WHAT'S NEW?
Loading...

মানুষের জীবন পইড়া গেছে

আলফাজ আনাম


 


সব ঠাণ্ডা
বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের মন্ত্রীরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন দেশের মানুষ এখন পরম সুখে আছে। গত সপ্তাহে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন বাংলাদেশ একটি সুখী মানুষের দেশ। বয়সের ভারে হোক বা অন্য কোনো কারণে হোক অর্থমন্ত্রী নানা সময়ে নানা কথা বলেন। শেয়ারবাজার বিপর্যয়ের পর জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, তিনিই মনে হয় দেশের সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর অর্থমন্ত্রী প্রথম একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাথে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এই নির্বাচনে তারা জনগণের ম্যান্ডেট পাননি। ফলে তাড়াতাড়ি আরেকটি নির্বাচন করতে হবে। এখন তিনি ১২টি বাজেট দিয়ে সাইফুর রহমানের রেকর্ড ভাঙতে চান বলে একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালকে দেয়া সাক্

ষাৎকারে বলেছেন।


সাংবাদিক তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের পক্ষ থেকে সরকারের মেয়াদ পূর্তির আগে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি আছে। সেটা হলে তো ১২টি বাজেট দেয়া সম্ভব হবে না এ প্রশ্ন করার সাথে সাথে সদা হাস্যোজ্জ্বল মুহিত বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, ‘কিসের নির্বাচন? সব ঠাণ্ডা। আমাদের মেয়াদ পূর্তির আগে কোনো নির্বাচন নয়।’ (বিডি নিউজ ২৪ ডটকম)। অর্থাৎ সরকার যখন সব কিছু ঠাণ্ডা করে ফেলেছে তখন আর ম্যান্ডেট দিয়ে কী হবে? ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচন ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের গণকবর রচিত হয়েছে। ফলে নির্বাচন নিয়ে অতীতের সব কথা এখন ভুলে যাওয়ার সময়।


 


প্রাচুর্যের বিড়ম্বনা
শুধু ভুলে যাওয়া নয় সরকার পরিচালনা নিয়েও মন্ত্রীদের মধ্যে অদ্ভুত এক আত্মতৃপ্তি রয়েছে। এবার বোরো ধান কাটার পর কৃষক ন্যায্য দাম তো পাচ্ছেনই না উৎপাদন খরচ তোলাও কঠিন হয়ে পড়েছে। ধান চাষ করে কৃষকদের মধ্যে এখন হাহাকার বিরাজ করছে। কৃষিমন্ত্রীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রাচুর্যের বিড়ম্বনা নিয়ে আমরা সাময়িক অসুবিধায় আছি। আশা করি দ্রুত এই সমস্যা কেটে যাবে।’ (প্রথম আলো, ২২ মে ২০১৫) সত্যিই কি বাংলাদেশ এখন প্রাচুর্যের মধ্যে আছে? তাহলে আমরা কি শায়েস্তা খাঁর যুগে ফিরে যাচ্ছি? সে সময় টাকায় আট মণ ধান পাওয়া যেত। কিন্তু এখন কৃষক বলছে, ‘এক মণ ধান বেইচা আধা কেজি ওজনের একটা ইলিশও কিনতে পারতেছি না।’ প্রতি কেজি গরুর গোশতের দাম ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা আর খাসির গোশত ৫৫০ টাকা। এক কেজি ইলিশ এক হাজার টাকা। আর এক মণ ধানের দাম ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা। অর্থাৎ এক মণ ধান বিক্রি করে কৃষক এক কেজি খাসির গোশতও কিনতে পারছেন না। আর এক কেজির একটি ইলিশ কিনতে গেলে তাকে দুই মণ ধান বিক্রি করতে হচ্ছে।


শায়েস্তা খাঁর যুগে

শুধু ধান সস্তা ছিল তা নয়, অন্য খাদ্যপণ্যের দামও কম ছিল। তখন কৃষকের ফ্যাকাসে মুখ নয়, তাদের জীবন ছিল আনন্দমুখর। শায়েস্তা খাঁর যুগে এ দেশ থেকে কেউ কাজের সন্ধানে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিদেশ পাড়ি দিয়েছে এমন তথ্য ইতিহাসে পাওয়া যাচ্ছে না। কয়েক মাস ধরে নৌকায় করে মালয়েশিয়া অভিমুখে ছুটছে বাংলাদেশীরা। তাদের অনেকে সমুদ্রে অর্ধাহারে-অনাহারে মারা গেছে আবার অনেকে মানবপাচারকারীদের অত্যাচার নির্যাতনে মারা গেছে। শেষ আশ্রয় হয়েছে মালয়েশিয়া আর থাইল্যান্ডের গণকবরে। এই হলো প্রাচুর্যে ভরা বাংলাদেশের মানুষের নিয়তি।


