মোহাম্মদ আবদুল মাননান
বরাবরই আমি এ-কাজটি থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছি, কখনো আবার সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেছি। ছোট সময়ে বাবাকেই এসব সামলাতে দেখেছি। ঢাকায় হল জীবনে এসবের বালাই ছিল না। এরপর চাকরি সেখানেও একটা মেসের মতো ছিল। সুতরাং বাজারকরা, আর সেটা যদি কাঁচাবাজার হয়; কে যায় ওদিকে! যদিও কাঁচা কেনো, পাকা বাজারেও আমি বেজায় রকমের কাঁচা।
উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময়ে দিন দু’য়েক হোস্টেলের বাজার করতে হয়েছে। সাথে হোস্টেলের বাবুর্চি। তারপরও গোলমাল করে ফেলেছি বাবুর্চির কথা না শুনে। রাতে খাচ্ছি। ফার্স্ট ইয়ারের এক ছেলে বলেই বসল বড় ভাইয়ারা কীসব বাজার করে না! ভাগ্যিস, ছেলেটি আমায় তখনো চিনত না। সখ করে কাজটি দুই-চারবার করিনি এমন নয়। বিশেষত বিয়ের পরে। গিন্নি তখনো সংসারে পাকা
হয়ে ওঠেনি। কিন্তু খুব কমদিনই তরতাজা মাছ বাসায় আনতে সক্ষম হয়েছি। সব ধরনের মাছ-টাছ চিনতামও না। বিয়ের পরপর শাশুড়ি এসেছেন; দেশী মাগুর আর শৈলমাছ কিনতে হবে। স্ত্রীর ধমক খেয়েছি, কারণ দু’টো। দেশী নয়, আফ্রিকান মাগুর চলে এসেছে, আর শৈল নয়, বাজার থেকে এনেছি গজার মাছ দু’টোর কোনোটাই শাশুড়ি ও তার মেয়ে ছোঁবেন না। পরের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। তখনো বুঝে উঠতে পারিনি শৈল আর গজারের ঠিক পার্থক্যটা কোথায়। লিচু কিংবা আমও সখ করে কিনেছি আমের একাংশে পচন আর লিচু শ’-এ আশিটা। গরুর গোশত দেখলেই মন আনচান করত, কিনেছিও অনেকবার। বাসায় ফিরলে বউ বলত এখানে কিছুতেই তিন কেজি হবে না, তোমায় মাপে ঠকিয়েছে।
সেকি কথা! এরপর চক্ষু-কর্ণের বিবাদ মেটানোর জন্য দুই-তিনবার মাপের ব্যবস্থা করে প্রতিবারই স্ত্রীর কাছে কেজিতে দু’শো থেকে তিনশত গ্রাম ধরা। ছেলেমেয়ের কাপড়-চোপড় কেনাতেও কোনো পারঙ্গমতা দেখাতে পারছি বলে মনে নেই। বিয়ে বার্ষিকী আর জন্মদিনে স্ত্রীর জন্য কাপড় কিনে প্রতিবারই ধরা খেয়েছি। জিনিসের গুণেও ধরা, দামেও তাই।
কী এনেছ? এসব কেউ পরে নাকি এখন?
