WHAT'S NEW?
Loading...

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় সরকার


জাকির হোসেন লিটন


 


দেশ-বিদেশের নানামুখী চাপের মুখে ক্ষমতাসীনরা কিছুটা ব্যাকফুটে গেলেও চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপের পথেই হাঁটছে। এ সময় বিরোধী জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার না করা হলেও একঘরে করে রাখা হবে। চলবে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের কাজ। লক্ষ্য

অর্জনে প্রশাসনের পাশাপাশি দলীয়ভাবে মাঠে নামানো হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের। হরতাল, অবরোধ ও নাশকতাবিরোধী জনমত গঠনের কাজও অব্যাহত থাকবে। ইতোমধ্যেই বিএনপি-জামায়াত জোটের কর্মকাণ্ডকে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে দেশ-বিদেশে উপস্থাপনের চেষ্টা হয়েছে। যদিও তা নিয়ে নানা বিতর্কের মুখে পড়তে হচ্ছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের। বিরোধী জোটকে আরো বিভ্রান্ত করতে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ডামাডোলও শুরু করে দেয়া হয়েছে।



সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের চলমান হরতাল-অবরোধে দেশজুড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেও হাল ছাড়তে নারাজ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সুশীলসমাজ, কূটনীতিকদের উদ্বেগ ও সরকারের বাইরে থাকা দলগুলোর চাপেরও শেষ দেখতে চায় দলটি। সে জন্য সাময়িক রোডম্যাপ বাদ দিয়ে এখন দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপের বিষয়টি মাথায় রেখে এগোচ্ছেন দল ও সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। তারা মনে করছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্বোচ্চ অবস্থান ও প্রশাসনের নানামুখী তৎপরতার মুখে বিএনপির আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হবে। এত দীর্ঘ আন্দোলন চালিয়ে যেতে ক্লান্ত হয়ে পড়বে সরকারবিরোধী নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া হরতাল, অবরোধ অব্যাহত থাকলেও একপর্যায়ে সাধারণ মানুষ সব আতঙ্ক পাশ কাটিয়ে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ফিরে আসবে। এতে সরকারবিরোধীদের দীর্ঘমেয়াদি এ আন্দোলন চূড়ান্তভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।



আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বিরোধী জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে একাধিকবার গ্রেফতারের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সর্বশেষ আদালতের একটি পরোয়ানাকে পুঁজি করে তাকে গ্রেফতারের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়েও নানা প্রতিকূলতার মুখে সেই অবস্থান থেকে সরে আসে সরকার। চলমান সঙ্কট আরো জটিল হওয়ার আশঙ্কা, জনমনে বিরূপ প্রভাব ও প্রবল কূটনীতিক চাপের মুখে অবস্থান পরিবর্তন করেছেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। সে জন্য আদালতের নির্দেশের পরও এখনই খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের ঝুঁকি নেয়া হচ্ছে না বলে সূত্র জানিয়েছে। বিশেষ করে খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হলে চলমান অস্থিতিশীলতা চরম পর্যায়ে পৌঁছতে পারে এবং গণতন্ত্রের যাত্রাও ব্যাহত হতে পারে ঢাকায় অবস্থিত কূটনীতিকেরা সরকারের উচ্চপর্যায়ে এমন একটি বার্তা পৌঁছে দেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ১৬ দেশের কূটনীতিকেরা মঙ্গলবার খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎও করেন। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার গ্রেফতার ও দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতির ওপর জাতিসঙ্ঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক মহলের কঠোর নজরদারি সরকারকে ভাবিয়ে তোলে।



এ দিকে ব্রাসেলসভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ক্রাইসিস গ্র“প’ গত মঙ্গলবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের সরকারবিরোধী আন্দোলনে গত জানুয়ারি থেকে ১০০ জনেরও বেশি লোকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের আদালত বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হলে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট আরো বাড়বে।’



এভাবে জাতিসঙ্ঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটিশ হাইকমিশন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নানামুখী তৎপরতা নিয়ে খানিকটা অস্বস্তি সৃষ্টি হয়েছে ক্ষমতাসীন দলটিতে। সরকারের মন্ত্রী ও দলের বিভিন্ন নেতা বিষয়টি পাত্তা না দিয়ে মুখে যা-ই বলেন না প্রকৃত অবস্থা ভিন্ন।



সিনিয়র নেতাদের মতে, কূটনীতিকদের এ দৌড়-ঝাঁপের বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ প্রতিদিন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতির যে হানাহানির চিত্র প্রকাশ হচ্ছে তা দেশের ভাবমূর্তির জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। শুরুতে সরকার শক্তি প্রয়োগ করে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করা হলেও দিন যতই যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সংশ্লিষ্টতা বাড়ছে। এর শেষ কোথায় তা কেউ অনুমান করতে পারছে না। জাতিসঙ্ঘসহ অন্যান্য মহল বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সত্যিকারের চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখলে তা সরকারের সব পরিকল্পনা মাটি করে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় দেশের সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হলে গণতান্ত্রিক সরকারের সবচেয়ে বড় অগণতান্ত্রিক আচরণই প্রমাণ হবে। এর মধ্য দিয়ে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, যা সরকারের জন্য বাড়তি ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।



