মো: রুহুল অমিন
পৃথিবীর মোট আয়তনের ৭১ ভাগ জল এবং বাকি ২৯ ভাগ স্থল। এই পানির মূল আধার জমে থাকা বরফ। তবে বরফ গলে এক সময় নদী বা প্রণালী বেয়ে চলে আসে সাগর-মহাসাগরে। পৃথিবীতে মোট মহাসাগরের সংখ্যা পাঁচটি এবং এই সাগরগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পৃথিবীর দেশগুলো। দেশগুলো আবার সাতটি মহাদেশের অধীনে রয়েছ
এ মহাদেশ সম্পর্কে জানার আগ্রহ নেই এমন কোনো লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। মহাদেশভিত্তিক তথ্যে এর অবস্থান আয়তনে পঞ্চম যা ইউরোপের এক দশমিক তিন গুণ বেশি। সে যা-ই হোক পাঠকদের কৌতূহল মেটাতে এন্টার্কটিকা সম্পর্কে আমাদের এবারের আয়োজন।
এন্টার্কটিকা নামকরণ করা হয়েছে গ্রিক শব্দ ‘antarktios' যার অর্থ হলো ‘আর্কটিকের বিপরীত’। যেহেতু আর্কটিক মহাসাগরের বিপরীত দিকে এর অবস্থান এ কারণে হয়তো এরূপ নামকরণ হয়ে থাকতে পারে। নাম যা-ই হোক না কেন কবে এন্টার্কটিকার জন্ম, কখন কিভাবে হয়েছিল এ ব্যাপারে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে গবেষকদের ধারণা ১৭০ মিলিয়ন বছর আগে এটি ‘সুপারকন্টিনেন্ট গনডোয়ানা’-এর অংশ ছিল। সময়ের ব্যবধানে ২৫ মিলিয়ন বছর আগে এর জন্ম হয়।
পৃথিবীর সর্বদক্ষিণে দক্ষিণ মহাসাগরের চাদর দিয়ে জড়ানো রয়েছে এ মহাদেশটি। এটির আয়তন ১৪ মিলিয়
এন্টার্কটিকা নামে যে একটি মহাদেশ আছে এটির প্রথম ধারণা দেন ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন জেমস কুক। তিনি দুই বার ১৭ জানুয়ারি, ১৭৭৩ এবং ১৭৭৪ সালে এন্টার্কটিকা ক্রস করেন। অবশ্য ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন, নাসা এবং অন্যান্য সূত্র থেকে জানা যায় যে, ১৮২০ সালে তিনজন রাশিয়ান ইম্পেরিয়াল নেভির ক্যাপ্টেন ফ্যাবিয়ান গেটিলিয়েব ভন বেলিংসওসেন, ব্রিটিশ নেভি’র ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড ব্রান্সফিল্ড এবং একজন আমেরিকান নাবিক নাথানিয়েল মালমারের দৃষ্টিগোচরে এন্টার্কটিকা আসে এবং তারা এর বিভিন্ন অংশে প্রবেশ করেন। তবে এন্টার্কটিকার ধারণা সবার দৃষ্টিতে জেমস কুক না আনতে পারলেও প্রথমে তিনি যে এ সম্পর্কে ধারণা দেন সে ব্যাপারে দ্বিমত নেই।
এন্টার্কটিকায় কোনো স্থায়ী বাসিন্দা নেই।
এ কারণে নিঃসন্দেহে এটি কারো মালিকানায় থাকার কথা। আসলে এই মহাদেশের মালিকানা কারো নয়। অবশ্য মালিকানা যে কেউ দাবি করেনি তা কিন্তু নয়। প্রথমে ১৯০৮ সালে তখনকার উপনিবেশবাদী দেশ ক্ষমতাধর ব্রিটেন এন্টার্কটিকার মালিকানা দাবি করে বসে। ব্রিটেনের দেখাদেখি এর কাছাকাছির দেশ ফ্রান্স ১৯২৪ সালে ‘এডিলি ল্যান্ড’ , নরওয়ে ১৯২৯ সালে ‘পিটার-১ আইল্যান্ডস’ এবং ১৯৩৯ সালে ‘কুইন মড ল্যান্ড’ , অস্ট্রেলিয়া ১৯৩৩ সালে ‘অস্ট্রেলিয়ান এন্টার্কটিকা টেরিটরি’ এবং আর্জেন্টিনা ১৯৪৩ সালে ‘আর্জেন্টাইন এন্টার্কটিক টেরিটরি’-এর মালিকানা দাবি করে বসে। অবশ্য স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাষ্ট্র, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন , ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ১২টি দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ১৯৫৯ সালে ‘এন্টার্কটিক চুক্তি’ (Antarctic Treaty) স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তির বলে কোনো রাষ্ট্র কর্তৃক এভাবে মালিকানা দাবির কোনো সুযোগ নেই। বিশেষ করে এখানে গবেষণা ছাড়া অস্ত্র পরীক্ষা চালানো বা কোনো জীবাণু অস্ত্র বহন করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়। ওই চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশের সংখ্যা প্রায় ৪৫টির বেশি। এন্টার্কটিকা কারো মালিকানায় না থাকলেও চুক্তি অনুযায়ী একজন প্রশাসক কিন্তু রয়েছেন।
সাধারণ মানুষের পক্ষে এন্টার্কটিকাতে যাওয়া বেশ কঠিন। কারণ সেখানে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আবহাওয়া এবং মাঝে মাঝে বিরূপ আবহাওয়া এন্টার্কটিকার পরিবেশ ভারী করে তোলে। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করতে গবেষকরা এন্টার্কটিকায় গমন করেন। গ্রীষ্মকালে গবেষক এবং পর্যটক মিলে মোট পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪ হাজার এবং শীতকালে তা কমে দাঁড়ায় ১ হাজারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এন্টার্কটিকাতে সীমিত আকারে পর্যটক যাওয়ার সুবিধা রয়েছে। অবশ্য তাকে আবার সব ধরনের কেমিক্যাল বা বায়োলজিক্যাল উইপন গবেষণা বা বহন থেকে বিরত থাকতে হবে। এখানে রয়েছে কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
কেউ যদি এন্টার্কটিকায় যেতে চায়, তালে তিনি বিমান বা জাহাজে সেখানে যেতে পারেন। বিমানে যেতে হলে নিউজিল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়া থেকে সরাসরি বিমান সার্ভিস রয়েছে। নব্বইয়ের দশক থেকে অস্ট্রেলিয়া-এন্টার্কটিকা বিমান সার্ভিস ‘কোয়ান্টাস’ নিয়মিতভাবে যাতায়াত করছে। অবশ্য ১৯৭৯ সালে নিউজিল্যান্ড থেকে এন্টার্কটিকাগামী একটি বিমান এন্টার্কটিকার ‘মাউন্ট ইরেবাস’-এর কাছে দুর্ঘটনাকবলিত হয় এবং ২৫৭ জন যাত্রী নিহত হন। তা ছাড়া, বরফের ওপর দিয়ে চলার সময় বিভিন্ন সময়ে বেশকিছু পর্যটক এবং গবেষক প্রাণ হারিয়েছেন।
এন্টার্কটিকাতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হওয়ার কারণে সেখানে ২০০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ এবং প্রাণীদের মধ্যে পেঙ্গুইন, তিমি এবং শিল মাছের দেখা পাওয়া যায়। অবশ্য গবেষকরা গ্রিন হাউজের মাধ্যমে কিছু উদ্ভিদ (খাবার হিসেবে) তৈরি করে যা তাদের পুষ্টি যোগাতে সহায়তা করে। এন্টার্কটিকাতে একটি জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি রয়েছে, যার নাম ইরেবাস। এটি রোডস দ্বীপের মাউন্ট ইরেবাস পাহাড়ে অবস্থিত। এখানকার পোর্ট লকারি মিউজিয়াম দেখার মতো। এটি দেখলে মনে হয় সেখানে বাস করা বেশ সহজ।
