WHAT'S NEW?
Loading...

সরকার এবং বিএনপি সমঝোতা!

 


আমীর খসরু


পুরো এক বছর নিস্তব্ধ, নিস্তরঙ্গ থাকার পরে গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে এই মার্চ পর্যন্ত আবার ব্যাপকমাত্রায় সরব, উত্তপ্ত ও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে রাজনৈতিক অঙ্গন। বলা যায়, এক বছর রাজপথে বা কোথায়ও বিরোধী পক্ষের তেমন কোনো কর্মকাণ্ড না থাকায় অথবা থাকতে না দেয়ায় ক্ষমতাসীনরা দেশের স্থিতিশীল

তা স্থায়ীভাবে ফিরে এসেছে বলে প্রচার-প্রচারণা চালাতে থাকে। এমন অবস্থার মধ্যেও বর্তমান সরকারের সব কার্যক্রম বিরোধী হটাও ও ঠেকাও-এর মূল লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এটা তাই প্রমাণ করে। তিন মাসের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে অফিস বন্দী করে রাখা, ইট-বালুর ট্রাক ভর্তি ব্যারিকেডের পুনরাবির্ভাব, জ্বালাও পোড়াও, পেট্রোল বোমায় নিহত আহত হওয়ার বিপরীতে অপহরণ, গুম, ক্রসফায়ার, কথিত গণপিটুনিসহ সকল উপায়ে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলতে থাকে। গুম এই দফায় আরও উচ্চতর ব্যক্তিবর্গের দিকে ধাবমান হতে থাকে এবং এরই কারণে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ এখনো নিখোজ। এছাড়া মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিরোধী অসংখ্য নেতাকর্মী জেলে অথবা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।


ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ইউনিয়নসহ পশ্চিমী দুনিয়ার পক্ষ থেকে সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক সহিংসতা প্রশমন এবং সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিস্থিতি সৃষ্টির আহ্বান জানানো হয়। বার বার বলা হতে থাকে, এছাড়া কোনো পথ এবং পন্থা খোলা নেই। জাতিসংঘ এবং এর মহাসচিব গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে একই কথা বলেন। জাতিসংঘ মহাসচিব চিঠিও দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি চেয়ারপার্সনকে। তিনি অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে দায়িত্ব দেয়া হ

য় দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতায় পৌছানোর সব চেষ্টা চালানোর জন্য। এই দফায় অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো নিজে আবার বাংলাদেশে এসে সংলাপের ক্ষেত্র প্রস্তুতের চেষ্টা চালানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তারানকো স্বয়ং এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট পর্যায়গুলোতে কথাও বলেছিলেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যর্থ হওয়ার কারণ, সরকারের অনমনীয়তা। তিনি যাতে বাংলাদেশে আসতে না পারেন সে ব্যাপারে সরকার অনঢ় ছিল।


কিন্তু সরকারের অনমনীয়তা এবং অনঢ় অবস্থানের পরেও জাতিসংঘ হাল ছাড়েনি, হাল ছাড়েনি পশ্চিমী শক্তিগুলো। কারণ জাতিসংঘের ওই উদ্যোগের পেছনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং এর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর প্রবল সমর্থন এবং চেষ্টা। উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ নামে কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক মাঠে নামলেও তারা স্বল্পকালেই আবার ‘গুহাবাসী’ হন। তাদের আর কোনো কার্যক্রমের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এক্ষেত্রে অনেকেই ক্ষমতাসীনদের উদ্ব্যতপূর্ণ আচরণকে দায়ী করেন।


এমন ধরনের উদ্যোগ এবং প্রচেষ্টা ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের আগেও জারি রাখা হয়েছিল। জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত হিসেবে অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর ঢাকায় এসেছিলেন এবং সংলাপের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য তিনি সরকার এবং বিরোধী পক্ষের সাথে আলাদা আলাদা বৈঠকও করেছিলেন। তখন তিনি ক্ষমতাসীন পক্ষকে প্রায় রাজিও করিয়ে ফেলেছিলেন সমঝোতার ব্যাপারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর অনঢ় অবস্থানের কারণে ওই সমঝোতা ভেঙ্গে যায়। এখানে বলা প্রয়োজন যে, এর আগে দিল্লিতে ভারতীয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের বাংলাদেশ বিষয়ক যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়, তাতে ভারতীয় পক্ষ থেকে তাদের কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। ভারতে ওই সময় কংগ্রেস সরকার ক্ষমতাসীন ছিল।


