই সাহস আর উদ্যম কোনো সাড়া জাগায়নি জিনপিংয়ের মধ্যে। তিনি ছিলেন নিরুত্তাপ। তবে চীনজুড়ে এ ঘটনা উত্তাপ ছড়াতে সময় লাগেনি।
দুই সপ্তাহে কিয়েভ দখলের দম্ভোক্তি
ভøাদিমির পুতিন বলেছেন, তার দেশ চাইলে দুই সপ্তাহে কিয়েভ দখল করতে পারে। ইতালির লা রিপাবলিক পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী ইউরোপীয় কমিশনের চেয়ারম্যান হোসে ম্যানুয়েল বারোসোর কাছে এ দম্ভোক্তি করেন পুতিন। তবে রাশিয়ার সরকারি দফতরগুলো পুতিনের কথিত এ উক্তির কথা কার্যত অস্বীকার করেছে।
জীবনযাপনের কয়েকটি অজানা তথ্য
সম্প্রতি নিউজউইক সাময়িকী পুতিনের জীবনযাপন ও ব্যক্তিগত জীবনের নানা বিষয় তুলে ধরেছে। এক প্রতিবেদনে বিষয়টি জানিয়েছে বিজনেস ইনসাইডার।
এ জীবনযাপনের কাহিনী লেখার জন্য তিন বছর সময় ব্যয় করেছেন বেন জুদাহ। এ সময় তিনি পুতিনের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের ইন্টারভিউ নেন।
পুুতিন দেরিতে ঘুম থেকে ওঠেন এবং প্রায় দুপুরের দিকে তার দিনের প্রথম খাবার খান। নাশতায় তার ‘কটেজ চিজ’ নামে পনির থাকে। এ ছাড়া তিনি কোয়েলের ডিম ও ফলের রস পছন্দ করেন।
সকালে নাশতার পর পুতিন সুইমিং পুলে নামেন সাঁতার কাটার জন্য। এ সময় তিনি সাঁতার কাটার চশমা পরে নেন এবং ক্রলিং স্টাইলে সাঁতার কাটেন।
সাঁতারের পর জিমে তিনি কিছুটা সময় দেন। এরপর গরম ও ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করেন।
পুতিন ইন্টারনেট পছন্দ করেন না আর তার অফিসে টেলিভিশনও নেই। যোগাযোগের ক্ষেত্রে তিনি খুবই নিরাপদ প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। এর অন্যতম হলো কাগজ ও সোভিয়েত যুগের ল্যান্ড টেলিফোন লাইন। তিনি খুব কমই ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। কারণ হিসেবে জানা যায় স্ক্রিনের ভেতর স্ক্রিন ও মেসেজের ভেতর বারগুলো তার কাছে বেমানান লাগে।
বিদেশ ভ্রমণের সময় নিরাপত্তার খাতিরে তার সাথে থাকে রাশিয়ান বাবুর্চি, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও ওয়েটার। হোটেলে থাকার সময় তার সাথে থাকা লোকজন হোটেলের সব কাগজ ও প্রসাধনী দ্রব্য সরিয়ে ফেলে সেখানে ক্রেমলিনের অনুমোদিত সামগ্রী রেখে দেয়। আর ক্রেমলিনের অনুমোদন ছাড়া তিনি কোনো বিদেশী খাবার খান না।
পুতিন মস্কোর বাইরের একটি স্থানে বাস করেন। এর কারণ হিসেবে জানা যায় তিনি যানজট, দূষণ ও মানুষের ভিড় অপছন্দ করেন। তিনি তার সরকারি দফতর ক্রেমলিনে যেতেও পছন্দ করেন না।
পুতিনের নিজস্ব কর্মীরা তাকে ‘টিসার’ নামে ডাকে। যার অর্থ বস।
পুতিনের মা-বাবা মারা গেছেন। স্ত্রীর সাথে তার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। তার দুই মেয়ে থাকলেও তারা রাশিয়ায় থাকেন না। ফলে তার ব্যক্তিগত জীবন সীমিত। গুজব রয়েছে তার কাছে প্রতি রাতে নারী মডেল, ফটোগ্রাফার ও জিনন্যাস্টরা আসেন। কিন্তু এর বাস্তব ভিত্তি পাওয়া যায়নি। বাস্তবে একটি কালো ল্যাব্রাডার কুকুরই পুতিনের সঙ্গী।
পুতিনের জীবন সাধারণ। কিন্তু তিনি নিজেকে একজন কঠোর পরিশ্রমী ব্যক্তি বলেই দাবি করেন। রাশিয়ায় স্ট্যালিনের পর নিজেকে তিনি সবচেয়ে পরিশ্রমী নেতা বলে দাবি করেন।
পুতিন শ্রেণিকক্ষের পেছনের বেঞ্চের বিষন্ন বালক
