আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
বারবারা আয়ারল্যান্ড এখন ‘দি নিউইয়র্ক টাইমস’-এর ট্রাভেল অ্যান্ড ফ্যাশন পেজের এডিটর। নিউইয়র্কে আসার আগেই ওকে জানিয়েছিলাম, আমি আসছি। ১৩ জুন পৌঁছেই বারবারাকে ফোন করে বলেছি সাক্ষাতের দিনক্ষণ ঠিক করার জন্য। সে উচ্ছ্বসিত, দীর্ঘ ১৮ বছর পর আমাদের সাক্ষাৎ হতে যাচ্ছে। বলল, ‘খুব ভালো সময়ে এসেছ তুমি। টাইমস স্কোয়ারের অফিস থেকে নতুন হেডকোয়ার্টারে শিফট হচ্ছে সব কিছু
ম্যানহাটানের বিখ্যাত টাইমস স্কোয়ার থেকে নিউইয়র্ক টাইমসের সদর দফতর এখন এইটথ এভিনিউ-এর ৪০ ও ৪১তম স্ট্রিটের মাঝামাঝি স্থানে নির্মীয়মান ভবনে চলে আসছে। এর আগে ১৯৮৯ সালে এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে স্যানফ্রান্সিসকো থেকে নিউইয়র্কে এসেছিলাম মাত্র তিন দিনের সময় নিয়ে। নগরী ঘুরিয়ে দেখানোর সময় সে টাইমস স্কোয়ারেও এনেছিল আমাকে। কিন্তু পরিচিত কেউ ছিল না বলে নিউইয়র্ক টাইমস সদর দফতরে প্রবেশ করতে পারিনি। এমনকি অনতিদূরে বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)-এর সদর দফতরে কর্মরত আমার বন্ধু জেফ ব্রাডলি (চিরকুমার জেফ ১৯৯৯ সালে মারা গেছে) তখন নিউইয়র্কের বাইরে থাকায় তার অফিসও দেখা হয়নি। আমি শুধু অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছি একটি সংবাদপত্র বা একটি বার্তা সংস্থার জন্য কি এত উঁচু ভবনের প্রয়োজন পড়ে? কারণ সে অট্টালিকাগুলোতে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের অফিস ছিল না।
১৯৮৮-৮৯ একাডেমিক ইয়ারে রয়টার্সের একটি বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জন এস নাইট ফেলোশিপ প্রোগ্রামের অধীনে পড়াশোনা করার সময় বারবারা আয়ারল্যান্ডসহ আরো কিছু আমেরিকান সাংবাদিকের সাথে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। বারবারা তখন ছিল ‘বাফেলো নিউজ’ নামে আঞ্চলিক এক দৈনিকের সিনিয়র রিপোর্টার। নিউইয়র্ক টাইমসে যোগ দিয়েছে ২০০১ সালে। পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী ‘ফিলাডেলফিয়া এনকোয়ারার’-এর জন ওয়েস্টেনডিক এখন ‘বাল্টিমোর সান’-এ জন হেনরি টেক্সাসের ‘অস্টিন-আমেরিকান স্টেটসম্যান’ ছেড়ে কয়েক বছর আগে যোগ দিয়েছে এপি’র ওয়াশিংটন ব্যুরো অফিসে। মার্কিন সংস্কৃতিতে কর্মস্থল পরিবর্তনের ব্যাপারটি অনেকটা পোশাক পাল্টানোর মতো হলেও মাইকেল কিফি গত প্রায় সাড়ে তিন দশক থেকে কলোরাডোর ‘ডেনভার পোস্ট’-এর কার্টুনিস্ট হিসেবে নিয়োজিত। বরং তারই চেষ্টায় জেফ ব্রাডলি এপি ছেড়ে ডেনভার পোস্টের সিনিয়র পদে যোগ দিয়েছিল এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। খবরটি আমাকে কিফিই জানিয়েছিল। থিয়েটার ক্রিস্টিক ন্যান্সি মেলিচ এখনো ইউতাহ’র ‘সল্ট লেক ট্রিবিউন’-এ আছে। অন্যান্যের মধ্যে দু’-একজন ছাড়া সবাই কর্মস্থল পাল্টেছে। বারবারা ও জন হেনরির কাছে যাদের ফোন নম্বর ছিল সেগুলো নিয়ে সবার সাথে কথা বলেছি।
