নিজ দেশে উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছে ইউক্রেনের অসংখ্য মানুষ। অবর্ণনীয় কষ্টে দিনাতিপাত করছে তারা। এই কষ্টের মধ্যেও প্রিয় স্বদেশভূমি নিয়ে তাদের আশাবাদ নিঃশেষ হয়নি। তারা ভাবে, এক দিন শেষ হবে এই গ্রহণের কাল। বিদেশী সাময়িকী অবলম্বনে ইউক্রেনের তিনটি উদ্বাস্তু পরিবারের কাহিনী জানাচ্ছেন হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
ইউক্রেন সঙ্কটের কথা, গণমাধ্যমের কল্যাণে সবার জানা। তবুও মূল কাহিনীতে প্রবেশের আগে গৌরচন্দ্রিকা হিসেবে দু-চারটি কথা বলা প্রয়োজন। যে সঙ্কট ইউক্রেন নামের দেশটিকে দুই ভাগে ভাগ করে দিয়েছে, জনগণের একাংশকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আরেক অংশের মুখোমুখি, সেই সঙ্কটের সূচনা বছরাধিক কাল আগে; তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের হাতে। সে সময় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে ইউক্রেনের সম্পর্ক
আরো ঘনিষ্ঠ করার একটি পরিকল্পনা একতরফাভাবে নাকচ করে দেন প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ। এর প্রতিবাদে রাজধানী কিয়েভের রাজপথে নেমে আসে হাজার হাজার মানুষ। ইউরোময়দান নামে পরিচিত নগরকেন্দ্রে সূচিত শান্তিপূর্ণ গণ-অভ্যুত্থানটি দ্রুতই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে এবং ইউক্রেনপন্থী ও রুশপন্থী এ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে শুরু হয় সহিংস সংঘর্ষ। এতে এ পর্যন্ত তিন হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত এবং ১০ লাখেরও বেশি সাধারণ ইউক্রেনীয় বাস্তুচ্যুত হয়েছে। দেশটির বিপুলসংখ্যক মানুষ এখন নিজ দেশে পরবাসী।
এই ভাগ্যাহত মানুষের অবস্থা দেখতে বিশ্ববিখ্যাত রিডার্স ডাইজেস্ট সাময়িকীর প্রতিবেদক এলিয়ানর রোজ গিয়েছিলেন ইউক্রেনে। তিনি দেখেছেন মানুষের দুঃখ-দুর্দশা এবং তারই পাশাপাশি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের দীপ্ত আশাবাদ। তিনটি পরিবারকে প্রতীকী হিসেবে উপস্থাপন করে সেসব তুলে ধরেছেন তিনি।
হাটসম্যান পরিবার
এই পরিবারটির বাস পূর্ব ইউক্রেনের স্লোভিয়ানস্ক শহরে; রাশিয়ার সীমান্তসংলগ্ন এলাকায়। পরিবারের কর্তা ইয়েভগেন হাটসম্যান (৪১) ও তার স্ত্রী সভেতলানা (৪০) দু’জনই স্কুলশিক্ষক। তাদের আছে দুই ছেলে। দু’জনই স্কুলে পড়াশোনা করে।
যখন ইউক্রেনের কেন্দ্রীয় সরকার টালমাটাল হয়ে পড়ল এবং ক্রিমিয়াকে অঙ্গীভূত করে নিলো রাশিয়া, তখনই স্লোভিয়ানস্ক শহরের পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠল। এক লাখ ১৭ হাজার জনসংখ্যা অধ্যুষিত শহরটিতে বেড়ে গেল রাজনৈতিক উত্তেজনা।
