WHAT'S NEW?
Loading...

বাংলাদেশ নিয়ে পশ্চিমের সাথে ভারতের সমন্বিত উদ্যোগ


গৌতম দাস


ভারতের নতুন পররাষ্ট্র সচিব সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্কর গত ২ মার্চ বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট কোন দিকে সে অভিমুখের পরের স্তর শুরু হতে যাচ্ছে এই সফর থেকে। জয়শঙ্কর যে বার্তা এনেছিলেন তা কেবল ‘পরিবর্তিত’ ভারতের একার কথা নয়; বরং তা একই সাথে আমেরিকা ও ইউরোপের সাথে ভারতের অবস্থান

মিলিয়ে এক সমন্বিত অবস্থান। সে সমন্বিত অবস্থানেরই বাহক তিনি। এর মানে হলো, জয়শঙ্করের সফরটা ভারত-বাংলাদেশের রুটিন সফর বা অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে কোনো আলোচনা নয়। বরং উদ্দেশ্য হচ্ছে অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে আলোচনা করতে আসার ছলে ‘সাইড টক’ হিসেবে বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট সম্পর্কে পশ্চিমের সাথে মিলিয়ে ভারতের ‘সমন্বিত বার্তা’ পৌঁছে দেয়া।



ভারত-বাংলাদেশের ঘোষিত রুটিন অমীমাংসিত দুই ইস্যুর একটা হলো তিস্তার পানি। এই ইস্যুতে সর্বশেষ অবস্থা বোঝার জন্য প্রথম আলোতে ১ মার্চ প্রকাশিত নয়াদিল্লির টনৈতিক সংবাদদাতা সৌম্য বন্দোপাধ্যায়ের রিপোর্ট পড়লেই জানা যায় বিষয়টি এখনো কত অপরিপক্ব অবস্থায় সাত হাত পানির নিচে পড়ে আছে। এ ছাড়া দ্বিতীয় ইস্যু ল্যান্ড বাউন্ডারি নিয়েও বাংলাদেশের সাথে কথা বলার কিছু নেই, সব আলোচনা বহু আগেই শেষ। কেবল বাকি আছে পার্লামেন্টে ভারতের কনস্টিটিউশনে আইনি সংশোধনী আনা। ভারতের চলতি বাজেট অধিবেশনে এই সীমান্ত বিল বা ল্যান্ড বাউন্ডারি বিল সংসদের চলতি অধিবেশনেই পাস হবে বলে শোনা যাচ্ছিল। যদিও এখন জানা যাচ্ছে অধিবেশনের প্রথমার্ধে তা সম্ভব হচ্ছে না। সর্বশেষ গত ৫ মার্চের প্রথম আলোর রিপোর্ট বলছে, এপ্রিলের ২০ তারিখ থেকে ৮ মে পর্যন্ত বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয়ার্ধে বিলটি পাস করা হবে। অর্থাৎ এই ইস্যু দুটো নিয়ে ভারতের করে দেখানোটাই সর্বশেষ অবস্থা, বাংলাদেশে এসে কথা বলার মতো কিছুই ছিল না। এর মানে এই দুই ইস্যু ছিল আসলে জয়শঙ্করের সফরের প্রকাশ্য উছিলা। আর প্রকৃত ইস্যু ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কটে ভারতের নতুন বদলে যাওয়া অবস্থান এবং আমেরিকা ও ইউরোপ মিলে তৈরি সমন্বিত অবস্থান জয়শঙ্করের মুখ দিয়ে শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপনের।



ভারতের অবস্থান যে বদলেছে সে বিষয়ে মানবজমিন রিপোর্টে বলছে, ‘পরিবর্তনের বার্তাই দিয়ে গেলেন জয়শঙ্কর’। ওই রিপোর্ট বলছে, জয়শঙ্করের সাথে সাক্ষাৎ শেষে হতাশ পররাষ্ট্র সচিব মো: শহীদুল হক উপস্থিত প্রেসকে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘একেক সরকারের একেক পলিসি থাকে। ভারতের সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে দেশটির ফরেন পলিসিতে ‘বড় রকমের পরিবর্তন’ এসেছে’। এ ছাড়া এই ‘পরিবর্তন’ যে একা ভারতের নয়; বরং একটা সমন্বিত বার্তা ছিল এর অন্য প্রকাশটা আমরা ঘটতে দেখলাম, পরের দিন আমেরিকান রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের নেতৃত্বে ঢাকার ১৬ কূটনৈতিক মিশনপ্রধান খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করার মাধ্যমে। আর এরও পর বাংলাদেশ চীন ও ভারতের দুই রাষ্ট্রদূত কখনো এর আগে দেখা করেছেন এমন খবর চিন্তা করা যায়নি। এ ব্যাপারে সাধারণভাবে ধারণা হলো, তারা বাংলাদেশ ইস্যুতে পরস্পর বৈরী। কিন্তু আমরা দেখলাম ভারত-আমেরিকা-ইউরোপের যৌথ অবস্থান চীনকেও ব্রিফ করতে বাংলাদেশে চীন-ভারতের রাষ্ট্রদূতদ্বয় সাক্ষাৎ করেছেন।


 


