WHAT'S NEW?
Loading...

বিশ্বাসের ব্যাংক

মারুরা ফগারতি


 


ইসলামে সুস্পষ্টভাবে সুদ হারাম। আবার ব্যাংকিংব্যবস্থায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে সুদের চক্র। ব্যাংকিং ছাড়া অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথা চিন্তাও করা যায় না।


এমনই এক পরিস্থিতিতে ইসলামি ব্যাংকিং মুসলমানদের বিশ্বাসের আলোকে অর্থব্যবস্থা পরিচাল

নার সুযোগ এনে দিয়েছে। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার ইসলামি ব্যাংকিং নিয়ে রিডার্স ডাইজেস্টে মারুরা ফগারতির বিশ্লেষণ ভাষান্তর করেছেন আসিফ হাসান



এশিয়ায় ইসলামি ব্যাংকিং ক্রমবর্ধমান হারে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অসংখ্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইসলামি ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ১২ মাসে মালয়েশিয়ায় গাড়ি-ঋণ প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন ব্যাংকের ইসলামি অর্থব্যবস্থার আলোকে সেবা প্রদানের হার তিন গুণ বেড়েছে।



ইসলামি ব্যাংকিংয়ের বিপুল প্রবৃদ্ধি শুধু এশিয়াতেই দেখা যাচ্ছে না। মুডি’স ভাষ্যানুযায়ী, চলতি বছরেই বিশ্বব্যাপী ইসলামি আর্থিক-পণ্যের চাহিদা এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আরব উপসাগরে এই শিল্পটি ইতোমধ্যেই প্রাধান্য বিস্তার করেছে এবং এশিয়াকে দ্রুত কব্জা করছে।



ব্লুমবার্গ জানাচ্ছে, অঞ্চলটি চলতি বছর বিশ্বব্যাপী বিক্রি হওয়া প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের ইসলামি বন্ড তথা সুকুকের ৬৮ শতাংশ সংগ্রহ করেছে। বিশ্বের ইসলামি বন্ডের বৃহত্তম ইস্যুকারী হিসেবে মালয়েশিয়া এশিয়ার শীর্ষ ইসলামি আর্থিককেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। মালয়েশিয়ায় ইসলামি ব্যাংকিংয়ের অংশ ২০ শতাংশ, উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোতে তা ৩৫ শতাংশ।



ইসলামি ব্যাংকিং কী?
ইসলামি ব্যাংকিংয়ের দু’টি বিশেষত্ব রয়েছে। যেসব মুসলমান হারাম কিছুর সাথে সম্পৃক্ত না হয়েই ব্যাংকিং কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হতে চায়, তাদের জন্য বিশেষভাবে এই ব্যাংকিং প্রয়োজনীয়। এটাকে নৈতিক মূল্যবোধবিশিষ্ট ব্যাংকিংব্যবস্থা হিসেবেও অভিহিত করা যেতে পারে।


এই বিকল্প ব্যবস্থাটি কিছুদিন ধরে পশ্চিমাদের জন্যও উন্মুক্ত। নৈতিক মূল্যবোধবিশিষ্ট ব্যাংকিংয়ে অন্য আরো কিছুর মতো অস্ত্র খাতে বা প্রতিরক্ষা শিল্পে বিনিয়োগ থেকে দূরে থাকে। ইসলামি ব্যাংকিংয়েও একই ধরনের কিছু মূল্যবোধ রয়েছে।



প্রচলিত ব্যাংকব্যবস্থার সাথে ইসলামি ব্যাংকব্যবস্থার মূল পার্থক্য শরিয়াহ আইন। শরিয়াহ আইনের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে সুদ দেয়া বা নেয়া উভয়টাই নিষিদ্ধ। এশিয়ায় ইসলামি অর্থসেবা দানের অন্যতম প্রতিষ্ঠান সিআইএমবি ইসলামিক ব্যাংক বেরহাদের নির্বাহী পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী অফিসার বাদলিসিয়া আবদুল গানি বিষয়টির ব্যাখ্যা দেন এভাবে : ‘পার্থক্যটা সুস্পষ্ট।


