WHAT'S NEW?
Loading...

কবি

 



হারম্যান হেস
অনুবাদ : মনোজিৎকুমার দাস


এক সন্ধ্যায় নদীর তীরে ল্যান্টার্নস উৎসবের জমজমাট আয়োজন চলছিল। হান ফুক একা একাই হাঁটছিল নদীর তীরে। হাঁটতে হাঁটতে অনুষ্ঠানস্থল থেকে বেশখানিকটা দূরেই এসে পড়ল। এক সময় নদীর জলের মধ্যে হেলে থাকা একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে দ

াঁড়িয়ে গেল সে। ওভাবে দাঁড়িয়ে সে নদীর জলে হাজার হাজার বাতির আলোর প্রতিবিম্ব দেখে হলো বিস্মিত।


সে দেখতে পেল নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী একে অপরকে অভিনন্দিত করছে। ফুলের মতো সুন্দর রঙবেরঙের পোশাক পরে তারা নৌকায় নদীতে ভেসে বেড়াচ্ছে আনন্দে। মেয়েদের কণ্ঠের সুরধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে নদীর কূলে। মধুর সুরে বাঁশি বাজছে। চার দিকে মনোরম পরিবেশ। আলোঝলমলে নীলাভ রাত! অপূর্ব দৃশ্য অবলোকন করতেই হান ফুলের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। তার মানসলোকে আনন্দের জোয়ার। আনন্দ আর সৌন্দর্যের সে যেন একমাত্র সাক্ষী। যদিও সে নদী পার হয়ে তার কনের সঙ্গীসাথীদের সাথে যোগদান করে আনন্দে শরিক হতে পারেনি। সে একান্ত নিজস্বভাবে এই উৎসবের সৌন্দর্যরাশিকে উপভোগ করতে চায় আর সেই দৃশ্যাবলিকে কবিতার ভাষায় রূপ দিতে ইচ্ছে পোষণ করে। নীলাভ রঙিন রাতের বুকে কবিতা যেন আপন মাধুর্যে ধরা দেয়ার জন্য তার দিকে ছুটে আসছে। পানির ওপর রাতের নীল আলোর খেলা চলছে। ওখানে উপস্থিত অতিথিরা আনন্দে আত্মহারা। সেই শুধু দূরের নদীর ওপর হেলানো গাছের গুঁড়িটির ওপর ঠেস দিয়ে অপেক্ষা রত।


এক সময় সে উপলব্ধি করল, যদি তার অভিজ্ঞতা থাকত তবে কবিতায় ফেস্টিভ্যাল সম্পর্কে সারা বিশ্বজগৎকে জানাত। সে নিঃসঙ্গতা আর একাকিত্বের মধ্যে জীবনকে অতিবাহিত করছে। তার মনে একমাত্র চিন্তা কিভাবে সে একজন খ্যাতিমান কবি হবে। কবিতাই তার ধ্যান-জ্ঞান। সে এই পার্থিব জগতে অমর হয়ে থাকতে চায়, একজন কবি হিসেবে।



হান ফুক বুঝে উঠতে পারল না সে ঘুমিয়ে পড়েছিল না জেগে ছিল। সে ক্ষীণ কণ্ঠের আওয়াজ শুনে সচকিত হয়ে তাকিয়ে দেখল একজন আগন্তুক পাশের গাছের গুঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি একজন বয়োবৃদ্ধ। গায়ে বেগুনি রঙের পোশাকে হান ফুক উঠে দাঁড়িয়ে আগন্তুকের সাথে কথা বলল স্বাগত কণ্ঠে। আগন্তুক হেসে কয়েক লাইন কবিতা বললেন। তরুণ যুবাটির হৃদয় বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে উঠল। বৃদ্ধ আগন্তুকের কণ্ঠ থেকে নিসৃত কবিতার পঙ্ক্তিগুলোর সৌন্দর্যে তরুণটি বিমুগ্ধ। সে তার কবিতার পঙ্ক্তিমালায় হতবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ওহ, আপনি কে? আপনি আমাকে আপনার আত্মাকে দর্শন করাতে সক্ষম হয়েছেন। আমার শিক্ষকদের কবিতার চেয়ে সুন্দর পঙ্ক্তিমালা আমাকে উপহার দিয়েছেন। আমি কবি হতে চাই। আপনি কে?’



