WHAT'S NEW?
Loading...

নূহ-তনয়ের জনপদে

মাসুমুর রহমান খলিলী


সন্ধ্যার আলো-অন্ধকারের এডেন যেন অন্য রকম আভা ছড়িয়ে দিচ্ছিল প্রকৃতিতে। এক প্রাচীন সভ্যতার জনপদকে আধুনিকতার ছোঁয়া কিভাবে অপূর্ব করে তুলতে পারে, শহরের প্রবেশস্থলের বেশ খানিকটা দূর থেকেই তা মোহিত করছিল সবাইকে। শহরের বুক চিরে আমাদের গন্তব্যস্থল শেরাটন হোটেলে যাওয়ার আগেই স্থির-নিশ্চল জলরাশির লেক অদ্ভুত এক নৈসর্গ তৈরি করে সানায় ইয়েমেনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জরুরি কাজ থাকায় হোস্ট মুজিব ভাইকে এডেন ভ্রমণে সাথে পাইনি। এ অভাব দূর করতে ইয়েমেনে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত বাংলাদেশী আলমগীরকে সঙ্গী করে দেন তিনি। এক দিনের সফরে এডেনের সৌন্দর্য পরখ করা অসম্ভব এক ব্যাপার। তবু এডেনের শহর, বন্দর আর সৈকতের অপরূপ সৌন্দর্য আট ঘণ্টার আধা পাহাড়ি রাস্তা ঠেলে আসার কষ্টটুকু ভুলিয়ে দেয় আমাদের। শেরাটনে রাত কাটিয়ে এডেনের সৈকতে পৌঁছতে আমাদের বেশখানিকটা দেরিই হয়ে যায়। সকালের মিষ্টি র

োদ ক্রমেই উত্তপ্ত হতে থাকে। সাথে সাথে এডেনের বালুকারাশিও গরম হয়ে ওঠে। এডেনের এই সৈকত সুবিশাল ও দীর্ঘ নয়। অনুত্তাল ঢেউগুলো সৈকতে আছড়ে পড়ার আগেই শান্ত হয়ে আসে। তবু এক পলক তাকিয়ে আমরা এডেন সামুদ্রিক প্রণালী ঘিরে তৈরি হওয়া ইতিহাসকেই স্মরণ করছিলাম। মঞ্জু ভাই, বাবু ভাই, রতন ভাই, শেখ নজরুল আমরা সবাই সানা ফিরে যাওয়ার তাগিদ খানিকটা ভুলেই এডেনের সৈকতে এক ঘণ্টার বেশি সময় কাটিয়ে দেই। এখানে সমুদ্রের বিশাল জলরাশির দিকে তাকাতে তাকাতে নানা স্মৃতি মনে পড়ে। মনে পড়ে বাংলাদেশের কথা, কক্সবাজারের দীর্ঘ বেলাভূমির কথা, নিউইয়র্ক, সানফ্রান্সিসকো, দুবাই এবং আটলান্টিকের তীরে গড়ে ওঠা আইভরিকোস্টের বাণিজ্যিক রাজধানী আবিদজানের সৈকতের কথা। সব সৈকতই যেন নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র-অনন্য। তবে এডেনটা যেন একটু অন্যরকম। পশ্চিমের সৈকতের মতো তারুণ্যের হালকা উচ্ছ্বাস নেই এডেনে। তবুও এডেন সৈকতের এক ঘণ্টার অবস্থান বেশ নস্টালজিক করে তুলেছিল আমাদের।


সংবাদপত্রের সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে বিশ্বের নানা দেশে বেড়ানোর অযাচিত সুযোগ এসেছে বিভিন্ন সময়। ইয়েমেনে যাওয়ার দাওয়াতটা কেন জানি একটু বাড়তি উচ্ছ্বাস ও আবেগ তৈরি করে আমার মধ্যে। কাউসার ভাই প্রথম ইয়েমেনে সফরের বিষয়টি জানান আমাকে। তার মেজ ভাই কে এম মুজিবুল হক ইয়েমেনের বাংলাদেশস্থ অনারারি কনসাল জেনারেল। ইয়েমেনের জাতীয় এয়ারলাইন্স ‘ইয়েমেনিয়া’র জিএসএ-টাও তার প্রতিষ্ঠানের। কাউসার ভাইয়ের সাথে পরিচয়টা আমার দীর্ঘদিনের। আমার স্ত্রীর নানা মুফতি মহিউদ্দিন বড়কাটরার বিশিষ্ট দ্বীনি ব্যক্তিত্ব পীরজি হুজুরের ভাগ্নে। এই পীরজি হুজুরের পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার সম্পর্ক মুরাদনগরের শাহ কায়কোবাদ পরিবারের। দুই পরিবারের পূর্বপূরুষরা ইসলাম বিস্তৃতির মিশন নিয়ে এ দেশে এসেছিলেন। এ সম্পর্কের বিষয়টি জানা হয় বেশ পর। ইয়েমেনে যাওয়ার আগে মুজিব ভাইয়ের সাথে কয়েক দফা ফোনে কথা হলেও অতটা ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়নি। ইয়েমেন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রায় এক সপ্তাহের সফরে যতই কাছ থেকে তাকে দেখেছি, ততই অসাধারণ এক বন্

ধুবৎসল ব্যক্তিত্বের মানুষ মনে হয়েছে তাকে।


ইয়েমেনের মূল কর্মসূচি ছিল দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। আমরা ১১ সাংবাদিকের এক প্রতিনিধিদল ছিলাম এ সফরে। সাংবাদিকের বাইরে মুজিব ভাই ছাড়া ছিলেন সার্ক চেম্বারের সহসভাপতি ও চট্টগ্রামের বিখ্যাত হোটেল আগ্রাবাদের মালিক হাকিম আলী। তিনি বাংলাদেশের হোটেল মালিক সমিতিরও গুরুত্বপূর্ণ নেতা। পোশাকি ভদ্রলোক ও সজ্জন ব্যক্তিত্ব তিনি। বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। সাংবাদিক প্রতিনিধিদলটির সমন্বয়ক ছিলেন দৈনিক ইনকিলাবের তদানীন্তন ডেপুটি এডিটর মঞ্জুরুল আলম আমার এক সময়ের চিফ রিপোর্টার। এখন তিনি ইসলামিক টেলিভিশনে নিউজের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন। টিমের সাথে ছিলেন রাশীদ উন নবী বাবু ভাই কার্যনির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দৈনিক আমার দেশের আত্মপ্রকাশ এবং এটাকে এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীর পত্রিকায় পরিণত হওয়ার মূল কারিগর তিনি। এখন তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন। সাথে ছিলেন রফিকুল ইসলাম রতন যাকে আমরা এভারগ্রিন বলতে বেশি পছন্দ করতাম। যুগান্তরের চিফ রিপোর্টারের দায়িত্ব থেকে সদ্য মুক্ত হয়ে তিনি ইয়েমেনে আসেন। দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র রিপোর্টার মাঈনুল আলমও ছিলেন এই সফরে। বাংলাদেশের তিন প্রধান চ্যানেলের ছয় সাংবাদিককে সাথে পাই এ সফরে। এর মধ্যে এটিএন’র শেখ নজরুল ছিলেন আসলেই অনন্য। পুরো সফরকে আনন্দময় রাখতে তার বিশেষ ভূমিকা ছিল। চ্যানেল আইয়ের সিনিয়র রিপোর্টার মাহবুব মতিন যে আসলেই এক উদীয়মান তারকা সাংবাদিক, তা বুঝতে পেরেছি ইয়েমেন এসে। সাদাসিধে চিন্তাশীল এক মিডিয়া কর্মী ছিলেন এনটিভি’র প্রযোজক শাহাবুদ্দীন। তবে তার পেছনে কেন যেন সার্বক্ষণিক লেগেই ছিলেন তার সহকর্মী ক্যামেরাম্যান হাসান হাফিজুর রহমান পুলক। সম্ভবত তাদের সম্পর্কের গভীরতার কারণে এটাওটা নিয়ে খুনসুটি লেগেই থাকত। এটিএন’র ক্যামেরাম্যান মিনহাজ মোসলেম আর চ্যানেল আই’র ইমাম হোসেন লবনের আবশ্যিক মজা ছড়িয়েছেন পুরো সফরে। সাংবাদিক প্রতিনিধিদলের পুরো সফরের কোনো ঘাটতিই যেন থাকতে দেয়নি মুজিব ভাইয়ের সার্বক্ষণিক তদারকি। গুণই মানুষকে মহান করে মুজিব ভাই সম্পর্কে মঞ্জু ভাইয়ের এ মতে যে কোনো মেদ ছিল না, তা সানার বিমানে ওঠার আগে থেকেই উপলব্ধি করতে শুরু করি।