জটের গোড়া খুলেছিল : মোদি-ওবামা বৈঠকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ
এসব কিছুর গোড়ার জটটা ছিল, বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভারত-আমেরিকার অবস্থানগত বিরোধ। এই বিরোধ কেটে গেছে এ বছরের শুরুতে গত জানুয়ারির শেষে। এ বিষয়ে খবরটা প্রচার হতে শুরু হয়েছিল গত ৪ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে। খবরটা ছিল, গত জানুয়ারি মাসের শেষে ওবামা ভারত সফরে এসেছিলেন, সেখানে ওবামা-মোদি দু’জনের আলোচনায় ‘বাংলাদেশ প্রসঙ্গ’ এসেছিল। ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস ২৬ জানুয়ারি। এ বছরের উদযাপন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হতে ওবামা ২৫-২৭ জানুয়ারি ভারত সফরে এসেছিলেন। সেখানে ওবামা-মোদির নানা দ্বিপক্ষীয় স্বার্থের প্রসঙ্গ আলাপের সময় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এসেছিল। আসারই কথা, এটা অনুমান করা খুব কষ্টকল্পিত কিছু ছিল না। কিন্তু এ তথ্যের প্রকাশ্য স্বীকারোক্তিতে আসা ছিল অবশ্যই কষ্টকল্পিত। যদিও ভারত অথবা আমেরিকার দিক থেকে এই স্বীকারোক্তি দেয়া বা না দেয়াটা খুব জরুরি নয়। এমনকি তা রেওয়াজসম্মতও নয় বলে কেউ তেমন আশা করেনি। রেওয়াজ মাফিক হলে সে ক্ষেত্রে হয়তো আমরা তা শুনতাম বড়জোর কোনো অনুসন্ধানী দেশী বা বিদেশী মিডিয়াকর্মীর বিশেষ রিপোর্ট থেকে। কিন্তু আমাদের অবাক করে এমন এক ব্যতিক্রম ঘটনায় আমরা দেখছি, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সিনিয়র পরিচালক ফিল রাইনার আমাদেরকে এই তথ্য নিজেই জানালেন।


ফিল রাইনার জানুয়ারিতে ওবামার ভারত সফরে সফরসঙ্গী ছিলেন। তবু লক্ষ করার মতো বিষয় হলো, তিনি প্রেসিডেন্টের হোয়াট হাউজ অথবা পররাষ্ট্র ডিপার্টমেন্টের নেহায়তই কোনো মুখপাত্র নন। অর্থাৎ স্টেট ডিপার্টমেন্ট এটা রুটিন কোনো মুখপাত্রের মাধ্যমে প্রকাশ বা প্রচার করতে চায়নি। সাদামাটা রুটিনের বদলে তারা চেয়েছে এই প্রকাশ ও প্রচার গুরুত্ব পাক। সদ্য সমাপ্ত ওবামার ভারত সফরে তার অর্জন বিষয়ে অবহিত করতে ডাকা কনফারেন্সে রাইনার সেখানে এসেছিলেন। এখানে ‘অর্জন’ শব্দটা সতর্কভাবেই জেনে ব্যবহার করতে হচ্ছে। কারণ এটা আমেরিকার দিক থেকে শুধু বিরাট অর্জনই নয়, ওবামার এই সফরকে রাইনার ‘গেম চেঞ্জিং’ বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ পাশা খেলায় দান বা চাল দিয়ে খেলার অভিমুখের উলটানোর মতো ঘটনা।



প্রেস কনফারেন্সে কথা বলতে গিয়ে ফিল রাইনার অনেক বেশি যেচে ও বিস্তার করে বাড়তি তথ্য দিয়েছেন। যেমন তিনি বলছিলেন, ‘আমি একটি বিষয় লক্ষ করেছি, প্রেসিডেন্ট ওবামা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছে। আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখেছি, যেটি একটি উদাহরণ। আমরা সাম্প্রতিক শ্রীলঙ্কায়ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখেছি। নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা উত্তেজনাপূর্ণ। এ সফরে দুই নেতা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শক্তি ও নাগরিক শক্তির যে উত্থান হয়েছে তাতে একমত পোষণ করেছেন। আমরা বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়েছি। বাংলাদেশ প্রশ্নে দুই নেতার মধ্যে এখনো আলোচনা অব্যাহত আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন’। অনেক লম্বা বক্তব্য। আর এতে প্রথমেই তার বক্তব্য নিবদ্ধ করেছেন ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ বলে এক শব্দ দিয়ে। অর্থাৎ বাংলাদেশে যে একটা সবার ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ হয়নি কথা সেদিক নেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন।


সাধারণভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিভিন্ন দেশের ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের’ উদাহরণ তুলে তিনি বলতে চেয়েছেন ভারত ও শ্রীলঙ্কায় ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশে তা হয়নি। তার এটাকে প্রসঙ্গ করার আর এক তাৎপর্য আছে। বাংলাদেশে গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার আর ওবামা সরকারের মধ্যে বড় ধরনের প্রকাশ্য বিরো দেখা দেয়। সবার ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ প্রশ্নে আমেরিকার পক্ষে আর ভারত বিপক্ষে। শুধু তাই নয়, ভারতের এই অবস্থানের প্র্যাকটিক্যাল সারার্থ তাৎপর্য হলো, হাসিনার পাবলিক রেটিং যত নিচেই হোক, নির্বাচনের নামে যা হয় হোক, বাংলাদেশের মানুষ যাকেই ভোট দিক, যেকোনো উছিলায় তারা আওয়ামী লীগকেই আবার ক্ষমতায় দেখতে চায়। রায়নার সম্ভবত সে কথা স্মরণ করে আমাদের জানালেন যে, এসব প্রশ্নে ভারতের সাথে বিরোধ আগে যে জায়গায়ই থাক এবারের মোদি-ওবামা আলোচনায় ভারত-আমেরিকার নীতি ও স্বার্থ বিষয়ে পুরনো অনেক বিরোধে এলোমেলো সঙ্ঘাতময় অবস্থানকে এবার যেমন ইস্ত্রি করে সোজা করা হয়েছে, সবার ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ এই কমন নীতিগত অবস্থান তেমনি একটা। এখানে তারা উভয়ে পৌঁছেছেন। এটাই ফিল রাইনার আমাদের জানাচ্ছেন। তা ভালো, আমরা জানলাম। এতটুকু নিশ্চয়ই অনেক ছিল। কিন্তু রাইনার এখানেও থামেননি। আরো বাড়তি বলছেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে’ নিয়েছেন। অর্থাৎ অতীতের সবার ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ প্রসঙ্গে এখন ভারত-আমেরিকা একমত হয়েছে শুধু তাই নয়, বরং ওই ভুয়া নির্বাচনের পরিণতিতে বাংলাদেশের বর্তমান ‘অস্থিতিশীল পরিস্থিতির’ দিকেও তাদের নজর রেখেছেন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শেষ বাক্য ‘বাংলাদেশ প্রশ্নে দুই নেতার মধ্যে এখনো আলোচনা অব্যাহত আছে’। অর্থাৎ তাদের অতীতের গুরুতর অনৈক্যমতের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনা বিষয়ে এখন শুধু ঐকমত্য প্রকাশ করা নয়, এখন সেই ঐকমত্যের বাস্তবায়ন বা কারেকশনের জন্য তারা কাজ করে যাচ্ছেন।