১২ এপ্রিল কালাশনিকভ রাইফেল নিয়ে একদল মুখোশধারী রুশপন্থী হামলা চালায় শহরের পুলিশ সদর দফতরে এবং সেটি দখল করে নেয়। ইউক্রেনের অখণ্ডতার পক্ষে সভা-মিছিল করা হয়ে পড়ে বিপজ্জনক। হাটসম্যান দম্পতি যে স্কুলে কাজ করতেন, সেখানকার পরিস্থিতিও বদলে যায়। প্রপাগান্ডা, বিদ্বেষ ও সহিংসতা শুধু শহরের বড়দেরই নয়, ছোটদেরও বিভক্ত করে ফেলে। ইয়েভগেন নিজেই এক দিন শুনতে পান এক ছাত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আরেক দলকে বলছে ‘পুতিনপন্থী মিডিয়ার শিকার’। তিনি উপলব্ধি করেন, শিশুরাও এখন বুঝতে পারছে যে, দেশে একটি তথ্যযুদ্ধ চলছে।
তবে বিষয়টা এখানেই থেমে থাকে না। তরুণদের মধ্যে ব্যাপকভাবে দুর্নীতি ছড়িয়ে দেয়া হয়। শিক্ষক দম্পতির ১৫ বছর বয়সী সন্তান ইয়েভগেনি এক দিন জানায়, তার সহপাঠীরা বিচ্ছিন্নতাবাদের পক্ষে মানব ব্যারিকেড দেয়ার জন্য ঘুষ পেয়েছে। সে বলে, আমার ক্লাসমেটরা বলেছে তারা প্রতিদিনের জন্য পাঁচ শ’ ইউক্রেনীয় মুদ্রা (প্রায় ৩০ মার্কিন ডলার) পেয়েছে। অস্ত্র হাতে নিলে আরো বেশি পাবে।
এভাবে স্লোভিয়ানস্ক শহরের শিশুরা প্রতিদিন যুদ্ধের নানা ‘সরঞ্জামের’ সাথে পরিচিত হয়ে উঠতে থাকে। ইয়েভগেনি বলে, ‘আমার ক্লাসটিচারের বাড়ির সাথে লাগিয়েই একটি ব্যারিকেড। সবখানে ব্যারিকেড। সবাই এ কাজে জড়িত।’
একপর্যায়ে স্লোভিয়ানস্ক শহরে ‘স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষে’ গণভোট নেয় রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। ‘ভুয়া গণভোট’ নামে ব্যাপকভাবে নিন্দিত তথাকথিত ওই গণভোটের ফলাফলে স্লোভিয়ানস্ক শহরকে ‘স্বাধীন রুশপন্থী রাষ্ট্রের অংশ’ বলে ঘোষণা করা হয়। এ অবস্থায় শিক্ষকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এই ভেবে যে, ছাত্ররা বুঝি আর স্কুলের লেখাপড়া শেষ করতে পারবে না।
তবে স্কুল খোলা থাকে, কিন্তু শিক্ষার্থীদের দেখা মেলে না। ইয়েভগেনির ছোটভাই দিমিত্রির (৯) ক্লাসে দেখা যায় কেবল দিমিত্রিই আছে। অন্যরা অনলাইনে তাদের হোমওয়ার্ক নেয়।
এ দিকে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী শহরটি ঘিরে ফেলে। রুশপন্থী বিদ্রোহীদের সাথে শুরু হয় তাদের যুদ্ধ। পড়তে থাকে গোলা। ভীত অভিভাবকরা তাদের ছেলেমেয়েদের এমন সব ছোট ছোট স্কুলে নিয়ে ভর্তি করান, যেখানটায় গোলা পৌঁছায় না। একপর্যায়ে ইয়েভগেন ও সভেতলানা তাদের দুই ছেলেকে শহরের বাইরে এক গ্রামে পাঠিয়ে দেন। সেখানে তারা স্থানীয় লোকজনের আশ্রয়ে থেকে স্কুলবর্ষ শেষ করবে। আর ইয়েভগেন-সভেৎলানা দম্পতি শহরে থেকে যাবে। শহরে নিজেদের অ্যাপার্টমেন্টটা দেখেশুনে রাখতে হবে না!