বন্ধন অনেক পুরনো


বাংলাদেশের মানুষ সৌদি আরব আর ইয়েমেনের সাথে আত্মার বন্ধনটা খানিকটা বেশিই অনুভব করে। মুসলিম বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এক জনপদ বাংলাদেশ। মুসলিম বিশ্বের মানচিত্র দেখলে এই জনপদে ইসলাম কিভাবে ছায়া বিস্তার করল, তা ভেবে বাইরের অনেকেই অবাক হন। এই অবাক করা ঘটনার সাথেই যুক্ত ইয়েমেনি দরবেশরা। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি ১৭ জন ঘোড়সওয়ার নিয়ে বঙ্গ বিজয়ের বেশ আগেই ইয়েমেনি সুফি সাধক হজরত শাহজালাল, শাহ মাখদুম, শাহ পরান, শাহ আমানতসহ তিন শতাধিক সুফি বাংলাদেশে ইসলামের বার্তা নিয়ে আসেন। সুফিবাদের শান্তি ও আধ্যাত্মিকতার অমিয় বাণী প্রচারের সাথে সাথে তারা জমিদারদের শোষণ থেকে মুক্ত করতে যুদ্ধও করেছেন। এভাবে এক শান্তিময় সমাজের রূপরেখা ইয়েমেনি সুফিরা আগেই রেখেছিলেন বলে বখতিয়ার খিলজির আগমনকে স্বাগত জানিয়ে সেন রাজাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন বাংলাদেশের মানুষ।


ইয়েমেনে পৌঁছার আগেই এসব ইতিহাস স্মৃতি নানাভাবে চিন্তায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। মুজিব ভাইয়ের গাইড অনুযায়ী আমরা কিছুটা সময় থাকতেই জিয়া বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জে একত্র হই। ইমিগ্রেশনের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করার জন্য লোকজন তিনি আগে থেকেই ঠিক করে রাখেন। যথাসময়ে আকাশে উড়াল দেয় ইয়েমেনিয়া। সুপরিসর বিমানটির ব্যবস্থাপনাও বেশ ভালো। ছয় ঘণ্টার বিমান ভ্রমণটা ক্লান্তিমুক্ত হয় আমাদের নানা গল্প-গুজবে। সবকিছুর সমন্বয়ক সেই মুজিব ভাই। সানায় বিমান অবতরণের পরই ইয়েমেনিয়ার কয়েকজন কর্মকর্তা আমাদের স্বাগত জানাতে অপেক্ষায় থাকেন। যথারীতি কুশল বিনিময়ের পর সানার সর্বাধুনিক হোটেল ‘মোভেন পিক’-এ নিয়ে যাওয়া হয় আমাদের। এ হোটেলেই ইয়েমেনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। শুমশাম আধুনিক হোটেল। অনুষ্ঠানের আয়োজনও সে রকমই। হোটেলটির নির্মাণকাজ পুরোটা শেষ না হলেও অসাধারণ করে গড়ে তুলতে সযতœ প্রচেষ্টা উদ্যোক্তাদের। সৌদি-ইয়েমেন যৌথ বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এটি। ব্যবস্থাপনায় রয়েছে ফরাসি একটি কোম্পানি।


সানার সংবর্ধনা


ইয়েমেনে আমাদের সফরের মূল কর্মসূচি ছিল সানায়। এ কর্মসূচির অংশ হিসেবে গত বছর (২০০৬) ২৬ আগস্ট সানায় বাংলাদেশে নিযুক্ত ইয়েমেনের অনারারি কনসাল জেনারেল এই সংবর্ধনার আয়োজন করেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল দুই দেশের মধ্যকার ঐতিহাসিক সম্পর্কে আবার মেলবন্ধন তৈরি করা। বেলা ১১টা বাজতেই আমন্ত্রিত অতিথিরা একে একে হাজির হতে থাকেন। ইয়েমেনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে উপস্থিত হন সরকারের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গ। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন এটিএন’র শেখ নজরুল ইসলাম। সাংবাদিক প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন মঞ্জু ভাই ও বাবু ভাই। চমৎকার বক্তব্যে বাংলাদেশকে তুলে ধরেন অনারারি কনসাল জেনারেল কে এম মুজিবুল হক। তার ইয়েমেনি পূর্বপুরুষের কথা, বাংলাদেশের মানুষের ইয়েমেনের সাথে আত্মিক বন্ধনের কথা, ইয়েমেনের সাথে বাংলাদেশের যৌথ ব্যবসায়-বিনিয়োগ ও জনশক্তি আদান-প্রদানে সহযোগিতার নানা দিক তুলে ধরেন তিনি। এভাবে দুই ঘণ্টা ধরে অনুষ্ঠিত হয় সংবর্ধনার আলোচনা ও মধ্যাহ্নভোজ।


অনুষ্ঠানে ইয়েমেনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে বাংলাদেশের প্রতি তার সরকারের আগ্রহের বিষয়টি ফুটে ওঠে। একই মনোভাবের প্রতিফলন ঘটান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ইয়েমেন সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে ইয়েমেন সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান ড. আবদুল হাদি আল হামদা, ঢাকায় নিযুক্ত ইয়েমেনের অনারারি কনসাল জেনারেল কে এম মুজিবুল হক, সার্ক চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সহসভাপতি হাকিম আলী, সাংবাদিক প্রতিনিধিদলের সদস্য রাশীদুন নবী বাবু ও মঞ্জুরুল আলম বক্তব্য রাখেন। বাংলাদেশের সাথে ইয়েমেনের ঐতিহাসিক সম্পর্কের ওপর গুরুত্বারোপ করে ইয়েমেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবু বকর আবদুল্লাহ আল কিরবি ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে একটি অভিন্ন বাজার গড়ে তুলতে পারলে তা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতাকে অনেক বেশি কার্যকর করবে বলে মত প্রকাশ করেন। তিনি বিশ্ববাণিজ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ ও ইয়েমেনের অভিন্ন স্বার্থের কথা উল্লেখ করেন। তার মতে, এ দুটি দেশ বাণিজ্য, বিনিয়োগ, পর্যটনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরস্পরকে সহযোগিতা করতে পারে। তার দেশ বিনিয়োগের জন্য এক মুক্ত এলাকা প্রতিষ্ঠার চিন্তাভাবনা করছে বলে উল্লেখ করে বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীদের সেখানে বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানান।
ইয়েমেনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশী সাংবাদিকদের সাথে অনুষ্ঠানস্থলেই মতবিনিময় করে দুই দেশের সম্পর্কের বন্ধনকে আরো দৃঢ় করার অঙ্গীকার করেন।
ইয়েমেনের অনারারি কনসাল জেনারেল কে এম মুজিবুল হকের সাথে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী আবদুল কাদের বেগ আনমল পরদিন ২৭ আগস্ট দুই দফায় দীর্ঘ সময় ধরে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হন। ইয়েমেনি প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্যিক, পর্যটন ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে কিভাবে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। দুই দেশের মধ্যে নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতার সম্পর্ক জোরদার হবে বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশ-ইয়েমেন যৌথ চেম্বার অব কমার্স গঠনের বিষয় নিয়েও কথা হয় তাদের মধ্যে।


