WHAT'S NEW?
Loading...

মেকং নদীর বাঁকে

 



মিয়া মুহাম্মদ আইয়ুব


মেকং নদীর প্রবাহ আর তার দুই তীরের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মনে হয়েছিল আমি যেন আমাদের পদ্মা বা মেঘনা নদীর তীরেই দাঁড়িয়ে আছি। নদীর ওপারের গ্রামগুলোতে সারি সারি তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে যেন কালের সাক্ষী হয়ে সব কিছু দেখছে। ভাটার টানে ধীরলয়ে ছুটে চলেছে দেশী নৌকা। জেলেরা মাছ ধরছে। মেকংয়ের অপরূপ দৃশ্য এবং শান্ত-সৌম্য নীরবতা আমাকে ক্ষণিকের জন্য হলেও যেন বাংলাদেশের নদ-নদী আর পাখাপাখালির স্বপ্নডানায় মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিল।



বলছিলাম, কম্বোডিয়ার সেই বিখ্যাত মেকং নদীর কথা। জাপানভিত্তিক এশিয়ান প্রোডাক্টিভিটি অর্গানাইজেশনের (এপিও) আমন্ত্রণে ‘কোয়ালিটি অ্যাওয়ার্ড’ বিষয়ে এক কর্মশালায় যোগ দেয়ার সুযোগ পাই। বাংলাদেশের শিল্পনীতিতে কোয়

ালিটি অ্যাওয়ার্ড প্রবর্তনের ব্যবস্থা থাকায় বিষয়টি সম্পর্কে অধিকতর জানার বেশ আগ্রহ ছিল। তাই সুযোগটি হাতছাড়া করিনি। কিন্তু এর চেয়েও বেশি আকর্ষণ ছিল আমার এক বন্ধুকে নমপেনে সারপ্রাইজ দিতে পারব ভেবে।



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে আমার সহপাঠী তরিকুল গনি। ডাক নাম চ্যাথাম। চাইনিজ নাম। ওর ডাক নামেই বন্ধুরা সবাই চেনে। স্বনামধন্য ও প্রথিতযশা রাজনীতিক মশিউর রহমান যাদু মিয়ার ছোট ছেলে। মাস্টার্স পরীক্ষায় মেধা তালিকায় আমরা পাশাপাশি ছিলাম। সেই তারুণ্যের যুগের চেয়ে পরিণত বয়সেই যেন আমরা পরস্পরে বেশি ঘনিষ্ঠতা অনুভব করছি। চ্যাথাম বেশ মেধাবী ও চৌকস। বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে দরাজদিল। বিশাল এক হৃদয়ের মানুষ। বন্ধুদের কাছে টানার একটা জাদু আছে তার। সবাই ওকে ভালোবাসে। ওর আন্তরিকতা উপচে পড়ে। রাজনীতি তার প্রিয় বিষয়। তবে সক্রিয় রাজনীতিতে সে জড়িত নয়। নমপেনে তার বাসায় আলাপকালে জানালো, পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় সে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেয়ার কথা এক সময়ে খুব ভেবেছিল; কিন্তু দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অবক্ষয় দেখে তার উৎসাহে ভাটা পড়ে।



দেশে থাকতে চ্যাথাম যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এনডিআই (ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ইনস্টিটিউট)-এর বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের একজন ঊর্ধ্বতন অফিসার হিসেবে কাজ করত। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে এনডিআই প্রতিনিধিরা পর্যবেক্ষক হিসেবে যে প্রতিবেদন তৈরি করে তাতে তার বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এরপর তাকে পাঠানো হয় কম্বোডিয়ায় একই ধরনের দায়িত্ব দিয়ে। কম্বোডিয়ার নির্বাচনের ওপরও সে মূল্যবান প্রতিবেদন তৈরি করে। একটি কপি আমাকেও দিয়েছিল। আমার নমপেনে পৌঁছার কয়েক মাস আগে সে ঢাকায় এসেছিল। এক আড্ডায় সে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল কম্বোডিয়ায় বেড়াতে যেতে। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানেই সে সুযোগ এসে গেল। আমি পুলকিত হলাম।
আমি নমপেনে যাওয়ার সফরসূচি তাকে জানিয়ে দিলাম ই-মেই