ইউক্রেনীয় বাহিনী ৫ জুলাই শহরটিকে রুশপন্থীদের দখল থেকে মুক্ত করে। আগস্টে ইয়েভগেন পরিবার নিজেদের বাড়িতে পুনরেকত্রিত হয়। ইয়েভগেন বলেন, সেনাসদস্যদের অনেকে এই শহরের যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়।
ওদিকে গ্রামেও ইয়েভগেনের ছেলেরা ভালোই ছিল। তাদের গ্রামীণ অভিভাবকরা ছিলেন সদাশয় মানুষ। ফলে স্কুলেও ভালো করে তারা। গত জুনে বার্ষিক পরীক্ষার ফল বেরুলে দেখা যায় ইয়েভগেনি ১২-এর মধ্যে ৯ দশমিক ৩ গ্রেড পেয়েছে। স্কুলটিতে ভর্তি হওয়ার আগে সে অবশ্য নতুন স্কুলের সাথে মানিয়ে নিতে পারবে কি না ভেবে বেশ ভয়ে ভয়ে ছিল। কিন্তু তার এ ভয় সঠিক ছিল না। নতুন স্কুলে সে অনেক বন্ধু পেয়ে যায়। এ কথা ভেবে এখন তার বেশ গর্ব হয়।
সভেতলানার ক্ষেত্রে ব্যাপারটি আরো চমকপ্রদ। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তার পুরো জীবনবোধকেই বদলে দেয়। তিনি বলেন, ‘আমি শিখেছি যে, আমি শুধু ইউক্রেনীয় ভাষা ও সাহিত্যের একজন শিক্ষকমাত্র নই, বরং আমি ইউক্রেন দেশের একজন নাগরিক। এটাই সবচেয়ে বড় কথা।’
ইয়েভগেন বলেন, ‘এখন আমি যে বিষয়টি অনুভব করি তা হলো যে, আমরা শুধু এক জাতি নই, এক পরিবার। যেসব লোক আমাদের বাঁচাতে এসেছিল তারা শুধু সৈনিক নয়, তারা আমাদের ভাই।’
স্তানিসল্যাভ ফেদোরচুক
দীর্ঘ প্রতিক্ষীত ইইউ পার্টনারশিপ চুক্তি স্বাক্ষরে প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচের অস্বীকৃতির প্রতিবাদে রাজধানী কিয়েভের রাজপথ যখন জনতার বিক্ষোভে প্রকম্পিত হচ্ছিল, পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক শহরের কেন্দ্রস্থলে তখন শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হচ্ছিল ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীদের ছোট একটি দল।
কেমন ছিল ওই দলটির বিক্ষোভ? স্তানিসল্যাভ ফেদোরচুক বলেন, ‘ওদের প্রতিবাদটি ছিল খুবই তারুণ্যদীপ্ত। খুবই সুন্দর, খুবই আন্তরিক, খুবই আবেগময়।’
স্তানিসল্যাভের পরিচয়টা এখানে একটুখানি বলে নেয়া যাক। তিনি দোনেৎস্ক শহরেরই মানুষ। রাজনীতিবিজ্ঞানী ও লেখক। বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের অনুষ্ঠানাদি এবং গণসংযোগে তার রয়েছে ব্যাপক অভিজ্ঞতা। পাশাপাশি পিএইচডি করছেন। তবে তিনি শুধু লেখাপড়ার মানুষ নন, যুগপৎ লেখাপড়া ও কাজের মানুষ। তিনি ২০০৪ সালের ‘কমলা বিপ্লবে’ অংশ নেন। যে কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট হন ইয়ানুকোভিচ, তার প্রতিবাদ করেন তিনি। এবং তখন থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার স্তানিসল্যাভ।
এমন মানুষ কি ছাত্রদের প্রতিবাদবিক্ষোভ দেখে চুপ করে বসে থাকতে পারেন? স্তানিসল্যাভ পারেননি। তার স্ত্রী তখন আট মাসের গর্ভবতী। কিন্তু স্তানিসল্যাভ জানেন, আন্দোলন সংঘটনে তার অভিজ্ঞতা ছাত্রদের জন্য হবে অমূল্য। অতএব স্তানিসল্যাভ ছাত্রদের সাথে যোগ দিলেন।
এর পরের কয়েকটি সপ্তাহ দোনেৎস্ক শহরের ইউরোময়দান প্রকম্পিত হলো স্লোগানে-বিক্ষোভে। তারা শুধু ইইউ পার্টনারশিপ চুক্তি চেয়েই ক্ষান্ত হলো না, তাদের দাবি বিস্তৃত হলো রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিতে। বিক্ষোভ নগরকেন্দ্রে সমাবেশে সীমিত থাকল না, ছড়িয়ে পড়ল শহরের রাজপথে; মিছিলে-স্লোগানে।
