ভারতের মাওবাদী গেরিলা তৎপরতার কথা আজকাল সবাই জানে। যা জানে না তা হলো, এই কর্মকাণ্ডের পেছনের কথা। কী সেই কথা জানাতে লিখেছেন সত্যপ্রকাশ রায়
ভারতে সাধারণভাবে ওদের পরিচয় নকশালী বা নকশালবাদী নামে। ওরা নিজেদের বলে মাওবাদ
ী। কমিউনিস্ট চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সে তুং (এখন মাও জে দং)-এর অনুসারী দাবিদার ওরা। সংবাদপত্র খুললেই প্রায় প্রতিদিন ভারতে কয়েকটি রাজ্যে ওদের তৎপরতার খবর চোখে পড়বেই। হয় সরকারি বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ, নয়তো ‘প্রতিবিপ্লবী’ কাউকে হত্যা এ-ই যেন নিত্যনৈমিত্তিক কর্মকাণ্ড মাওবাদীদের।
অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। মাও মারা গেছেন কত আগে। তারপর তার নীতি থেকে অনেক দূর সরে গিয়ে এখন প্রায় মুক্তবাজার অর্থনীতি চালুই করে দিয়েছে চীন। দেশটির গায়ে এখন কমিউনিজমের খোলসটাই আছে শুধু, বাকি সবই পুঁজিবাদের।
নিজ দেশেই যখন মাওতন্ত্রের এই দুর্দশা, তখন মাওবাদী পরিচয় নিয়ে ওরা কারা, ওরা কী করছে ভারতের খনিজ সম্পদসমৃদ্ধ কয়েকটি রাজ্যে?
ওরা কারা এক কথায় আসলে বোঝানো যাবে না। ওরা থাকে গহিন জঙ্গলে, ওদের হাতে আধুনিক অস্ত্র। ওদের সাদা চোখে চেনা যায় না। নাম শুনেও বলা যায় না কোনটা কে। কারণ ওদের নানা নাম, নানা পরিচয়। এই যেমন ধরুন মানসের কথা। ২৭ বছর বয়সী এই যুবক মাওবাদী গেরিলাদের একটি জোনের কমান্ডার। তাকে কেউ চেনে প্রশান্ত নামে, কেউবা পরমজিৎ। কখনো আবার গোপালজী। তাকে ধরার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে থাকা ভারতীয় সরকারি বাহিনীর চোখে ধুলো দিতেই এত নাম।
তবে সরকারি বাহিনী খুঁজে না পেলেও দেশী-বিদেশী সাংবাদিকেরা ঠিকই তাদের কাউকে কাউকে খুঁজে বের করে ফেলেন। সাক্ষাৎকার নেন এবং তাদের সাথে দিনকয় কাটিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড দেখেন। মার্কিন সাংবাদিক অ্যান্টনি লয়ডও সেভাবে কমান্ডার মানসের সাক্ষাৎ পান। তিনি সেই সাক্ষাতের বর্ণনা দিয়ে করা প্রতিবেদনে লিখেছেন, সময়টা ছিল সন্ধ্যার ঠিক পূর্বমুহূর্ত। চার দিকে ছোপ ছোপ অন্ধকার। আমরা একটি বড়সড় আখরোট গাছের নিচে অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো রোগাভোগা একজন মানুষ। হাতে মেশিনগান। আবছা অন্ধকারে কথা বলতে বলতে যতটুকু দেখা গেল, জীর্ণশীর্ণ শরীর। বোঝাই যায়, জঙ্গলে থেকে থেকে ম্যালেরিয়া ও টাইফয়েডে ভুগে কাহিল মানুষটি।
তবে শরীর যত শীর্ণই হোক, মানুষটির মনোবল অতি উচ্চে। বললেন, গরিব মানুষের প্রতি সমাজের এই অন্যায়-অবিচারই এক দিন আমাদের বিজয় এনে দেবে। দিল্লির সরকার এক দিন উৎখাত হবেই। এটা অনিবার্য। কেউ একে ঠেকাতে পারবে না।