ভ্লাদিমির পুতিন রুশ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্কে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। সেন্ট পিটার্সবার্গে বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো ২০১৩ সালে যখন জি-২০ সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, বিশ্লেষকেরা তখন রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের গতি-প্রকৃতি নিয়ে ব্যস্ত। তারা মনে করছেন, স্নায়ুযুদ্ধের পর দেশ দু’টির সম্পর্কে এখন সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা বিরাজ করছে।
ওবামা ও পুতিনের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কে অবনতির বিষয়টি ২০১৩ সালের জুনে উত্তর আয়ারল্যান্ডে জি-৮ সম্মেলনেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তখন এই দুই নেতার যে ছবি প্রকাশিত হয়, তাতে তাদের আন্তরিকতাপূর্ণ অবস্থায় দেখা যায়নি। এর কয়েক সপ্তাহ আগে ওবামা ঘোষণা দেন, পুতিনের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক খারাপ নয়। তবে একই সাথে তিনি তখন ঠাট্টা করে পুতিনকে ‘শ্রেণিকক্ষের পেছনের বেঞ্চের বিষন্ন বালক’ আখ্যা দেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে বলেছে, ওবামার ওই মন্তব্যে ক্ষিপ্ত হয়েছেন পুতিন।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের রাশিয়া বিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রু কাচিনসের মতে, ‘একটি বিষয় স্পষ্ট, মার্কিন-রুশ নেতাদের মধ্যে ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সম্পর্ক চলছে এখন। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন নেতাদের মধ্যে এর চেয়ে ভালো সম্পর্ক ছিল। আমার মনে হয়, পুতিন ও ওবামা কেউ কাউকেই পছন্দ করেন না।’
বিশ্ব অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ‘পরজীবী’র মতো
পুতিন মনে করেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ‘পরজীবীর মতো জেঁকে বসেছে’। ডলারের আধিপত্য বিশ্ব অর্থবাজারের জন্য হুমকি বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ২০১১ সালে মস্কোর উত্তরে সরকারপন্থী যুবদল ‘নাশি’র গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্পে এ মন্তব্য করেন পুতিন। পুতিন বলেন, তাদের (মার্কিনিদের) জীবনযাপন তাদের সামর্থ্যকে ছাড়িয়ে গেছে, আর তারা তাদের সমস্যার আংশিক ভার বিশ্ব অর্থনীতির ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে তারা পরজীবীর মতো অবস্থান করছে আর ডলারের একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করে রেখেছে।
হিটলারের সাথে তুলনা চার্লসের
এডলফ হিটলারের সাথে পুতিনকে তুলনা করেছেন যুক্তরাজ্যের প্রিন্স চার্লস। তিনি বলেছেন, হিটলার যা করেছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনও এখন সেই কাজ করছেন। ২০১৪ সালের মে মাসে পোল্যান্ডের যুদ্ধ-উদ্বাস্তু মেরিয়েনে ফারগুসন নামক এক স্বেচ্ছাসেবীর সাথে কানাডার হ্যালিফ্যাক্সে নোভা স্কটিয়া জাদুঘরে কথা বলার সময় চার্লস এ মন্তব্য করেন। চার্লসের এমন মন্তব্যের কথা ব্রিটিশ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন ফারগুসেন নিজে। ফারগুসন তার বাবা-মা এবং দুই বোনকে নিয়ে কানাডায় পালিয়ে বাঁচলেও হিটলারের নাৎসি ক্যাম্পে যেতে হয়েছিল তার পরিবারের অন্য সদস্যদেরকে।