ফিল রাইনারের যেচে এসে এসব তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের আর এক উদ্দেশ্য সম্ভবত আছে। বাংলাদেশ নীতি প্রশ্নে আমেরিকা-ভারতের অবস্থানের সঙ্ঘাত ২০১১ সাল থেকে। এরপর সেই স্বার্থবিরোধ ২০১৩ সালে এসে চরম স্থবির অবস্থায় পড়ার কথা আমরা সবাই জানতাম। এই স্থবির দশা এরপর কোন দিকে যাবে আদৌ যাবে নাকি এমনই দিশাহীন কত দিন পড়ে থাকবে কেউ জানত না। এরপর ২০১৪ সালের মে মাসে মোদির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসা, এরপর আস্তে আস্তে ভারত-আমেরিকার পুরনো স্থবির বিরোধের ঝাঁপি মোদির খুলে দেখতে দেখতে এটা ছিল মোদি-ওবামার খুবই স্বল্প সময় সাড়ে তিন মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বার ওবামার সাথে সাক্ষাৎ। আগের লেখায় বলেছি, ভারত-আমেরিকার বিরোধ যতটা না ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার ও রাজনীতিবিদের এর চেয়ে সম্ভবত আরো বেশি আমেরিকার সাথে ভারতের গোয়েন্দা-আমলার পর্যায়ের বিরোধ।



এ প্রসঙ্গে আমরা আমেরিকায় ভারতের কূটনীতিক দেবযানী খেবড়াগোড়া কাহিনী আর এর পালটা ভারতে আমেরিকান কূটনীতিকদের বিশেষ সুবিধা কেড়ে নেয়া এমনকি নিরাপত্তা কমিয়ে দেয়ার বিষয়টা স্মরণ করতে পারি। ভারতের নির্বাচনের আগে এবং পরে বহুবার আমরা বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণকে বলতে শুনেছি যে, ভারতের নির্বাচনের ফলাফলে কংগ্রেস-ভিন্ন দলের বিজয়ে সরকার বদল হলেও ভারতের বৈদেশিক নীতিতে এর প্রভাব পড়ে না, বদল হয় না। এ কথার অর্থ আরো পরিষ্কার করে তিনি গত জুন ২০১৪ সালে অর্থাৎ মোদির জয়লাভে প্রধানমন্ত্রিত্ব নেয়ার পরও বলেছিলেন, বাংলাদেশে ‘০৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার প্রয়োজনে। আমরা ওই ইস্যু এখন আর আবার ফিরে মূল্যায়ন করতে চাই না কারণ এখন এজেন্ডা ভিন্ন হয়ে গেছে’। (About the January 5 elections, Pankaj Saran said that was a constitutional requirement. `I do not see that issue will be revisited today because today the agenda is different.'- ) অর্থাৎ এক দিকে ভারত-আমেরিকার সামগ্রিক সম্পর্ক স্থবির হয়ে আছে, বাংলাদেশ নীতিতে উভয়ে দুই মেরুতে চরমে উঠে আছে, পরে এই সম্পর্ক এবং গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অমীমাংসিত ইস্যু উভয় পক্ষের জন্য এক জায়গায় আসা জরুরি সেটা আদৌ হবে বা এর কী হবে তার কোনো দিশা নেই। অন্য দিকে মে মাসের ২০১৪ সালেই ভারতের নতুন দল ক্ষমতায় এসেছে এবং সেটা নরেন্দ্র মোদির, যার প্রায়োরিটি ও এজেন্ডা কংগ্রেসের থেকে একেবারেই আলাদা এবং নতুন প্রধানমন্ত্রী মোদি আমেরিকার সাথে ভারতের নিজস্ব অমীমাংসিত ইস্যুগুলো (এবং এরই ফাঁকে বাংলাদেশ নীতিতে বিরোধও) নিয়ে ভারতের নিজের কারণেও নতুন করে সমাধানে উদ্যোগী হতে বাধ্য। ফলে তা কোন দিকে মোড় নিয়ে কিভাবে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, ঐকমত্যে আসে কি না সেসব যা-ই হোক না কেন পঙ্কজ শরণ এর জন্য অপেক্ষা করতে একেবারেই রাজি নন। তিনি আগেই শেখ হাসিনার সমর্থকদের মনোবল চাঙ্গা করে রাখতে চান। সে জন্য আগেই নিজ দায়িত্বে ঘোষণা দিয়ে রাখছিলেন যে, মোদি প্রধানমন্ত্রী হলেও তাতে ভারতের নীতিতে কোনো বদল হবে না, ভারত যেভাবেই হোক হাসিনার টিকিয়ে রাখার পক্ষেই থাকবে ইত্যাদি।