আগন্তুক সন্তষ্টির হাসি হেসে বললেন, ‘যদি তুমি কবি হতে চাও তবে আমার সাথে এসো। তুমি পর্বতমালার উত্তর পশ্চিমের বড় নদীটার তীরে আমার কুটির দেখতে পাবে। যেখানটাতে আমি মাস্টার অব দ্য পারফেক্ট ওয়ার্ড নামে অভিহিত হয়ে থাকি।’ কথাগুলো বলে বৃদ্ধলোকটা গাছের পাতার সরু ছায়ার দিকে হাঁটতে লাগলেন। কিন্তু হাঁটতে না হাঁটতেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন তিনি। হান ফুক তাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কোনো হদিস পেল না। মনে মনে ভাবল, সে হয়তো এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। সে নদী পার হওয়ার জন্য দ্রুত নৌকায় গিয়ে উঠল। যোগ দিলো ফেস্টিভ্যালে। কথাবার্তা ও বাঁশির সুরের মধ্যেও তার কানে আগন্তুকের কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে লাগল। সে আগন্তুকের কণ্ঠস্বর শুনছে তো শুনছেই। তার অন্তরাত্মাটা ওই আগন্তুকের সাথে উধাও হয়ে যাচ্ছে। সে স্বপ্নাবিষ্ট চোখে একটু দূরেই বসল। পাশে যারা আনন্দ-ফুর্তি করছিল তারা তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করছিল।



কয়েক দিন পরে হান ফুকের বাবা তার বন্ধু আর আত্মীয়দের আমন্ত্রণ জানালেন তার ছেলের বিবাহের দিন ধার্য করার উদ্দেশে। কিন্তু হান ফুক তার বাবাকে বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করুন। আমি যদি পিতার অবাধ্য হয়ে অন্যায় করে থাকি তবে পুত্র হিসেবে পিতার কাছে চিরদিন দায়ী থাকব। আপনি জানেন আমি কবিতার জন্য নিবেদিত। কবিতা আমার ধ্যানজ্ঞান। যদিও আমার কয়েকজন বন্ধু আমার লেখা কবিতার প্রশংসা করে থাকে। তবুও আমি ভালো করেই জানি আমি এখনো নবীন। আমাকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। সুতরাং আমি আপনাকে অনুরোধ করছি যে আমাকে কিছু দিনের জন্য একাকী থাকতে দিন যাতে আমি কবিতাচর্চায় মনোনিবেশ করতে পারি। এক সময় আমার স্ত্রী, বাড়িঘর আর অন্য সব কিছু হবে। এখন আমি তরুণ এবং অন্যান্য কর্তব্যকর্ম থেকে মুক্ত। আমি একাকি শুধু কবিতার সাথে সময় কাটাতে চাই। আমি আশা করি আমার কর্ম আমাকে আনন্দ ও খ্যাতি দান করবে।



পিতা-পুত্রের এই বক্তব্যে মজা পেয়ে বললেন, ‘তুমি কবিতাকে সবার ওপরে স্থান দিচ্ছ। এ কারণেই তুমি বিয়ের বিষয়ে অমত করছ? নাকি কনে পছন্দ নয়? যদি তুমি কনেকে পছন্দ না করে থাকো তবে বল, আমি অন্য মেয়ে দেখি।’



কিন্তু পুত্র পিতার কথা শুনে প্রতিজ্ঞা করে বলল যে সে কনেটিকে আগের চেয়ে কম ভালোবাসে না। তাদের মধ্যে অপছন্দের কোনো বাতাবরণ সৃষ্টি হয়নি। সে সময়ই সে তার পিতাকে বলল যে ল্যান্টর্ন ফেস্টিভ্যালের দিন একজন জ্ঞানী মানুষ নিজে তার সামনে উপস্থিত হয়ে তাকে কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। বর্তমানে তার সর্বপ্রধান মনোবাঞ্ছা ওই জ্ঞানী মানুষটির শিষ্য হওয়া।



‘বেশ, ভালো কথা’ পিতা বললেন, ‘আমি তোমাকে এক বছর সময় দিলাম। এই সময়ের মধ্যে তুমি তোমার স্বপ্নকে সফল করে তুলবে, যে স্বপ্ন তোমাকে দেখিয়েছেন তিনি একজন দেবতা।’ ‘ওটা করতে দুই বছরও লাগতে পারে হান ফুক ইতস্ততভাবে বলল’ তার পিতা তাকে চলে যাওয়ার অনুমতি দিলেন দুঃখভারাক্রান্ত মনে।