তবে দোনেৎস্ক শহরটি একসময় শাসন করতেন ইয়ানুকোভিচ। ফলে শহরটি ছিল তার সহযোগীতে ভর্তি। তারা ইউক্রেনপন্থী ও ইউরোপপন্থী বিক্ষোভকারীদের হুমকি দিতে থাকল। কয়েক সপ্তাহের মাথায় দেখা গেল, শহরের বেশির ভাগ তরুণ বৃহত্তর বিক্ষোভে যোগ দিতে রাজধানী কিয়েভে চলে গেছে। শহরে বিক্ষোভকারী বলতে আছে নারী ও শারীরিকভাবে খানিকটা অসমর্থ প্রবীণেরা। নিজেদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তারা নিয়মিত বিক্ষোভ করেই যেতে থাকল। এ পরিস্থিতিতে স্তানিসল্যাভ ভাবলেন, তাদের রক্ষার দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে।
২০১৪ সালের ২২ জানুয়ারি। দুই শ’র মতো ইউরোময়দান বিক্ষোভকারী, যাদের বেশির ভাগ নারী ও বৃদ্ধ, প্রায় ৯০০ বিক্ষোভকারী তাদের ঘিরে ফেলেছে। ওদের কেউ কেউ আবার সিরিঞ্জ দিয়ে তাদের দিকে এসিটোন ও স্পিরিটযুক্ত ডিটারজেন্ট ছুড়ছে। ওসব যার গায়েই লাগছে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে।
এ অবস্থায় স্তানিসল্যাভসিদ্ধান্ত নিলেন বিক্ষোভকারীদের রুশপন্থীদের হাত থেকে বাঁচাতে ছোট ছোট দলে ভাগ করে সরিয়ে নিতে হবে। কাজ শুরু করতেই দেখা গেল, প্রতিটি দলের পেছন পেছন কয়েকজন করে রুশপন্থী আসছে। তাদের হাতে বেসবল খেলার ব্যাট ও অন্যান্য অস্ত্র। তারা প্রস্থানোদ্যত বিক্ষোভকারীদের প্রকাশ্য দিনের বেলায় পেটাতে থাকল আর হুমকি দিতে থাকল, ফের যদি আসিস তো একেবারে জানে মেরে ফেলব।
আন্দোলন চালিয়ে নিতে এবার গঠিত হলো ১১ সদস্যের একটি কমিটি। স্তানিসল্যাভ পেলেন নিরাপত্তাবিধান ও তহবিল সংগ্রহের দায়িত্ব। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ৩৪ জন ইউরোময়দান বিক্ষোভকারীর শৈল্যচিকিৎসার অর্থ জোগান দিলেন। তারা সবাই মুখে ও মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন।
ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে এসে স্তানিসল্যাভ একটি সংবাদ সম্মেলন করলেন। নিরাপত্তার খাতিরে এর আগে তাকে পাঁচবার বাসস্থান বদলাতে হয়েছে। এখানেও সেই একই অবস্থা। মুখোশ ও হাতে বেসবল খেলার ব্যাট নিয়ে বাইরে তার জন্য ‘অপেক্ষা’ করছে ৩০ জনের একটি গ্রুপ। আধঘণ্টা অপেক্ষা করে স্তানিসল্যাভ জানালা দিয়ে ‘পালিয়ে’ গেলেন। এর মধ্যে তিনি পুলিশ ডেকেছিলেন। তবে তারা আসতে সময় নেয় এক ঘণ্টা। এ দিকে স্তানিসল্যাভ চলে গেছেন জানতে পেরে মুখোশধারীরাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেল।
পরে স্তানিসল্যাভ থানায় যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখতে পান, সেই লাঠিধারীরা থানার বাইরে তার জন্য অপেক্ষমাণ। কিছুক্ষণ পর তাদের একজন এগিয়ে এসে দাঁড়াল স্তানিসল্যাভের সামনে। বলল, ‘ব্যক্তিগতভাবে আপনার বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। তবে আপনি ও আপনার পরিবার ঝামেলায় পড়বেন। আপনাকে তিন দিন সময় দেয়া হলো। আপনি এ শহর ছেড়ে চলে যান।’
স্তানিসল্যাভের মানসচক্ষে ভেসে উঠল এক ধূসর বাস্তবতা অন্যের নিরাপত্তা দেয়া তো দূরের কথা, নিজেরই নিরাপত্তা নেই তার। এই কঠিন বাস্তবতার মুখে এক দিন স্ত্রী ও দুই মাস বয়সী শিশুসন্তানকে নিয়ে শহর ছাড়লেন স্তানিসল্যাভ। প্রথমে গেলেন জর্জিয়ার তিবলিসিতে। পরে ফিরে এলেন নিজ দেশে পশ্চিম ইউক্রেনের লভিভ শহরে।