লের মাধ্যমে। সে তো মহা খুশি। কোন হোটেলে উঠব তাও জানালাম। মোটামুটি একটা ভালো হোটেলেই উঠেছিলাম। নামটা আজ আর মনে নেই। তবে হোটেলে যেটি সবচেয়ে ভালো লেগেছে সেটি হলো সেখানকার প্রধান শেফ আমির হোসেনের কথা যিনি একজন বাংলাদেশী। তিনি জানালেন, কম্বোডিয়ায় আছেন প্রায় ত্রিশ বছর ধরে এবং সেখানে রীতিমতো বিয়েশাদী করে স্থায়ী নাগরিক হয়ে গেছেন। আমি বিদেশে বিশেষ করে অমুসলিম দেশে গেলে খাবারে সাধারণত গোশত এড়িয়ে চলি। প্রধান শেফ আমির বললেন, নির্দ্বিধায় বিফ খেতে পারেন; কারণ এগুলো হালাল। তিনি আরো জানালেন, অস্ট্রেলিয়া থেকে হালাল গোশত তারা আমদানি করে।



আমি নির্ধারিত কর্মশালায় সারা দিন কর্মব্যস্ত থাকি আর বিকেলে চ্যাথামের সাথে ঘুরতে বের হই। সে নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে আমাকে নমপেনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঘুরে দেখাল। নমপেন তেমন বড় নগরী নয়। মাত্র ২৫-৩০ লাখ লোকের বাস। রাজধানীতে রাজার প্রাসাদ, স্বাধীনতা স্কোয়ার ইত্যাদি। স্থাপত্যে বিশেষ কোনো জৌলুশ না থাকলেও তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ছাপ রয়েছে। রাজধানীর ভবন ও বিপণিবিতানগুলো দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, দেশটির অর্থনৈতিক হালহকিকত খুব ভালো নয়; অনেকটা আমাদের মতো। বরং আমরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওদের চেয়ে ভালো আছি। রাস্তাঘাটগুলো সাদামাটা ধরনের। যানবাহনে আমাদের মতো বৈচিত্র্য নেই। জিএমসি বা বিএমডব্লিউ গাড়ি তেমন চোখে পড়বে না। রাস্তায় মোটর বাইকের ছড়াছড়ি। এটাই বেশ জনপ্রিয় বাহন। রাস্তার পাশে আমাদের দেশের মতো ছোট ছোট দোকানপাট। তাতে নেই কোনো ঝলমলে ভাব। যুবকরা আমাদের বেকারদের মতোই জটলা করে আর আড্ডা দেয়। বিকেল বেলা স্বাধীনতা স্কোয়ারে হাজারো মানুষের ঢল নামে। কম্বোডিয়ানরা বেশ শান্তশিষ্ট ও বন্ধুসুলভ। তাদের একটি বৈশিষ্ট্য সত্যি প্রশংসনীয় সেটি হলো তারা বেশি রাত জাগে না।শহরের লোকরাও রাত ৯-১০টার মধ্যে ঘুমিয়ে যায় এবং বেশ সকালে জেগে ওঠে।



কম্বোডিয়ার ইতিহাস জানার ব্যাপারে আমার যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। রাজনীতি বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে তো বটেই; আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে লেখালেখি করার সুবাদে কম্বোডিয়ার প্রিন্স নরদম সিহানুক, লননল, পলপট, খেমাররুজ ইত্যাদি নামগুলোর সাথে কমবেশি পরিচিত ছিলাম। সত্তর ও আশির দশকে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় দ্রুত ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি নিয়ে আমাদের দেশের পত্রপত্রিকায় প্রতিদিন প্রতিবেদন প্রকাশিত হতো। চ্যাথামের সাথে বেড়ানোর সুযোগে তাই কম্বোডিয়ার সমাজ-সংস্কৃতি থেকে শুরু করে রাজনীতি, অর্থনীতি ও ইতিহাস জানার জন্য একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছিলাম।