বললাম, দোকানি যে বলল, এটাই এখন চলছে।
তোমায় পেয়ে বসেছে, বুঝলে। তোমার মতো খদ্দেরই খুঁজে বেড়ায় ওরা।
এরপর আর সঠিক দামটাও বলা যায়নি কখনো কখনো।
বলা বাহুল্য, এসব কাপড়-চোপড় হয় বাসায় পড়ে ছিল দীর্ঘদিন, নয়তো তাৎক্ষণিক সম্প্রদান কারকে রূপ নিয়েছে, নয়তো সুযোগ থাকলে দোকানেই ফেরত কিংবা বদলিয়ে নেয়া এখন আর এসব আইটেম কিনতেই মানা। নিজের জামা কিনেও ক’দিন বাদে কাউকে দিয়ে দেয়ার রেকর্ড একদম কম নয়। অতঃপর ঘরের লক্ষ্মী স্ত্রী-ই এটি নিয়ে নিয়েছি, নাকি আমিই ছেড়ে-ছুঁড়ে বেঁচে গেছি সে কথা আর মনে নেই। তবে বাজারের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ স্ত্রীর ওপর বর্তে যাওয়ার সুখটা বেশ ভালো করেই উপভোগ করছি। সোফায় শরীর এলিয়ে দিয়ে মাঝে-মাঝেই তা অনুভব করি এ এক মহা-আনন্দ, মহানির্ভরতা! নিজের শার্ট, প্যান্ট, আন্ডারওয়ারও বধূ কিনে আনে, ছেলেমেয়ের কাপড় কেনার মতো ঝামেলাও হস্তান্তরিত এখন এমন আরাম আর কিসে আছে! তবে তাতে সমস্যা একটা দেখা দিয়েছে জগৎ-সংসারের বিশাল এক-জ্ঞানভাণ্ডার থেকে বঞ্চিত আছি; এই যেমন তেল-নুন-চিনি কিংবা চালের কেজি কতটাকায় মেলে তাও জানিনে, কেবল মূল্যবৃদ্ধির দৈত্য ধেয়ে এলে কাগজ পড়ে বুঝি বাজারে আগুন লেগেছে দুই-চারটে জিনিসের দামও চোখে পড়ে যায় তখন।
বিয়ের বছর দু’য়েক পর থেকে অবশ্য অফিসের লোকজনও এসবে সাহায্য করছে, ঢাকার বাইরে এই একটা সুবিধে; ততদিনে একটু জ্যেষ্ঠ হয়ে গেছি। এখন আর কাঁচাবাজার-টাজারে তেমন সমস্যা নেই। তবে উপলক্ষ পেলেই শুনতে হয়।
ঢাকায় কিন্তু পিওন-টিওন একদম পাবে না। গাড়িও থাকবে না পুরোসময়। অতএব কাঁচাবাজারটা হয়তো তোমাকেই সামলাতে হবে।
স্ত্রীর এ-কথায় ভেতরে-ভেতরে একটু হেলদোল অনুভূত হয়; হ্যাঁ, তাই তো, শুনেছি, রাজধানী ঢাকায় মন্ত্রী আর পুলিশ ছাড়া সবাইকে স্বয়ং বাজারে যেতে হয়। ভাবী, পুলিশেই ভালো। গাড়িতে পুলিশ, বাসায় পুলিশ, বাচ্চার স্কুলে পুলিশ, স্ত্রীর শপিংয়ে পুলিশ, শ্যালিকা শপিংয়ে যাবে দিয়ে দাও দু’জন।
বাগানের কাজে পুলিশ; রান্নাঘরও নাকি একজন কনস্টেবল সামলায়। গিন্নি শুনে বলে, ধেৎ, পুরুষ মানুষ রান্নাঘরে ঢুকলে আমার পক্ষে সেখানে যাওয়া সম্ভব না। ঢাকায় বাজার, সেটা আবার কাঁচাবাজার মাছ কি পচা, না ফর্মালিনাকীর্ণ কে জানে, ভাবতেই শরীরে কিছু তাপ অনুভূত হতে থাকে, যদিও সেটা বেশি বাড়তে পারে না। চাকরির যে ধরন তাতে যেকোনো সময়েই ঢাকা বদলি হতে পারি, তবে সেজন্য তদবিরটা জরুরি। তদবির