স্তানিসল্যাভের ওপর ব্যাপক চাপ ছিল চুপচাপ থাকার। কিন্তু তিনি জনসমক্ষে কথা বলতে কৃতসঙ্কল্প। তিনি প্রকাশ্য সমাবেশে ইউক্রেনবাসীর প্রতি আবেদন জানালেন যেন তারা রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং গোত্রীয়, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও পরস্পরের প্রতি সহিষ্ণু থাকে। নতুন শহরে এনজিও ও রাজনীতিকদের সাথে অনেক বৈঠক করলেন স্তানিসল্যাভ এবং বাস্তুহারা পরিবারগুলোকে আরো সাহায্য দেয়ার জন্য দেনদরবার করতে থাকলেন।
স্তানিসল্যাভের অক্লান্ত প্রচেষ্টা বিফলে গেল না। তিনি গর্বভরে দেখলেন, একটি উন্নততর ভবিষ্যৎ গড়ার আকাক্সক্ষায় হাজার হাজার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তিনি আশাবাদী, আগামী দিনগুলোতে আরো অগ্রগতি হবে।
স্তানিসল্যাভ বলেন, ‘আমি জানি, একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজ রাতারাতি বদলে যেতে পারে না। তবে আমি বিশ্বাস করি ঐক্য ও বহুমাত্রিকতায়। বিশ্বাস করি, আমাদের মতপার্থক্য আমাদেরকে সমৃদ্ধ করে।’
ইসমাইল ওসমানভ
ইসমাইল ওসমানভের দাদা যখন ক্রিমিয়ায় তাদের নতুন বাড়ির আঙ্গিনায় পা রাখেন তখন তিনি কাঁদছিলেন। কাঁদছিলেন ইসমাইলের দাদী এবং আট বছর বয়সী ইসমাইল নিজেও। তবে এ ছিল সুখের কান্না।
সেই ১৯৪৪ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট একনায়ক স্তালিন নিষ্ঠুরভাবে দেশছাড়া করে ক্রিমিয়ার তাতার মুসলিম জনগোষ্ঠীকে। তারপর বহুকাল কেটে যায়। ভেঙে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। ক্রিমিয়া পরিণত হয় ইউক্রেনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে। বিতাড়িত তাতার মুসলমানেরা ফিরতে থাকে স্বদেশভূমিতে। সেটা ১৯৯০ সালের কথা।
ঘরে ফেরার ২৪ বছর পর ইসমাইল (৩২), তার স্ত্রী এবং আট ও ছয় বছর বয়সী দুই মেয়েকে আবার ক্রিমিয়া ছাড়তে বাধ্য করা হলো। এবার তারা গেছে পশ্চিম ইউক্রেনের ছোট শহর সকাল-এ।
রুশ সৈন্যরা যখন ক্রিমিয়ায় ঢুকে পড়ে তখন ইসমাইল বাস করতেন ক্রিমিয়ার রাজধানী সিমফারপুলে। পাঁচ বছর কষ্ট করে দাঁড় করিয়েছেন একটি ব্যবসা। মিষ্টির দোকান। সুখেই কাটছিল তার দিন। ক্রিমিয়ান তাতারদের প্রতি ইউক্রেনের সহিষ্ণুতার প্রশংসা করেন ইসমাইল। ইউক্রেনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগদানও সমর্থন করেন তিনি। তাই এর পক্ষে দেশব্যাপী যখন বিক্ষোভ শুরু হলো, তখন নাগরিক কর্তব্য মনে করে তাতেও যোগ দেন ইসমাইল।
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্রিমিয়ার রুশপন্থী রাজনীতিকেরা একটি গণভোট অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেন। গণভোটের বিষয় হলো, ক্রিমিয়াবাসী ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাশিয়ার সাথে যোগ দিতে চায় কি না। প্রস্তাবিত গণভোট ঠেকাতে পাঁচ হাজার ক্রিমিয়ান তাতার রাজধানী সিমফারপুলের সুপ্রিম কাউন্সিল (সংসদ) ভবন ঘিরে ফেলে। এই বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ইসমাইলও ছিলেন।
সন্ধ্যার দিকে বিক্ষোভকারীদের বলা হয় ঘরে ফিরে যেতে। ইসমাইল বলেন, এ কথা শুনে বিক্ষোভকারীরা হতচকিত হয়ে পড়ে। তারা কী করবে ভেবে পায় না। কিন্তু ক্রিমিয়ান তাতার পার্টির নেতারা যখন এসে বলেন যে, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’ তখন বিক্ষোভকারীরা আশ্বস্ত হয়ে ঘরে ফিরে যায়।