এমত এক প্রেক্ষাপট এবং পরিস্থিতিতে ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন, নজির সৃষ্টিকারী নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে বার বার এ কথাটি বলা হতে থাকে যে, এটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। তাদের পক্ষ থেকে এমন ধারণাও দেয়া হয় যে, অচীরেই সব দলের অংশগ্রহণে আবার একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ বিষয়টি শুধু দেশজ পর্যায়ে নয়, বিদেশীদেরও খুব স্থিরভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। তারা বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন বলেই মনে হয়।


এরপরে একদিকে বিএনপির নানা অন্তর্গত দুর্বলতা বিশেষ করে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সক্রিয়তাবিহীন মনোভাব, সমন্বয়হীনতা, অক্ষমতা, চরম মাত্রার ভীতি এবং ‘ক্ষমতার খোয়াড়ী’ তাদের নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল। অন্যদিকে, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের দোদুল্যমানতার কারণে তারা এমন সমঝোতার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় যে, খুব শিগগিরই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং এতে তাদের প্রস্তুতি গ্রহণ বাঞ্ছনীয়। এরই কারণে এবং দলীয় নেতাকর্মীদের চাপে দলটি উপজেলা নির্বাচনেও অংশ নিয়েছিল। আর তখনো ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে একটি আশ্বাসবাণী শোনানো হয় যে, ওই নির্বাচনটিতে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা হবে না। কিন্তু প্রথম দফার উপজেলার নির্বাচনের ফলাফল দেখে ক্ষমতাসীনরা আর তাদের আশ্বাস যেমন মানতে পারেনি, তেমনি বিএনপি বিশ্বাস ভঙ্গের যাতনায় দুমড়ে মুচড়ে পড়ে।


এর পরবর্তীকালে বিএনপি যতোটা না নিজেদের নিজস্ব শক্তিতে আস্থাশীল হতে পেরেছে, তার চেয়েও বেশি তাকিয়ে থেকেছে ‘বিদেশী শক্তি’ কিছু একটা করে দেবে - এমন প্রত্যাশা, আকাঙ্খা এবং বিশ্বাসে। এরই এক পর্যায়ে ভারতীয় জাতীয় নির্বাচনে বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদীর সম্ভব বিজয়ের বিএনপি এতোটাই উত্তেজিত, আশান্বিত হয়েছিল যে, অচিরেই এক্ষেত্রেও তাদের মোহভঙ্গ হতে সময় লাগেনি। বিরোধী পক্ষ চুপচাপ থাকার নীতি গ্রহণ করলেও ক্ষমতাসীনরা ক্রমাগত মামলা-মোকদ্দমা, গ্রেফতার এবং সভা-সমাবেশ করতে না দেয়ার নীতিতে বিশ্বাসী থেকে কর্মকান্ড চালিয়ে গেছে।


দীর্ঘকাল এমনই এক পরিস্থিতি কাটিয়ে ৫ জানুয়ারির বর্ষপূর্তিতে যখনই বিএনপি ঢাকায় সমাবেশ করতে চেয়েছে, সরকার তখনই তাদের উপরে চরমভাবে আঘাত হেনেছে। বিএনপি এর আগেও কয়েক দফা সভা-সমাবেশ করতে চাইলেও তা তারা পারেনি সরকারের প্রবল বাধা বিঘ্নের কারণে। ২০১৫’র ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করেও সরকার আরও কঠিন-কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। একই সাথে বিরোধী পক্ষ দমনে আর নাশকতা সৃষ্টি বা উন্নয়নে বাধাবিঘ্ন সৃষ্টিকারী শব্দগুলো আর ব্যবহার করা হয়নি। এবার আরও উচ্চস্বরে তারা বলতে শুরু করলো - এরা উগ্রবাদী, জঙ্গীবাদী। আর এভাবেই তাদের দমনে নানা কৌশল ও পন্থা ব্যবহৃত হতে থাকে। অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়নের নতুন নতুন কৌশল গৃহীত হতে থাকে। বিরোধী নির্মূল ও হটাওযজ্ঞ চলতে থাকে দেশজুড়ে, আবার অন্যদিকে বিরোধী নেত্রীকে অফিস বন্দী করে রাখা হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ বহু নেতাকর্মীকে জেলে নেয়া হয়। এই দফায়ও বিএনপির সমন্বয়হীনতা, দোদুল্যমানতা, সিদ্ধান্তহীনতা এবং সর্বোপরি প্রস্তুতি না থাকার অবস্থা সরকারের কৌশলী অপকৌশলের কাছে পরাজিত হয়। এখানে বলা প্রয়োজন যে, এরই মধ্যে চলতে থাকে বিদেশী এবং দেশীয় বিশিষ্টদের সমঝোতা উদ্যোগ। আর এ উদ্যোগটি নেপথ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে মূলত রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে সত্যিকার জঙ্গী, উগ্রবাদী শক্তি যতোটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তা যেন আর বাড়তে না পারে। তবে এটা তাদের কোনো প্রকাশ্য অবস্থান নয়। তাদের প্রকাশ্য অবস্থান হচ্ছে - বিবাদমান দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতা করে বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরন।