ছাড়াও ঢাকা যাওয়া চলে তবে যে জায়গায় কেউ সচরাচর যেতে চায় না এমন জায়গায়। এ দিকে আর একটা পদোন্নতি হয়ে গেলে জেলায় তেমন বেশি পদ নেই, তখন হয়তো ঢাকাই হবে গন্তব্য এই চাকরিতে ঢাকাতেই অধিক পদ বানিয়ে রাখা হয়েছে; হয়তো টাকাওয়ালা লোকেরা ঢাকার চার দিকে ঘুরপাক খাচ্ছে বলেই এমন হয়েছে তা হবে না কেন, রাজধানী ঢাকায় নাকি টাকা উড়ছে, ধরতে পারলেই হলো! যদিও আর একটা পদোন্নতির জন্য বছর তিনেক অপেক্ষা করতে হবে।
এবার আর এড়াতে পারলাম না। কর অ্যাকাডেমি পাঁচ দিনের একটি ট্রেনিংয়ে ডেকেছে ই-রিটার্নসহ আরো কীসব বিষয়ে জ্ঞান বিতরণ হবে; সরকারি চাকরিতে এসে মাঝে-মধ্যেই এমনটি পাচ্ছি। এসবের জন্য বিদেশযাত্রাও আছে, তবে সেটার জন্য কপালের জোরটা একটু বেশি দরকার হয় এই যা সেই জোরটা নেই বলে এখনো কপালে তেমন কিছুই জোটেনি, মানে বিভুঁইযাত্রার সিল কপালে লাগেনি এখনতক। ট্রেনিংয়ের আগে দু’দিন বন্ধ, শেষেও অনুরূপ শুক্র-শনিবার। বসকে বলে ছুটি নিলাম আরো দু’দিনের এ-সময়ে ছেলেমেয়ের পরীক্ষা হয়েছে বলেই। এতেই সেরেছে। ছেলেমেয়ের নানা-নানী ঢাকায় থাকেন, আরো আছে ওদের খালা ও আপ্তজনেরা। ভাইবোন দু’জনই নানার বাসায় উঠতে চেয়েছিল। আমার তিন-তিনটে ভাই এবং বড়বোনও ঢাকায় সে কারণেই হাতে একটু সময় নিয়ে আসা। কিন্তু মা ঢাকায়, এখন মেজোভাইয়ের বাসায়। সেখানেই উঠতে হলো, স্ত্রীও সম্মতি দিয়েছে কী জানি হয়তোবা মন খারাপ করেই কিনা!
ঢাকায় ক’দিন আছি এ-যাত্রায় শুনেই মেজোভাই শুরু করলেন।
তুই এসে গেছিস, ভালোই হলো। কাউকে তো আর পাচ্ছিনে, সবাই ব্যস্ত। আর তুই-তো এসবের মধ্যে থাকিস না বললেই হয়।
মেজোভাইয়ের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই ঠিক ধরতে পারছিলাম না। ঠিক পরেরটুকুন না শোনা অবধি।
এবারের দিনটা ভালোই পড়েছেরে আসিফ। শুক্রবার। বাবার মৃত্যুর ঠিক পরের বছরও দিনটা শুক্রবার ছিল। শোন, গত বছর বড় ভাই বাবার মৃত্যুবার্ষিকী করে বিরক্ত আর ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কী করা বল, জরুরি দরকারেই আমাকে সেইসময়ে দিল্লি যেতে হয়েছিল। আর তোর সেজো ভাই তো মাননীয় হওয়ার পর থেকে এ দিকে যেন তাকানোরও ফুরসত নেই কেবল মিলাদের সময়েই নাকি বড় ভাইয়ের বাসায় গিয়েছিল, হয়তো এবারো তাই-ই হবরে। আর ছোটটা তো বাড়ি থেকে আসতেই পারেনি, এবারো পারবে না; যত্তোসব! সবটা শুনে আমার কাজটা কী সেটা বুঝে উঠতে পারছিলাম না, আর সেটার জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করার