পরদিন তারা আবার একই স্থানে সমবেত হওয়ার চেষ্টা চালায়। কিন্তু তারা দেখতে পায়, রাজপথ বোঝাই হয়ে আছে সৈনিকে। ওদের উর্দিতে পরিচয়বাহী কোনো ব্যাজ নেই, কিন্তু হাতে রয়েছে অস্ত্র। ইসমাইল ধারণা করেন, তারা রাশিয়ার সৈন্য। তিনি বলেন, এবার আমরা সত্যি সত্যি ভয় পেতে শুরু করি।
কয়েক দিনের মধ্যে রাশিয়ান সৈন্যে ভরে যায় ক্রিমিয়ার রাজধানী সিমফারপুল। ইসমাইল নিজেই রুশ সৈন্যবোঝাই ৭০টি ট্রাক দেখতে পান।
চার দিকে তীব্র অস্থিরতা। ইসমাইল শুনতে পান, মুখোশধারী দুর্বৃত্তের দল তাতারদের বাড়িঘরে ঢুকে লুটপাট চালাচ্ছে এবং বাড়ির লোকজনকে মারধর করছে। এরই মধ্যে মার্চ মাসে এক দিন খবর পাওয়া গেল, তাতারদের আন্দোলনের এক সক্রিয় কর্মীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দুই সপ্তাহ পর তাকে পাওয়া গেল এক ডোবায় মৃত, নগ্নগাত্র ও হ্যান্ডকাফ লাগানো।
একই সময় তাতাররা আরো একটি বিষয় লক্ষ করল। তারা দেখল, কোনো কোনো এলাকায় বেছে বেছে তাতারদের বাড়ির দেয়ালে কে বা কারা ক্রস (ঢ) চিহ্ন এঁকে দিয়েছে। ইসমাইল ও তার প্রতিবেশীদের বুঝতে বাকি থাকল না যে, পরবর্তী হামলার লক্ষ্যবস্তু তারাই।
এরই মধ্যে মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হলো ‘গণভোট’। এতে ক্রিমিয়ার রাশিয়ায় অন্তর্ভুক্তির পক্ষে রায় এলো। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই গণভোটের নিন্দা জানাল, একে ‘অবৈধ’ আখ্যায়িত করল, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নিলো না।
এবার শুরু হলো তাতার মুসলমানদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন। তাদের ধর্মকর্ম পালনে বাধা দেয়াটা সৈন্যদের নিয়মিত কাজ হয়ে দাঁড়াল। মুসলমানদের স্কুলের শিক্ষকদের হেনস্তা করা হতে থাকল। তাতারদের ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন চালাতে থাকল পুলিশ। সব দেখেশুনে ইসমাইল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, নাহ! এ দেশে আর নয়। এবার দেশ ছাড়তে হবে।
পরিবার নিয়ে ইসমাইল চলে এলেন পশ্চিম ইউক্রেনের ছোট শহর সকাল-এ। নিজে যোগ দিলেন ক্রিমিয়ান ওয়েভ নামে একটি সংগঠনে; স্বেচ্ছাসেবক হয়ে। এ সংগঠনের কাজ ছিল বাস্তুহারা ক্রিমিয়ান পরিবারগুলোকে সহায়তা করা।
ইসমাইল তার ব্যবসা-বাণিজ্য সবই হারিয়েছেন। সেজন্য দুঃখ তো তার আছেই। তার চেয়েও বড় দুঃখ, নিজেদের জাতিগত পরিচয় ভুলে যাওয়া। এটি যাতে না হয়, সে জন্য তারা এখন আবার তাদের ভুলে যাওয়া ভাষা চর্চা করছেন। পাশাপাশি ইউক্রেনীয় ভাষাও শিখছেন ইসমাইল। কেননা ধর্ম আলাদা হলেও ইউক্রেনীয়দের সাথে ক্রিমিয়ান তাতারদের রয়েছে ইতিহাস ও ভাষার বন্ধন। ইসমাইল বলেন, এই ধরুন না, ইউক্রেনে যাকে ‘ময়দান’ (মাঠ) বলা হয়, এটি এসেছে ক্রিমিয়ান তাতার ভাষা থেকে।
ইসমাইলের মেয়েরা প্রায়ই জানতে চায়, ‘বাবা, আমরা কি দেশে ফিরতে পারব?’
ইসমাইল বলেন, ‘আমি ওদের বলি, হ্যাঁ। আমি নিজেও এটা বিশ্বাস করি। হয়তো আজ বা আগামীকাল পারব না, হয়তো ভবিষ্যতে। তবে আমি জানি, এটাই আমার নিয়তি।’
0 comments:
Post a Comment