পঙ্কজের এই ‘বাড়াবাড়ি সার্ভিস’ এবারের জয়শঙ্করের সফরে উদোম হয়েছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভারতের গোয়েন্দা-আমলা যতই শক্তিশালী হোক না কেন রাজনীতিকেরাই শেষ কথা বলার ক্ষমতা রাখেন এবং এটা আইনি, আমলাদের বিজনেস রুল ও রেওয়াজের দিক থেকেও সত্য। ভারতের গোয়েন্দা-আমলারাও এটা মেনে চলতে অভ্যস্ত। তবু পঙ্কজ যেন কী কারণে মরিয়া। তিনি ধরেই নিতে চান, রাখতে চান যে নতুন দলের প্রধানমন্ত্রী মোদি আমেরিকার সাথে স্থবির অমীমাংসিত ইস্যুতে যাই করেন, যেভাবে নতুন রূপ আকার সমাধান দেন না কেন তা পঙ্কজকে তথা গোয়েন্দা-আমলাদের হিসাব,পথ ও কথা না শুনে তা যেন করতে পারবেন না। এক কথায় বললে, এটা রাজনীতিবিদদের ওপর আমলাদের ক্ষমতা কর্তৃত্বে বসিয়ে নিয়ে দেখা এক বোকার চিন্তা ও কল্পনা। রাজনীতিবিদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য খোলা স্পেস ছেড়ে না দিয়ে উল্টো তাদের নিয়ন্ত্রণ করার অক্ষম প্রচেষ্টা। এর ফলেই কি ইতোমধ্যে সচিব পর্যায়ের তিনজনের বাধ্যতামূলক অপসারণ এমন মনে করার কারণ আছে। আর পঙ্কজ যে হাসিনার কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করার পক্ষে কাজ করতে মিথ্যা ধারণা ছড়াচ্ছিলেন এর প্রমাণ হলো গত সপ্তাহে সচিব জয়শঙ্করের বাংলাদেশ সফর ও ‘সমন্বিত বার্তা বহন। ফিল রাইনার ওবামা-মোদির নীতিগত ঐকমত্যের দিকটি দৃশ্যমান করতেই ওই প্রেস কনফারেন্সে স্পষ্ট ও বিস্তৃত স্বীকারোক্তি হাজির করেছিলেন।



ফিল রাইনারের বক্তব্যের সারকথার আর এক গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, তিনি দাবি করছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় ‘শান্তি ও স্থিতিশীলতা’ ব্যাপারে দুই নেতা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন। এই বিষয়টা ওবামা-মোদির স্বাক্ষরিত ৫৯ দফা ‘যৌথ ঘোষণার’ ৪৬ নম্বর দফায় এবং আলাদা করে স্বাক্ষরিত ‘এশিয়া নীতি বিষয়ে যৌথ স্ট্র্যাটেজিক ভিশন’ ডকুমেন্টের শুরুতেও তা উল্লেখিত হয়েছে। এগুলো গেল ভারত-আমেরিকার নীতিগত ঐকমত্যের দিক। কিন্তু কী উপায়ে এসব নীতি বাস্তবায়ন করা হবে এ প্রসঙ্গে ফিল রায়নার দাবি করছেন ওবামা ভারতের সক্রিয় ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া’ ও ‘এর নির্বাচন’ এবং ‘এটা যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে’ এবং এর মাধ্যমে ‘গণতান্ত্রিক শক্তির ক্ষমতা’ এবং ‘জনগণের সব অংশের ক্ষমতাবান হয়ে ওঠা’ এসব কিছু হতে পারে সেই উপায়। এ ব্যাপারে উভয় নেতা একমত হয়েছেন। তাই এই উপায়কে তারা উভয়ে খুব গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন এবং উৎসাহিত করতে থাকবেন। ‘উভয় নেতার কথোপকথন দেখে  (I was able to see in terms of the conversation) এটাই ফিল রায়নারের অনুভব ও মন্তব্য।



এখনকার প্রসঙ্গে সার করে আমাদের জন্য এতটুকুই প্রাসঙ্গিক যে, এ যাত্রায় মোদি ওবামার সাথে মিলে ‘গণতান্ত্রিক নীতি ও মানবাধিকারের’ নীতির মাহাত্মে যদি মেতে ওঠেন, ফিল রায়নারের বক্তব্য যদি অর্থপূর্ণ হয় তাহলে অন্তত বাংলাদেশের ভোট, ভোটার বা নির্বাচন আমরা কিছু বুঝি না, ভারতের জন্য বাংলাদেশের অমুক দলকেই আমরা ক্ষমতায় দেখতে চাই এই অন্যায় দুঃসহ আবদার থেকে আমাদের আপাত মুক্তি মিলতে পারে। আমাদের নগদ লাভ এখানেই। তবে এখানে এসব কথার অর্থ আরো পরিষ্কার করার দরকার আছে। যেমন এর অর্থ এমন নয়, এটা চীনের বা আমেরিকার পক্ষপুষ্ট হয়ে বা গিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে যাওয়া মনে করা ভুল হবে।



সাধারণভাবে বললে এশিয়ায় ভারত, চীন বা আমেরিকা এই তিন শক্তির কোনো একটার দিকে ঢলে পড়ে অপর দুটোর কোনো একটার বিরুদ্ধে এটাকে ব্যবহার করার চিন্তা করাই যাবে না। বরং কারো স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থের পক্ষে না গিয়ে বিশেষত কারো স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থের বিপক্ষে অন্যকে সুবিধা দেয়ার আত্মঘাতী পথে না গিয়ে বাংলাদেশের নিজের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে এক ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান অবশ্যই নিতে হবে। এটাই একমাত্র রাস্তা আমাদের জন্য খোলা আছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে এমন রাজনৈতিক ক্ষমতা দাঁড় করানো যাবে না যে, তা নিজের জনসমর্থন হারিয়ে, আকণ্ঠ লুটপাটে নিমজ্জিত হয়ে এরপর চীন অথবা ভারতকে বিশেষ সুবিধা দেবো বিনিময়ে সে যেন আমাকে ক্ষমতায় রাখে এই দুর্গতির পথে হাঁটা যাবে না। এটা বর্তমান আওয়ামী লীগের সরকার, আগামী সম্ভাব্য বিএনপি অথবা আসন্ন যেকোনো দলের বেলায় কঠিনভাবে সত্যি। এ দিকটা খেয়াল রেখে এ জন্য উপযোগী রাজনৈতিক ক্ষমতা, পদ্ধতি কাঠামো তৈরি করা বাংলাদেশের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। তবেই আমরা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ তৈরি করতে সক্ষম হতে পারি। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ কোনো বিভাজনের ইস্যু পরিহার করে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরির দিকে মনোযোগী হতে হবে।