মানস যখন আমার সাথে কথা বলছিলেন তখন তার চোখ দু’টি বিপ্লবের কাক্সক্ষায় জ্বলজ্বল করছিল। তিনি বলছিলেন, ‘একটি বয়স্ক বাঘ বুড়ো হয়, তারপর মারা যায়। ঠিক তেমনিভাবে যে সরকারটিকে উৎখাতের জন্য আমরা লড়াই করছি, সেটিও ভেতর থেকে ক্ষয়ে যাচ্ছে। এখন তার মরার অপেক্ষামাত্র। অপর দিকে আমাদের বিপ্লব এখনো তরুণ। এর বিকাশ হবেই। এটা পৃথিবীর নিয়ম। পুরনো ধারার রাজনীতিক এবং একটি নতুন সমাজব্যবস্থার মধ্যে চলছে লড়াই। জনগণই এ লড়াই করছে। জনতার জয় অবশ্যম্ভাবী।’
মাওবাদীদের টহল
সূর্য অস্ত না যাওয়া পর্যন্ত কমান্ডার মানস কথা বলেন ওই বিদেশী সাংবাদিকের সাথে। অন্ধকার ঘন হয়ে আসতেই তিনি তার দলবল নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যান। সরকারি বাহিনী ক্রমেই কাছে আসছিল। তাদের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ার আগেই তারা দূরে সরে যায়।
সাংবাদিক অ্যান্টনি লয়ড এর পরেরবার যখন মানসকে দেখেন, মানস তখন মৃত। তার দীনহীন গ্রামের রাস্তার পাশে একটি মন্দিরে শেষকৃত্যের জন্য রাখা ছিল তার মৃতদেহ। গ্রামবাসী তাকে জানান, তাদের সাক্ষাতের অল্পক্ষণ পরই সরকারি বাহিনীর সাথে লড়াইয়ে নিহত হন মানস। তার সমাধিফলক থেকে সাংবাদিক লয়ড জানতে পারেন অনেক নামের এই গেরিলা কমান্ডারের আসল নামটি : লালেশ।
কোথায় লড়াই, কেন লড়াই
ভারতের জ্বালানি চাহিদা প্রতিদিনই বাড়ছে। বাড়ছে কাঁচামালের জন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষুধা। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন তথা মাটির তলা থেকে কয়লা, ইস্পাতসহ যা কিছু খনিজসম্পদ আছে, তা তুলে আনার জন্য দেশটি পাগলপারা হয়ে গেছে। আর এখান থেকেই মাওবাদী বিদ্রোহ পেয়েছে অনুপ্রেরণা। এক দিকে খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ রাজ্যগুলোর দারিদ্র্য, তার সম্পদ বণ্টনে বৈষম্য, খনিজসম্পদ আহরণ করতে গিয়ে আদিবাসী বা অনুন্নত জাতিগোষ্ঠীগুলোর বাসস্থান উচ্ছেদ এবং তাদের চিরায়ত সংস্কৃতি ধ্বংস, অন্য দিকে খনি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নানা উপায়ে চাঁদা সংগ্রহের সুযোগ মাওবাদী গেরিলাদের বিদ্রোহের আগুনে ঘি ঢালার কাজটি ভালোভাবেই সম্পন্ন করছে।
এটাই স্বাভাবিক। আগেই বলা হয়েছে, প্রধানত খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ রাজ্যগুলোতেই মাওবাদী তৎপরতা বেশি। এর মধ্যে রয়েছে ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং সংলগ্ন আরো কয়েকটি রাজ্য। তবে মাওবাদী তৎপরতার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ঝাড়খন্ড ও ছত্তিশগড়। খনিজসম্পদের দিক থেকে ভারতের সবচেয়ে ধনী রাজ্য হচ্ছে এ দু’টি। ভারতের মজুদ কয়লার ৪০ শতাংশের বেশি রয়েছে এ দুই রাজ্যে। এ ছাড়া এখানকার মাটির নিচে রয়েছে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের লৌহ আকরিক, চুনাপাথর, ডলোমাইট ও বক্সাইটের মজুদ। এখানকার কয়লা দিয়ে চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয় ভারতের দূর-দূরান্তের বহু নগর। এখানকার ইস্পাতে অন্যত্র তৈরি হয় আধুনিক ভবন, ঝলমলে টেক-কমপ্লেক্স, যানবাহন, ইঞ্জিনিয়ারিং প্রজেক্ট।