১৪ জুন বারবারা ফোনে জানালো যে, পরদিন সে যতটা ফ্রি থাকবে বলে ভেবেছিল তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত থাকতে হবে তাকে, অতএব পুরনো অফিসটি সে দেখাতে পারবে না। ১৭ জুন নিউইয়র্ক টাইমসের নতুন সদর দফতরে বউসহ আমাকে লাঞ্চে আমন্ত্রণ জানালো সে। সানিসাইডের লোয়ারি স্ট্রিট সাবওয়ে স্টেশন থেকে সাত নম্বর ট্রেনে উঠলাম। ট্রেনটি রাউসন স্ট্রিট, কুইন্স প্লাজা, কোর্ট হাউস স্কোয়ার, হান্টার্স পয়েন্ট এভিনিউ, ভারমন বুলভার্ড জ্যাকসন এভিনিউ স্টেশনগুলো পেরিয়ে গ্রান্ড সেন্ট্রাল স্টেশনে থামলে আমরা নামলাম। গত চার দিন এ লাইনে বেশ ক’বার যাতায়াত করলেও মাটি ফুঁড়ে ওপরে উঠলাম ভুল রাস্তায়। থার্ড এভিনিউ। আরো চারটি এভিনিউ পার হয়ে এইটথ এভিনিউ আমার গন্তব্য। দূরত্বটা আমার মতো হাঁটতে অভ্যস্ত লোকের জন্য খুব বেশি না হলেও আমার বউয়ের জন্য দীর্ঘ পথ। সে হাঁটছে, আর আমার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছে ওকে এতটা পথ হাঁটতে বাধ্য করার জন্য। আমি শুধু ওকে দেখাচ্ছি কত বিপুলাকৃতির নারী-পুরুষ হাতে-কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে জোরকদমে হেঁটে যাচ্ছে।
দুপুর সাড়ে বারোটা থেকে ৪১ নম্বর স্ট্রিটের কোনায় দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। পৌঁছলাম পৌনে একটায়। বারবারা বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় পাকা চুলের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়া আঠারো বছর আগে দেখতে যেমন ছিল তেমনি আছে। অতিরিক্ত মেদ জমেনি তার দেহে। হাসিটিও অমলিন। ওর সাথে হাত মিলালাম, গালে গাল স্পর্শ করলাম। আপাদমস্তক ওকে দেখে আমার অনুভূতি ব্যক্ত করলাম। আমার বউকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুমি সামান্য মোটা হয়েছো, মুখটা আগের মতোই আছে। আনোয়ারের চুল পাকা ছাড়া একটুও বদলায়নি সে।’ পাশেই নিউইয়র্ক টাইমসের নির্মীয়মান ৫২ তলাবিশিষ্ট সদর দফতর। সিকিউরিটি চেকআপের পর ‘ভিজিটর’ কার্ড বুকে ঝুলিয়ে বারবারার সাথে লিফটের সামনে দাঁড়ালাম। প্রথমে সপ্তম তলায় ওর অফিসে নিয়ে গেল। ভবনের কেন্দ্রস্থলে ছ’টি বিশালাকৃতির লিফটের জায়গাটুকু ছাড়া পুরো ফ্লোর উন্মুক্ত। এমনকি ভবনের বহিঃপ্রাচীরগুলোও কাচের। অতএব চারদিকে ঝলমলে আলো। ওই ফ্লোরে প্রায় দু-শ’ কিউবিকল। বারবারা আমাকে, আমার বউকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল, প্রফেশনাল গাইডের মতো সব কিছুর বর্ণনা দিচ্ছিল। অনেকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে।