কারণ প্রচলিত ব্যাংকিংব্যবস্থায় অর্থের ওপর অর্থ ধার্য করা হয় রিবা নামে পরিচিত ঋণদাতা-ঋণগৃহীতার সম্পর্ক বা আইওইউ সম্পর্কের মাধ্যমে, যা ইসলামি ব্যাংক করে না।’ ব্যাংকগুলো বিলম্বে অর্থ পরিশোধের জন্য জরিমানা করার মাধ্যমেও লাভ করে না, যদি জরিমানা করেও, সে-ই অর্থ কোনো দাতব্য কাজে দান করে দেয়া হয়।



সব ইসলামি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ইসলামি ব্যাংকিং ও অর্থশাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ পেশাজীবী ও শরিয়াহ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত শরিয়াহ কমিটি রয়েছে। মুসলমানদের ইসলামের নির্দেশিত নীতিমালার আলোকে সঞ্চয়, ঋণগ্রহণ বা বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করা হয়, তবে এতে অংশগ্রহণ করা বা না করার ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।



ইসলামি ব্যাংকি পণ্যরাজি
ব্যাংক জমা থেকে ক্রেডিট কার্ড, বিনিয়োগ ও বীমাসহ ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রমের আওতায় বিপুলসংখ্যক পণ্য ও সেবা পাওয়া যায়। সবচেয়ে জনপ্রিয় কয়েকটির কথা এখানে উল্লেখ করা হলোÑ
বন্ধক ও গাড়ি বিনিয়োগ : এই পদ্ধতিতে সাধারণত মুরাবাহা বা ইজারা আর্থিক চুক্তি সম্পাদন করা হয়। মুদারাবা আর্থিক চুক্তিতে, ক্রেতা যে জিনিসটি কিনতে চায় (গাড়ি বা অন্য কোনো সামগ্রী) তা ব্যাংক নিজেই বিক্রেতার কাছ থেকে কিনবে এবং তারপর একটা নিষ্পত্তিমূলক দরে সেটা ওই ক্রেতার কাছে বিক্রি করবে। ক্রেতা কিস্তিতে মূল্য পরিশোধ করবে।


ইজারা আর্থিক পদ্ধতিতে, ব্যাংক বিক্রেতার কাছ থেকে কিনবে, তারপর তা ক্রেতার কাছে একটা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ইজারা দেবে এই শর্তে যে, সব শেষে তিনি এটা কিনে নিতে পারেন। ইজারার অর্থ কিভাবে পরিশোধ করা হবে সেটা পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়।
বিনিয়োগ তহবিল : সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ তহবিলগুলোর (এসআরএফ) মতো ইসলামি তহবিলগুলোও শুধু নৈতিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নিয়োজিত কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করে। ইসলামি তহবিল ব্যবস্থাপনা শরিয়াহ আইনের ভিত্তিতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। সাধারণভাবে যেসব কোম্পানি অ্যালকোহল, তামাক, জুয়া ও পর্ণোগ্রাফি ব্যবসায়ে নিয়োজিত, সেখানে তারা বিনিয়োগ করে না। এ ছাড়া যেসব কোম্পানি শুকর বা প্রচলিত অর্থব্যবস্থায় সম্পৃক্ত (অর্থাৎ যেসব প্রতিষ্ঠান ব্যাংক ও বীমা কোম্পানির মতো সুদি কারবারে জড়িত) তাদের শেয়ার কেনে না।



সোসাইটি অব ফিন্যান্সিং সার্ভিস প্রফেশনালসের সাবেক সভাপতি লিওঙ জি হিয়ান মনে করেন, ইসলামি তহবিলগুলো ঝুঁকিমুক্ত নয়। আপনার এসব তহবিলের বিপদ সম্পর্কে ধারণা না থাকলে আপনি অনেক বড় ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। তার মতে, আপনার সব অর্থ ইসলামি তহবিলে বিনিয়োগ করাটা যথাযথ না-ও হতে পারে।



