WHAT'S NEW?
Loading...

সিটি নির্বাচনের পর কূটনৈতিক তৎপরতা


গৌতম দাস


 


গত ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালের তামাশার নির্বাচনকে আমেরিকা নিজেরই স্বার্থের দিক থেকে সমর্থন দেয়া সঠিক হবে না বলে অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু সেসময়ের কংগ্রেসের ভারত কূটনৈতিক রীতিনীতি ভেঙে শেখ হাসিনার পক্ষে প্রকাশ্যে ওকালতি ও অবস্থান নেয়ার কারণে এই নির্বাচন বাস্তবে যতই উদোম তামাশা দেখাক না কেন, হাসিনা এই তামাশার নির্বাচনকেই তার ক্ষমতার বৈধতা ও উৎস বলে দাবি করতে থাকেন। ওই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই ভারত-আমেরিকার পারস্পরিক সম্পর্ক তলানিতে তো বটেই, এমনকি পরস্পরের কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেয়ার প্রতিযোগিতার মতো অবস্থায় চলে গিয়েছিল। পরে আমেরিকা ভারতের সাথে তার সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করা বাংলাদেশ বিষয়ে নতুন কিছু ভাববারও আগের কাজ মনে করেছিল।



দিকে ভারতের নির্বাচনে বিজেপির মোদি জয়লাভ করাতে ওবামা ও মোদি উভয়ের পক্ষেই স্বল্প কাঠখড় পুড়িয়ে ভারত-আমেরিকার সম্পর্ককে আবার একটা গঠনমূলক অবস্থানে নিতে সফল হয়েছিল। ভারত-আমেরিকার বাংলাদেশ নীতিতে অবস্থানের সঙ্ঘাত কমিয়ে এক বা কাছাকাছি অবস্থানে আসার চেষ্টাও কিছু দূর এগিয়েছিল। গত জানুয়ারিতে (২০১৫) ওবামার ভারত সফর শেষে অগ্রগতির সব হিসাব মিলিয়ে দেখে মনে হওয়া শুরু হয়েছিল যে, বাংলাদেশ নীতিতে ভারত ও আমেরিকা বোধহয় পরস্পর সমন্বয় করে এক নীতিতে পরিচালিত হতে সক্ষম হচ্ছে বা হতে যাচ্ছে। কিন্তু এখন ক্রমশ দেখা যাচ্ছে না আসলে তা হচ্ছে না। সম্ভবত তা আর না হওয়ার দিকে চলে যাচ্ছে।
ওদিকে ২০১৪ সাল ওই বছরটা জুড়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলনামূলক ঠাণ্ডা বা নিরুত্তাপ থাকার পর চলতি বছর ২০১৫ সালের শুরু থেকেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত হতে শুরু করে। তিন মাস অবরোধ চালিয়ে শেষে সিটি নির্বাচনের উছিলায় অবরোধ আন্দোলন থেকে সরে বিএনপি সিটি নির্বাচনের রাজনীতিতে মনোনিবেশ করে।


খালেদা জিয়া সিটি নির্বাচনে আসায় প্রায় সব পক্ষের মুখ রক্ষা হয়। হাসিনা খালেদার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করিয়েছিলেন কিন্তু গ্রেফতার করতে পারছিলেন না বা চাচ্ছিলেন না। হাসিনার ভিন্ন হিসাবের দিকগুলো থেকে বিবেচনায় হাসিনা দেখছিলেন যে, খালেদাকে গ্রেফতার তো করাই যায় কিন্তু তাতে অবরোধ কর্মসূচি খালেদার মুখ থেকে প্রত্যাহারের ঘোষণা আদায় তিনি করতে পারছেন না। ওদিকে আদালতও গ্রেফতারি পরোয়ানা দিয়েছেন কিন্তু দেড় মাসের ওপর রাষ্ট্রের নির্বাহীরা তামিল না করাতে আদালতের ইজ্জত কর্তৃত্ব দাওয়ে পড়েছিল। আবার খালেদা জিয়াও গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে তা উপেক্ষা করে বাসায় আটকে ছিলেন। অর্থাৎ সবার পক্ষেই একটা অস্বস্তিকর অবস্থা ছিল সেটা। ফলে সিটি নির্বাচনকে উপলক্ষ করে খালেদা জিয়া আদালতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকেই যেন অস্বস্তি থেকে মুক্তি দেন। আবার নিজ দল ও জোটকে তিনি আবার প্রমাণ করার