কিছু জিজ্ঞাসা করে জানার প্রয়োজনের চেয়ে আমি হাঁ করে শুধু দেখে যাচ্ছিলাম ১৫৬ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিকের বিশাল সদর দফতরের অভ্যন্তরভাগ। এর আগে একটি বড় সংবাদপত্রের অফিস পরিদর্শনের সুযোগ হয়েছিল বার্লিনে। এক্সেল ¯িপ্রঙ্গার পাবলিশিং হাউসের ‘বার্লিনার মরগেন পোস্ট’-এর অফিস। প্রায় বার্লিন প্রাচীরের পাশ ঘেঁষে ১৮ তলাবিশিষ্ট সেই প্রকাশনা সংস্থা দু’টি দৈনিকসহ মোট আটটি সংবাদপত্র প্রকাশ করে। তাদের বিশাল প্রেস দেখে অবাক হয়েছিলাম। নিজস্ব জাদুঘর দেখে আরো অবাক হয়েছি যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্লিন পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তারা কি করে তাদের নিদর্শনাদি সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। নিউইয়র্ক টাইমসেরও নিজস্ব জাদুঘর আছে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে বলে বারবারা জানালো। কারণ দর্শনীয় জিনিসগুলো নতুন ভবনে গোছানো হয়নি।
অধিকাংশ কিউবিকল শূন্য। বারবারা বলল, ‘সবাই লাঞ্চে গেছে। চৌদ্দতলায় ক্যাফেটেরিয়া। চল আমরাও লাঞ্চ সেরে নেই। পরে বাদবাকি অংশ দেখা যাবে।’ আমরা চৌদ্দতলায় উঠে গেলাম। বুফে লাঞ্চ। অসংখ্য আইটেম, শ’দুয়েক তো হবেই। যার যেটা ইচ্ছা নিচ্ছে। কাউন্টারে দাম চুকিয়ে অথবা কার্ডে পে করে টেবিলে বসছে। এক সাথে তিনশ’ লোক খেতে পারে এমন ডাইনিং হল। স্থান বের করাই কঠিন। হই চই নেই, পরিপাটি। মনে হলো এটি সংবাদপত্রের ক্যাফেটেরিয়া নয়, কোনো ফাইভ স্টার হোটেলের রেস্টুরেন্ট।
২০০৭ সালের মধ্যেই সদর দফতরে নির্মাণকাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হবে এবং ম্যানহাটানভিত্তিক প্রায় তিন হাজার সাংবাদিক-কর্মচারী যারা সাবেক সদর দফতরসহ সাতটি বিভিন্ন ভবনে অফিস করছে তারা এখানে চলে আসবে, যাদের মধ্যে রয়েছে প্রায় চারশ’ রিপোর্টার, পঞ্চাশজন ফটোসাংবাদিক। এ ছাড়া নিউইয়র্কেই আছে আরো কয়েকশ’ ফ্রিল্যান্ড রিপোর্টার যারা মাঝে মাঝে অফিসে আসেন।