দরকার হবে না, কারণ আমি আমার ভাইদের ভালোভাবেই চিনি। তবে মনে মনে ভাবছিলাম, বড় ভাই তো আমাকে সবটাই বলেছেন, মেজো ভাই তুমি তো গত বছর বাবার মৃত্যুবার্ষিকী জেনেও ভায়রার সাথে ভারতযাত্রায় শামিল হয়েছিলে তা ভালোই হয়েছে এবার তোমার ওপরই পড়েছে; তবে ধন্যবাদটা মা-ই পেতে পারেন, কেননা মা সময়টা বেছেই তোমার বাসায় আছেন।
শোন, তোকে খুবকিছু করতে হবে না। তুই তো আবার বাজার-টাজার করতে পারিস না। আমার সাথে থাকলেই হবে। কালকে নয়তো পরশুর মধ্যেই ক’জন ভিক্ষুককে বলে আসতে হবে।
আমি রীতিমতো হতবাক। কী বলছে ভিক্ষুককে দাওয়াত দিয়ে আনতে হবে! ঢাকার রাস্তার ওপড় দাঁড়ালেই তো আট-দশজন পাওয়া যাবে। আমার উস্তুম-খুস্তমভাব দেখে মেজো ভাই বললেন মফস্বল শহর আর ঢাকা এক নেই। এখানে কাঙালিভোজ, চল্লিশা, মৃত্যুবার্ষিকীর জন্য ওদের আগাম বলে আসতে হয়। বুকিং যাকে বলে, বুঝলি আসিফ!
এভাবে কতজনকে বলতে হবে?
গত বছরের আগের বছর তো আমি জনা-চল্লিশেক বলেছিলাম। এবার পঞ্চাশজনই বলি, কী বলিস? মাও চাচ্ছেন, এসব দিনে ভিক্ষুক খাওয়ানোই শ্রেয়তর। আত্মীয়স্বজন তো আর কম আসছে না, কম খাচ্ছে না।
পঞ্চাশজন ভিক্ষুক একসাথে কোথায় পাওয়া যাবে?
বলতেই মেজো ভাই কথাটা লুফে নিলেন। মনে হয় এটির জন্যই অপেক্ষমাণ।
এখানেই অভিজ্ঞতার প্রশ্নটি আসে। সেই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছিস, আর তো এদিকে পা দিস নাই। ঢাকায় এখন ভিক্ষুক নেমন্ত্রণ করতে হয়। তাদের আবার জোন-টোন ভাগ আছে মনে হয়। আমি সেবার নয়াবাজারে গিয়েছিলাম। আমাকে সাফ বলে দিলো, ধানমণ্ডি তারা আসতে পারবে না।
শুনে শুনে আমার গলা শুকিয়ে আসছে। ভিক্ষুক খোঁজার কাজটা শেষমেশ আমাকে দিয়েই করাতে চান মেজো ভাই। ফরিদপুর থেকে ঢাকা আসার জন্য এই সময়টা বেছে নেয়া যে কোনো কাজের কাজ হয়নি তা এতক্ষণে অনুধাবন করতে আরম্ভ করলাম।
শোন, কারওয়ানবাজারের ভেতরের দিকটায় কিছু ভিক্ষুক পেতে পারিস, যদি এতদিনে জায়গা বদল না হয়। আর মোহাম্মদপুরের দিকেও পাবি তবে মোহাম্মদপুরে যে কোন এলাকায় ওরা থাকে সেটা একটু জেনে নিতে হবে।
রাতে খেতে-খেতে মাও বললেন, তুই এসেছিস ভালোই হলোরে বাবা। এই ছয়-সাত বছরে প্রথমবার বাদে তুই তো কোনোবারই ছিলি না আসিফ। জানি এ-কথার জবাব দেয়া মানে মায়ের কষ্ট বাড়িয়ে দেয়া। তারপরও বলতে হলো মা, এইবারই কী কারণে ওদের পরীক্ষা ১৫ দিন আগে শেষ হলো, বলেই আসতে পারলাম।
কী চাকরি করিস বাবা, বাবার মৃত্যু দিনটাতেও ঢাকা কিংবা বাড়ি যেতে পারিস না।