সুযোগ পেয়েছেন যে তার দল ও জোট মূলত নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। আর হাসিনার সরকার এমন দুর্দশাতে পড়েছে যে, বিরোধী কাউকে ন্যূনতম লিবারেল স্পেস দেয়ার যোগ্য অবস্থায় বা কোনো বিরোধীকে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করতে দেয়ার সামর্থ্য রাখে না। এটাই পুরো রাজনৈতিক সঙ্কটের মূল কথা।



ক্ষমতাসীনদের মূল সঙ্কট হলো তারা জনসমর্থনহীন; গণ-আস্থা ও বৈধতার সঙ্কট তার চিরসঙ্গী হয়ে গেছে। তাই নিজের বিরোধীদের নিয়মতান্ত্রিক বিরোধিতার রাজনীতিও করতে দেয়ার অবস্থায় নেই। আবার তামাশার দিক হলো, হাসিনা নিজের এই অপারগতা ভেতরেও বিরোধীদের তিনি এক নির্বাচনে যোগ দিতে ডাকতে গেছেন। কিন্তু নির্বাচনী তৎপরতা, এটাও তো সেই ঘুরেফিরে আর এক ধরনের নিয়মতান্ত্রিক বিরোধিতাই। ফলে নির্বাচনে ডেকে নিয়ে এলেও শেষে আবার বাধাদানই শেখ হাসিনার পক্ষে একমাত্র উপায়, যাতে জনসমর্থনহীনতা নিজের হাত থেকে ক্ষমতা চলে যাওয়ার অবস্থার দিকে মোড় না নেয়। পরপর চার দিন খালেদা জিয়ার গাড়িতে প্রকাশ্যে হামলা করতে উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়া হয়। আর নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করার ঘোষণা দিয়ে পরের দিন আবার তা প্রত্যাহার করে নেয়া, এটাও হাসিনার এক মরিয়া অবস্থার প্রকাশ। এই দুই বিষয়ে অন্তত চক্ষুলজ্জার কথাও বিবেচনা করার অবস্থায় তিনি নেই। কারণ চক্ষুলজ্জার কথা বিবেচনা করলে ক্ষমতা চলে যাওয়ার রিস্ক নিতে হবে। অর্থাৎ এ ব্যাপারেও হাসিনা মরিয়া দুর্দশায়। তবে এ দুই ঘটনা থেকে সিটি নির্বাচনের ফলাফল কী হতে যাচ্ছে তা ক্ষমতাসীনরা স্পষ্ট করে দিতে বাধ্য হন।



ওদিকে এপ্রিল মাসজুড়েই হাসিনা খালেদার ওপর কথার আক্রমণ বজায় রেখেছিলেন এই বলে যে, খালেদা সহিংস রাজনীতি করেন। ফলে তাকে আবার ভোট দেয়া কী! এই হলো সার বয়ান। কৌশল ছিল যে মানুষেরা বিএনপিকে ভোট দেয় কল্পিত সে জনগণের বিরুদ্ধেও কামান দাগেন। ‘এমন ভোটদাতারা মানুষ কি না’ সে প্রশ্নও তোলেন। কিন্তু সীমাহীন কারচুপি, মিডিয়া রিপোর্ট আর বিএনপির বর্জনের ঘোষণার পর উল্টো হতাশ হয়ে পড়ে ক্ষমতাসীন দল ও জোট। তারা এবার উল্টো আবদার করছেন, বিএনপি কেন ভোট বর্জনের পর এর সপক্ষে প্রতিবাদ মিছিল করল না! এর মাধ্যমে আসলে তারা বলতে চাচ্ছেন যে প্রতিবাদ মিছিল করলে বা গাড়ি পোড়ালে হাসিনার খালেদার বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগ ন্যায্যতা পেত। এখানে তারা লস করেছে।