 


নরেন্দ্র মোদি আর প্রণব মুখার্জির দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য
তবে আরো কিছু কথা আছে। আমেরিকাকে হাসিনার এই উন্নাসিক নীতি তৈরির পটভূমিটা তৈরি হয়েছিল প্রেসিডেন্ট বুশের সাথে তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের বোঝাপড়া ও সম্পর্কের ভিত্তিতে, তারই ফলাফলে। কিন্তু প্রণবের সেই কংগ্রেস সরকার আর এখন ক্ষমতায় নেই, গত হয়েছে। আর মোদি কোনো বিবেচনাতেই প্রণব নন। ব্যক্তিগতভাবে প্রণবের সাথে হাসিনার সম্পর্ক যে পর্যায়ে ছিল মোদি ঠিক তেমন ভাবের কোনো সম্পর্ক চান বলে মনে হয় না, প্রমাণ নেই। যেমন বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে অর্থনৈতিক করিডোর বা কূটনৈতিক ভাষায় ভারত যেটাকে ‘কানেক্টিভিটি’ বলে তা মোদিও অবশ্যই চান। কিন্তু এর অর্থ প্রণব করেন এভাবে যে, এটা হাসিনার সরকারের কাছ থেকে আদায় করা বিনাপয়সায় ট্রানজিটের মালামাল নেয়ার একটা কাগুজে অনুমতিপত্র হিসেবে। কিন্তু মোদি এই পেটি মনোভাব থেকে ব্যাপারটাকে দেখেন না। তিনি ট্রানজিট, করিডোর বা কানেক্টিভিটি বলতে বোঝেন কোনো অনুমতির কাগজ নয় বরং বাংলাদেশে করিডোরের জন্য রাস্তাঘাট ব্যবস্থার ফিজিক্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার।


ফলে স্বভাবতই সেটার বিস্তারিত অর্থ হলো, এ কাজে বিনিয়োগের লক্ষ্যে দেশী-বিদেশী অর্থ জোগাড়, যৌথ প্রকল্প হাতে নেয়া আর পরে বাস্তব ইনফ্রাস্ট্রাকচার রাস্তাঘাট ইত্যাদি। অর্থাৎ এক বিশাল অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক কারবার হবে, যার মধ্যে দুই পক্ষের লাভালাভ দেখতে পাওয়া, বাংলাদেশের হাত মুচড়ে তা আদায়ের পথেরও বাইরে এই প্রজেক্টের নিজস্ব বাণিজ্যিক ভায়াবিলিটি থাকবে। ফলে চাপে পড়ে নয়, এরপর বাংলাদেশের সক্রিয় উদ্যোগ, অংশগ্রহণ এবং ভারতের টোল দিয়ে ব্যবহার করার ব্যাপার হবে। কারণ প্রশ্নটা হাত মুচড়ে নেয়ার নয়, প্রজেক্টের নিজস্ব বাণিজ্যিক ভায়াবিলিটি তৈরি করা। ট্রানজিট ইস্যুতে এখানে প্রণবের এপ্রোচটা হলো হাসিনার কাছ থেকে একটা পার্মানেন্ট দাওয়াতপত্র জোগাড় করা ধরনের।


অথচ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখা বা নিঃশর্ত সমর্থনের বিনিময়ে বাংলাদেশ থেকে একটা কাগজ জোগাড়ের বিষয়ই মূলত এটা নয়। ভারতীয় ট্রাক যাওয়ার ব্যাপারটি শুধু অনুমতির বিষয় নয়; সেই লং-হুইল ট্রাক যাওয়ার ‘রাস্তা’ কী হবে সে প্রশ্নে চুপ থেকে প্রকারান্তরে সেটা বাংলাদেশ নিজ রাজস্ব আয় দিয়ে ‘যেভাবে পারে’ জুগিয়ে যাবে ধরে নিতে পারে একমাত্র পেটি-চিন্তার মন। কোনো সিরিয়াস ব্যবসায়ীর চোখে এটা কোনো অর্জন নয়। ‘যেভাবে পারে’ অবস্থার রাস্তার দশা কেমন হবে সেটা যেকোনো সিরিয়াস প্রফেশনাল ব্যবসায়ী বোঝেন। ফলে এটা ব্যবহার করে কোনো ব্যবসার সম্ভাবনা তিনি দেখবেন না। ফলে প্রণবের চোখে ট্রানজিট ইস্যুটা হলো তথাকথিত রাজনৈতিক, একটা তাঁবেদার সরকার বসিয়ে অনুমতির কাগজ জোগাড়ের। আর মোদির চোখে সেটা সিরিয়াস অর্থনৈতিক, বাস্তব ইনফ্রাস্ট্রাকচারের। বাংলাদেশে নিজের পছন্দের হাসিনা ধরনের সরকার সেখানে কোনো ইস্যুই নয়। আবার ওদিকে ভারতের পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা ইস্যুটাও বাংলাদেশের তাঁবেদার সরকার বসালেই সমাধান হবে বলে প্রণব দেখেন। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক এমন নয়। আসল সমাধান ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্ব থেকে রিসোর্স বণ্টনে পিছিয়ে পড়া পূর্বাঞ্চলকে মনোযোগ দেয়া। মোদি এভাবে ব্যাপারটাকে দেখেন বলে নির্বাচনী প্রচারণার সময় থেকেই জানিয়েছেন। সারকথায় প্রণবকে হাসিনা যা বিক্রি করেছিলেন মোদির বেলায় মোদি তা কিনে ভারতের কোনো লাভ আছে বলে মনে করেন না। ফলে তিনি হাসিনার গ্রাহকই নন। হাসিনাকেই ক্ষমতায় রাখতে হবে এমন বাসনা বা গরজ তাই মোদির নেই। অন্তত প্রণবের মত তো নয়ই।