কম্বোডিয়ার আগের নাম হচ্ছে কম্পুচিয়া। এখন আর কেউ ওই নামে পরিচয় দেয় না। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও লাও প্রজাতন্ত্রের মধ্যখানে এবং থাই উপসাগরের কোল ঘেঁষে কম্বোডিয়ার অবস্থান। প্রধান নদী মেকং। একে স্থানীয় ভাষায় বলে ‘টনলি থম’ অর্থাৎ বিশাল নদী। আর আছে বড় একটি হ্রদ নাম টনলি স্যাপ অর্থাৎ সুস্বাদু পানির হ্রদ। দেশটির কৃষি ও মৎস্যসম্পদ এই দু’টি জলাধারের ওপর প্রধানত নির্ভরশীল।



বর্তমানে কম্বোডিয়ার জনসংখ্যা মাত্র এক কোটি ৪০ লাখ। ১৯৯১ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৭১ লাখের কিছু বেশি। সত্তর ও আশির দশকে যুদ্ধবিগ্রহে লাখ লাখ লোক মারা যায়। অনেকে দেশান্তরিত হয়। দেশটির আয়তন এক লাখ ৮১ হাজার বর্গকিলোমিটার। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব খুবই কম। প্রতি বর্গকিলোমিটারেও মাত্র ১২ জন। প্রায় ৬০ শতাংশ লোক কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। প্রধান খাদ্য ভাত আর মাছ। জলবায়ু অনেকটা বাংলাদেশের মতো। আমাদের মতোই জীব-বৈচিত্র্যে ভরপুর। নানা প্রকারের পশুপাখি ও মৎস্যসম্পদের বাহারি মেলা।



কম্বোডিয়ার জনসংখ্যার ৯৫ শতাংশ ভাগ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মাত্র ৩ শতাংশ মুসলিম ও ২ শতাংশ খ্রিষ্টান। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা খেমার নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর এবং মুসলমানরা চ্যাম গোষ্ঠীর। খেমাররুজরা মুসলমানদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালিয়েছিল। তখন ১৩২টি মসজিদ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল। মুসলমানরা বেশ ধার্মিক। অনেকেই হজব্রত পালন করেন। নমপেন শহরে ছয়-সাতটি মসজিদ রয়েছে। কম্বোডিয়ার সামাজিক জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতিতে বৌদ্ধ ধর্মের বিরাট প্রভাব রয়েছে।



কম্বোডিয়ার সংস্কৃতি বেশ উপভোগ্য। প্রতি বছর তারা মেকং নদীতে জাঁকজমকসহকারে নৌকাবাইচের আয়োজন করে। অনেকটা জাতীয় উৎসবের মতো। নদীটি যখন শান্ত থাকে এবং পানির প্রবাহ কমে যায় সে সময়ে নৌকাবাইচ অনুষ্ঠিত হয়। বৌদ্ধ ধর্মের রীতি অনুযায়ী তারা ঘটা করে নববর্ষ পালন করে। ফুটবল তাদের অন্যতম প্রিয় খেলা। গান ও নৃত্যের প্রচলনও জনপ্রিয়। এপওি’র আয়োজকরা আমাদের একটি সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় নিয়ে গিয়েছিলেন। কম্বোডীয় ন্যাশনাল প্রোডাক্টিভিটি অর্গানাইজেশন এক নৈশভোজে আমাদের আপ্যায়িত করে। এরপর নাচগান। মোটামুটি শালীনতা রয়েছে দেখলাম। এক পর্যায়ে পারফরমাররা নৃত্যে যোগ দিতে আমাদের পীড়াপীড়ি করে। অনেকেই এতে যোগ দিলেও আমি প্রকৃতিগত রক্ষণশীলতার জন্য অগ্রসর হতে পারিনি। একদিন চ্যাথাম আমাকে বলল, মেকং তীরের রেস্টুরেন্টে আপ্যায়ন আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান না দেখলে কম্বোডিয়ার সংস্কৃতি আর নমপেনের জীবনধারা বোঝা যাবে না। পরদিন সন্ধ্যার পর আমাকে সেখানে নিয়ে গেল। নদীর পাড় ঘেঁষে বিশাল হল ও মঞ্চ। কয়েক হাজার লোক একত্রে খেতে ও অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারে। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবাই এসেছে সন্ধ্যা কাটাতে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আরো বেশি জমে। নাটক, গান ও বিচিত্রানুষ্ঠানের যেন বিশাল মেলা। সবাই যেন প্রাণবন্ত। তরুণ-তরুণীদের হৈহুল্লোড় আর শিশুদের চেঁচামেচিতে এক এলাহি কাণ্ড। বেশ ভালোই লাগল। মেকং নদীর তাজা মাছের স্বাদ নিয়ে আমরা সেখানে ডিনার সেরে নিলাম। পরের দিন আমার বন্ধু আমাকে ডিনার খেতে নিয়ে গেল স্থানীয় একটি ছোট্ট রেস্তোরাঁয়। সেখানে দেখি রেস্তোরাঁর মালিক-কর্মচারী সবাই বাংলাদেশী। সেখানে বাংলাদেশী খাবার খেয়ে আমরা পরিতৃপ্ত হই।