বাবার মৃত্যুবার্ষিকী প্রথম তিন-চারটে বাড়িতেই হয়েছে তখন মা ঢাকায় আসতেই চাইতেন না, আর বড় ফুফুও বেঁচে ছিলেন। রাতের খাওয়ার পর আরো একটা কাজ ধরিয়ে দিলেন মেজো ভাই এমনিতেই রাতের ঘুমটা হবে কিনা সে টেনশনে ছিলাম। এবার বোধহয় সেটা নিশ্চিতই হয়ে গেলো। মেজো ভাই বললেন এই মোবাইল নম্বরটা টুকে রাখ, বাবুর্চির মোবাইল। কালকে ফোন করলে চলে আসবে, বাজারের ফর্দ নেবে। আমি আবার সকাল-সকাল একটু ফ্যাক্টরিতে যাব।
ছাত্রজীবনে ওকে পোংটা বললেও দেখলাম এদ্দিন পরও ওকেই ঢাকাতে নানা কাজে পাওয়া যায়; কেবল অপরের উপকার করে বেড়ানোই ওর স্বভাব। পেয়েও গেলাম রঞ্জুকে। কিন্তু পরের দিন যাওয়ার একটু আগেই ফোন করে জানিয়ে দিলো সরি দোস্ত, আফিয়ার মেয়ে হসপিটালে, যেতেই হবে।
প্রথম একটু বিরক্ত হলেও পরে ভালোই লাগল দেখলাম, ক্লাসমেটদের বিপদে-আপদে এখনো আগের মতোই দৌড়াচ্ছে। ঠিক লোকেশনটা আগের দিনই রঞ্জু বলে দিয়েছিল। মেজো ভাইকেও জিজ্ঞেস করে জানা যেত, কিন্তু সাহস হলো না। যদিও রঞ্জুকে নিয়ে মোহাম্মদপুরেই যাব বলে কথা হয়েছিল, ও না আসায় কারওয়ানবাজারের দিকেই এগোলাম।
একটা টালির ভাঙাঘর, পরে জেনেছি এখানেই অনেক আগে পাইকারি কাঁচাবাজার বসত। এদিকটায় আগে কখনো এসেছি বলে মনে করতে পারছিনে। খুবই অপরিচিত মনে হচ্ছে এ-জায়গা মনে মনে রঞ্জুকে একটা গালি দিলাম। ঘরটির বারান্দার একদিকে টলটলে দেয়ালদেয়া পানির ট্যাংকি। চার দিকটা উঁচু করে দেয়াল দেয়া, পানি উপচে পড়ার উপক্রম। তার পাশেই একটা পানির কল দিয়ে অব্যাহত পানি পড়ছে। এখানেই ওস্তাদ আফির উদ্দিন গোসল করছে। সময়টা কি গোসল করার মতো, ভাবছিলাম। পরক্ষণেই ভাবনাটায় ছেদ পড়ল।
বারান্দার পাশেই দেখলাম একটা লাল রঙের কেমি সাবানের খাপ এ-সাবান তো বিদেশীই। আমি বরং দেখতে চাইলামÑ সাবানটা আজই প্রথম ব্যবহৃত হচ্ছে, দূর থেকেও সাবানের গন্ধ পাচ্ছিলাম। এরকম গন্ধ গোসলের আগ্রহ বাড়িয়ে তুলছে যেন। অদূরেই আফির উদ্দিন ওস্তাদ বালতি থেকে সশব্দে অবিরাম পানি ঢালছে সারা শরীরময় উদোম শরীর, পরনের লুঙ্গি উঠছে-নামছে একটা ছন্দের ভঙ্গিতে। সেই পানি ঢালার দৃশ্যটা অনেক দিন পরও মনে করতে পারি। গোসলেও যে একটা পরিতৃপ্তি আছে সেটা ভিক্ষুক-ওস্তাদ আফির উদ্দিনের গোসলে যেভাবে দেখলাম সেটাও মনে থাকারই কথা। আমি ঠিক তার গোসলটাই উপভোগ করছিলা এ সময়ে থামিয়ে কথা বলা যায় না। কিছুক্ষণ পর গোসল থামিয়ে ওস্তাদই কথা বললেন, এতক্ষণে আমায় দেখেছেন মনে হলো আমার কাছে আইছেন?