ম্যানহাটানের অন্যতম আকর্ষণ বিখ্যাত টাইমস স্কোয়ার। ১৯০৪ সালে নিউইয়র্ক টাইমসের সদর দফতর সেখানে স্থাপিত হওয়ার পরই স্থানটির নামকরণও হয়েছিল পত্রিকাটির নামে। নিউইয়র্কে থার্টিফার্স্ট নাইট অর্থাৎ নিউ ইয়ার্স সেলিব্রেশনের মূল অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয় টাইমস স্কোয়ারেই। নিউইয়র্ক টাইমস কর্তৃপক্ষ তাদের ভবন শীর্ষ থেকে আলোকোজ্জ্বল একটি গোলক নিচে নামিয়ে দেয়ার রীতি প্রচলন করেন, যা প্রত্যক্ষ করার জন্য বছরের শেষ রাতের মধ্য প্রহরে অসংখ্য মানুষ ভিড় করে টাইমস স্কোয়ারে। তের বছর পর নিউইয়র্ক টাইমসের প্রথম সদর দফতরটি ৪২ নম্বর স্ট্রিট থেকে ৪৩ নম্বর স্ট্রিটে স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু আলোকিত গোলক নামানোর রীতি পালনে কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি এতদিন পর্যন্ত। টাইমস তার বর্তমান সদর দফতরে চলে আসার পর এ রীতি অনুসরণে ব্যাঘাত পড়ে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করল বারবারা। কারণ, এখনকার ভবনের সামনে খোলা চত্বর নেই।
নিউইয়র্ক টাইমস প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। উদ্যোক্তারা শুরু থেকেই দৈনিকটির লক্ষ্য স্থির করেছিলেন যে, তারা কোনো ধরনের রগরগে বা অতি সংবেদনশীল সংবাদ প্রকাশকে উৎসাহিত করবেন না। আজকের এই বিখ্যাত দৈনিকটির প্রথম নাম ছিল ঘব-িণড়ৎশ উধরষু ঞরসবং। ১৮৫৭ সালে নামটিতে পরিবর্তন এনে 'ঞযব' যোগ করে 'উধরষু' শব্দটি বাদ দেয়া হয়। নিউ ও ইয়র্কের মাঝখানে যে হাইফেন ছিল সেটি উঠে যায় ১৮৯৬ সালে।
১৮৬৯ সালে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিষ্ঠাতা হেনরি জে রেমন্ডের মৃত্যুর পর প্রকাশক জর্জ জোনস এর হাল ধরেন। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রথম পঁচিশ বছরে নিউইয়র্ক টাইমস তার প্রতিদ্বন্দ্বী নিউইয়র্ক ট্রিবিউন, নিউইয়র্ক সান ও নিউইয়র্ক হেরাল্ডের সাথে মানগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে সমকক্ষতা অর্জন করতে না পারলেও নির্ভরযোগ্য দৈনিক হিসেবে রিপাবলিকান পাঠক মহলে সমাদৃত হয়েছিল। জর্জ জোনস ১৮৯১ সালে মৃত্যুবরণ করলে নিউইয়র্ক টাইমসের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এর ত্রাণকর্তা হিসেবে এগিয়ে আসেন ঈযধঃঃধমড়ড়হধ ঞরসবং-এর আটত্রিশ বছর বয়স্ক প্রকাশক এডলফ এস ওকস। ১৮৯৬ সালে ওকস বিত্তবান ডেমোক্র্যাটদের আর্থিক সহায়তা নিয়ে ৭৫ হাজার ডলারে কিনে নেন নিউইয়র্ক টাইমস এবং পত্রিকাটি ডেমোক্র্যাট লাইনে চলে যায়। এর আগে ১৮৮৪ সালে পত্রিকাটি প্রথমবার পার্টি লাইন পরিবর্তন করেছিল। এডলফ ওকস পাঠকদের প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি সব ভয়ভীতি ও আনুকূল্যের ঊর্ধ্বে থেকে নিরপেক্ষভাবে সংবাদ পরিবেশন করবেন। তার এ প্রতিশ্রুতি নিউইয়র্ক টাইমসের প্রথম পৃষ্ঠায় মুদ্রিত থাকত, 'অষষ ঃযব ঘবংি ঞযধঃ'ং ঋরঃ ঃড় ঢ়ৎরহঃ.'