দুই : আমেরিকান উদ্বিগ্নতা
ওদিকে সিটি নির্বাচনের পরের বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশীদের উদ্বিগ্ন হওয়া এবং উদ্বিগ্নতা প্রকাশ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়েছিল। আবার সাধারণ মানুষের নালিশটাও স্বভাবতই সরকারের বিরুদ্ধে। বিদেশীরা তাতে সায় দিয়েছেন শুধু না সাথে নিজস্ব অভিযোগ, মূল্যায়নও হাজির করছেন। এই বিদেশমুখী মানে আসলে মূলত আমেরিকা। যদিও আমেরিকার তাতে দ্বিধাগ্রস্ততাও কম প্রকাশিত নয়। এমন দ্বিধাগ্রস্ততার অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে একটা বড় কারণ, ভারত ও আমেরিকা উভয় রাষ্ট্রের বাংলাদেশ নীতিতে প্রকাশ্য চরম বিরোধিতা যেটা আমাদের গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্য মুখোমুখি হতে দেখেছিলাম। এই বিরোধের আবার দুটো স্তর আছে। একটা স্তর হলো, ভারত ও আমেরিকার প্রশাসন বা সরকারের অবস্থানগত বিরোধ। যেটা আগে বলছিলাম ভারতের গত নির্বাচনে (লোকসভা ২০১৪) কংগ্রেসের বদলে বিজেপির মোদি সরকার গঠন করার ফলে পরের এক বছরেরও কম সময়ে এ পর্যন্ত দুইবার ওবামা-মোদি শীর্ষপর্যায়ে বৈঠক হতে পেরেছে। এই প্রথম স্তরে বিরোধ সঙ্ঘাত সামলে সম্পর্কের নতুন পাতা উল্টিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। ওবামার গত জানুয়ারিতে ভারত সফরের সময় অন্য দ্বিপক্ষীয় বিষয়ের পাশাপাশি আমেরিকা চেষ্টা করছিল যাতে ওই সুযোগে বাংলাদেশ নীতিতে ভারত-আমেরিকার একটা সমন্বিত অবস্থানের ভিত্তিগুলো আরো স্পষ্ট করে এঁকে নিতে পারে। ভারত ও আমেরিকার প্রশাসন বা সরকারের পর্যায়ের স্তরের বিরোধ দাগ অনেকটাই কেটে গেছে বলা যেতে পারে।



দ্বিতীয় স্তরের বিরোধ : ভারত-আমেরিকা উভয় সরকারের বাংলাদেশ নীতিতেই তবে আর এক স্তরে ভিন্ন আর এক ধরনের বিরোধ আছে। এটাও বাংলাদেশ নীতি প্রসঙ্গেই নীতিগত বিরোধ। কিন্তু এটা কাজ করে ভারতের রাজনৈতিক ও আমলা এই দুইয়ের কর্তৃত্ব ও সম্পর্কের পর্যায়ে। যেমন ভারতের বাংলাদেশ নীতি এবং নিরাপত্তা নীতি কী হবে, এ বিষয়টা দেখার ক্ষেত্রে ভারতের গোয়েন্দা ও আমলা প্রশাসন (এক কথায় এর পর থেকে কেবল আমলা বলব) আর ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের অবস্থান আলাদা আলাদা। যদিও বিগত কংগ্রেস সরকারের দশ বছর আমলে কংগ্রেসের রাজনৈতিক নেতৃত্বের অবস্থান আমলাদের মতোই প্রায় একই অবস্থানে বলে আমলাদের অবস্থান প্রায় সময়ই আলাদা করে প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু মোদির আমলে রাজনৈতিক অবস্থান বেশির ভাগ সময়ে আমলাদের চেয়ে আলাদা বলে প্রায়ই আমলা-রাজনৈতিক বিরোধ প্রকাশ্য হয়ে পড়েছিল।