তখন মাগরিবের আজানের প্রস্তুতি চলছে। তার আগে একজনকে জিজ্ঞেস করায় পথ বাৎলে দিলো। সামনে গিয়ে একটু ডানে গিয়ে সামনে যাবেন, আবার ডানে গিয়ে সোজা চলে যাবেন, ওখানে আফির উদ্দিনকে পেয়ে যাবেন। এ নামটা রঞ্জুই বলেছিল, আমি টুকে মানিব্যাগে অতি যতেœ রেখে দিয়েছি। পাইকারি কাঁচাবাজার হয়ে একটু সামনে এগোতেই জায়গাটা বেশ স্যাঁতসেতে, আরো এগোলে রাস্তাটা কাঁচা, কোথাও ইট বিছানো, হয়তো পাকা হওয়ার অপেক্ষায়। যাওয়ার পথটা সরুগলির মতো, এক দিকে তিন-চারটে বস্তির মতো। একজন বয়স্ক মানুষকে বসা দেখে কৌতূহল বশে বললাম মৃত্যুবার্ষিকীর দাওয়াত নেবেন?
সামনে যান, ওস্তাদ আছে, তাইনেই যা কওয়ার কইবে।
বুঝলাম, এখানে ওস্তাদের দাপট ঠিক ওস্তাদের মতোই যেন।
হ্যাঁ বলতেই বললেন বলেন, বলেন।
আগামী শুক্রবার একটা মৃত্যুবার্ষিকী আছে, চল্লিশ-পঞ্চাশ জন লাগবে।
সংখ্যা একটা ব্যাপার না। জায়গাটা কোনখানে?
ধানমন্ডি, সাত নম্বরে।
সাত কি আমাদের মধ্যে ওস্তাদের মধ্যে স্বগতক্তি লক্ষ করলাম। মওলা, মওলা বলে জোরে আওয়াজ তুললেন ওস্তাদ। আসার সময়ে বারান্দায় দেখা মানুষটি দ্রুত চলে এলেন। দু’জনই ষাটোর্ধ্ব। কে বড় ঠিক বোঝা গেলো না।
ধানমন্ডি সাত কি আমাদের মধ্যেরে মওলা? ওস্তাদ শুধালেন।
বাসার নম্বরটা কী বলবেন স্যার? মওলা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন। আমি বাধ্যগতের মতোই বলালাম এগারো-এ।
এগারো-এ লইয়া একটু গোলমাল আছে ওস্তাদ। আমরাই যাই, তবে ওরাও দু’-একবার আইছে। একবার তো আমাদের লগে লাইগ্গাই গেছিল।
অসুবিধে নাই। দাওয়াত লও। শোনেন স্যার, জায়গাটা একটু দূরে আর ভেজালও আছে। বাড়াইয়া দিতে হবে, লেংড়া, লুলা, কানারা যাবে তো, রিকশা ছাড়া হবে না। আর রিকশা ভাড়ার তো মা-বাপ নাইকা; এগারোটাকে জিগাইলে একটায় রাজি হয়, আবার ত্রিশ টাকার ভাড়া নব্বই চেয়ে বসে থাকবে, যেন নবাব আলীবর্দি খাঁর ভাতিজা।
মওলার কথায় বরিশালের উচ্চারণ আঁচ করা যায়, কিন্তু ওস্তাদের কথায় কিছুই ঠাহর করা যাচ্ছিল না, তবে দেখলাম এই প্রথম স্যারও বললেন, এমন আশাও করিনি।