অথচ এই দু’টি রাজ্য ভারতের দরিদ্রতম রাজ্যগুলোর অন্যতম। ২০১০ সালে জাতিসঙ্ঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ভারতের দারিদ্র্য বিষয়ে এক ব্যাপকভিত্তিক জরিপ চালায়। এতে দেখা যায়, ঝাড়খন্ড ও ছত্তিশগড়সহ ভারতের আটটি রাজ্যের গরিব মানুষের সংখ্যা আফ্রিকার ২৬টি হতদরিদ্র দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেশি।
ধনী-দরিদ্র বৈষম্য ছাড়াও খনিজসম্পদ আরো নানা সমস্যা সৃষ্টি করেছে। যেমন বিভক্তি, পরিবেশ দূষণ, সহিংসতা এবং কেবল জমিজমার ওপর নির্ভরশীল মানুষের বাস্তুচ্যুতি। কথা ছিল, খনির কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষগুলোর ক্ষতি পুষিয়ে দেয়া হবে চাকরি দিয়ে, নগদ অর্থ দিয়ে এবং নতুন বসতি ও বসতবাড়ির ব্যবস্থা করে। এদের অনেকে নগদ অর্থের বিনিময়ে খনি কর্তৃপক্ষকে তাদের জায়গা দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যেসব মানুষ অবিচ্ছেদ্যভাবে জমির ওপর নির্ভরশীল, নগদ অর্থের প্রলোভন তাদের টানেনি। তারা যখন চোখের সামনে দেখেছে তাদের আবাদি জমি ও বাড়িঘর চলে গেছে খনির আওতায়, তারা মানতে পারেনি।
হেন্দা গ্রামের এক তরুণ বলেন, ‘আমাদের গ্রামের ৭৫ শতাংশ লোকই খনি কোম্পানিকে জমি দিতে চায়নি। খনি কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে জমির বদলে টাকা দিতে চেয়েছে। আর বলেছে কয়লাখনিতে চাকরি দেবে। কিন্তু এটাই কি যথেষ্ট? টাকা খরচ হয়ে যায়, চাকরির মেয়াদও এক দিন শেষ হয়। তারপর? আর দেখুন না, বলেছে প্রতি দুই একর জমির জন্য একজন চাকরি পাবে। এখানে এমন পরিবারও আছে, যার সদস্যসংখ্যা ৯ জন, জমি আছে ১০ একর। তখন? তাই আমরা জমি দিচ্ছি না।’
খনি কোম্পানিকে জমি দেয়া নিয়ে অনেক গ্রামে মানুষ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। অনেকে জমি দিয়ে দিয়েছে এবং অন্যদেরও দিতে প্ররোচিত করছে। অনেকে আবার জমি ছাড়তে নারাজ। মাওবাদীরা এর সুযোগ নিয়েছে। তারা দেয়ালে পোস্টার সেঁটেছে : ‘আমাদের জমি নাও, তোমাদের মাথা আমাদের দাও।’
খনিজসম্পদ আহরণের কারণে এভাবে সুবিধাবঞ্চিত ও দারিদ্র্যপীড়িত আদিবাসীরা বাস্তুচ্যুত হলে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় তাকে কৌশলে কাজে লাগায় মাওবাদী গেরিলারা। কিন্তু পাশাপাশি এ-ও সত্য, তারা কিন্তু খনিজসম্পদ আহরণের বিরোধী নয়। সাংবাদিক অ্যান্টনি লয়ড মাওবাদী কমান্ডার মানসের কাছে জানতে চাইছিলেন ঠিক এ কথাটাই : ‘মাওবাদীদের মাইনিং পলিসি কী হবে?’ জবাব দিতে গিয়ে অনেক দোনোমোনো করেন কমরেড মানস। শেষে বলেন, কোথাও খনির কাজ শুরু হয়েছে জানতে পেলেই মাওবাদী ইউনিটগুলো যে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তা নয়, বরং তারা জানতে চায় : পার্টিকে কত টাকা দেবে ওরা?