চলতি শতাব্দীর শুরু থেকেই মানে ৯/১১-এর পর থেকেই প্রায় চৌদ্দ বছর আমলা অবস্থান হলো, আমেরিকার এশিয়া নীতিতে অন্তত চীন ঠেকানো আর ওয়ার অন টেররের ইস্যুতে আমেরিকা ভারতের সহযোগিতা কামনা করে, আকাক্সক্ষী। এটাকে ভারতের আমলারা আমেরিকার ভারতের কাছে ঠেকা থাকা বলে মনে করে বা পাঠ করে। এখন ভারতের আমলাদের কথা হয়তো সঠিক। কিন্তু কতটা? কতটা সত্যতা এখানে আছে? ভারতের আমলারা সেজন্য আমেরিকার কাছে যা খুশি দাবি করতে পারে, যত দূর খুশি এটাকে ইলাস্টিকের মতো টেনে লম্বা করতে পারে কি? বলা বাহুল্য দুনিয়ার কোনো কিছুই ইলাস্টিক নয়, কোনো কিছুই অসীম নয়। এশিয়ায় ভারতের চোখ দিয়ে দেখে আমেরিকাকে নিজের নিরাপত্তা নীতি সাজাতে হবে, ভারতের অনুসরণে আমেরিকার বাংলাদেশ নীতি সাজাতে হবে, আমেরিকান যাতাকাঠি ভারতের হাতে তুলে দিতে হবে, ভারতের আমলাদের এমন আবদার করা অথবা আমেরিকান ঠেকাকে মূল্যায়ন করা কি ঠিক?
জবাব হলো যে, না। এটা অবাস্তব। কারণ বাংলাদেশের ওপর প্রয়োগের যাঁতাকাঠি আমেরিকা যদি ভারতকে ব্যবহারের জন্য দিয়েই দেয় তাহলে আমেরিকা আর আমেরিকা থাকে না। তাতে ভারতের কাছে আমেরিকার যত ঠেকাই থাক। যদিও এ কথা ঠিক প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশ তার দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্টের আমলে তিনি ভারতের আমলাদের নিজের যাতাকাঠি দিয়ে এমন ‘মুই কি হনু’ গোছের লোভ জাগিয়ে ‘অবাস্তব ও লোভী’ বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। কিন্তু অচিরেই পরের ওবামা প্রশাসনের প্রথম টার্মেই বুশের এই অবাস্তব চিন্তানীতির সমস্যাগুলা প্রকট হয়ে হাজির দেখতে শুরু করেন। বলা যায় এর পর থেকে ওবামার কাফফারা গোনার দিন শুরু হয় যা এখনো চলছে। শুধু তা-ই নয়, সেখান থেকেই ওবামা প্রশাসনের সাথে ভারতের আমলা ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মুখোমুখি সঙ্ঘাত ও পরে সম্পর্কে চূড়ান্ত অবনতি ও স্থবিরতা আসে। যদিও এই পর্যায়ে ভারতের আমলা এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব, এমন উভয় গোষ্ঠীর সাথে সঙ্ঘাতের কথা বলছি। তবু আমলাদের সাথে সঙ্ঘাতের বিষয়টা আলাদা করে বিবেচনার দরকার আছে। কারণ প্রায় দশ মাস ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক চরমভাবে স্থবির এবং তিক্ততার চরমে ওঠার পর ২০১৪ এপ্রিলের নির্বাচনে ঘটনাচক্রে কংগ্রেসের বদলে বিজেপির মোদির জয়লাভ ঘটেছিল। ফলে ভারত-আমেরিকার বিরোধ আর চরমে না গিয়ে অন্তত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের পর্যায়ে যত দ্রুত সম্ভব জট খোলার চেষ্টা দুই তরফেই তাগিদ দেখা দেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমলাদের পূর্ণ মনোযোগ সক্রিয়তা মোদি এখনো পাননি। আমলাদের এই ধারা এখনো নিজেরা মনে করে যে, ওবামাকে ঠিকমতো চাপ দিতে পারলে বুশের আমলের মতোই, আমেরিকান যাঁতাকাঠি ভারতের পক্ষে আদায় এবং ভারতের চোখ দিয়ে এশিয়ায় আমেরিকাকে নিজের নিরাপত্তা নীতি সাজাতে বাধ্য করা সম্ভব ছিল। তা হয়নি। কারণ মোদির এজেন্ডা ভিন্ন। ফলে তাড়াহুড়াও আছে। মোদির মূল এজেন্ডা ভারতের অর্থনীতি, বিকাশ। এ জন্যই গোয়েন্দা আমলারা একযোগে আমেরিকাকে চাপ দিয়ে ধরে বার্গেনিং করে কিছু আদায় করতে পারেনি।