কম্বোডীয়রা পারিবারিক জীবনকে ঐতিহ্যগতভাবে গুরুত্ব দেয়। একক পরিবারই বেশি। তবে যৌথ পরিবারও আছে। বংশধারার ঐতিহ্য এখানে তেমন নেই। বর্তমান প্রজন্ম দুই বা তিন পুরুষের আগের খবর জানে না। তবে রাজপরিবার ও এরূপ কিছু ঐতিহ্যবাহী পরিবারের কথা আলাদা। কম্বোডিয়ার বেশির ভাগ মানুষ বাস করে গ্রামে এবং অনেকটা আমাদের গ্রামীণ জীবনের মতো। নারীরা প্রধানত বাড়িতে কাজ করে আর পুরুষরা কঠোর শ্রমঘন কাজ করে। পারিবারিক বিষয় ও বাজেট প্রণয়নে নারীর ভূমিকা মুখ্য। ধর্মীয় বিষয়াদিতে নারী বিশেষ করে কন্যারা প্রাধান্য পায়।



কম্বোডীয়রা দিনে তিন-চারবার খাবার খায়। ভাতের সাথে মাছ, সবজি থাকবেই। এ ছাড়া তারা নিয়মিত নানা ধরনের ফল খেয়ে থাকে। যদিও দেশটির জনস্বাস্থ্যে পুষ্টি পরিস্থিতি তেমন সন্তোষজনক নয়। পোশাক-পরিচ্ছদে কম্বোডীয়রা এক দিকে তাদের ঐতিহ্যবাহী সম্পোদ ও সারঙ ধরে রেখেছে; অপর দিকে পাশ্চাত্য পোশাকও বাড়ছে। নিজস্ব তাঁতের তৈরি সারঙ তাদের ঐতিহ্যের প্রতীক। অভিজাত অনুষ্ঠানাদিতে নারীরা জাঁকালো সম্পোদ ও পুরুষরা সারঙ পরে। গ্রামের মেয়েরা স্কার্ট ও ব্লাউজ বা শার্ট পরে। গ্রামীণ কৃষকরা পরে ঢিলা প্যান্ট-শার্ট। স্কুলের ছেলেমেয়েরা পাশ্চাত্যের পোশাক পরে।



এবার আসি দেশটির করুণ রাজনৈতিক ইতিহাস স্মৃতিচারণে। কম্বোডিয়া ১৮৬৩ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত ৯০ বছর ফ্রান্সের প্রোটেক্টরেট হিসেবে শাসিত হয়। এর মধ্যে আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপান ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত দেশটি দখলে রাখে। রাজা নরদম সিহানুকের নেতৃত্বে দেশটি ১৯৫৩ সালের ৯ নভেম্বর স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর কম্বোডিয়ায় সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৫ সালে নরদম সিহানুক তার পিতার অনুকূলে সিংহাসন ত্যাগ করেন এবং জনগণের ভোটে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৬০ সালে তার পিতা মৃত্যুবরণ করলে সিহানুক আবার রাজার আসনে বসেন এবং প্রিন্স উপাধি গ্রহণ করেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় সিহানুক তার দেশকে নিরপেক্ষ অবস্থানে রাখার নীতি গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৯৭০ সালে তিনি বিদেশ সফরে গেলে জেনারেল লননলের নেতৃত্বে এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এর পেছনে আমেরিকার সমর্থন ছিল। প্রিন্স নরদম সিহানুক উপায়ান্তর না দেখে কম্যুনিস্ট চীনে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং উত্তর ভিয়েতনামের সমর্থক চীনা কম্যুনিস্ট নেতাদের সাথে হাত মেলাতে বাধ্য হন। এ দিকে খেমাররুজ নামক বিদ্রোহীরা উত্তর ভিয়েতনামের কম্যুনিস্টদের সমর্থন নিয়ে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট জেনারেল লননলের সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। প্রিন্স সিহানুক তার সমর্থকদেরও লননলের সরকার উৎখাতে গৃহযুদ্ধে উৎসাহ দেন।