গত ২০১১ সাল থেকে ওবামা বাংলাদেশের ওপর দিল্লির মধ্যস্থতায় ব্যবহারের যাঁতাকাঠিটা ভারতের থেকে ফিরিয়ে নিজের কব্জায় নিয়েছেন। এতে ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের চেয়ে ভারতের আমলা-গোয়েন্দারা নাখোশ হয়েছেন বেশি। অন্য দেশের ওপর প্রভাব খাটানোর অনিবার্য ক্ষমতা একটি দেশ অর্জন করে মূলত নিজ অর্থনীতির সক্ষমতাকে দুনিয়ার প্রধান দু-তিনটা অর্থনীতির একটি হিসেবে হাজির করতে পাওয়ার ওপর। ভারতের আমলা-গোয়েন্দারা সেটা করে দেখানোর মুরোদ অর্জন করার কষ্টকর কাজটা করে দেখানো ছাড়াই আমেরিকার যাঁতাকাঠি চায়। প্রণবের কংগ্রেসের বিদেশনীতির ভারকেন্দ্র ছিল এখানে। গত ২০০৭ থেকে ২০১১ এই কয়েক বছর সেটা ব্যবহারের জমিদারি সুখ ভোগের পর সেটা ফিরে পাওয়া তাদের এখনকার একমাত্র আরাধ্য, সেটা পেলেই কেবল তারা সন্তুষ্ট হবে। কিন্তু বাস্তবতা পালটে গেছে অথচ তারা সে বাস্তবতা মেনে ভিন্ন চিন্তা করতে চায় না। গত বছর মোদি জিতে আসার আগ পর্যন্ত ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক স্থবির হয়ে পড়েছিল। আগেই বলেছি ভারতের সমস্যাকে দেখার এপ্রোচ মোদির ভিন্ন। ফলে ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিজের মতো মোদি ঢেলে সাজিয়ে নিতে পারলেও এর পক্ষে একই সমতালে আমলা-গোয়েন্দাদের উদ্যোগ শামিল করতে পারছিলেন না।


এ কাজে ভারতের পররাষ্ট্র বিভাগ থেকে সবার আগে মোদির এপ্রোচের পক্ষে সক্রিয় সাড়া ও সহায়তা তিনি পান জয়শঙ্করের কাছ থেকে, তিনি তখন ছিলেন আমেরিকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত। সেই থেকে মোদির চোখে জয়শঙ্করের গুরুত্ব ও ঘনিষ্ঠতা। আর ঠিক সমান বিপরীত মাত্রায় তখনকার পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের প্রতি মোদির দূরত্ব সৃষ্টি ও অসন্তুষ্টি। পদের স্তর হিসেবে সার্ভিস আয়ুষ্কালের দিক থেকে জয়শঙ্কর সুজাতার চেয়ে সিনিয়র হলেও সুজাতার অধীনের পদে ছিলেন জয়শঙ্কর। গত জানুয়ারিতে ওবামার ভারত সফরের সময় এই পরিস্থিতি এতই মিসম্যাচ হয়ে উঠেছিল যে, ওই সফরের আয়োজন উপলক্ষে মন্ত্রণালয়ের আমলাদের কাজের দায়িত্ব বণ্টনে সুজাতাকে কোনো বিশেষ দায়িত্বের বাইরে রাখা হয়েছিল বলে ভারতীয় মিডিয়ায় খবর এসেছিল। জমতে থাকা এসব টেনশনের ফলাফলে ওবামার ভারত ত্যাগের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সুজাতার বরখাস্ত আদেশ আসে। আর জয়শঙ্করের সরকারি চাকরিজীবন শেষ হওয়ার মাত্র দু’দিন আগে তাকে পররাষ্ট্র সচিব বলে ঘোষণা করেন মোদি।


জয়শঙ্করের বিশেষত্ব হলো, তিনি বুশের থেকে তুলনায় বদলে যাওয়া ওবামার নীতি সহজে মেনে নিয়ে এরপর আমেরিকান স্বার্থ আর ভারতের স্বার্থের কমন জায়গা কী হতে পারে তা এক্সপ্লোর করে ভায়াবল ও কার্যকর পথ বের করতে সমর্থ একজন কারিগর হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছেন। এমন কাজ সফল করতে গিয়ে আবার জয়শঙ্কর এক বিশাল সুবিধা অর্জন করেছেন। ভারতের সাথে আমেরিকার অমীমাংসিত ইস্যুগুলোতে ঐকমত্যের জায়গা বের করার জন্য আমেরিকাও মুখিয়ে ছিল। কারণ আমেরিকার এশিয়া নীতিতে সাফল্য আসার ক্ষেত্রে ভারতের সাথে সম্পর্ককে আমেরিকা খুবই নির্ধারক বিষয় মনে করে। ফলে আমেরিকার কাছেও জয়শঙ্কর একজন গভীর আস্থার ব্যক্তিত্ব হয়ে হাজির হলেন, যিনি আমেরিকার চাওয়া-পাওয়াগুলোর দিকগুলোর পজিশনের সম্যক খবর রাখেন। এসব কিছু মিলিয়ে আমেরিকার আস্থার জয়শঙ্ক যিনি গত ২ মার্চ বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন।


 