মোদি সাথে প্রথম ওবামার সাক্ষাৎ হয়েছিল নির্বাচিত হওয়ার মাত্র পাঁচ মাসের মাথায়। আর দ্বিতীয়বার মোলাকাত ওবামার গত জানুয়ারি ২০১৫-তে ভারত সফরের সময়। ইতোমধ্যে ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক পুরনো স্থবিরতা ছাড়িয়ে আবার জট খুলে নতুন রাস্তায় উঠে যাওয়া বলা যায়, যেন নতুন করে সদর রাস্তায়। কিন্তু ভারতের আমলা মহলে একটা বড় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে ওবামার সফর-উত্তর পরিস্থিতি শেষ হয়। পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংয়ের অপসারণ আর জয়শঙ্করের সেই সচিব পদলাভ, এ ঘটনায় মনে হয়েছিল ভারতের গোয়েন্দাসহ আমলা বাহিনী বোধ হয় ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে হার স্বীকার করে নিলো, অধীনস্থতা মেনে নিলো। অর্থাৎ আমলা বনাম পলিটিক্যাল নেতৃত্বের লড়াইয়ের সমাপ্তি ঘটল।



এমন মনে হওয়ার পেছনে আর এক ঘটনা ছিল, ওবামার ভারত সফরের সময়ে ওবামা প্রশাসনও আমাদেরকে এমন ধারণা দিয়েছিল যে, বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারত-আমেরিকার এক কমন নীতি বা এক সমন্বিত অবস্থান বোধ হয় এই সফরে আঁকা হয়ে গেছে। ওবামা সফরসঙ্গী যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সিনিয়র পরিচালক ফিল রেইনারও এমন ধারণা দিয়েছিলেন। অর্থাৎ ওবামা প্রশাসনও অনুমান করেছিলেন ভারতের আমলাদেরকে জয় তারা মোটামুটি করে ফেলেছেন। যেহেতু উভয় রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্তরে বড় ধরনের সমঝোতার ভিত্তি টানা হয়েছিল।



গত ৩০ এপ্রিল ২০১৫ আমেরিকান কংগ্রেসের বিদেশনীতিবিষয়ক উপকমিটির বাংলাদেশকে নিয়ে এক শুনানি ডাকা হয়েছিল। অর্থাৎ গত ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালে নির্বাচনের পর এই প্রথম শুনানি ডাকা দেখে এটা বোঝা যাচ্ছিল যে, ভারতের সাথে আমেরিকার সম্পর্কের জট খোলা শেষ করার পরই বাংলাদেশ ইস্যুতে আমেরিকার সম্ভবত আবার সক্রিয়তা দেখাতে চাইছে। সে হিসাবে গত ৩ ফেব্রুয়ারির ফিল রেইনারের প্রেস কনফারেন্সকে মনে হয়েছিল ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রহসনের পর আমেরিকার এই ইস্যুতে আবার সরব ও সংশ্লিষ্ট হওয়ার ইঙ্গিত। বিশেষত ভারতের সাথে নতুন করে সম্পর্কের একটা ভিত্তি এঁকে নেয়ার পরে।



কিন্তু ৩০ এপ্রিল ২০১৫ আমেরিকান কংগ্রেসের শুনানি অনুষ্ঠানের পর থেকে এটা পরিষ্কার জানা যাচ্ছে যে আসলে ভারতের আমলাদের সম্পর্কে ওবামা প্রশাসনের অনুমানই ভুল ছিল এবং তা প্রকারান্তরে স্বীকার করা হলো। এক কথায় বললে, ভারতের আমলাদের থেকে যাঁতাকাঠি ফেরত নেয়া আর ভারতের চোখ দিয়ে আমেরিকার এশিয়া নিরাপত্তা দেখতে অস্বীকার করার কাফফারা দেয়া ওবামার শেষ হয়নি। আরো কত কী কাফফারার ভেতর দিয়ে যেতে হবে! কেন এমন হলো তা বোঝার চেষ্টা করব নিচের অংশে।