অন্য দিকে দুই মাস ধরে চলা বিএনপি জোটের অবরোধ-হরতালে ইতোমধ্যেই দেশের অর্থনীতি গভীর খাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী এরই মধ্যে প্রায় এক লাখ পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে গেছে। এ অবস্থায় খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হলে তাদের আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হবে। বাড়তে পারে অস্থিতিশীলতা ও নাশকতা। এতে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম শঙ্কা দেখা দিতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সরকারের উচ্চপর্যায়ে এমন রিপোর্ট দিয়েছে। ফলে খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারে নীতিগত সিদ্ধান্ত থাকলেও সরকার আপাতত সেখান থেকে সরে আসে।



তবে অন্য একটি সূত্র জানায়, বিভিন্ন চাপের মুখে সাময়িকভাবে গ্রেফতার এড়ানো গেলেও খালেদা জিয়া গ্রেফতার হবেনই। এর আগে তাকে কারাবন্দীর আদলে গুলশান কার্যালয়ে একঘরে করে রাখা হবে। ইতোমধ্যেই সেখানে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। আর পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে গ্রেফতারের মতো সরকারের সর্বোচ্চ এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে। এ ক্ষেত্রে গ্রেফতার কার্যক্রম হতে পারে কয়েক ধাপে ও ভিন্ন কৌশলে। বিশেষ করে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার না করে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এমন সিদ্ধান্ত নিতে যাওয়া চরম আত্মঘাতী হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। সে জন্য আপাতত বিদেশীদের সাথে বোঝাপড়ার দিকটিকেই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যা যা করণীয় সবই করতে সরকার প্রস্তুত বলে জানিয়েছে সূত্রগুলো।



ওদিকে দেশব্যাপী চলমান রাজনৈতিক সহিংসতাকে ‘জঙ্গি’ হিসেবে উপস্থাপনের কৌশল নিয়েছে সরকার। সেই লক্ষ্যে সিডি ও ডিভিডিসহ তথ্যচিত্র নির্মাণের কাজ অব্যাহত রয়েছে। তৈরি হলে তা বিদেশী দূতাবাসসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরাম ও সংস্থায় সরবরাহ করা হবে। লাগাতার অবরোধসহ সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনে জাতিসঙ্ঘসহ বিদেশীদের আনুকূল্য পেতেই এ কৌশল নেয়া হয়েছে বলে আওয়ামী লীগ ও সরকারের একাধিক সূত্র জানিয়েছে। ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত থেকে দেশের সব কূটনীতিকসহ বিশিষ্ট জনের সামনে একটি ভিডিও তথ্যচিত্র তুলে ধরেছেন। এর মাধ্যমে মূলত হরতাল অবরোধে ঘটে যাওয়া নানা নৃশংসতার ফল ঘরে তুলতে চায় সরকার। এর আগে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে দেশব্যাপী চলা সহিংসতার ভিডিওচিত্র নির্মাণ করে একইভাবে বিদেশী দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক নানা সংস্থাসহ সারা দেশে মাঠনেতাদের কাছে সরবরাহ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।



পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রশাসনের পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মীদেরও মাঠে নামাচ্ছে সরকার। নীতিনির্ধারকদের মতে, এ অবস্থা বেশি দিন চলতে থাকলে এক সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ক্লান্ত হয়ে পড়বে। অন্য দিকে সরকারদলীয় নেতাকর্মীরাও ঝিমিয়ে পড়বে। সে জন্য শুধু প্রশাসনের ওপর ভরসা করে বসে না থেকে দলীয় রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে নেতাকর্মীদেরও মাঠে নামানো হচ্ছে। ইতোমধ্যেই দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা সব এমপি ও কেন্দ্রীয় নেতাদের নিজ নিজ এলাকায় অবস্থানের নির্দেশ দিয়েছেন। পাড়া-মহল্লায় নেতাকর্মীদের দিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি গঠনেরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে এসব সিদ্ধান্তের তেমন কোনো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। দলীয় এমপিরা এ পরিস্থিতিতে এলাকায় তেমন যাতায়াত করছেন না। এ নিয়ে সরকারের শীর্ষ মহলে ক্ষোভ রয়েছে বলে খবর বেরুচ্ছে।



চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও বিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ডামাডোল শুরু করে দিয়েছে সরকার। নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ প্রার্থীও ঘোষণা দিয়েছে। নিজ নিজ অবস্থান মজবুত করতে সেসব প্রার্থী মাঠে নেমে পড়েছেন। এ নির্বাচনের পরই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু করবে নির্বাচন কমিশন। বিএনপি জোটের আন্দোলনের মোড় ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিতেই এমন কৌশল নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।


 

0 comments:

Post a Comment