জয়শঙ্করের বাংলাদেশ সফরের গ্রাউন্ড প্রস্তুতি
কিন্তু জয়শঙ্করের এই সফরের গ্রাউন্ড প্রস্তুত করতে মোদির স্টাইল খুবই চমকপ্রদ। মোদি চমক দিয়ে কাজ করতে দেখাতে ভালোবাসেন। তিনি কোনোভাবেই জয়শঙ্করের বাংলাদেশ সফরকে হাই প্রোফাইলে দেখাতে রাজি নয়। অর্থাৎ জয়শঙ্কর মূলত কেবল ভারতের নয়, একটা সমন্বিত বার্তা নিয়ে আসছেন। ফলে এমন হাই প্রোফাইল সফর হওয়া সত্ত্বেও মোদি সেটা লো প্রোফাইলে হাজির করতে চান। কারণ তাতে সফলতার সম্ভাবনা অনেক বেশি এবং তা সফরের লক্ষ্যের সাথে ফিট করে। মোদি একে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের রুটিন সার্ক দেশগুলো সফর বলে হাজির করতে চাইলেন। জয়শঙ্করের এই সফরের অফিসিয়াল নাম তাই ছিল ‘সার্ক-যাত্রা’, অর্থাৎ কেবল বাংলাদেশ নয়।



কিন্তু দাওয়াতের একটা ব্যাপার আছে। এখানে দাওয়াত মানে ইজি মুলাকাত, আপসে, নো টেনশন। জয়শঙ্কর একটা দাওয়াতে, যা মূলত সম্মতিতে, বাংলাদেশে আসছেন সেটা দেখানোর দিকটাও জরুরি। তাই মোদি এবার ক্রিকেট-কূটনীতি ব্যবহার করলেন। তখন ওয়ার্ল্ড কাপ শুরু হচ্ছিল। ফলে মোদি ওই খেলার আয়োজনে সার্কের সদস্য যারা বিশ্বকাপে অংশ নিচ্ছেন এমন সরকারপ্রধানদের স্ব-স্ব দেশকে তার সাফল্য কামনা জানাতে মোদি ফোন করেছিলেন। ক্রিকেট ছিল সেই উছিলা। মোদি হাসিনাকে ফোন করেন গত মাসের ১৩ ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ এর আগে থেকেই জয়শঙ্কর যে সমন্বিত বার্তাবাহক হিসেবে আসবেন তা সাব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। ওই ফোনকল থেকে মোদির যা পাওয়ার ছিল তা হলো, জয়শঙ্করকে তিনি পাঠাচ্ছেন এই সফরের পক্ষে হাসিনার সম্মতি আদায় বা জানিয়ে রাখা। তবে এজেন্ডা কী হবে তা নিয়ে খুব বিস্তারিত কিছু আলাপ তিনি তোলেননি; সেটা অনুমান করতে পারি আমরা। মোদির ফোনের পর হাসিনার সাথে কী বিষয়ে কথা হয়েছে তা নিয়ে ভারতের মুখপাত্র সৈয়দ আকবর উদ্দিনকে প্রেস প্রশ্ন করেছিল। প্রশ্নের জবাবে তিনি জানিয়েছিলেন, ক্রিকেট শুভেচ্ছার বাইরে অনেক কিছু নিয়েই আলাপ হয়েছে।



এরপর ভারতের পররাষ্ট্র বিভাগ থেকে সার্ক-যাত্রার ঘোষণা আসে। কিন্তু কবে আসবেন, কী এজেন্ডায় জয়শঙ্কর বাংলাদেশ আসছেন এর শিডিউল গত ২৫ ফেব্রুয়ারির আগে জানানোই হয়নি। মিডিয়ায় যেখানে যতটুকু প্রকাশিত হয়েছে তা অনুমাননির্ভর, ইনফরমাল উৎসের, আনুষ্ঠানিক নয়। এর কারণ কী? ভারতের ‘দি হিন্দু’ পত্রিকার সুহাসিনী হায়দার জানাচ্ছেন, এর কারণ। তিনি লিখছেন,‘জয়শঙ্কর আমেরিকা সফরে আছেন। তিনি ফেরত আসার পরই ২৬ ফেব্রুয়ারি শিডিউল জানানো হতে পারে’। অনুমান করা যায় ‘সমন্বিত বার্তা’ তৈরি ফাইনাল করতে জয়শঙ্করের আমেরিকা সফরের সম্ভবত একটা উদ্দেশ্য। এটা ভারতের একার ইস্যু নয়। তাই সম্ভবত সেই সমন্বিত বার্তা ঠিকঠাক করে জয়শঙ্কর যাওয়ার জন্য রেডি হবেন, বার্তার ড্রাফট রেডি হবে এসব বিষয় ছিল তাই আগে তার সফরসূচি আমাদের জানাতে পারছিলেন না। বাংলাদেশের পত্রিকা ও ভারতের পত্রিকার অনুমিত খবরে তাই বাংলাদেশ সফরের তারিখ কেউ জানাচ্ছিলেন ১ মার্চ, কেউবা ২ মার্চ।



সমন্বিত বার্তা বাহকের ভূমিকার কথা ভারত তার মিডিয়ার বাইরে রাখতে পেরেছেন বলেই মনে হচ্ছে। যেমন ভারতের ‘দি হিন্দু পত্রিকার’ সুহাসিনী ২৮ ফেব্রুয়ারি জয়শঙ্কর বাংলাদেশে কী নিয়ে মেতে থাকবেন সে প্রসঙ্গে লিখছেন, In Dhaka, he is expected to discuss the issues of the Land Boundary Agreement, which is expected to be tabled in Parliament for clearance, as well as the Teesta water settlement, given the nod by West Bengal Chief Minister Mamata Banerjee during her visit to Dhaka last week. Prime Minister Modi is understood to have told Sheikh Hasina about his intention to visit Dhaka very soon when he spoke to her ahead of the Foreign Secretary's visit.অর্থাৎ একেবারেই রুটিন অমীমাংসিত ইস্যু কেন্দ্র করে লেখা রিপোর্ট। অথচ আগেই বলেছি এসব ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশের সাথে ঝুলে থাকা কোনো বিষয়ই নেই। বিষয়টা ভারতের দিক থেকে অ্যাকশনের, করে দেখানোর। এসব তো হাসিনা ভালোই জানতেন। তাহলে মোদির ক্রিকেট কূটনীতির ফোনালাপে জয়শঙ্করকে মোদির সফরে পাঠানোর ইচ্ছাকে হাসিনা সাড়া দিলেন কেন? কী বুঝে?