ওকস-এর ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ছিল সহজÑ মান বৃদ্ধির পেছনে ব্যয় করলে মুনাফা অর্জন নিশ্চিত। নিউইয়র্ক টাইমস তার ব্যবস্থাপনায় আসার পর প্রথম পঁচিশ বছরে মুনাফার ৯৭ শতাংশই তিনি ব্যয় করেন এর উন্নয়নে। তার জামাতা ও উত্তরাধিকারী আর্থার হেস শুলজবার্জার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বিজ্ঞাপনের পরিমাণ সীমিত করে অগ্রাধিকার দেন সংবাদ প্রকাশের ওপর। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বশক্তিতে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি নিউইয়র্ক টাইমসের সমৃদ্ধিও আর থেমে থাকেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে তথ্যের যথার্থতা ও বস্তুনিষ্ঠতার কারণে অন্য সব প্রতিদ্বন্দ্বী দৈনিককে পেছনে ফেলে নিউইয়র্ক টাইমস এগিয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের প্রশাসন নিউইয়র্ক টাইমসকে আস্থায় নিয়েছিল বলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে স্পর্শকাতর অনেক তথ্য এড়িয়ে গেছে পত্রিকাটি। জাপানে যে আণবিক বোমা ফেলা হবে সে তথ্য জানতেন নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টার উইলিয়াম এল লরেন্স। কিন্তু এত বড় স্কুপ নিউজ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি।
স্নায়ুযুদ্ধের সময়েও মার্কিন প্রশাসনের সাথে নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পর্ক ছিল নিবিড়। কেনেডি প্রশাসনও টাইমসের সম্পাদককে অনুরোধ জানিয়েছিল কিউবার বে অফ পিগস-এ ১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে স্থগিত অবরোধ সম্পর্কে যতটা জানে তার চেয়ে কম রিপোর্ট করতে। দু’বছর পর তিনি পত্রিকার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে আবারো অনুরোধ জানান ভিয়েতনামে মার্কিন হস্তক্ষেপ সম্পর্কে নমনীয় কাভারেজ দিতে। কিন্তু নিউইয়র্ক টাইমস ভিয়েতনাম যুদ্ধের তীব্র সমালোচকে পরিণত হয় এবং যুদ্ধ সংক্রান্ত ‘পেন্টাগন পেপারস’ প্রকাশ করতে শুরু করে। ভিয়েতনাম যুদ্ধ সম্পর্কিত এসব গোপন দলিল প্রকাশ পত্রিকাটির ভবিষ্যৎকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল যতক্ষণ পর্যন্ত না সুপ্রিমকোর্ট রিপোর্টগুলোর যথার্থতার পক্ষে রায় দিতে পত্রিকাকে নির্দোষ সাব্যস্ত করে।
দি নিউইয়র্ক টাইমস কোম্পানির মালিকানাধীন নিউইয়র্ক টাইমস বিশ্বের সংবাদপত্র শিল্পে বিশাল এক সাম্রাজ্য। বর্তমানে ৪৪টি শহর থেকে যুগপৎ প্রকাশিত হয় নিউইয়র্ক টাইমস। নিউইয়র্ক অঞ্চলে এর ১৬টি ব্যুরো অফিস রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে ১১টি ন্যাশনাল ব্যুরো ও ২৬টি বিদেশী ব্যুরো। টাইমস কোম্পানি নিউইয়র্ক টাইমস ছাড়াও আরো ১৫টি সংবাদপত্র প্রকাশ করে, যার অন্যতম হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন ও বোস্টন গ্লোব। এ পর্যন্ত নিউইয়র্ক টাইমসের ৯৫ জন সাংবাদিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্যাটাগরিতে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের আর কোনো দৈনিক সংবাদপত্রে এত অধিকসংখ্যক পুলিৎজার বিজয়ী নেই।