ফারগুসন জানান, সেই সময়ের ঘটনা নিয়ে আলাপচারিতার একপর্যায়ে হিটলারের একের পর এক দেশ দখলের প্রসঙ্গ উঠলে চার্লস বলেন, ‘পুতিন এখন যা করছেন তা হিটলারের সাথে তুলনা করা যেতে পারে।’
মালয়েশীয় বিমান ধ্বংসে চাপের মুখে
১৯৮৩ সাল। সোভিয়েত ইউনিয়নের (রাশিয়া) আকাশসীমায় ভুল (?) করে ঢুকে পড়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ার একটি যাত্রীবাহী বিমান। বিমানটি লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় একটি রুশ যুদ্ধবিমান। একেবারে ধ্বংস হয়ে যায় যাত্রীবাহী বিমানটি। সেই সাথে নিহত হয় ২৬৯ জন আরোহীর সবাই। সে সময় সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’-এর অভিযোগ তুলেছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান।
প্রায় ৩১ বছর পর ১৭ জুলাই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ইউক্রেনের আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের যাত্রীবাহী বিমান এমএইচ-১৭ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। প্রাণ হারায় এর ২৯৮ জন আরোহী। রাশিয়ার নাম এ ক্ষেত্রেও জড়িয়ে যায়। তবে প্রত্যক্ষ হামলাকারী হিসেবে নয়, ইউক্রেনের রুশপন্থী বিদ্রোহীদের সমর্থক ও প্রশ্রয়দাতা হিসেবে। সন্দেহ করা হয়, ইউক্রেন সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরাই এ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র একেবারে নিশ্চিত করেই বলেছে, মালয়েশীয় এয়ারলাইনসের বিমানটি রাশিয়াই ধ্বংস করেছে। রাশিয়াই ইউক্রেনের রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করেছে। এই দাবির সপক্ষে তাদের কাছে তথ্য-প্রমাণও রয়েছে বলে দাবি করে।
বিমান ধ্বংস নিয়ে ‘স্বার্থ হাসিলের খেলা’
ইউক্রেনে মালয়েশীয় উড়োজাহাজ ভূপাতিত হয়ে প্রাণহানির পর সমালোচনার মুখে থাকা রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন এ ঘটনা নিয়ে অন্যদের বিরুদ্ধে স্বার্থ হাসিলের অভিযোগ তোলেন। তিনি মনে করেন, গত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে নতুন করে সামরিক অভিযান শুরু না করলে এই বিয়োগান্তুক ঘটনা এড়ানো যেত।
হুঁশিয়ারি আইএসের
গত সেপ্টেম্বরে পুতিনের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় ইরাকভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। সম্প্রতি প্রকাশিত এক ভিডিওবার্তায় লৌহমানব হিসেবে পরিচিত বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর নেতা পুতিনকে সতর্ক করে দিয়েছে আইএস।
ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, আইএসের প্রকাশ করা ভিডিওচিত্রটিতে একজন যোদ্ধা আরবিতে বলেন, ‘হে ভøাদিমির পুতিন, এই বার্তা আপনার জন্য। জঙ্গি বিমানগুলো আপনি প্রেসিডেন্ট বাশারকে পাঠিয়েছিলেন। আর এখন আমরা সেগুলো পাঠাব আপনার কাছে। আপনার সিংহাসন এরই মধ্যে টলমল করছে। হুমকিতে রয়েছে। আমরা যখন আসব, তখন এর পতন ঘটবে।’
চীনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির উদ্যোগ
ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার ভেতর টেনে নেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সম্পর্ক এখন দা-কুমড়ো। ইউক্রেন বলেছে, পুতিন যা করছেন, পরিণামে তা সামরিক বিরোধ ডেকে আনবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়ার চার পাশে নিষেধাজ্ঞার কঠিন বেড়াজাল তৈরি করলে, রাশিয়া কী করবে?