এ দিকে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট দক্ষিণ ভিয়েতনাম বাহিনী ও মার্কিন সৈন্যরা কম্বোডিয়ায় হামলা ও বোমাবর্ষণ করে বেশ কিছু এলাকা দখল করে নেয়। ব্যাপক আক্রমণে প্রায় ২০ লাখ কম্বোডীয় উদ্বাস্তু হিসেবে নমপেনে গিয়ে ওঠে। কিন্তু নমপেন দখলের জন্য খেমাররুজ কম্যুনিস্ট বিদ্রোহীরা সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। তারা মেকং নদীতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং সড়কপথ দখল করে নেয়। মার্কিন বিমান তাদের ওপর বোমাবর্ষণ করলেও খেমারদের রকেট হামলায় তারা সুবিধা করতে পারেনি। পরিস্থিতি ভয়াবহ দেখে জেনারেল লননল পদত্যাগ করে পালিয়ে যান। মার্কিন দূতাবাসের কর্মচারীরা হেলিকপ্টারে করে পালিয়ে যায়। ১৯৭৫ সালে জেনারেল পলপটের নেতৃত্বে খেমাররুজ কম্যুনিস্টরা নমপেন দখল করে এবং ক্ষমতা গ্রহণ করে। চীন তাদের সমর্থন দেয়। খেমাররুজরা দেশের নাম পাল্টে রাখে কম্পুচিয়া।



ক্ষমতা দখল করে খেমাররুজ কম্যুনিস্টরা নমপেনে ব্যাপক নৈরাজ্য চালায়। তারা নমপেনের সব মানুষকে নগরী ছেড়ে গ্রামে যেতে এবং গ্রামে গিয়ে কৃষিকাজে নিয়োজিত হতে বাধ্য করে। নমপেনের বাইরেও সর্বত্র ব্যাপক পাশবিক নৃশংসতা ও নির্মমতা চলে। গ্রামে গ্রামে একাদশ শতাব্দীর আদলে কৃষিকাজ চালু করা হয়। পাশ্চাত্যের আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি বাতিল করা হয়। তারা ধর্মীয় উপাসনালয়, পাঠাগার ধ্বংস করে দেয়। পাশ্চাত্যের মডেলে যা কিছু ছিল সব স্থাপনা নির্মূল করা হয়। তাদের নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞে ৪০ লাখ জনসংখ্যার ১০ লাখই নিহত হয়। অনেকে অপুষ্টি, খাদ্যাভাব ও অমানুষিক পরিশ্রমে মারা যায়। সে সময় লাখ লাখ লোক সীমান্ত অতিক্রম করে থাইল্যান্ড ও অন্যান্য দেশে আশ্রয় নেয়। কারো কারো মতে, খেমাররুজ কম্যুনিস্টদের হাতে অন্তত ২০ থেকে ৩০ লাখ লোক নিহত হয়। ইদানীংকালেও বহু গণকবর আবিষ্কৃত হচ্ছে। তাদের নির্মমতার সবচেয়ে বেশি শিকার হয় সংখ্যালঘুরা বিশেষত চীনা বংশোদ্ভূত সংখ্যালঘু ও চ্যাম মুসলমানরা। মুসলমানদের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ১৯৬৫ সালে যেখানে দেশটিতে চীনাদের সংখ্যা ছিল চার লাখ ২৫ হাজার; ১৯৭৫ সালে মাত্র ৬১ হাজার ৪০০ বাদবাকি সবই খেমাররুজদের হাতে নিহত হয়।