হান ফুক দীর্ঘ দিন বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করে একটা নদীর উৎসমুখে এসে একটা বাঁশের কুটির দেখতে পেল। কুটিরের সামনে বুনানো মাদুরে বসে আছেন একজন বৃদ্ধ। এই বৃদ্ধকেই বহু দিন আগে নদীর ধারের গাছের গুঁড়ির কাছে দেখতে পেয়েছিল সে। বৃদ্ধটি সেখানে বসে তার বীণা বাজাচ্ছিলেন। যখন অতিথিকে তার দিকে আসতে দেখলেন তখন তিনি উঠে দাঁড়ালেন না কিংবা তাকে অভিনন্দিতও করলেন না। শুধু একটু হেসে বীণার তারে হাতের আঙুল স্পর্শ করেই চললেন। জাদুকরী সঙ্গীতের সুরে উপত্যকাটিতে একটা রুপালি মেঘের আবির্ভাব ঘটল। এতে তরুণটি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে সব কিছু ভুলে বীণার সুরে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ল। এক সময় সে মহাজ্ঞানী পাশে বীণাটি রেখে কুটিরের ভেতর যাওয়ার জন্য পা রাখলেন। হান ফুক তাকে অনুসরণ করল তার একান্ত অনুগত সেবক ও শিষ্য হিসেবে।
এক মাস অতিক্রান্ত হলো, হান যে সব কবিতা লিখেছিল তা তার মন থেকে মুছে গেল। কয়েক মাসের মধ্যে সে তার বাড়িতে শিক্ষকের কাছে যা যা শিখেছিল তার সবই সে ভুলে গেল। ওস্তাদ এখন তার এই বৃদ্ধজ্ঞানী। ওস্তাদ তার সাথে খুব কমই কথা বলেন, যা বলেন তা অতি শান্তভাবে বলেন। তিনি হান ফুককে বীণায় যন্ত্রের সুরধ্বনি শেখাতে লাগলেন যে পর্যন্ত না সে সঙ্গীতে পারদর্শী হলো।



একদিন হান ফুক হঠাৎ একটা কবিতা রচনা করে ফেলল। তার কবিতায় চিত্রিত হলো দু’টি পাখির ওড়াউড়ি এবং শরতের আকাশ। কবিতাটি রচনা করে সে বড়ই আনন্দ পেল, যা তার কাছে বেশ চমৎকার বলে মনে হলো। কিন্তু কবিতাটা বিজ্ঞজনকে দেখানোর সাহস করল না। একদিন সন্ধ্যায় সে কুটিরের কাছে বসে গান গাইতে থাকল। বৃদ্ধজ্ঞানী মনোযোগ দিয়ে শুনলেন তার গান কিন্তু একটা শব্দও মন্তব্য করলেন না। তিনি শুধু তার বীণাযন্ত্র করুণ সুরে বাজিয়ে চললেন। হঠাৎ করে বাতাস শীতল হলো আর অন্ধকার নেমে এলো। একটা ঝড়ো বাতাস বইতে আরম্ভ করল যদিও সময়টা ছিল গ্রীষ্মের মাঝামাঝি। আকাশের রঙ ধূসর, আকাশে দু-ঝাঁক পাখি সারি বেঁধে উড়ে যাচ্ছে নতুন দেশের সন্ধানে। ওই পাখিগুলো ছিল তার কবিতাগুলোর চেয়েও সুন্দর। হান ফুক চরম দুঃখ পেয়ে নীরবে বসে রইল আর ভাবল আসলে সে একটা অপদার্থ।



এক বছর অতিক্রান্ত হলো। এর মধ্যে হান ফুক সুন্দরভাবে বীণা বাজাতে শিখল। সে বুঝতে পারল কবিতা লেখা অধিক কষ্টসাধ্য। দু’বছর অতিক্রান্ত হলো। বাড়ির জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল তার মন। উদগ্রীব হলো তার পরিবার, তার স্বদেশ আর তার জন্য মনোনীত কনের জন্য। তাই সে তার গুরুর কাছে বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রার্থনা জানাল। গুরু হেসে মাথা নাড়িয়ে বললেন, ‘তুমি মুক্ত’, ‘তুমি যেখানে ইচ্ছে যেতে পারো। আবার ফিরে আসতেও পারো। অন্য জায়গায়ও থাকতে পারো। তুমি যেটা পছন্দ করো তাই করো।’