বিএনপির সামনে এমন একটি প্রস্তাবে রাজি হওয়া ছাড়া তাদের হাতে আর কোনো পথ যেমন খোলা নেই, তেমনি সরকারও চাইছিল এমন অবস্থান থেকে বিএনপি যেন দুরে থাকে।


বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে নানা দৌড়ঝাপের পরে অবশেষে একটি সমঝোতা হয়েছে। সরকারের দিক থেকে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে জানান দেয়ায় বেজায় আপত্তি রয়েছে।


সমঝোতাটির রূপরেখা হচ্ছে এমন যে, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে এবং একে বলা হচ্ছে - ‘সংলাপের ক্ষেত্র প্রস্তুতের প্রথম স্তর’। শর্ত অনুযায়ী, দ্বিতীয় পর্যায়ে সরকার একটি নির্বাচন দেবে অচিরেই। যদিও কবে সে বিষয়টি এখনো স্পষ্ট করা হয়নি। বিএনপি চাইছে, তিন মাসের মধ্যে।


তবে সমঝোতার অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে - বিএনপি ও জামায়াতকে আলাদা আলাদাভাবে নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকারটি কেমন হবে তা নিয়ে সমঝোতার চূড়ান্ত না হলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই নতুন ধরনের একটি সরকার করা যায় কিনা সে চেষ্টা চালাচ্ছে বিদেশীরা। এ অবস্থায় সরকার শর্ত দিয়েছে যে, বিএনপি ওই নির্বাচনের স্বার্থে নতুন কোনো আন্দোলন করতে পারবে না। আর বিএনপি চাইছে, তাদের নেতাকর্মীদের মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহার।


কিন্তু সরকারের দিক থেকে প্রধান সন্দেহ এবং অবিশ্বাসের বিষয়টি হচ্ছে - বিএনপি ও জামায়াত আলাদা আলাদাভাবে নির্বাচন করবে কিনা সে প্রশ্নে। সরকারের দিক থেকে সন্দেহটি এখানে যে, বিএনপি এখন এতে রাজি হলেও নির্বাচনের আগে গোপনে অথবা অন্য উপায়ে দু’পক্ষের মধ্যে কৌশলগত আসন ভাগাভাগি হয়ে যাবে এবং এদের মধ্যকার সম্পর্ক সত্যিকার অর্থেই আলাদা হবে কি না। এছাড়া ঢালাওভাবে মামলা-মোকদ্দমা প্রত্যাহারের বিষয়েও সরকারের দিক থেকে আপত্তি আছে।


এই সমঝোতার প্রথম ধাপ হিসেবে বিএনপি নিজেদের নামে নির্বাচন না করে শত নাগরিকের নতুন সংগঠন ‘আদর্শ ঢাকা আন্দোলন’-এর কাধে উঠে পড়েছে সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। আর বিএনপি কার্যত সব কিছুই মেনে নিয়েছে। আর এ কারণেই বেগম খালেদা জিয়া সব কিছু ছেড়ে হাজিরা দিয়ে নিজ বাসগৃহে চলে গেছেন। ক্ষমতাসীনরা কি সবার জন্য সমান সুযোগ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টিকারী সহি একটি সিটি নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত রাজি থাকবে? যদি না থাকে তাহলে এই সমঝোতার পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাড়াবে?


কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হচ্ছে - বিএনপি সব কিছু মোটামুটি মেনে নিলেও ক্ষমতাসীনরা আখেরে কতোটা আন্তরিক থাকবে এই সমঝোতার ব্যাপারে? তারা আদৌ শর্তগুলো মেনে চলবে শেষ দিন পর্যন্ত? অথবা ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির পরের পরিস্থিতি পুনরাবৃত্তি ঘটবে আরেকবার? সবকিছুই ধোয়াটে।


কারণ একটি বিষয় ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে, ‘নিজস্ব স্বার্থে’ প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যেই আপোসহীন নেত্রীর প্রমাণ দিয়েছেন। তিনি এ ব্যাপারে কতোটা কঠিন-কঠোর অবস্থানে যেতে পারেন তাও প্রমাণিত হয়েছে। তবে বেগম খালেদা জিয়া হারিয়েছেন তার আপোসহীন নেত্রীর খেতাব।


আমাদের বুধবার


 

0 comments:

Post a Comment