খেমাররুজদের নৃশংসতা ও গণহত্যা বন্ধের লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে ভিয়েতনাম বাহিনী কম্বোডিয়ায় অভিযান চালায়। আশির দশকজুড়ে দুই পক্ষের লড়াই চলে। অবশেষে ১৯৮৯ সালে প্যারিসে সমঝোতার আলোচনা শুরু হয়। ১৯৯১ সালে জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতিসহ শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৯৩ সালে নতুন সংবিধান প্রবর্তন করা হয়। এর মাধ্যমে দেশটিতে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র, সংসদীয় গণতন্ত্র ও বহুদলীয় ব্যবস্থা চালু করা হয়। প্রিন্স নরদম সিহানুক আবার সিংহাসনে বসেন। এর মধ্যে আবার ১৯৯৭ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অস্থিতিশীলতার চেষ্টা চলে। ২০০৪ সালে সিহানুক হঠাৎ করে সিংহাসন ছেড়ে দেন। এরপর নরদম সিয়ামনি রাজা হিসেবে সিংহাসনে বসেন। চ্যাথাম জানাল যে, প্রিন্স সিহানুকের মতো রাজা নরদম সিয়ামনিও বেশ জনপ্রিয়। বহুদলীয় ব্যবস্থায় কম্বোডিয়ার রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মতোই পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী।



কম্বোডিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় এখানকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধীরগতির। আমাদের চেয়েও কম হারে জিডিপি বাড়ছে। গার্মেন্টস খাত সাম্প্রতিককালে গতি পেলেও বিশ্ব মন্দার প্রভাবে পড়েছে। গার্মেন্টসের পর তাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের উৎস হচ্ছে পর্যটন শিল্প। তবে সরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কায় দেশটিতে কাক্সিক্ষত মাত্রায় বৈদেশিক বিনিয়োগ হচ্ছে না। যদিও প্রচুর বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া গেছে। দেশটি এখনো বিদেশীদের শোষণ চলছে। দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি সে দেশের স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ও বিদেশীদের লোলুপ দৃষ্টি রয়েছে। এখনো টিম্বার সংগ্রহ ও রফতানিতে কয়েকটি দেশ কলকাঠি নাড়ে। আবার খেমাররুজরা এখনো গুপ্তভাবে টিম্বার সংগ্রহে ভাগ বসায়। উপকূলে তেল ও গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর প্রতি পড়েছে পাশ্চাত্যের শকুনদের দৃষ্টি। দেশীয় দালালদের সহায়তায় দেশটির মূল্যবান সম্পদ সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে চলে যায় কি না সে জন্য অনেকে উদ্বিগ্ন।



বন্ধু চ্যাথামের উঞ্চ আতিথেয়তা আর কম্বেডিয়ার করুণ ইতিহাস স্মৃতিতে নিয়ে দেশে ফেরার প্রস্তুতি নেই। ফেরার আগে এক রাত ওর বাসাতেই ছিলাম। চ্যাথাম বিরাট এক বাড়িতে একাই থাকে। ভাবী ও মেয়েরা থাকে কানাডায়। মাঝে মধ্যে সে কানাডায় যায় তাদের সঙ্গ দিতে। সারা রাত অনেক গল্প করে কাটালাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা স্মৃতি ও বন্ধুদের প্রসঙ্গ থেকে শুরু করে দেশের হালহকিকত সবই আলোচনায় এলো। চ্যাথাম কোন ফাঁকে আমার স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য এক গাদা কম্বোডিয়ার ঐতিহ্যবাহী স্যুভেনির পরিধেয় কিনে এনেছে। আমি বিব্রত হলাম। অবশ্য উপহার পেলে কে না খুশি হয়। আমার বন্ধু বিমানবন্দর পর্যন্ত এলো আমাকে বিদায় জানাতে। কিছু দিন হলো চ্যাথাম বদলি হয়ে নাইজেরিয়ায় চলে গেছে। ইতোমধ্যে একবার দেশেও এসেছিল।


 

0 comments:

Post a Comment