 


পাগলের দেশ
প্রধানমন্ত্রী অবশ্য এসব মানুষ অভাবের তাড়নায় কাজের সন্ধানে গেছে বলে মনে করেন না। তিনি বলেছেন, সবাই অভাবের তাড়নায় এভাবে দেশ ছাড়ছে, এ কথা সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে তারা সোনার হরিণের পেছনে ছুটছে। তারা মনে করছে, বিদেশে যেতে পারলে তারা অনেক টাকা উপার্জন করবে। তিনি বলেন, টাকার সন্ধানে অবৈধ পন্থায় পর দেশে পাড়ি দেয়া এই মানুষগুলো মানসিকভাবে অসুস্থ। এভাবে তারা মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছে বা তাদের জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে বরং তারা বিদেশে যাওয়ার জন্য যে পরিমাণ অর্থ দালালদের দিচ্ছে, তা দিয়ে তারা দেশে কিছু করলে অনেক সুন্দর জীবনযাপন করতে পারত। অবৈধভাবে কেউ বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলেছেন। (বাসস, ২৪ মে ২০১৫) দেশে হঠাৎ করে কেন এত মানসিকভাবে অসুস্থ লোকের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে তা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। এ দেশে মানসিক রোগীদের পাগল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। দেশে কি তবে দেশ ছেড়ে যাওয়া পাগলের সংখ্যা বেড়ে গেল? যারা অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তবে যেসব কৃষক ধানের দাম পাচ্ছেন না তারা এ মানসিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়েছে।



আশুগঞ্জের কৃষক শহিদ এই মানসিক অসুস্থতার কারণ বর্ণনা করে একজন সাংবাদিককে বলেছেন, ‘তিন বছর ধইরা দাম পাই না। এখন বুঝতাছেন কেন মানুষ সাগর পাড়ি দিয়া থাইল্যান্ডের জঙ্গলে যায়?’ আর অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি এমনকি রাজনৈতিক কারণেও অনেকে এভাবে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তবে প্রধানমন্ত্রী একটি বিষয় সঠিকভাবে অনুধাবন করেছেন। তিনি বলেছেন দালালদের পাশাপাশি যারা অবৈধভাবে বিদেশে যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। এভাবে তারা তাদের জীবন বিপদের মধ্যে ঠেলে দেয়ার সাথে সাথে দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুন্ন করছে। সত্যিই তারা দেশের ভাবমর্যাদা দারুণভাবে বিপন্ন করছে। বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমে এসেছে বলে প্রচারণা এবং নানাজন নানাভাবে যে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছিলেন তা অর্থহীন হয়ে পড়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো সমুদ্রে ভাসা এসব মানুষের বিরুদ্ধে সরকার কিভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে? প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে প্রকাশ পেয়েছে। অনেক সংবাদমাধ্যম শিরোনাম করেছে Bangladesh PM calls would be migrants 'mentally sick প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য দেশের ভাবমর্যাদা বাড়ালো কি না তা এখন ভেবে দেখার বিষয়।


 


কৃষকের আর্তনাদ
কৃষকেরা যে ধানের দাম পাচ্ছেন না তা নিয়ে বেশ কিছু দিন থেকে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশ হচ্ছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের অনেক চালকল বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের ১৮ হাজার চালকলের ৭০ শতাংশই বন্ধ রয়েছে। কারণ বাজারে ধানের দাম কম, ফলে সরবরাহও কমে গেছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের বড় ধান-চালের বাজার নওগাঁ, বগুড়া, দিনাজপুর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গায় ধান-চালের বাজারে একই চিত্র। সার, বীজ, ওষুধসহ কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধিতে এক বিঘা জমিতে ধান উৎপাদন করতে যে পরিমাণ ব্যয় হচ্ছে উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে সেই পরিমাণ খরচ উঠছে না। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে প্রান্তিক চাষি। যারা ঋণ নিয়ে ধান উৎপাদন করেছে তারা উৎপাদিত ধান বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। সরকার প্রতি মণ ধান ৮৮০ টাকায় কেনার ঘোষণা দিলেও প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৫২০ থেকে ৫৫০ টাকায়। উত্তরাঞ্চলে কোথাও ৩৮০ টাকা মণ দরে চাল বিক্রি হচ্ছে। গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে কৃষক ধানের দাম না পেয়ে মহাসড়ক অবরোধ করে রাস্তায় ধান ফেলে রাখে। অথচ সরকারি হিসাবেই প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচ ৭০০ টাকা হিসাব করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল।