এমনিতেই ‘আমেরিকান কংগ্রেসে শুনানি’-এর অর্থ তাৎপর্যের দুটো দিক আছে। আমেরিকান নির্বাহী সরকার যেটা আমেরিকার প্রচলিত ভাষায় ‘ওবামা প্রশাসন’ বলা হয় সেই প্রশাসনের কাছে কংগ্রেসের শুনানি (আমাদের ভাষায় সংসদীয় স্থায়ী কমিটির শুনানি) মানে হলো নিজের কথা নিজেই শোনা আর কংগ্রেস সদস্যদের শোনানো। তবে অ্যাকাডেমিক বা থিংকট্যাংক জাতীয় প্রতিষ্ঠানের বরাতে। শুনেও কংগ্রেসের যেহেতু নির্বাহী ক্ষমতা নেই ফলে শুনে কিছুই করার নেই। তবে নির্বাহী বিভাগে কী হচ্ছে, কী চলছে জনগণের হয়ে তা কয়েকজন এক্সপার্টের বরাতে শুনে নেয়া, নীতিগত বিচ্যুতি হলে বকা দেয়া, আবার নির্বাহী বিভাগ নতুন কোনো নীতি নিলে সেটা কেমন, কী হবে হতে পারে এসব বিষয় এক্সপার্টদের নিয়োগ করে তাদের বরাতে শুনে নেয়া। এই হলো এক অর্থ তাৎপর্য। আর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিকটা হলো আমেরিকান সরকারের কোনো নীতিপলিসি পাবলিক ডকুমেন্ট নয়। খুব কম অংশই সাধারণত প্রকাশ্য তথ্য। নানা রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার বেড়াজালে এটা আটকা থাকে। কিন্তু কংগ্রেসের শুনানিতে ব্যবহার করা শুধু ডকুমেন্ট নয়, পুরো শুনানিটাই পাবলিকলি প্রেসের কাছে উন্মুক্ত। যেমন বুশ প্রশাসনের নিজের যাঁতাকাঠি ভারতকে ধার দেয়া যে সঠিক হবে এরকম যে প্রশাসন ভাবছে এই বিষয়টা আমরা তৎকালীন কংগ্রেসের এক শুনানি থেকে জানতে পেরেছিলাম। কিন্তু এই বিষয়টার সরকারের কোনো নীতি বা এ বিষয়ের কোনো ডকুমেন্ট থেকে আমরা জানতে পারি না। পারব না।



যা হোক ৩০ এপ্রিলের শুনানিতে পাঁচজন অ্যাকাডেমিক বা থিংকট্যাংক জাতীয় প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তি প্রতিনিধিকে ডাকা হয়েছিল। তাদের মধ্যে ড. আলী রিয়াজ এক বাংলাদেশী আমেরিকান, এক থিংকট্যাংকের প্রতিনিধি। আর লিসা কার্টিজ, থিংকট্যাংক হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র গবেষক। কংগ্রেস শুনানিতে তার মুখ দিয়ে একটা রেকমন্ডেশন বা পরামর্শ আমাদের জানানো হয়েছে। এই পরামর্শ থেকে জানা যাচ্ছে ভারতীয়দের অবস্থান সম্পর্কে আমেরিকান প্রশাসনের মূল্যায়ন কী? এবং সে মূল্যায়ন তারা অপ্রত্যক্ষে ভারতকে জানাতে চায়। লিসা কার্টিসের মুখ দিয়ে যাতে এটা আমেরিকান সরকারি ভাষ্য নয় বলে অস্বীকারের সুযোগ নেয়া যায়। লিসার পরামর্শের প্রথম প্যারাগ্রাফের সারকথা কথা হলো, বাংলাদেশের সরকার ও বিরোধীকে ডায়ালগে বসাতে ওবামা প্রশাসনের প্রভাব বিস্তার করা উচিত। পরের প্যারাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাই সেটা হুবহু নিচে অনুবাদ করে দিলাম।....


 


‘আমেরিকার ভারতের সাথে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া উচিত। যদিও এ পর্যন্ত মনে হচ্ছে, নয়াদিল্লি শেখ হাসিনার ওপর নিজের প্রভাব ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক যাতে হাসিনা বিরোধীদের সাথে যোগাযোগ করেন, কথা বলেন। ভারতীয় নেতৃত্ব সম্ভবত নিজের স্বার্থের হিসাব করছে এভাবে যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই তাদের স্বার্থ ভালোভাবে হাসিল হবে। তাই তারা শেখ হাসিনা যেন বিএনপিকে রাজনৈতিক স্পেস দেন এ ব্যাপারে চাপ দিতে ভারত অনিচ্ছুক। যদিও নয়াদিল্লির এটা সঙ্কীর্ণ চোখে দেখা অবস্থান। যদি হাসিনা তার ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী ঝোঁকের শাসনের বিরুদ্ধে কোনোই আন্তর্জাতিক চাপ অনুভব না করেন তবে বাংলাদেশের রাজনীতি অবশ্যই মারাত্মকভাবে সহিংসতায় ছেয়ে যাবে এবং রেডিক্যাল ইসলামিস্টরা আরো বেশি করে দলে রিক্রুট করার মতো সমর্থক সহজেই লাভ করবে।’