মস্কো ব্যবসা-বাণিজ্য, জ্বালানি সরবরাহ, অস্ত্রসংক্রান্ত লেনদেন ও রাজনৈতিক সহযোগিতার বিষয়ে এশিয়ার সাথে নতুন করে সখ্য গড়ে তুলবে। সাম্যবাদের নীতির সূত্র ধরে বেইজিংয়ের সাথে মস্কোর দহরম-মহরম অনেক পুরনো। এশিয়ায় বর্তমানে অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হিসেবে চীনকে বিবেচনা করা হয়। চীনের সাথে ইতোমধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নিয়েছেন পুতিন। পাশাপাশি তিনি ব্রিকস দেশগুলো (ব্রাজিল, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা) নৈতিক সমর্থন পেয়েছেন পুতিন। এর মাধ্যমে তিনি লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর সাথে নতুন করে পুরনো বন্ধুত্বকে ঝালাই করে নিয়েছেন।
একজন ‘পরিপক্ব কুস্তিগির’
পুতিনকে একজন ‘পরিপক্ব কুস্তিগির’ বলে দাবি করেছেন তার দেশেরই এক কূটনীতিক। গত বছর অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবোট পুতিনকে দুর্বলোচিত বলে মন্তব্য করার প্রত্যুত্তরে এ মন্তব্য করেন ক্যানবেরায় কর্মরত মস্কো দূত আলেকসান্দর ওডোভস্কি।
মূল ঘটনাটি ঘটে ২০১৪ সালের জুলাইয়ে। তখন জি-টুয়েন্টি সম্মেলন চলাকালে রাশিয়ার দোনেৎস্কে একটি মালয়েশিয়ার বিমান ভূপাতিত হয়। এ সময় অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যাবোট রাষ্ট্রপতি পুতিনকে হটাতে ‘শার্টফ্রন্ট’ কৌশল নেয়ার ঘোষণা দেন। ‘শার্টফ্রন্ট’ হলো ফুটবল খেলার একটি কৌশল, যেখানে প্রতিপক্ষ ফুটবলারকে শারীরিকভাবে দুর্বল মনে করে হঠাৎ বুক দিয়ে আক্রমণ করে বল ছিনিয়ে নেয়া।
আর তাই পুতিন মোটেও এমন নন দাবি করে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর এমন আচরণকে অবিবেচক বলেও দাবি করে মস্কো।
শান্তিতে নোবেলের জন্য মনোনয়ন
ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চলে সেনা পাঠিয়ে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করলেও ২০১৪ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন ভøাদিমির পুতিন। সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র হামলার জন্য সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন ঠেকানোয় পুতিনের ভূমিকার কারণে অক্টোবরে নোবেলের জন্য তার নাম প্রস্তাব করে একটি অ্যাডভোকেসি গ্রুপ। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি।
শেষ কথা
ইউক্রেনে সঙ্কট এবং একে কেন্দ্র করে ইউরোপীয় প্রতিবেশী ও পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে রাশিয়ার ঘোরতর সঙ্ঘাতের পরও সবচেয়ে বেশি জনসমর্থন পেয়েছেন ভøাদিমির পুতিন। রাশিয়ার নাগরিকেরা এমনকি স্বাধীনতা, সামরিক বাহিনী এবং নির্বাচন নিয়েও সন্তুষ্ট। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে নতুন এক গ্যালাপ জরিপে এ তথ্যই বেরিয়ে এসেছে।
পুতিনের কর্মকাণ্ড সমর্থন করছেন ৮৩ শতাংশ রুশ নাগরিক। এ হার ২০০৮ সালের সাথে মিলে গেলেও ২০১৩ সালের তুলনায় তা ২৯ শতাংশ বেশি। ২০০৮ সালের পর এই প্রথম বেশির ভাগ রুশ নাগরিক তাদের নেতা সঠিক পথেই রয়েছেন বলে মত দিয়েছে। তা ছাড়া রুশদের ৭৮ শতাংশ দেশের সামরিক বাহিনী, ৬৪ শতাংশ জাতীয় সরকার এবং ৩৯ শতাংশ নাগরিক দেশের নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় সততার ব্যাপারে আস্থা প্রকাশ করেছে।
তবে রুশরা কেবল তাদের সরকার নিয়েই ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেনি বরং এ বছর নাগরিক স্বাধীনতা নিয়েও সন্তোষ প্রকাশ করেছে ৬৫ শতাংশ রাশিয়ান। আর দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে বলে মত দিয়েছে ৩৫ শতাংশ নাগরিক।
জরিপে দেখা গেছে, রুশরা নিজেদের সরকার নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করার পাশাপাশি পশ্চিমা বিমুখ হয়ে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে জনসমর্থন এক অঙ্কে নেমে আসে।
বেড়েছে কেবল চীনের জনসমর্থন। জরিপে দেখা গেছে, চীনকে সমর্থন দিয়েছে রেকর্ড ৪২ শতাংশ রুশ নাগরিক। সম্প্রতি কয়েক মাসে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। সই হয়েছে ৪০ হাজার কোটি ডলারের গ্যাস চুক্তি।
0 comments:
Post a Comment