ধানের ভরা মওসুমে ব্যাপক ভিত্তিতে চাল আমদানি যে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে তা বোঝা এখন খুব কঠিন নয়। নয়া দিগন্তের খবরে বলা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী গত এপ্রিল মাসেই চাল আমদানি করা হয়েছে এক লাখ ৩০ হাজার টন। এ জন্য ব্যয় হয়েছে ৩২৭ কোটি টাকা। আরো আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে এক লাখ ১০ হাজার টন। এ জন্য ব্যয় হবে আরো পৌনে ৩০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) চাল আমদানি করা হয়েছে তিন হাজার ৭১৬ কোটি টাকার। এভাবে অবাধ আমদানির সুযোগে বাংলাদেশের চালের বাজার ভারতের নিয়ন্ত্রণে। ভারতীয় চালে এখন গোডাউনগুলো ভরে গেছে। গণমাধ্যমে এ নিয়ে খবর প্রকাশের পর চাল আমদানির ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। কিন্তু কৃষকের যা ক্ষতি হওয়ার হয়েছে।


 


বর্গি এলো দেশে
কৃষকেরাও বুঝতে পেরেছেন প্রাচুর্যের দেশে কিভাবে বর্গি চলে এসেছে। ধান চাষ করে ফতুর হওয়া কৃষককে খাজনা দেয়ার জন্য রসুন বুনতে হবে। কৃষকেরা কিন্তু এই বর্গিদের ভালোভাবেই চিনে ফেলেছে। দেশের মধ্যাঞ্চলে ধান-চালের প্রধান কেনা-বেচার কেন্দ্র আশুগঞ্জ ঘুরে এসে প্রথম আলোর একজন প্রতিবেদক লিখেছেন ধান-চালের বাজার নিয়ে আলাপ তুলতেই ক্ষোভ-বেদনা আর হতাশার কথা জানালেন কৃষকেরা। শহিদ-কবির ট্রেডার্সের ক্যাশবাক্সের সামনে বসা একজন ধান ব্যবসায়ী বললেন, ‘সব শেষ হওয়ার পর ওনারা আসছেন কৃষকের খোঁজখবর নিতে। ইন্ডিয়ান চাইলে বাজার যখন ভইরা গেল, তখন কোথায় আছিলেন। এখন ১০ পারসেন কেন, ১০০ পারসেন টেকশ (কর) বসাইলেও লাভ নাই।’ দেশের বাইরে থেকে বর্গিরা কিভাবে আসে কৃষক তা ভালোভাবেই জানে। বর্গিদের আসার পথ কারা দেখায় সেটাও তাদের অজানা নয়। মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার জন্য সরকার যখন ডুগডুগি বাজাচ্ছে তখন সর্বস্ব হারানো কৃষকের কণ্ঠে আর্তনাদ। একজন কৃষক বলছেন, ‘ভাই লিইক্কা দেন, আশুগঞ্জ অচল হইয়া গেছে। ধান দিয়া এই এলাকা উঠছিল। এখন সেই ধানই নাই, যা আছে তারও দাম নাই। ধানের দামের মতো এলাকার মাইনষের জীবনও পইড়া গেছে।’



হ্যাঁ মানুষের জীবন এখন পইড়া গেছে। গরিব ও অসহায় মানুষকে আমরা মানসিক রোগী হিসেবে আখ্যায়িত করে বিচার করতে পারি। তাদের জেলে ভরতে পারি। কিন্তু যাদের জীবন পইড়া গেছে তাদের কিভাবে টেনে তোলা হবে? সরকারের মন্ত্রীরা যেভাবে উন্নয়নের বয়ান দিচ্ছেন তাতে এই কৃষকের কি কোনো লাভ হচ্ছে? কৃষক কি ধানের ন্যায্যমূল্য পাবে? সমুদ্র পাড়ি দেয়ার মানসিক রোগীদের সংখ্যা ভবিষ্যতে কমবে না বাড়বে? রাস্তাঘাট ফ্লাইওভার নয়, এ রকম মানসিক রোগীর সংখ্যা কমলে দেশের উন্নয়ন হবে। সত্যিই প্রাচুর্যে ভরা দেশ হবে। প্রাচুর্যে ভরা দেশ নয়, দেশী-বিদেশী বর্গিদের লুণ্ঠনে হাড্ডিসার বাংলাদেশের ছবি এখন বিশ্বজুড়ে ছাপা হচ্ছে।


 

0 comments:

Post a Comment