নিউইয়র্ক টাইমসের ইতিহাস ঘেঁটে আরো জানা গেল যে, পত্রিকাটি প্রথমে রোববার ছাড়া সপ্তাহে ছয় দিন প্রকাশিত হতো। কিন্তু আমেরিকান গৃহযুদ্ধের সময় থেকে অন্যান্য প্রধান দৈনিকের সাথে এটি রোববারেও প্রকাশিত হতে থাকে।
নিউইয়র্ক টাইমস প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে প্রথম পাঁচ দশক পর্যন্ত সংবাদ সংগ্রহ ও সংবাদপত্র বিতরণে সনাতন পদ্ধতিই অনুসৃত হয়েছে। ১৯০৪ সালে পীত সাগরে (ণবষষড়ি ঝবধ) রুশ-জাপান যুদ্ধের সময় পোর্ট আর্থারে রুশ নৌবহর ধ্বংস সংক্রান্ত খবরটি ছিল ওয়্যারলেসপ্রাপ্ত নিউইয়র্ক টাইমসের প্রথম সংবাদ। ১৯১০ সালে বিমানযোগে টাইমস সর্বপ্রথম পাঠানো হয় ফিলাডেলফিয়ায়। বিমানযোগে প্রথম ট্রান্স-আটলান্টিক ডেলিভারি দেয়া হয় ১৯১৯ সালে লন্ডনে। ১৯২০ সালে ভোর চারটায় ‘বিমান সংস্করণ’ ছেপে পাঠানো শুরু হয় শিকাগোতে। নিউইয়র্ক টাইমস ১৯৪৬ সালে একটি আন্তর্জাতিক সংস্করণ প্রকাশ শুরু করে, কিন্তু ১৯৬৭ সালে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে নিউইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবিউন ও ওয়াশিংটন পোস্টের সাথে যোগ দিয়ে প্যারিস থেকে প্রকাশ শুরু করে ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন।
নিউইয়র্ক টাইমস কর্তৃপক্ষের দাবি অনুসারে বর্তমানে পত্রিকাটির দৈনিক সার্কুলেশন প্রায় ১১ লাখ এবং রোববারের সংখ্যা ১৬ লাখের অধিক। প্রতিদিনের সংখ্যার মূল্য এক ডলার হলেও রোববারের সংখ্যার মূল্য সাড়ে তিন ডলার। কোনো কোনো রোববারে ও বিশেষ সংখ্যা পাঁচ ডলার পর্যন্ত মূল্য নির্ধারিত থাকে। ইন্টারনেট প্রযুক্তি চালু হওয়ায় উন্নত বিশ্বের সব সংবাদপত্রের মতো নিউইয়র্ক টাইমসের সার্কুলেশনও হ্রাস পাচ্ছে। ২০০৬ সালে ঘণঞরসবং.পড়স ওয়েবসাইটে ভিজিটর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৬ লাখ।
আমেরিকার বিখ্যাত সংবাদপত্র মালিক পরিবারগুলোর অন্যতম নিউইয়র্ক টাইমসের মালিক ওকস শুলজবার্জার পরিবার ১৯৬০-এর দশকে দি নিউইয়র্ক টাইমস কোম্পানিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত করলেও ভোটাধিকারের ক্ষমতা প্রয়োগকারী ‘বি’ শ্রেণীভুক্ত ৮৮ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা তাদের হাতেই রয়েছে। ভোটাধিকারবিহীন ‘এ’ শ্রেণীভুক্ত ১৯ শতাংশ শেয়ারের মালিকও তারাই। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে আট পরিচালকের মধ্যে ছয় জনের সম্মতির প্রয়োজন পড়ে।
নিউইয়র্ক টাইমসের সদর দফতর স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত যে হুট করেই নেয়া হয়েছে তা নয়। দীর্ঘ পরিকল্পনার ফল বর্তমান সদর দফতর। এক দশকেরও আগে স্থান নির্ধারণ করে এর নকশা তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্থপতি বেনজো পিয়ানোকে। তিনি ফক্স অ্যান্ড ফাউলে আর্কিটেক্টস নামে একটি স্থাপত্য প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় ১৯৯৮ সালে ৫২ তলাবিশিষ্ট গ্লাস টাওয়ারের