সুতরাং শিষ্য বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলো। কোথাও না থেমে চলল একনাগাড়ে। একদিন সকালে সে তার নিজের শহরে গিয়ে হাজির হলো। সে দুরুদুরু বক্ষে তার বাগানে গেল এবং জানালা দিয়ে সে তার পিতার নাক ডাকা শুনতে পেল। তিনি তখন ঘুমাচ্ছিলেন। তাদের বাড়ির একটু দূরে বৃক্ষরাজির মধ্যে তার কনের বাড়ি। কনেটাকে একনজর দেখার ঔৎসুক্য জেগে উঠল তার মনে। সে চুপেচুপে মেয়েটার ঘরের পাশের একটা গাছে চড়ে বসল। কনে তার কক্ষের মধ্যে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। সে ওই দৃশ্যটা অবলোকন করে শিহরিত হলো। কিন্তু উপলব্ধি করল বাড়ির জন্য তার মনটা উদগ্রীব হওয়ার কারণ সে আসলে কবি হতে পারেনি। কবি হতে গেলে একটা মেয়ের জন্য এতটা উদগ্রীব হওয়ার কোনো অর্থ হয় না। সুতরাং, সে গাছ থেকে নেমে নিজ গ্রাম থেকে পালিয়ে পর্বতময় সেই উপত্যাকায় ফিরে গেল। সে দেখতে পেল আগের মতোই তার গুরু কুটিরের সামনে তার মাদুরটায় বসে বীণা বাজাচ্ছিলেন। হানকে দেখে অভ্যর্থনা জানিয়ে তিনি দু’টি কবিতা আবৃত্তি করে শিল্পকলা সম্বন্ধে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। গুরুর মনোমুগ্ধকর কবিতার পঙ্তির শব্দে হান ফুকের চক্ষুদ্বয় থেকে অশ্রুবিন্দু ঝরে পড়তে লাগল।



আবার হান ফুকের মনে পড়ল তার প্রভুর পার্ফেক্ট ওয়ার্ডের কথা। তিনি বীণাযন্ত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ বাদক হিসেবে তাকে শিক্ষাদান করে চলেছেন। তারপর মাসের পর মাস অতিক্রান্ত হলো। কতবার পশ্চিমা বাতাস বয়ে গেল, কতবার তুষারপাত হলো, কতবার বসন্ত এলো আর গাছে গাছে ফুল ফুটল।



দ্বিতীয়বার হান ফুকের বাড়ির কথা মনে পড়ল। প্রথমবার সে রাতের আঁধারে নিশ্চুপে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। কিন্তু এবার বাড়ি যাওয়ার আগে স্বপ্ন দেখল। দেখল, বাড়িতে সে একটা গাছের চারা লাগাচ্ছে তার পাশে তার স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। আর তার সন্তানেরা গাছের গোড়ায় পানি ও দুধ ছিটাচ্ছে। যখন সে জেগে উঠল তখন চাঁদের আলো তার ঘরের ভেতর ছড়িয়ে আছে। সে দেখতে পেল তার গুরু তার পাশে গভীর নিদ্রায় মগ্ন। হঠাৎ তার মন পাশে শুয়ে থাকা মানুষটার প্রতি বিরক্তি আর ঘৃণায় ভরে গেল। এই মানুষটিই তার জীবনটাকে বরবাদ করে দিয়েছে। তার ভবিষ্যৎ জীবনটাকে নষ্ট করে দিয়েছে। সে শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে যে মুহূর্তে হত্যা করতে যাবে ঠিক সে সময় বৃদ্ধ মনীষী জেগে উঠলেন। চোখ খুলে তার দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধ চোখে হাসতে লাগলেন। তার চোখের স্নিগ্ধ হাসিতে হান ফুকের হাত থেকে খসে পড়ল অস্ত্র।



‘মনে রেখো, হান ফুক,’ বৃদ্ধ মানুষটি শান্তভাবে বললেন, ‘তুমি মুক্ত। তোমার ইচ্ছা অনুযায়ী যা খুশি তাই করতে পারো। তুমি তোমার দেশে ফিরে যেতে পারো। গাছ লাগাতে পারো। তুমি আমাকে ঘৃণা করতে পারো কিংবা আঘাত করে হত্যা করতেও পারো সেটা কোনো একটা বিষয়ই না।’



‘ওহ, আমি আপনাকে কিভাবে ঘৃণা করলাম?’ কবিটি ধরা গলায় চিৎকার করে বলে উঠল, ‘ওটা ছিল ঈশ্বরের নিজের বিষয়।’
সুতরাং সে বীণা বাজানো আবার শিখতে আরম্ভ করল। গুরুর নির্দেশে কবিতাও লিখতে লাগল। ক্রমে ক্রমে সে রহস্যময় শিল্পকলা সম্পর্কে অনেক জ্ঞান লাভ করল। সে গুরুর কাছ থেকে রহস্যময় জগৎ সংসার সম্বন্ধে অনেক অনেক জ্ঞানার্জন করল।
বড় নদীটির তীরে হান ফুক কত বছর অতিবাহিত করেছে তা তার স্মরণে নেই। জ্ঞানীবৃদ্ধের সম্মোহনী শক্তির প্রভাবে এখন হান ফুক তার বয়স আর সময় সম্বন্ধে সব জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।