আমাদের হোটেলটি ছিল সানার আধুনিক শহরের কাছে। এর অদূরেই ইয়েমেনের প্রধানমন্ত্রীর অফিস। কাছাকাছি আমেরিকান দূতাবাসসহ বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশন। আমাদের সফরের অল্প কিছু দিন পর সেপ্টেম্বরেই আরো সাত বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন আলী আবদুল্লাহ সালেহ। প্রেসিডেন্ট যে নতুন এক মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হচ্ছেন তা মোটামুটি সবারই জানা ছিল। দুই ইয়েমেনকে একত্র করার নায়ক ছিলেন আলী আবদুল্লাহ সালেহ। সংযুক্তির আগে উত্তর ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি।


ইতিহাস অনেক পুরনো


ইয়েমেনের রাজনৈতিক ইতিহাস অনেক পুরনো। বিশ্বের সব চেয়ে পুরনো সভ্যতার একটির বিকাশ ঘটে এখানে। খ্রিষ্টপূর্ব ৯ শতক থেকে খ্রিষ্টাব্দ ৬ শতক পর্যন্ত দেশটি সাবীয়, আসানীয়, মিনায়ী, হজরে মাউতসহ বিভিন্ন রাজ্যের অংশ ছিল। এ সময়ই ছিল পুরনো সভ্যতার বিকাশকাল। মুসলিম শাসকরা পরে এটাকে আরো অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যান। ষষ্ঠ দশকের শেষ এবং সপ্তম দশকে সাদ মা’রিফ বা মারিফ বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর বহুসংখ্যক সাবীয় ইয়েমেনের বাইরে এবং উত্তর আফ্রিকা ও আরব উপদ্বীপের উত্তর দিকে চলে যায়। সপ্তম শতকে ইসলামের খলিফারা এখানে শাসন কায়েম করেন। এই খেলাফত ভেঙে যাওয়ার পর জায়েদি শিয়া ইমামরা উত্তর ইয়েমেনে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। একাদশ শতকে মিসরীয় সুন্নি খলিফারা উত্তর ইয়েমেনের আধিকাংশ এলাকায় কর্র্তৃত্ব স্থাপন করে। ষোড়শ শতক এবং আবার ঊনবিংশ শতকে তুর্কি খেলাফতের নিযন্ত্রণে চলে যায় ইয়েমেন।


১৯৯৮ সালে উত্তর ইয়েমেন অটোমান সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং ১৯৬২ সালে এটি পরিণত হয় একটি প্রজাতন্ত্রে। ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে উত্তর ইয়েমেনে অটোমান শাসন নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর নিয়ন্ত্রণ মূলত শহরকেন্দ্রগুলোতে সীমিত ছিল। জায়েদি ইয়ামদের শাসন স্বীকৃত ছিল আপার ইয়েমেনে। ১৯১৮ সালে তুর্কি বাহিনী প্রত্যাহার করা হলে ইমাম ইয়াহিয়া মুহাম্মদ মুতাওয়াক্কালিত ‘কিংডম অব ইয়েমেন’ সৃষ্টি করে তার নিয়ন্ত্রণকে সংহত করেন। ইয়েমেন ১৯৪৫ সালে আরব লিগ এবং ১৯৪৭ সালে জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৪৮ সালে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে ইমাম ইয়াহিয়া মারা যান এবং তার পুত্র আহমদ বিন ইয়াহিয়া ক্ষমতাসীন হন। দক্ষিণে ব্রিটিশ উপস্থিতি এবং আরব জাতীয়তাবাদীদের প্রতি মিসরের জামাল আব্দুল নাসেরের সমর্থন, গেরিলা উত্থানসহ নানা কারণে সঙ্ঘাত ও অশান্তি বাড়তে থাকে ইয়েমেনে। ১৯৬২ সালে ইমাম আহমদ মৃত্যুবরণ করেন। এর অব্যবহিত পরেই বিপ্লবী বাহিনীর দ্বারা ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ আল বদর ক্ষমতাচ্যুত হন। বিপ্লবী বাহিনী সানার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ইয়েমেন আরব প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। মিসর তাদের সেনা দিয়ে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। অন্যদিকে সৌদি আরব ও জর্দান বদরের অনুগত বাহিনীকে সাহায্য করে নবগঠিত প্রজাতন্ত্রের বিরোধিতা করে। এভাবে উত্তর ইয়ামেনে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। ১৯৬৭ সালে মিসরীয় সৈন্য প্রত্যাহারের আগ পর্যন্ত থেমে থেমে সঙ্ঘাত চলতে থাকে। ১৯৬৮ সালে রাজ অনুগতরা সানা দখল করে এবং বিরোধিতাকারী অধিকাংশ নেতা সমঝোতায় উপনীত হন। ১৯৭০ সালে সৌদি আরব ইয়েমেন প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দেয়।


দক্ষিণ ইয়েমেনে ব্রিটিশ স্বার্থসংশ্লিষ্টতা সৃষ্টি হয় ১৮৩২ সালে ব্রিটিশ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি জোর করে এডেন বন্দর দখল করার পর। ভারতে বাণিজ্যিক যাত্রার পথে এখানে জাহাজের একটি কোলিং স্টেশন স্থাপনের জন্য তারা এডেন দখল করে। ১৮৬৯ সালে সুয়েজ খাল খুলে দেয়ার পর এখানকার ব্রিটিশ দখলদারিত্ব রাজনৈতিক ও কৌশলগত গুরুত্ব লাভ করে। এডেন ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের অংশ হিসেবে শাসিত হয়। এরপর এডেন হয়ে যায় ব্রিটিশ উপনিবেশ। এই এডেনের পশ্চাৎভূমি ও হজরে মাউত নিয়ে পরে দক্ষিণ ইয়েমেন গঠিত হয়। এডেন-বহির্ভূত দক্ষিণ ইয়েমেনের বাকি অংশ সরাসরি এডেন-শাসিত না হলেও প্রতিরক্ষা চুক্তির আওতায় পরোক্ষভাবে ব্রিটিশদের দ্বারাই এ অঞ্চল নিয়ন্ত্রিত হতো। ঊনবিংশ শতকের শেষ দশক থেকে শুরু করে বিশ শতক পর্যন্ত সালতানাত আমিরাত ও শেখদের মধ্যে প্রশাসনিকভাবে বিভক্ত ছিল এতদঞ্চল। পুরো এলাকাকে প্রধানত পূর্ব এডেন প্রতিরক্ষা ও পশ্চিম এডেন প্রতিরক্ষা দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। প্রথম ভাগে হজরে মাউতের তিনটি স্টেট এবং শেষোক্ত ভাগে বাকি রাজ্যগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল।


মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুন নাসেরের নেতৃত্বে ব্রিটেনের আরব উপনিবেশগুলোতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হলে বিগত শতকের ষাটের দশকব্যাপী দ্বন্দ্বসঙ্ঘাত লেগে থাকে দক্ষিণ ইয়েমেনে। এ সময় মিসর ও সৌদি আরব সমর্থিত বিভিন্ন গেরিলা গ্রুপ সক্রিয় ছিল এখানে। মার্ক্সবাদী সমাজতন্ত্রে দিক্ষিত কিছু গোষ্ঠীও ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে যোগ দেয়। এভাবে দীর্ঘ সঙ্ঘাত-সংঘর্ষের এক পর্যায়ে ১৯৬৯ সালে মার্ক্সবাদী এনএলএফ ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং ১৯৭০ সালের ১ ডিসেম্বর দেশটির নাম দেয় পিপলস ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব ইয়েমেন। এরপর সব রাজনৈতিক দলকে ইয়েমেনি সোস্যালিস্ট পার্টিতে একীভূত করে এটাকে একমাত্র বৈধ রাজনৈতিক দল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ সময় শাসকরা সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, কিউবা ও কট্টরপন্থী ফিলিস্তিনিদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে।


উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেনের মধ্যে দুই জার্মানির মতো বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক চলতে থাকলে ১৯৭২ সালে দুই ইয়েমেনের সংযুক্তির ঘোষণা দেয়া হয়। আরব লিগের হস্তক্ষেপে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ হয় একাধিক সময়ে। অবশেষে ১৯৭৯ সালে দুই ইয়েমেনের একত্রীকরণ শীর্ষক আলোচনা শুরু হয় কুয়েতে। ১৯৮০ সালে দক্ষিণ ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইল ইস্তফা দিয়ে নির্বাসনে চলে যান। তার উত্তরসূরী আলী নাসির মোহাম্মদ ক্ষমতা নিয়ে প্রতিবেশী উত্তর ইয়েমেন ও ওমানের সাথে বিরোধ মিটিয়ে ফেলার উদ্যোগ নেন। ১৯৮৬ সালে আলী নাসের ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ইসমাইল সমর্থকদের মধ্যে রক্তাক্ত সংঘর্ষ বাধে। এতে আলি নাসির ক্ষমতাচ্যুত হন আর মৃত্যুবরণ করেন ফাত্তাহ ইসমাইল। এরপর ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত একত্রীকরণ আলোচনা শেষে দুই ইয়েমেন একীভূত হয়। এর মধ্যেই বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার ফলে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে মার্কিন একক কর্তৃত্ব বিস্তার করে বিশ্ব ব্যবস্থায়।


এডেন থেকে সানা


এডেনের সড়ক জনপদ সৈকতে ঘুরতে ঘুরতে এসব ইতিহাস নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল আমাদের মধ্যে। এডেন ও সানার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সঙ্ঘাতে যেমন ভিন্ন মাত্রা রয়েছে, তেমনি এডেনের দৃশ্যপটটাও যেন ভিন্ন। অনেকটা আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিন্যস্ত সবকিছু। শহর সংলগ্ন পোতাশ্রয়, ছোট ছোট পাহাড় ঘেঁষা ভবন, শহরের কেন্দ্রস্থল, আধুনিক হোটেলের সমাহার সর্বোপরি এডেন বন্দরের বাণিজ্যিক নৌবহরের সদা ব্যস্ত আসা-যাওয়া এক ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে এডেনকে।


২৭ আগস্ট হোটেল শেরাটনে রাত যাপন করে আমাদের আবার সানায় ফিরে যাওয়ার কর্মসূচি নির্ধারণ করা আছে। এডেনে ভ্রমণের সময়টাকে কিছুটা দীর্ঘায়িত করার জন্য মুজিব ভাই সানা থেকেই চেষ্টা করেন আমাদের জন্য বিমান টিকিটের ব্যবস্থা করার। কিন্তু এক সাথে ইয়েমেনিয়ায় আটটি টিকিট না পাওয়ায় সেই সড়ক পথেই আবার ফিরতে হয় সানায়।


এডেন-সানা সড়কের দুই পাশে পাথরের সারি সারি পাহাড় যেমন রয়েছে তেমনি কাদ চাষের সযতœ পরিচর্যায় দেখা যায় ইয়েমেনি চাষিদের। কিছু দূর পর পরই রাস্তার পাশে মিষ্টি কদুর মতো ফল একধারে স্তূপ করে রাখা। ছোট শিশু-যুবক-বৃদ্ধ নানা বয়সী মানুষ দেখা যায় রাস্তার পাশে, লোকালয়, ব্যবসা কেন্দ্র ও ক্ষেত খামারে। এডেন থেকে সানার পথে অসমতল দীর্ঘ এলাকার যেখানে কৃষিচাষের মতো সমতল ভূমি ছিল তার অধিকাংশতেই দেখা গেছে কাদ চাষ। ‘কাদ’ হচ্ছে বাংলাদেশের চা গাছের সদৃশ্য একধরনের গাছ। সাধারণত এক থেকে পাঁচ মিটার দীর্ঘ হয়। পান চাষের মতো অত্যন্ত যতœ করে কাদ উৎপাদন করতে হয়। চা গাছের মতো শিখরের কচি ডগাটা সংগ্রহ করে উৎপাদকরা। সেটি ছোট ছোট আঁটি করে বিক্রি করে তারা। গোটা ইয়েমেনে ‘কাদ’ ব্যাপক জনপ্রিয় একটি বস্তু। নেশাজাতীয় গাছ হিসেবে সৌদি আরবসহ প্রতিবেশী মুসলিম দেশগুলোতে এটি নিষিদ্ধ। ইয়েমেনিরা বেলা ১২টা না বাজতেই দুপুরে খাবারের পর কাদের আঁটি নিয়ে বসে একটার পর একটা পাতা মুখে পুরে। রস খেয়ে কাদের পাতার চিবানো অংশটুকু মুখের একপাশে জমা রাখে। এভাবে রাতের খাবার পর্যন্ত একনাগাড়ে চলে কাদ গ্রহণ। মাঝে শুধু নামাজের জন্য কাদ খাওয়া থেকে বিরত থাকে অনেকে। ছোট শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই নিজেদের দৈনন্দিন কাজের সাথে সাথে অথবা এক জায়গায় আড্ডা বসিয়ে কাদ খায়।


ইয়েমেনিদের মধ্যে কাদ যে কতটা বিস্তৃত হয়ে আছে, তা সাধারণ কেউ চিন্তাই করতে পারে না। খাদ্যের পেছনে একজন ইয়েমেনি যে অর্থ ব্যয় করে, তার চেয়ে বেশি খরচ হয় কাদে। ইয়েমেনি আর্থিক লেনদেনের এক-তৃতীয়াংশজুড়ে হয় কাদকে কেন্দ্র করে। প্রতিবেশী সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, ইরিত্রিয়া থেকে এই কাদ আমদানি করতে ইয়েমেনের বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়। কাদের মধ্যে এমন কী বিস্ময়কর গুণ রয়েছে যার জন্য এর মধ্যে এক রকম নিমগ্ন হয়ে আছে ইয়েমেনিদের মতো একটি লড়াকু জাতি। এর স্বাদ পরখ করতে এনটিভি ক্যামেরাম্যান তুষার এক আঁটি কাদ কেনেন। কাদ খাবার এক পর্যায়ে তার চেহারায় যেন একরকম তৃপ্তির আভা ফুটে ওঠে। জিজ্ঞেস করার পর তুষার জানান, এর স্বাদ অনেকটা পান আর আমলকীর মাঝামাঝি। পান-আমলকী খাওয়ার পর একধরনের তৃপ্তিময় স্বাদ সৃষ্টি হয়। কাদ খাওয়ার পরও তাই দেখা যায় কাদ মুখে পানি খেলে সেই পানির স্বাদ মনে হয় অনন্য। ইয়েমেনিরা নিশ্চয় এর চেয়েও অধিক কিছু পেয়েছে কাদ থেকে। সে বিষয়টি ভিন্ন। তবে কাদ ইয়েমেনিদের কতটুকু উপকার করছে আর জীবনীশক্তিকে কতটা পঙ্গু করে দিচ্ছে, সে বিতর্কটা উঠতেই পারে। তবে কাদ নিষিদ্ধ করে বড় রকমের গণরোষানলে পড়তে সাহস করেন না কোনো শাসকই। এ ব্যাপারে কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও নিবৃত হয় সরকার।