নকশা তৈরির কাজ সম্পন্ন করেন। রেনজো পিয়ানোর অনেক কাজের মধ্যে প্যারিসের সেন্টার জর্জ পম্পিডো, ওসাকার কানসাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট ও বার্লিনের পোস্টডেমার প্লাটজের নকশা বিখ্যাত। নিউইয়র্ক টাইমসের সদর দফতরকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী আলোকিত একটি অট্টালিকা হিসেবে নির্মাণের চিন্তা প্রথম থেকেই ছিল পরিকল্পনাবিদদের মাথায়। ২০০৩ সালে নিউইয়র্ক টাইমস কোম্পানির একটি প্রতিনিধিদল ও নকশা প্রস্তুতকারক এবং প্রকৌশল ঠিকাদাররা বার্কেলির এনভায়রনমেন্টাল এনার্জি টেকনোলজিস ডিভিশনের ল্যাবরেটরি পরিদর্শন করে ভবনটিকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী, আরামদায়ক ও কাজের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী করে নির্মাণের ব্যাপারে আলোচনা করেন এবং বিষয়টি নিয়ে যৌথভাবে গবেষণা চালিয়ে নিশ্চিত হন যে, দিনের বেলায় খুব বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার না করেও পর্যাপ্ত আলো পাওয়া যাবে এবং সে জন্য প্রয়োজন পড়বে ভবনটিতে সংযোজিত সব ব্যবস্থার মধ্যে সর্বোচ্চ সমন্বয়।
বার্কেলির গবেষণাগারে প্রমাণিত হয়েছে যে, দিনের আলো যথাযথভাবে ব্যবহার করে আলোর জন্য বিদ্যুৎ ব্যবহার হ্রাস হবে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত এবং তাতে পুরো ভবনের জন্য বিদ্যুৎ ব্যবহার হ্রাস পাবে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত। এ ছাড়া শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ও উষ্ণতা বজায় রাখার জন্য যেসব সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হয় তার ওজনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পাবে।
নিউইয়র্ক সিটির নাগরিক জীবনের কর্মকাণ্ড অর্থাৎ সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে নগরবাসীর যোগসূত্র বজায় রাখার জন্য নিচতলায় একটি মিলনায়তন রয়েছে। বেসমেন্ট অর্থাৎ ভূগর্ভস্থ দু’টি ফ্লোরে বসানো হয়েছে অত্যাধুনিক প্রেস, টাইমসের সাবেক সদর দফতরে প্রেস ছিল না। পত্রিকা ছাপার কাজ হতো অন্যত্র। দ্বিতীয় তলা থেকে সপ্তম তলা পর্যন্ত বার্তা কক্ষ।
বারবারা আয়ারল্যান্ড নিউইয়র্ক টাইমসের মতো একটি দৈনিকের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরে অত্যন্ত গর্বিত। ষাটোর্ধ্ব বয়সী বারবারা পেশা জীবনের প্রায় পুরোটাই কাটিয়েছে ছোট শহর বাফেলোর আঞ্চলিক সংবাদপত্রে কাজ করে। এ সুযোগটা হঠাৎ করেই এসেছিল এবং সে লুফে নিয়েছে। প্রতি চার বছর অন্তর স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে আমাদের ফেলোশিপ প্রোগ্রামের সাবেক ফেলোদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠিত হয়। ২০০১ সালের পুনর্মিলনীতে বারবারা যোগ দিয়েছিল। সে বছরের মূল বক্তা ছিলেন নিউইয়র্ক টাইমসের নির্বাহী সম্পাদক হাওয়েল রেইনস (ঐড়বিষষ জধরহবং)। সেখানেই বারবারার সাথে আলাপ হয় হাওয়েলয়ের এবং তিনি তাকে নিউইয়র্ক টাইমসে যোগ দেয়ার অফার দেন। বাফেলো নিউইয়র্ক