বললাম ভালো খানা দেয়া হবে, অসুবিধে নেই। কাচ্চি বিরিয়ানি, খাসির রে...।
এসব বলে লাভ নেই। এসব কাচ্চি-টাচ্চি, মোরগ বিরিয়ানি, খাসি খেয়ে-খেয়ে ওদের অরুচি ধইরা গেছে। আপনি স্যার টাকা বাড়াইয়া দিয়েন, ভিখিরি বলে কথা।
আমার কথা কেড়ে নিয়ে ওস্তাদ বললেন। আর মওলাকে ইশারা করলেন, আমাকে নিয়ে কথা বলতে। আমি যেতে যেতে পুনর্বার বালতি থেকে মগ দিয়ে ওস্তাদের শরীরে পানি ঢালার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। শব্দটার কোথাও জানি একটি তাল, একটা লয় লুকিয়ে আছে বলে মনে হলো।
ওস্তাদের সাগরেদ মওলার পেছনে-পেছনে এলাম। একটা পাটি বিছিয়ে মওলার অফিস। সামনেই একটা ক্যাশ বাক্সের মতো, যেটা মহাজনি দোকানে ম্যানেজার সারাক্ষণ আগলে রাখে। পাশে দু’টো মোবাইল ফোন একটু পর ফোন এলে জানা যায় ওরই একটি বড় ওস্তাদের। ওস্তাদের ফোনটা দেখার মতো, অন্তত আমার হাতের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দামের। বললাম, ওস্তাদ কি এখানেই থাকেন?
সেকি কথা! ওস্তাদ এখানে থাকব ক্যান? আমি কথা বাড়ালাম না।
কত করে কথা হয়েছে? মওলার প্রশ্ন।
সে রকম চূড়ান্ত হয়নি, তবে দু’ শ’ করে দিতে চাই।
কিছু না বলেই মওলা উঠে গিয়ে ওস্তাদ আফির উদ্দিনের সাথে কিছু একটা বলে আবার ফিরে এসে বললেন ওটা একটা ঝামেলার জায়গা, দুই-এলাকার ভিখিরিদের এলাকার আধিপত্য নিয়ে গোলমাল আছে। ওস্তাদ বললেন তিন শ’ করেই দিতে হবে, সাথে রিকশা ভাড়া পারহেড আরো পঞ্চাশ। কিছু আ্যডভান্সও লাগবে।
ভিক্ষুক নিমন্ত্রণে আগাম দিতে হবে এমন জানা ছিল না। এ দিকে পকেটে কেবল খরচের টাকা। এই টাকা দেয়ার মানেই হচ্ছে ধার করে শহর ছাড়তে হবে। তারপরও কোনো উপায় না দেখে পকেটের প্রায় আধেকটা অগ্রিম দিতে হলো বাবার সপ্তম মৃত্যুবাষির্কীর ভিক্ষুকভোজে। আগাম দিতে দিতেই জানতে চাইলাম, ওস্তাদ এখান থেকে কিছু পাবেন কিনা। একরকমের তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন ভিখিরি দলের ক্যাশিয়ার মওলা।
হেইডায় আপনার জাননের কাম কী!