ব্যাংক জমা :


বিভিন্ন পণ্যে ব্যাংক জমা গ্রহণ করে। মুদারাবা হিসাবে ব্যাংক সঞ্চয়কারীর সাথে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং প্রাপ্য লাভ ভাগাভাগি করে নেয়। ওয়াদিয়া পদ্ধতিতে ব্যাংক সঞ্চয়কারীকে সুদ প্রদান না করে হিবা (উপহার) দিতে পারে।



তাকাফুল (ইসলামি বীমা) :


এ ধরনের বীমায় একদল লোক তাকাফুল কোম্পানির পরিচালিত তহবিলে চাঁদা প্রদান করে থাকে এবং লাভ বা লোকসানসম্মত চুক্তি অনুযায়ী বণ্টন করে নেয়। এই ব্যবস্থায় ঝুঁকি গ্র“প বা সম্প্রদায়গতভাবে ভাগাভাগি করে নেয়া হয়।



প্রচলিত ব্যাংকব্যবস্থার সাথে তুলনা করা হলে দেখা যাবে, ইসলামি অর্থব্যবস্থার ঝুঁকি-বণ্টনের একটি মধ্যবর্তী কাঠামো আছে এবং কোনো কোনো আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতা একটি স্বীকৃত শর্ত। বাদলিসিয়া বলেন, ইসলামি ব্যাংকিংয়ে কোনো ধরনের গোপন খরচ নেই। তা-ই ক্রেতারা যা দেখেন, সেটাই পান। তিনি বলেন, অধিকন্তু আপনি প্রচলিত ব্যংকিংয়ের মতো একই ধরনের অধিকার ও সুরক্ষা পাবেন। তিনি জানান, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো উভয় শিল্পই একই ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রকের আওতায় একইভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় এবং ক্রেতা-অধিকার সমানভাবে সুরক্ষিত।’



মালয়েশিয়া বিশ্বের অন্যতম প্রতিযোগিতামূলক স্থান হওয়ায় এখানে দেশী ও বিদেশী উভয় ধরনের কোম্পানিই ইসলামি ব্যাংকিং সেক্টরে সক্রিয়।



সিআইএমবি ইসলামিক ব্যাংকের মতো স্থানীয় ব্যাংকগুলো এইচএসবিসি আমানাহ ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড সাদিকের মতো বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ইসলামিক ব্যাংকিং শাখা হিসেবে কাজ করছে। মালয়েশিয়া এই অঞ্চলে সবচেয়ে উন্নত ইসলামিক ব্যাংকিং খাতসমৃদ্ধ হিসেবে পরিগণিত হলেও প্রতিবেশী সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়াও এই শিল্পটি বিকাশে উৎসাহের সৃষ্টি করে যাচ্ছে।



ইন্দোনেশিয়া ছোট ও মাঝারি কোম্পানিগুলোকে ইসলামি বিনিয়োগে বেশি সুবিধা দেয়ার পরিকল্পনা করছে। দেশটি ইসলামি ব্যাংকিং সেবার জন্য কর প্রণোদনাও দিচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া জনসংখ্যার দিক থেকে বৃহত্তম মুসলিম দেশ হলেও ইসলামিক ব্যাংকিংয়ে প্রবেশ করেছে কিছু দেরিতে। কর্তৃপক্ষ এটা বুঝতে পেরে নিয়ন্ত্রণ-কাঠামো ও আইনগত কাঠামো উন্নত করতে কাজ করে যাচ্ছে। দেশটি যেকোনো ধরনের অর্থনৈতিক বা আর্থিক সঙ্কট থেকে রেহাই পেতে দেশটির সব অংশে দ্বৈত ব্যাংকিংব্যবস্থা, প্রচলিত ও ইসলামি, চালুর পরিকল্পনাও করছে।


 

0 comments:

Post a Comment