সিটি থেকে দু-শ’ মাইল দূরে। সেখান থেকে সংসার গুটিয়ে চলে আসে বারবারা। এখন লং আইল্যান্ডে থাকে। ট্রেন বা বাসে অফিসে যেতে-আসতে এক ঘণ্টার পথ। বারবারা খুব খুশি যে এখন তাকে আর ছোটাছুটির কাজ করতে হয় না। অফিসে বসেই পেজ এডিটিংয়ের কাজ তার। তবে তার কষ্ট যে, তার নিয়োগকর্তা হাওয়েল রেনস আর নিউইয়র্ক টাইমসে নেই। জনৈক রিপোর্টারের কয়েক বছরব্যাপী চালিয়ে যাওয়া প্রতারণার দায় মাথায় নিয়ে ২০০৩ সালে হাওয়েল পদত্যাগ করেন। পত্রিকাটি স্বীকার করে যে, তাদের রিপোর্টার জেসন ব্লেয়ার বেশ ক’বছর ধরে রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে প্রতারণার আশ্রয় নেয়ায় অন্যান্য সাংবাদিকের সাধারণ পেশাদারিত্বও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। প্রতারণার ঘটনা প্রমাণিত হওয়ায় জেসন ব্লেয়ার পদত্যাগ করেন। পাশাপাশি প্রশ্ন ওঠে সাংবাদিকতায় দায়দায়িত্ব স্বীকারের। সে দায় মাথায় নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের নির্বাহী সম্পাদক হাওয়েল রেনস ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক জেরাল্ড এম বয়েড এক সাথে পদত্যাগ করেন।
লাঞ্চ সেরে আমরা আরো কয়েকটি বিভাগ ঘুরে দেখি। এরপর পারিবারিক প্রসঙ্গে ফিরে আসি আমরা। আমার মেয়ের বিয়ে হয়েছে, ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে শুনে বারবারা অবাক হয়। স্ট্যামফোর্ডে থাকতে আমার ছেলের বয়স ছিল দু’বছর। সারাক্ষণ ওর দৌড়াদৌড়ি করার কথা মনে আছে বারবারার। সে বলে, ‘আমিও গ্রান্ডমা হয়েছি। আমার মেয়ের দু’টি ছেলেমেয়ে হয়েছে, আর ছেলের ঘরেও এক নাতি আছে।’ ওর স্বামী কোরিডন কেমন আছে জানতে চাই। হেসে ফেলে সে, ‘কোরিডন, আর আমার স্বামী নেই। আবার বিয়ে করেছি আমি।’ কোরিডনের সাথে পরিচয় হয়েছিল। বারবারার দ্বিতীয় স্বামী ছিলেন ভদ্রলোক। বয়সে বারবারার চেয়ে বেশ ক’বছরের ছোট ছিল। বারবারার দুই সন্তান ছিল প্রথম স্বামী থেকে। কোরিডন নিজেও ফ্রিল্যান্ড সাংবাদিক ছিলেন। আমার সাথে খুব জমতো তার। কিছুটা আহত হলাম। আমার বউ বিচ্ছেদের কারণ জানতে চাইলে সে বলে, ‘সে আরেক মহিলার সাথে থাকতে শুরু করেছিল। অতএব, ডিভোর্স ছাড়া উপায় ছিল না।’ বর্তমান স্বামীর ভূয়সী প্রশংসা করে সে। লোকটি ভিয়েতনামে যুদ্ধ করেছে। এখন কোনো কাজ করে না। বই পড়া আর বাগান করার শখ তার। আমাদের তার লং আইল্যান্ডের বাড়িতে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাল। পরবর্তী শনিবার বারবারা তার স্বামীসহ এসে নিয়ে যাবে আমাদের। শনিবার ও রোববার ওর বাসায় কাটিয়ে সোমবার চলে আসত। এর মাঝে আমরা ওয়াশিংটন ডিসিতে যাব। জন হেনরি আমাদের যেতে বলেছে। পথে পড়বে বাল্টিমোর। সেখানে যদি ওয়েস্টনডিকের সাথে সাক্ষাৎ হয় তাহলে ভালো। তা না হলে ফোনেই আলাপ সেরে নিতে হবে।
বারবারার সাথে আবার দেখা হচ্ছে পরবর্তী সপ্তাহে। ওর দিনের অসমাপ্ত কাজ সাড়ার জন্য বিদায় নিয়ে লিফটের সামনে দাঁড়ালাম। ভবনের বাইরে বের হয়ে এসে আবার তাকিয়ে দেখলাম সুউচ্চ টাইমস ভবন।
0 comments:
Post a Comment