আবরাহার হস্তি কাহিনী


এডেন থেকে আমাদের সানায় পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল গড়িয়ে যায়। আমরা বেরিয়ে পড়ি পুরনো সানা শহর দেখতে। যতই এগোতে থাকি, একের পর এক বিস্ময় সৃষ্টি হয় আমাদের মধ্যে। হজরত নুহ আ: -এর পুত্র শ্যাম সানা শহরের গোড়াপত্তন ঘটিয়েছিলেন। এরপর অনেক সভ্যতার জন্ম দিয়েছে এ শহরটি। এ জনপদে অনেক নবী-রাসূলের আবির্ভাব যেমন হয়েছে, তেমনিভাবে আল্লাহর ঘর কাবা ধ্বংস করতে উদ্যত আবরাহা তার হস্তিবাহিনী নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন এই সানা থেকে। তার সেই ফিল রোডটি এখনো রয়েছে। সেই গির্জার স্মৃতিও খুঁজে পাওয়া যায় এখানে। যেটি নির্মাণ করে পবিত্র কাবার পরিবর্তে এই গির্জাকে তীর্থ কেন্দ্র বানাতে চেয়েছিল আবরাহা।


আবরাহার কাহিনী আগে কম-বেশি সবারই জানা ছিল আমাদের। এখানে এসে তা নতুন করে শোনা। আবরাহা ছিলেন ষষ্ঠ শতকের প্রথম ভাগে তদানীন্তন হাবশার (ইথিওপিয়া) সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা। একজন গোলাম থেকে নিজ যোগ্যতাবলে তিনি হাবশি সেনাবাহিনীতে নিজের জন্য স্থান করে নিতে সক্ষম হন। ইয়েমেনের ইহুদি শাসক যুনুওয়াস খ্রিষ্টানদের ওপর জুলুম-অত্যাচার শুরু করলে হাবশার খ্রিষ্ট শাসক রোমানদের সহযোগিতায় ইয়েমেন আক্রমণ করে ৫২৫ সালে হাবশার শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। যে দুজন সেনাধ্যক্ষের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালিত হয়, তার একজন ছিলেন আবরাহা। অন্য সেনাধ্যক্ষ আররিয়াতের সাথে আবরাহার বিরোধ হলে সৃষ্ট সঙ্ঘাতে আররিয়াতের মৃত্যু হয়। এতে প্রভাব বিস্তৃত হয় আবরাহার। হাবশি সম্রাটের মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীরা আবরাহাকে ইয়েমেনের গভর্নর হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আবরাহার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর ইয়েমেন উপকূলের বাণিজ্যের ওপর আরব আধিপত্য খর্ব হয়। এভাবে ইয়েমেনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক একাধিপত্য অর্জনের পর আবরাহা নিজেকে স্বাধীন শাসক হিসেবে ভাবতে থাকেন। ৫৪৩ সালে ইয়েমেনে এক বিশাল উৎসবের আয়োজন করে আবরাহা। সেখানে রোমের কায়জার, ইরানের বাদশাহ, হিরার বাদশাহ এবং গাসসানের বাদশাহ প্রতিনিধি পাঠিয়ে অংশ নেন। এরপর তার মাথায় চেপে বসে আরবের ধর্মীয় কর্তৃত্ব গ্রহণের। এ উদ্দেশ্যে আবরাহা সানায় এক বিশাল গির্জা নির্মাণ করে। আল কালিস নামের এ গির্জা তৈরি করার পর আবরাহা হাবশার বাদশাকে জানায়, ‘আমি আরবদের হজকে মক্কার পরিবর্তে সানার এ গির্জার দিকে ফিরিয়ে না এনে ক্ষান্ত হব না।’ এ ঘোষণা আবরাহা চারদিকে ছড়িয়ে দেয়। ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ এক কুরাইশ গির্জায় প্রবেশ করে মলমূত্র ত্যাগ করে। এটাকে মক্কা আক্রমণের বাহানা করে নেয় আবরাহা। ৫৭০ সালে ৬০ হাজার পদাতিক, ১৩টি হাতি নিয়ে মক্কা আক্রমণের জন্য সানা থেকে রওনা দেয় আবরাহা। পথে ইয়েমেনি সরকারের ছোটখাটো বাধা পার হয়ে মক্কার কাছাকাছি পৌঁছে যায় আবরাহার বাহিনী।


মক্কা থেকে তিন ক্রোশ দূরে আবরাহা তার অগ্রবাহিনীকে সামনে যেতে নির্দেশ দেয়। তারা কুরাইশদের উট, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি পশু লুট করে নিয়ে যায়। এর মধ্যে রাসূল সা:-এর দাদা আবদুল মোত্তালিবের ২০০ উটও ছিল। আবরাহা মক্কাবাসীর কাছে একজন দূত পাঠায় এবং বলে যে, তাকে কাবা শরীফকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে দিলে মক্কাবাসীর ধন সম্পদের কোনো ক্ষতি করবে না। একই সাথে মক্কার সরদারকে তার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য খবর দেয়। দূত মক্কার প্রবীণ সরদার আবদুল মোত্তালিবের কাছে আবরাহার বার্তা পৌঁছে দেয়। তিনি দূতের সাথে আবরাহার কাছে যেতে সম্মত হন। আবরাহা আবদুল মোত্তালিবের সুশ্রী, আকর্ষণীয় ও প্রতাপশালী ব্যক্তিত্বে প্রভাবিত হয়ে সিংহাসন থেকে নেমে যান। আবরাহা জিজ্ঞেস করেন, আপনি কী চান? জবাবে তিনি আবরাহার বাহিনীর লুট করা ২০০ উট ফেরত চান। বিস্মিত হয়ে আবরাহা জানতে চায়, আপনি উট ফেরত চাইলেন কিন্তু যে ঘরটা আপনার ও পূর্বপুরুষদের ধর্মীয় কেন্দ্র সে সম্পর্কে কিছুই বলছেন না। আবদুল মোত্তালিব জানান, আমি ২০০ উটের মালিক সেটিই আমি চাচ্ছি। এ ঘরের মালিক যে আল্লাহ তিনিই এর হেফাজত করবেন। আবদুল মোত্তালিবকে তার উট ফেরত দেন আবরাহা।
আবদুল মোত্তালিব নিজ গোত্রের কাছে ফিরে এসে গণহত্যার হাত থেকে রক্ষা পেতে পরিবার-পরিজন নিয়ে পাহাড়ে চলে যেতে বলেন সবাইকে। আর পবিত্র কাবায় গিয়ে আবদুল মোত্তালিব প্রার্থনা করেন ‘হে আল্লাহ, বান্দা নিজের ঘর রক্ষা করে তুমিও তোমার ঘর রক্ষা করো। কাল তাদের ক্রুশ ও তাদের কৌশল যেন তোমার কৌশলের ওপর বিজয় লাভ না করে। যদি তুমি ছেড়ে দিতে চাও তাদেরকে ও আমাদের কিবলাহকে, তাহলে তাই করো যা তুমি চাও।’ তিনি দোয়া করেন, ‘হে আমার রব তাদের মোকাবেলায় তুমি ছাড়া কারো প্রতি আমার আশা নেই। হে আমার রব, তাদের হাত থেকে তোমার হারমের হেফাজত কর। এ ঘরের শত্রু তোমার শত্রু, তোমার জনপদ ধ্বংস করা থেকে তাদের বিরত রাখো।’