আমি ঘাবড়ে গেলাম, পাছে দাওয়াতটা আবার ফিরিয়ে না দেয়। ভাবলাম, আমি একজন পদস্থ সরকারি চাকুরে। মওলা হয়তো জানে না, আমার ইচ্ছেয় লাখ টাকার ইনকাম ট্যাক্স হাজারে নেমে আসে। আর জানলেইবা কী এখানে আমি যে সেবা নিতে এসেছি।
শুক্রবারটা দ্রুতই চলে এলো বলে মনে হয়। আসরের পর মসজিদে মিলাদ। মিলাদের পর তবারক বিতরণ পাঁচ-ছয় শ’ প্যাকেট করা হয়েছে, প্যাকেটে মিস্টি, ঝাল, ফল কোনোটাই বাদ যায়নি। এরপর নির্বাচিত মেহমানদের জন্য কাচ্চি বিরিয়ানির সাথে নানা পদ। এ আয়োজন মেজো ভাইয়ের বাসাতেই। আসরের কিছু পরেই দাওয়াতি ভিক্ষুক আসবে ওস্তাদ আফির উদ্দিনের নেতৃত্বে কী জানি, হয়তোবা আফির উদ্দিন নিজে নাও আসতে পারেন। মওলাই বলছিল, একইদিনে বনানীতেও কী অনুষ্ঠান আছে।
সন্ধ্যা থেকে আসবে ঢাকা শহরের আত্মীয়স্বজন এদের কেউ কেউ বেশি রাত করেও ফিরতে পারে।
আসরের জন্য মসজিদে যাওয়ার প্রস্তুতি শেষ করে নিচে নামতেই সেই শুভ ভয়ঙ্কর! মেজো ভাইয়ের পেছনে আমি আর মেজো ভাইয়ের বড় ছেলে। আমি আগেই একটু ইঙ্গিত পেয়েছিলাম, কাউকে বলিনি; আবার এমনটি আশাও করিনি। সংখ্যায় পনেরো বা একটু বেশি হবে, এক দঙ্গল ভিক্ষুক নিচতলায় আগেই জড় হয়েছে। আমাদের আসার অপেক্ষাতেই ছিল। মেজো ভাই বললেন তোমরা কারা? আমরা মোহাম্মদপুরের করিম ওস্তাদের গ্রুপ। এই এলাকা আমাদের, এখানে আফির উদ্দিনের আগমন মানি না।
একজন একটু এগিয়ে এসে এ কথা বলল। সাথে সাথে বাকিরা বলে উঠল মানি না, মানব না। করিম ওস্তাদ জিন্দাবাদ। পেছনে জনা দু’য়েক অন্ধের মুখে তখনো একই স্লোগান।
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়, মুখে কিছুই আসছিল না। মেজো ভাই এই শহরের সিজনড মানুষ, একজন এমপির বড় ভাই, নিজেও যৎসামান্য রাজনীতির সাথে যুক্ত, একটা পারিবারিক শিল্প সামলাচ্ছেন দেড় যুগ ধরে। বিস্ময়ে তাকালাম মেজো ভাই কী করেন।
এই তোমরা কতজন?
সতেরো জন। সামনের লোকটি একবার পেছনের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো।
এই নাও। মেজো ভাই এক হাজার টাকার তিনটে নোট দ্রুতই পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের সামনের লোকটির হাতে দিলেন।
স্যার, ক’জন অন্ধ আছে, একটু বাড়িয়ে...।
মেজো ভাই আরো একটি হাজার টাকার নোট বের করলেন।
ওস্তাদের জন্য কী দিলেন স্যার?
তোমার করিম ওস্তাদ আমার পরিচিত, এই কার্ড নাও, আমার সাথে কথা বলতে বলো। যাও, একটু ধমকের সুরেই মেজো ভাই বললেন।
কী জানি, ম্যাজিকের মতোই কাজ হলো। ওরা সবাই নিমিষে গেট দিয়ে বের হয়ে গেলো। মেজো ভাই পেছনে আমার দিকে তাকালেন, পাশে দাঁড়ানো ছেলের দিকে তাকালেন। ভাইয়ের দুই-ঠোঁটের মাঝে এক চিলতে হাসির রেখা। দেখে মনে হচ্ছে, সারা মুখে একটা বিজয়ের আনন্দ সেটা করিম ওস্তাদের ভিক্ষুক দলকে দ্রুত ফেরত দেয়ার জন্য, না করিম ওস্তাদের টাকাটা না দেয়ার বাহাদুরি, নাকি ছেলে আর চাকরিজীবী আমলা ভাইকে এই বিকেলের কারিশমা দেখানো; তা আর ঠিক বুঝতে পারলাম না।
আমি ভাবছিলাম, মেজো ভাই কি ব্যাপারটা আগে ভাগেই জানতেন, নাকি নিজেই এই বৈকালিক নাটকটা করলেনÑসেটাইবা কী করে সম্ভব?
0 comments:
Post a Comment