লিসা কার্টিসের একথার সোজা অর্থ হলো, ওবামা প্রশাসন ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বপর্যায়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে সমন্বিত অবস্থান নিতে পারলেও আমলাপর্যায়ে গিয়ে তা আর প্রসারিত বা কার্যকর হতে পারছে না।
এর মূল কারণ হাসিনার সরকারের সাথে ভারতের গোয়েন্দাসহ আমলা প্রশাসনের যে সখ্য, পরস্পর পিঠ চুলকানির ঐক্য ২০০৯ সালে হাসিনার সরকার কায়েম হওয়ার আগ থেকেই বুশ প্রশাসনের শেষ জমানায় এবং বুশ প্রশাসনের মধ্যস্থতায় যাত্রা শুরু করেছিল। পরে ২০১১ সাল থেকে ওবামা প্রশাসন সে নীতি থেকে সরে এলেও ভারতের গোয়েন্দাসহ আমলা প্রশাসনের সাথে হাসিনার সে সখ্য রয়েই যায়। বিশেষত ওবামার বদলে নেয়া বাংলাদেশ নীতির পরিণতিতে ভারতের আমলাদের সাথে কখনো স্থবির সম্পর্ক অথবা কখনো মোদি আমলে নতুন মাত্রায় সম্পর্ক চালু করলেও বিপরীতে নিয়মিতভাবে হাসিনার দিক থেকে ভারতীয় আমলাদের যে খোলা দুয়ার আহ্বান, একে উপেক্ষা করা ভারতের গোয়েন্দা আমলাদের জন্য অসম্ভব। বিশেষত, ভারতের বাংলাদেশের কাছ থেকে যেকোনো বিষয়ে সুবিধা নেয়ার দরকার মনে হলে সবটাই তারা পেতে পারে। কোনো বিনিময় বা কোনো শর্ত ছাড়াই তা দিতে হাসিনা যেকোনো ডেসপারেট অবস্থা পর্যন্ত যেতে রাজি থাকে। হাসিনার কেবল একটাই শর্ত ভারতের চাপ দেয়া দূরে থাক বরং ভারত তাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করলেই হবে।
ওবামা প্রশাসন এ দিকটা আমলে নিয়েছে কিন্তু নিজ মুখে তা না বলে লিসা কার্টিজের মুখ দিয়ে প্রকাশ করেছে। 



সারকথায় পরিস্থিতিটা হাসিনার জন্য এক মরিয়া অবস্থা, ভারতকে যেকোনো কিছু দেয়ার বিনিময়ে সে ভারতের সমর্থন হাসিল করতে চায়। আবার ওদিকে ওবামা প্রশাসনের দিক থেকে নিজ কর্মদোষে কাফফারা দিতে দিতে সে দিশেহারা। ভারতের গোয়েন্দা-আমলাকে যে স্বাদ একবার যে চাখিয়েছে সে স্বাদ সে ছাড়তে পারছে না।



তবে লিসা কার্টিজ ভারতকে ইসলামি রেডিক্যালদের উত্থানের ভয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এতে ভারত ভয় পাবে কি না আমরা জানি না। তবে এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, ভারতের হাসিনা রেজিমকে সমর্থনের বিনিময়ে বাংলাদেশকে ন্যাংটা করে সব নিয়ে নেয়াই শেষ কথা নয়। সেটা ভারতের বিনা পয়সায় বাংলাদেশজুড়ে উপকূলীয় জাহাজ চলাচলের অনুমতি বা অমন যা কিছুই হোক। অপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারের থেকে অনেক কিছুই নিয়ে নেয়া যায় যেটা জনগণ ও পপুলার জনমতের বিপক্ষে একটা কাজ। এর জন্য ভারতকে কি মূল্য দিতে হতে পারে সে দিকটাও খেয়াল রাখা বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাজ।


 

0 comments:

Post a Comment