এ দোয়ার পর আবদুল মোত্তালিব ও তার সঙ্গীরা পাহাড়ে আশ্রয় নেন। আবরাহার বাহিনী এগিয়ে যায় মক্কা আক্রমণের জন্য। আবরাহার সর্বাধিক পছন্দের হাতি ‘মাহমুদ’ ছিল সবার আগে। বসে পড়ে মাহমুদ। কুড়ালের আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করেও কাবার দিকে উঠানো যায়নি তাকে। অন্য তিন দিকে মুখ করে উঠাতে চেষ্টা করলেই ছুটে চলে যায় হাতিটি। এমন সময় ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা ঠোঁটে ও পাঞ্জায় পাথরকণা নিয়ে উড়ে এসে সেনাদলের ওপর টপাটপ ফেলতে থাকে। আবাবিল পাখির ছুড়ে ফেলা এ পাথর যার দেহে পড়ত তার শরীর সাথে সাথে গলে যেত। একই অবস্থার সম্মুখীন হয় আবরাহাও। পাখির পাথরকণার আঘাতে তার শরীর টুকরো টুকরো হয়ে ঝরে পড়ে। এভাবেই রাস্তায় অসহায়ভাবে এক উদ্যত বিদ্রোহীর জীবনাবসান ঘটে। আবরাহার এ ঘটনার বছরই আবির্ভাব ঘটে মহানবী সা:-এর। তার আবির্ভাবে বিশ্ব ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা হয়। এ পরিবর্তনের ঢেউ লাগে ইয়েমেনেও। আরব উপদ্বীপে আবরাহার বিপর্যয়কর কাহিনী ছিল সবার জানা। এ ঘটনার পর আরবদের মধ্যে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে সন্দেহমুক্ত ধারণা ছড়িয়ে পড়ে। পবিত্র কাবা শরীফে অসংখ্য মূর্তি স্থাপন করে তাদের আরাধনা করলেও উদ্যত আবরাহার বিপদের সময় কুরাইশরা এক আল্লাহর কাছেই তার ঘর রক্ষার জন্য প্রার্থনা করেন।


শ্যামের শহর


হজরত নূহ আ:-এর পুত্র শ্যাম প্রতিষ্ঠা করেন ইয়েমেনের রাজধানী সানা নগরী। হজরত নূহ আ: যেসব গোত্রের প্রতি দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছিলেন, তার প্রধান কয়েকটি গোত্রের অবস্থান ছিল ইয়েমেনে। শত শত বছর ধরে সত্যের দাওয়াত দেয়ার পরও তা গ্রহণ থেকে নিবৃত থাকার কারণে তিনি আল্লাহর কাছে তার আহ্বান প্রত্যাখ্যানকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রার্থনা করেন। এর পরবর্তী নূহের মহাপ্লাবনের কথা সবারই জানা। শ্যামের প্রতিষ্ঠিত সানা নগরীর স্মৃতিচিহ্ন এখন তেমন একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে দীর্ঘ সময়ের জন্য ইয়েমেন ভ্রমণকারীদের অনুসন্ধানে হয়তো অনেক স্মৃতি পাওয়া যেতে পারে।
ইয়েমেনের বর্তমান ভূখণ্ড একসময় হজরত দাউদ ও হজরত সোলায়মানের রাজত্বের অংশ ছিল। রানী সাবার রাজত্বও ছিল ইয়েমেনে। হজরত দাউদ ও সোলায়মান আ: ছিলেন স্রষ্টার অনুগত নবী ও শাসক। এ দুজনের কর্তৃত্বের বিস্তৃতিও ছিল ব্যাপক। পবিত্র কুরআনের বহু স্থানে দুই শাসক নবীর নানা কাহিনী বিবৃত রয়েছে। অন্যদিকে আল্লাহর আহ্বান ও সত্যের প্রতি বিদ্রোহে সাবার শাসকদের পরিণতির কথাও উল্লেখ রয়েছে কুরআনে। সূরা সাবা নামে একটি সূরাই রয়েছে এ মহাগ্রন্থে। এতে আল্লাহর প্রতি দুই অনুগত শাসক নবী ও সত্যের প্রতি বিদ্রোহী সাবার শাসকদের কথা বলা হয়েছে।


সানার সহস্র বছরের ঐতিহ্যের নিদর্শনের অধিকাংশরই পুরনো শহরে। এসব নিদর্শন দেখার জন্য আমরা যখন রওনা দিই, তখন দুপুর গড়িয়ে যায়। হোটেল মোভেন পিক থেকে মাইক্রোবাসে করে চলতে থাকি বাবে ইয়েমেনের পথে। ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষের অধিবাস সানায়। এর বড় অংশ বাস করে পুরনো সানা এলাকায়। সংযুক্ত ইয়েমেনের রাজধানী সানা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ৩৫০ মিটার উপরে। এখানে পৃথিবীর বৃহত্তম মিউজিয়ামের অবস্থান। ইউনেস্কো পুরনো ইয়েমেনে হাজার বছরের পুরনো কারুকার্যময় ভবন রাস্তাঘাটকে ঘোষণা করেছে ‘কালচারাল ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’। ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে ইউনেস্কো এ ঘোষণা দেয়। পুরনো শহরের বিরাট এলাকাজুড়ে তৈরি এসব অপূর্ব কারুকার্যময় ভবন দেখলে বোঝার উপায় নেই ৫-৬ শত বছর আগে এসব ভবন তৈরি করা হয়েছে হাজার বছরের পুরনো দেশজ নির্মাণরীতিতে। তুর্কি খেলাফতের অধীনে ইমামদের শাসনকালে অপূর্ব সব স্থাপত্য নির্মিত হয়। এ সময়ে এক পাথুরে পাহাড়ের পাদদেশে তৈরি ‘জেবেল নুকুম’র ভবন আর মসজিদের মিনারগুলো দূর থেকে দেখলে এক অপূর্ব সভ্যতার কথা মনে পড়ে যায়। অভ্যন্তরীণ নানা সঙ্ঘাত, সংঘর্ষ ও বৈদেশিক শক্তির আক্রমণ থেকে নিরাপদ রাখার জন্য পাহাড়ের চার পাশের নিরাপত্তা বলয়ের ভেতরে গড়ে তোলা হয় সুরম্য বাড়িঘর ও প্রাসাদ। এসব প্রাসাদে অপূর্ব প্রযুক্তিতে তৈরি করা হয় হাম্মামখানা। ইমাম ইয়াহিয়ার প্রাসাদ ও পাহাড় বেষ্টিত দুর্গের অবশিষ্টাংশ পুরনো সানাকে এখনো পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত করে রেখেছে। ত্রয়োদশ শতকে ইয়েমেন শাসনকারী এই ইমামের মূল প্রাসাদটি প্রায় ৪০ তলা ভবনের উচ্চতার এক পাহাড়ের শিখরে তৈরি করা। পাহাড়ের পুরো শিখরজুড়ে রয়েছে প্রাসাদটি। এর প্রতিটা কক্ষ, হাম্মামখানা স্থাপত্য নির্মাণের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাতাসের গতিবেগ নিয়ন্ত্রণ করে প্রাসাদে তৈরি করা হয়েছে প্রাকৃতিক হিমাগার। এতে শাকসবজি ও অন্যান্য সামগ্রী দীর্ঘ সময়ের জন্য সতেজ রাখার ব্যবস্থা ছিল। ইমামের প্রাসাদের অদূরে রয়েছে আরো অনেক সুউচ্চ পাহাড়ে তৈরি করা সরকারি ভবন। পুরো এলাকাটিকে তৈরি করা হয় প্রাকৃতিক পাহাড়ি দুর্গে। ইমামের প্রাসাদের নিচে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে এর নির্মাণশৈলী পরখ করার চেষ্টা করেছি আমরা। বহুবার ইয়েমেনে আসা মুজিব ভাইয়ের কাছে ইমামদের কিছু কিছু কাহিনী শুনেছি। তবে দেখে তৃপ্ত হতে পারিনি সময়ের সীমাবদ্ধতার কারণে। এই প্রাসাদের নিচেই ইয়েমেনের বিভিন্ন ফলমূলের পসরা সাজিয়ে বসেছেন স্থানীয় কয়েক ইয়েমেনি। আমরা স্থানীয় জাতের সুমিষ্ট আপেলসহ বিভিন্ন ফলের স্বাদ নিই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। অপূর্ব এ স্বাদের আপেল অন্য কোথাও পাইনি আমরা। তবে ফলের দাম কিছুটা বেশিই মনে হয়েছে।