এটা বোঝা কঠিন নয় যে, শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের বিষয়ে বিদেশী কারো সাথে ডায়লগে আগ্রহী নয়, ফলে কোনো কূটনৈতিক সফরে এ বিষয়কে এজেন্ডা রাখতেই রাজি না। এই ‘বিদেশ’ বলতে ভারতও অন্তর্ভুক্ত। এই বিচারে হাসিনার এগোনোর কৌশলের দিক থেকে তিনি মোদির কাছে ধরা খেয়েছেন, বলতে হবে। তবে হতে পারে তখনো তিনি জানতেন না জয়শঙ্করের এই সফর আসলে ‘সমন্বিত বার্তা’ বাহকের সফর। অনুমান করা যায় অন্তত সফরের দিনে ততক্ষণে তিনি যথেষ্ট জেনে গিয়েছেন। কিন্তু ব্যাপারটা স্রেফ হাসিনার জানা- অজানার মধ্যে সীমাবদ্ধ দেখলে ভুল হবে। জয়শঙ্করের সফরকে সাড়া দেয়ার পেছনে হাসিনার মূল ভাবনা হলো, ভারতের সমর্থন লাভের প্রয়োজন ও কড়কড়ে লোভ। এই লোভের জায়গাতেই তিনি ফেঁসেছেন। ফলে তাকে জয়শঙ্করের সমন্বিত বার্তা ধৈর্য রেখে শুনতে হয়েছে। ধরে নেয়া যায় স্বভাবতই তিনি বিরক্ত হয়েছেন। ‘ভারতকেও দেখা হয়ে গেল’ ধরনের একটা শ্বাস ফেলেছেন হয়তো। কিন্তু মনে করা ভুল হবে যে, তিনি এতটুকু টলবেন। ভারতসহ বিদেশী কারো সমর্থন ছাড়াই তিনি কোনো আলোচনা ডায়লগ সংলাপ ছাড়াই আগের মতো ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার পথেই দৃঢ়তা দেখাতে থাকবেন। অর্থাৎ সারকথা হলো, ঘটে যাওয়া জয়শঙ্করের সফরটা আমরা বলতে পারি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কটে সর্বশেষ আলাপ-আলোচনা, মধ্যস্থতা ইত্যাদির সিভিল ও কূটনৈতিক পথে কোনো সুরাহা পাওয়ার শেষ সুযোগ। তবে এটা সুযোগ হলেও কোনো পক্ষের ভোগে লাগছে না, আপাতদৃষ্টিতে নিষ্ফলা সুযোগ হয়ে থাকছে। আর কূটনীতিকদের দিক থেকে তারা যে উদ্যোগ রেখেছিলেন এর রেকর্ড হয়ে থাকল, যা আগামীতে দরকার হবে।



তাহলে এখন কী হবে? যা হবে তা হলো, কোনো বলা-কওয়ার সুযোগ না নিয়ে দেশী এবং বিদেশীরা সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকে একপক্ষীয় অ্যাক্ট, যা তারা দেখাতে পারবে তাই দেখাতে থাকবে, এই পথে হাঁটবে। সেই পথেই বাংলাদেশ যাচ্ছে। অর্থাৎ হাসিনা ইনক্লুডেড আলাপের পথ শেষ, যার যার আলাদা পথে পোলারাইজেশনের শুরু হবে এখান থেকে।



জয়শঙ্করের এই সফর পুরোটাই মূলত একটা অঘোষিত এজেন্ডার সফর। সাইড টকের ভেতর ছিল আসল এজেন্ডা। আর সাইড টকে কী ছিল তা ঘোষিত এজেন্ডায় আনার দরকার থাকে না। এ ছাড়া খালেদার সাথে জয়শঙ্করের সাক্ষাৎ কী এজেন্ডায় থাকবে কি না এ জল্পনা-কল্পনা ছিল। সেটা শুধু খালেদাকে গ্রেফতারের পরোয়ানা তখনো তামিল হয়নি সে জন্য নয়। এ ছাড়া আরো দুটো উদ্যোগ আমরা জয়শঙ্করের সফরের আগের দিন দেখেছিলাম। খালেদা এখন যে অফিসে থাকছেন তা তল্লাশির পক্ষে আদালতের অনুমতি জোগাড় করা হয়েছিল। আর বাড়ির সামনের সব পুলিশ প্রত্যাহার করা হয়েছিল। অর্থাৎ জয়শঙ্কর যদি যেতেন যেন দেখে মনে না হয় যে, একজন ‘গ্রেফতারের পরোয়ানা পাওয়া আসামি’ খালেদার সাথে তিনি দেখা করতে এসেছেন। একজন কূটনীতিকের জন্য এটা খুবই বিব্রতকর। শেষে জয়শঙ্কর খালেদার সাথে সাক্ষাৎ করতে যাননি।



 


হাসিনার অপছন্দের কাজ
কিন্তু একটা অনুমান এখানে করা যায়। জয়শঙ্করের এই সফরে হাসিনার অপছন্দ হবে এমন দু’টি কাজ তাকে করতেই হয়েছে। এক. ‘সমন্বিত বার্তা’ শোনানো আর দুই. খালেদার সাথে (সম্ভাব্য) দেখা করা। এই দুটোর মধ্যে প্রথমটা করতেই তার এখানে আসা। আর দ্বিতীয় অপছন্দের কাজটা খালেদার সাথে দেখা করা। আমরা দেখলাম সেটা তিনি এড়ালেন বটে। কিন্তু সে মেসেজটা অন্যভাবে হাজির করলেন। পরের দিন আমেরিকান রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের নেতৃত্বে ঢাকার ১৬ কূটনৈতিক মিশন প্রধান খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করলেন। অর্থাৎ অপছন্দের কাজটা অন্যভাবে ঘটানো হলো।


 

0 comments:

Post a Comment