একদিন ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠে সে তার গুরুকে কোথাও দেখতে পেল না। সব জায়গায় সে তার মনিবকে খোঁজ করল কিন্তু কোথায়ও তার দেখা মিলল না। দিন গিয়ে রাত এলো, একটা ঋতুর পর আর একটা ঋতু এলো। পাখিরা এলো আবার উড়ে গেল, গাছে গাছে ফুল ফুটল, আবার ঝরেও গেল, নদী দিয়ে কতজল গড়িয়ে গেল কিন্তু জ্ঞানীবৃদ্ধটি আর ফিরে এলো না।



তারপর হান ফুক তার ছোট বীণাটি হাতে নিয়ে তার নিজের দেশের উদ্দেশে রওনা হলো। সে গ্রামে প্রবেশ করলে গ্রামবাসী তাকে একজন জ্ঞানীবৃদ্ধ মানুষ হিসেবে পেয়ে উষ্ণ অভিনন্দন জানাল। সে তার নিজের বাড়িতে পৌঁছে তার পিতা, তার কনে আর আত্মীয় স্বজনদের কাউকেই দেখতে পেল না। তারা সবাই মারা গেছেন। বর্তমানে তাদের বাড়িতে অন্য লোকেরা বসবাস করছে।



সেদিন সন্ধ্যায় ওখানকার নদীতে ল্যান্টার্ন ফেস্টিভ্যাল আয়োজন চলছিল। কবি হান ফুক নদীর তীরের একটু দূরে আঁধারে বুড়ো গাছটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এক সময় সে তার হাতের ছোট্ট বীণাটি বাজাতে আরম্ভ করল। তখন আশপাশের মেয়েরা তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল। তরুণ যুবকেরা এগিয়ে এসে হান ফুককে আমন্ত্রণ জানাল। কিন্তু পরমুহূর্তে তারা তাকে সেখানে দেখতে পেল না। তার বীণাযন্ত্রের সুরে মুগ্ধ হয়ে তাকে উচ্চৈস্বরে চিৎকার করে ডাকতে লাগল।



হান ফুক দূর থেকে তাদের ডাকাডাকি শুনে একটু হাসল। একটু তাকাল নদীর জলের দিকে। নদীর জলে হাজার হাজার ল্যান্টনের আলোর প্রতিবিম্ব যেন সাঁতার কাটছে। সে কিভাবে জানবে প্রতিবিম্বগুলোর মধ্যে কোনটি আসল। অনেক অনেক দিন আগের এক সন্ধের কথা তার মানসপটে ভেসে উঠল। সেদিন সে ছিল তরুণ যুবা, সেদিনের সন্ধ্যায় সে অদ্ভুত একজন জ্ঞানী ব্যক্তির কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিল।


হারম্যান হেস (১৮৭৭-১৯৬২) সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী লেখক। ‘বিট জেনারেশনের’ সর্বশেষ লিটারারি আইডল হিসেবে হারম্যান হেস খ্যাত। ১৮৭৭ সালে সয়াবিয়াতে তার জন্ম। প্রথম জীবনে পুস্তক বিক্রেতা, মেকানিকের কাজ থেকে নিজের মেধা, মনন আর অসাধারণ প্রতিভা বলে ‘পিটার ক্যামেনজিন্ড (১৯০৪) এবং আন্টার র‌্যাড (১৯০৫) নামে দু’টি উপন্যাস লিখে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯১১ সালে তিনি ভারত ভ্রমণ করে ১৯২৩ সালে ‘সিদ্ধার্থ’ গ্রন্থটি রচনা করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তার জীবনে বিশেষ প্রভাব ফেলে। তিনি তার বিভিন্ন উপন্যাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর অনুষঙ্গকে অনবদ্য গদ্যে উপস্থাপন করেন। তার লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ডেমিয়ান (১৯১৯), স্টোপ্পরওলফ (১৯২৭), দাস গ্লাসপারলেনসপিয়েল (১৯৪৩)। তিনি তার অসাধারণ রচনাসম্ভারের জন্য ১৯৪৬ সালে নোবেল পুরস্কার পান। হারম্যান হেসের লেখা গল্পের উবহাবৎ খরহফষবু এর ইংরেজি ভাষান্তরিত ঞযব চড়বঃ গল্পের অনুবাদ ‘কবি’।


 

0 comments:

Post a Comment