প্রচলিত ইয়েমেনি কাহিনী অনুযায়ী হজরত নূহের পুত্র শ্যাম উত্তরের আরব অঞ্চল থেকে আসেন ইয়েমেনে। তার সাথে ছিল একটি বিশেষ পাখি। সেই পাখির ইঙ্গিতেই শ্যাম ইয়েমেনে বসতি করার সিদ্ধান্ত নেন। এ কারণে এ শহরকে বলা হয় শ্যাম-এর শহর। শ্যাম ঠিক কোন স্থানে জনপদ গড়ে তুলেছিলেন, তা নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা মুশকিল। তবে সানার প্রাথমিক জনবসতির স্থান হিসেবে একটি এলাকাকে চিহ্নিত করা হয়। এখানকার জরাজীর্ণ বাড়িতে প্রাচীন আমলের নিদর্শন যেমন দেখা যায়, তেমনি হাজার বছর আগে তৈরি করা বিভিন্ন ইমারতও প্রত্যক্ষ করা যায়।


পুরনো সানার প্রাণকেন্দ্রে মদিনা নামের একটি এলাকা আছে যেখানকার ব্যাপক এলাকায় কোনো আধুনিক বা পশ্চিমা ধাঁচের ভবন নেই। এখানকার প্রতিটি ভবন সুউচ্চ এবং ইয়েমেনি মুসলিমস্থাপত্য রীতিতে তৈরি করা। এসব ভবনের প্রায় প্রতিটাতেই ইয়েমেনিরা বসবাস করেন। পুরনো সানার এ ধরনের বাড়ির সংখ্যা ১৪ হাজার। পুরনো সানার সারি সারি ভবনের সামনে রয়েছে সুপরিসর সড়ক। দুই পাশের সড়কের মাঝখানে একটি খাল। বর্ষায় খালটি কানায় কানায় ভরে যায়। আমরা খালটির তলদেশে চমৎকার একটি রাস্তা পেয়েছি। এ ক্যানেল রাস্তা দিয়ে সানার অনেক পথ আমরা ঘুরেছি।


বাবে আল ইয়েমেন হলো পুরনো সানার সবচেয়ে বড় ও ঐতিহ্যগত বাণিজ্য কেন্দ্র। বাবে আল ইয়েমেনের অর্থ হলো ইয়েমেনের প্রবেশপথ। এর ভেতরে শত শত বাড়িঘর ও দোকানপাট রয়েছে। আবরাহার ফিল রোডের অবস্থান এর কাছাকাছি। বাব আল ইয়েমেনে ঐতিহ্যবাহী মসলা, ইয়েমেনি ছুরি (প্রত্যেক ইয়েমেনি তাদের কোমরে ঝুলিয়ে রাখে এ ছুরি), ফলমূল, কাপড়-চোপড়সহ বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রীর দোকানপাট রয়েছে।


ইয়েমেনের রাজনীতি


ইয়েমেনের রাজনীতির নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এখানকার আইন পরিষদ দ্বি-কক্ষের। প্রেসিডেন্ট ইয়েমেনের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হলেও সরকারপ্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী। ২০০১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সংবিধান সংশোধন করে দুই কক্ষের আইনসভা করা হয়েছে এখানে। শূরা কাউন্সিলের ১১১ জন সদস্যকে মনোনীত করেন প্রেসিডেন্ট। প্রতিনিধি সভার ৩০১ জন সদস্য সাধারণ মানুষের ভোটে নির্বাচিত হন। ১২টি রাজনৈতিক দল এখানে সক্রিয় থাকলেও এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রেসিডেন্টের জেনারেল পিপলস কংগ্রেস, শেখ আবদুল্লাহ বিন হোসাইন আল আহমারের নেতৃত্বাধীন ইসলামিক রিফর্ম গ্রুপ বা ইসলাহ, আবদুল মালিক আল মাকলাদির ইউনিয়নিস্ট পার্টি, ড. কাসিম সালামের ন্যাশনাল আরব সোস্যালিস্ট বাথ পার্টি ও আলী সালেহ মাকাবিলের ইয়েমেনি সোস্যালিস্ট পার্টি অন্যতম। গতবারের নির্বাচনে এসব দল বিভিন্ন স্থানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। ১৯৯০ সালের মে মাসে দুই ইয়েমেন একত্র হয়ে ইয়েমেন প্রজাতন্ত্র হওয়ার পর শাসন ক্ষমতায় উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেনিদের মধ্যে একধরনের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন উত্তর ইয়েমেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ। আর ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন দক্ষিণ ইয়েমেনের কর্মকর্তারা। মেজর জেনারেল আব্দ্ আল রব মানসুর আল হাদি ও আব্দ্ আল কাদির আল জামাল যথাক্রমে এ দুটি পদে দায়িত্ব পালন করছেন। গত ২৩ সেপ্টেম্বর ইয়েমেনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে আরো সাত বছর মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট হন আলী আবদুল্লাহ সালেহ। আগেরবার তিনি ৯৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। এবারো ভোটের হার কিছুটা কমেছে। এটাকে কেউ কেউ আরব স্টাইলের ভোট বলে উল্লেখ করে থাকেন।


১৯৯০ সালের ২২ মে দুই অংশ একীভূত হওয়ার পর ইয়েমেন নতুন পথ চলা শুরু করে। উত্তর-দক্ষিণের বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার সাথে সাথে প্রতিবেশী সৌদি আরব ও ওমানের সাথে সীমানা বিরোধও মিটিয়ে ফেলেছেন দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ।