আগেই বলা হয়েছে এন্টার্কটিকাতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। অবশ্য শীত ও গ্রীষ্মে রকমফের রয়েছে। সাধারণত শীতকালে এখানকার তাপমাত্রা থাকে মাইনাস (-) ৮০ থেকে মাইনাস (-) ৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং গ্রীষ্ম মৌসুমে এ মাত্রা থাকে ৫ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে এন্টার্কটিকার পশ্চিম দিকের তুলনায় পূর্ব দিকে শীতের প্রকোপ অনেক বেশি । এ হিমাঙ্কের নিচে গড় তাপমাত্রা থাকাতে এখানকার জীবন বেশ কঠিন। শুধু গবেষণা ও আবিষ্কারের নেশা এবং অ্যাডভেঞ্চারের জন্য মানুষ এন্টার্কটিকাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনের পর দিন অবস্থান করে।
এন্টার্কটিকাতে কোনো স্থায়ী বাসিন্দা নেই। তাই বলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেমে থাকবে তা কি হয়? তবে সে অর্থনীতি অবশ্য বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। যারা ওখানে গবেষণার জন্য যান তারা কৌতূহলবশত মাছ শিকার করেন। অবশ্য শিলমাছ শিকার করা ঠিক নয় মর্মে পরিবেশ আন্দোলনকারীদের জন্য বন্ধের পথে। এখানকার মাছের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন জাতের শিল, তিমি এবং পিলেৎজিক শ্রেণীর কিছু মৎস্য। এ ছাড়া খনিজসম্পদও রয়েছে সীমিত আকারে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কয়লা, হাইড্রোকার্বন, লৌহ খনি, প্লাটিনিয়াম, নিকেল ইত্যাদি। তবে ১৯৯১ সালের ‘এন্টার্কটিক এনভায়রনমেন্ট প্রটোকল’ এবং এই প্রটোকলের অধীনে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর সদস্যদের মধ্যে ১৯৯৮ সালের এক চুক্তি অনুযায়ী ২০৪৮ সালের মধ্যে এন্টার্কটিকার কোনো অংশে খনিজসম্পদ উত্তোলনের জন্য কোনো ধরনের খননকাজ করা যাবে না। অবশ্য মৎস্য শিকার এর আওতাবহির্ভূত রয়েছে।
পৃথিবীব্যাপী শিল্পায়ন এবং পরিবেশকে যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে মানুষ যেমন বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না, ঠিক তেমনি রক্ষা পায়নি এন্টার্কটিকা। বায়ুমণ্ডলে গ্যাসের বিভাজন মাত্রাভেদে পরিবর্তনের কারণে ওজোনস্তর পুটো হয়ে যাচ্ছে। কসমিক রশ্মি এবং আলট্রাভায়োলেট রশ্মি সোজাসুজি পৃথিবীতে চলে আসছে । ফলে নতুন নতুন রোগ দেখা দিচ্ছে এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসছে।
এন্টার্কটিকার ওপর অনুরূপ প্রভাব পড়ার কারণে সেখানকার বরফ গলতে শুরু করেছে এবং তা সাগর দিয়ে গড়িয়ে মহাসাগরে গিয়ে পড়ছে। বেড়ে যাচ্ছে মহাসাগরের পানির উচ্চতা এবং তা আবার সাগর-উপসাগরের মাধ্যমে গড়িয়ে গিয়ে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাকে প্লাবিত করে দিচ্ছে। সার্বিক বিচারে এন্টার্কটিকা বাঁচাতে পৃথিবীর বড় বড় দেশগুলোকে কিয়োটো প্রটোকল মেনে চলা উচিত। নইলে মহাসাগর ও সাগরের পানি উচ্চতা বেড়ে অদূরভবিষ্যতে পৃথিবীর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হবে এবং এ থেকে উন্নত দেশগুলো যে রেহাই পাবে তা হলফ করে বলা যায় না।
0 comments:
Post a Comment