সম্মৃদ্ধির একাল-সেকাল


৩ হাজার বছরের পুরনো সভ্যতার জাগ্রত নিদর্শনের দেশ ইয়েমেন। লোহিত সাগর, এডেন উপসাগর ও আরব সাগরের কোলঘেঁষে গড়ে ওঠা প্রাচীন এই জনপদ সমৃদ্ধির সড়ক থেকে বিচ্যুত হয়ে এক পর্যায়ে আরবের সবচেয়ে দরিদ্র দেশে পরিণত হয়। উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেনে বিভক্ত হয়ে দুই দেশের সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ দেশটির এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে বারবার ব্যাহত করেছে। ২ কোটি ১৪ লাখ ৫৬ হাজার মানুষের দেশ ইয়ামেন নানা প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। স্বর্ণ, তেল, গ্যাস, কফি ও নানা খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ হলেও ইয়েমেনের মাথাপিছু জাতীয় আয় ৬০০ মার্কিন ডলারের মতো। তবে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সম্পদের বিস্তর ব্যবধান থাকায় ৪৫ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। বেকারত্বের হারও ৩৫ শতাংশের মতো। ১১.৮ শতাংশ উচ্চহারের মূল্যস্ফীতি থাকলেও অর্থনীতির বিকাশের হার মাত্র ২.৪ শতাংশ। এ হার গত দুই বছর থেকে কিছুটা বেড়ে ৫ শতাংশ অতিক্রম করেছে প্রধানত তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে। দেশটির দেশজ উৎপাদনের সাড়ে ১৩ শতাংশ আসে কৃষি থেকে। খাদ্যশস্য, ফলমূল, শাকসবজি, ডাল, কাঠ, কফি, তুলা, পশুসম্পদ, মাছ ও হাঁস-মুরগি থেকে এ আয় আসে। এর বাইরে শিল্প খাত থেকে দেশজ উৎপাদনে আয় আসে ৪৭.২ শতাংশ। শিল্পায়নের দিক থেকে একেবারে পিছিয়ে থাকলেও মূলত জ্বালানি তেলের কারণে শিল্প খাত থেকে জাতীয় আয়ের অর্ধেক পাওয়া যায়। এর বাইরে জিডিপি’র ৩৯.৩ শতাংশ আয় আসে সেবা খাত থেকে। সেবা খাতও ইয়েমেনের দ্রুত বিকাশমান খাত।


ইয়েমেনে বাংলাদেশের মতো বিপুল মধ্যবিত্ত শ্রেণী নেই। ধনী-দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধানও বিস্তর। দেশের ১০ শতাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মোট জাতীয় আয়ের যেখানে মাত্র ৩ শতাংশ অংশ রয়েছে, সেখানে ১০ শতাংশ ধনীর জাতীয় আয়ের অংশ ২৫.৯ শতাংশ। সম্পদের অসম বণ্টনের পাশাপাশি, স্বল্প শিক্ষার হার দেশটির বিপুল জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যপীড়িত করে রেখেছে।


ইয়েমেনের আয়ের বড় অংশই এখন তেল থেকে এলেও বর্তমান নেতৃত্ব অর্থনীতিকে বহুমুখীকরণের উদ্যোগ নিয়েছে। দেশটির ১ হাজার ৪৩৪ কোটি ডলারের অর্থনীতির আকার অথবা ৫৬১ কোটি ডলারের বার্ষিক বাজেটের কথা বিবেচনা করলে বৃহৎ অর্থনীতির দেশ মনে হবে না ইয়েমেনকে। তবে এখানে ৪৩৭ বিবিএল তেলের মজুদ রয়েছে, যা দেশটির খুব অল্প এলাকায় অনুসন্ধানের পর পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে আবিষ্কৃত ১৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ দেশটির বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে স্মরণ করে দেয়। এ গ্যাসকে সামনে রেখে এলএনজি প্ল্যান্ট তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ঘাটতিহীন অবিরাম বিদ্যুৎ সরবরাহ শিল্পায়নের জন্য ইতিবাচক সুবিধা তৈরি করেছে এখানে। এর পাশাপাশি সড়ক অবকাঠামোও ক্রমেই মজবুত হচ্ছে। এ ছাড়া রয়েছে হাজার হাজার বছরের বিখ্যাত সমুদ্রবন্দর এডেন ও দুই পাশের দীর্ঘ সামুদ্রিক বেলাভূমি। স্বর্ণখনি ইয়েমেনের সমৃৃদ্ধ ভবিষ্যৎ তৈরি করবে একসময়। তেল রফতানি করে ৬৩৮ কোটি ডলার প্রতি বছর রফতানি আয়ের কারণে চলতি হিসাবে ২০০৫ সালে ১২২ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ায় এ উদ্বৃত্ত আরো বড় হবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশটি মুদ্রামান ক্রমেই কমছে। ১ ডলারের বিপরীতে ইয়েমেনি রিয়ালের দাম এখন ১৯৭।


বাংলাদেশীদের কথা


ইয়েমেনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন পর্যায় শুরুর প্রেক্ষাপটে বিপুল বাংলাদেশী দক্ষ জনশক্তির কর্মসংস্থান হতে পারে সে দেশে। মাথাপিছু আয়ের হিসেবে বাংলাদেশের চেয়ে খুব বেশি অগ্রসর দেশ নয় ইয়েমেন। বাংলাদেশে যেখানে মাথাপিছু জাতীয় আয় ৫২০ ডলার সেখানে ইয়েমেনে ৬০০ ডলার। তবে শিক্ষা ও প্রযুক্তি জ্ঞানের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকায় দক্ষ শ্রমশক্তির চাহিদা ইয়েমেনে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। কয়েক শ দক্ষ বাংলাদেশী এখন বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও পাঁচতারা হোটেলে কর্মরত রয়েছেন। তাদের অধিকাংশই পরিবার নিয়ে বসবাস করেন সানা ও এডেন শহরে।


মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কয়েকটি প্রতিবেশী দেশের মতো বাংলাদেশীদের এখানে তাচ্ছিল্যের সাথে দেখেন না স্থানীয় নাগরিকরা। সম্মানের সাথে কথা বলেন, মেলামেশা করেন। সানার একটি অটোমোবাইল কোম্পানিতে কর্মরত রয়েছে আলমগীর। তার ভাই দস্তগীর সহযোগী এক কোম্পানিতে কাজ করেন। দস্তগীরকে এডেন ছাড়াও অন্য কয়েকটি দেশে যেতে হয় কোম্পানির কাজে। নিজের অভিজ্ঞতার উল্লেখ করেই তিনি জানান, ‘কম্পিউটার শিক্ষা ও মাঝারি মানের দক্ষতা থাকলেই বাংলাদেশের যে কেউ এখানে ভালো করতে পারেন।’ জীবনযাত্রার ব্যয় খুব বেশি না হওয়ায় ২০০-৩০০ ডলার বেতন নিয়ে পরিবার নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকা যায় এখানে।


বড়মাপের দক্ষতা ছাড়াই ইয়েমেনে কর্মরত রয়েছেন অনেক বাংলাদেশী। তাদের অনেকে টেইলারিংয়ের কাজ করেন। আবার অনেকে কর্মরত বিভিন্ন কোম্পানিতে। সানার একটি রেস্টুরেন্টে এ রকম ২৫ থেকে ৩০টি পরিবার একত্র হন বাংলাদেশী মিডিয়া টিমের সাথে সাক্ষাতের জন্য। তাদের সবাই নিজ নিজ অভিজ্ঞতার কথা জানান। ইয়েমেনিদের সজ্জন, স্বভাব ও আতিথেয়তার কথা বলেন সবাই। ইয়েমেনে কর্মরত বাংলাদেশীদের হাত ধরে কেউ কেউ এখানে আসছেন কর্মসংস্থানের জন্য।


বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের জন্য ইয়েমেনি সুফিদের ব্যাপক অবদান থাকলেও দুই দেশের মধ্যে জোরালো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। প্রতিবেশী সৌদি আরব ও ওমানে বাংলাদেশে পূর্ণাঙ্গ দূতাবাস রয়েছে। কিন্তু ইয়েমেনে নেই। ইয়েমেন সরকার বাংলাদেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কে এম মুজিবুল হককে সে দেশের অনারারি কনসাল জেনারেল নিয়োগ করেন।


উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেন একীভূত হওয়ার পর নতুনভাবে যাত্রা শুরু করেছে। এক ধরনের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি চালু হয়েছে এখানে। অন্য দেশের সাথে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার ওপর গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে সানা সরকার। এভাবে বাংলাদেশ-ইয়েমেন সম্পর্ক ধীরে ধীরে জোরদার হতে শুরু করেছে। তবে বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগটা যত জোরালো হওয়া প্রয়োজন, ততটা নেই এখনো।


 

0 comments:

Post a Comment