অন্য সব গেরিলা দলের মতো মাওবাদী গেরিলাদেরও টিকে থাকার জন্য চাই বিপুল অর্থ। কাজেই তারা এ প্রশ্ন করবে এটাই স্বাভাবিক। ফলে খনি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে চাঁদা নেয়াটা মাওবাদীদের জন্য নিয়মিত ঘটনা হয়ে গেছে। তারা আগে টেন্ডু পাতার (যে পাতা দিয়ে বিড়ি তৈরি করা হয়) ওপর, এমনকি ধনী কৃষকদের ওপরও ‘ট্যাক্স’ বসাত। তা থেকে যে আয় হতো, খনির আয় তার সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে।
ভারতের পূর্ববর্তী কংগ্রস সরকারের সাবেক মন্ত্রী জয়রাম রমেশ এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে কড়া অবস্থান নিয়ে খোলামেলা ভাষায় বলেছেন, ‘ভারতের অনেক জায়গায় মাওবাদীরা এখন আদর্শ দিয়ে চালিত হয় না, চালিত হয় চাঁদা দিয়ে।’ তিনি মাওবাদী তৎপরতা ও খনি শিল্পের সম্পর্ক নিয়ে এতটাই দ্বিধাহীন ছিলেন যে, গেরিলা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে সব খনি এক বছরের জন্য বন্ধ রাখার প্রকাশ্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তার মতে, খনি থেকে চাঁদা না পেলে মাওবাদী গেরিলারা এমনিতেই থেমে যাবে। তার ভাষায়, ‘যেখানে খনি আছে সেখানেই মাওবাদী গেরিলা গজিয়ে উঠছে। কারণ যত খনি তত টাকা, যত টাকা তত চাঁদা।’ তিনি আরো বলেন, ‘ভারতের বেশ কিছু বিখ্যাত কোম্পানি মাওবাদীদের চাঁদা দিয়ে ওসব এলাকায় খনি ব্যবসা করছে। আমি কারো নাম বলতে চাই না। তবে ওসব কোম্পানির অনেকগুলোই বেশ বিখ্যাত।
শুধু কি চাঁদাবাজি, মাওবাদী গেরিলারা নিজেরা ব্যবসাও করছে। ঝাড়খন্ডের একটি কোক কয়লা প্ল্যান্টের কথাই ধরা যাক। লাইসেন্সবিহীন এ প্ল্যান্টটি গেরিলাদের। গেরিলা তৎপরতার পাশাপাশি এটির চালানোর দায়িত্বে আছেন কমরেড রণজিত। ঝাড়খন্ডের থার্মাল পাওয়ার স্টেশনের কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত এ প্ল্যান্টটি চালানো হয় সম্পূর্ণ পেশাদারি ভিত্তিতে। এর সব কর্মী মাওবাদী। এটি চলে চোরাই কয়লা দিয়ে। স্থানীয় লোকজন কাছের খনিগুলো থেকে কয়লা চুরি করে এখানে বিক্রি করে। এ প্ল্যান্টের লাভের ভাগ পায় পুলিশের কর্তারা। কমরেড রনজিত জানান, প্ল্যান্টের ধারেকাছে না আসার জন্য পুলিশ কর্তাদের প্রতি মাসে প্রায় এক লাখ রুপির মতো দেয়া হয়। কয়লাবাহী বৈধ ট্রাকবহরের ভেতরে মাওবাদীদের ২৫ টন কয়লাবাহী ট্রাক ঢুকিয়ে দেয়ার জাল কাগজপত্র বানিয়ে দেন যেসব সরকারি কর্মকর্তা তাদেরও অনেক টাকা দিতে হয়। সব খরচ বাদ দিয়ে মাওবাদীদের দৈনিক মুনাফা থাকে এক হাজার ডলারের মতো। কমরেড তাই মৃদু হেসে বলেন, মাইনাররা (খনি কর্তৃপক্ষ) আমাদের শত্রু নন।
অবৈধ কোক কয়লা প্ল্যান্ট ও কয়লাখনি থেকে যে হাজার ডলার আয়ের কথা বলা হলো, মাওবাদীদের আয় তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। যেমন শীর্ষস্থানীয় খনি কর্তৃপক্ষগুলো তাদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য মাওবাদীদের প্রতি বছর বিপুল অর্থ দিয়ে থাকে, সাবেক মন্ত্রী জারাম রমেশের ভাষায় যার পরিমাণ ‘লাখ লাখ ডলার।’
সব মিলিয়ে মাওবাদী গেরিলাদের আদর্শ মাওবাদ এখন জাদুঘরে চলে গেছে, তারা এখন মোটা তহবিল পাওয়া মিত্র গেরিলা দল, যারা এমনকি ইউরোপীয় অর্থনীতির সাথেও কোনো না কোনোভাবে যুক্ত। মাওবাদী অতীতের চেয়ে বৈশ্বিক বর্তমানের চেহারা নিয়েই তারা এখন দৃশ্যমান যদিও তারা থাকে জঙ্গলে।
গহিন জঙ্গল মাওবাদীদের দেয় সুরক্ষা, খনি শিল্প দেয় অর্থ সরকারের ভূমি হুকুমদখল ও তজ্জনিত বাস্তুচ্যুতি দেয় বিপুলসংখ্যক গেরিলার জোগান। এই গেরিলার দল সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মাওবাদের নামে, মাওবাদী পরিচয়ে।
ভূমি হুকুমদখল বিষয়টির ওপর এখানে একটু আলোকপাত করা যাক। ১৮৯৪ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার ‘ভূমি হুকুমদখল আইন’ করে। এ আইনবলে সরকার নামেমাত্র ক্ষতিপূরণ দিয়ে রাস্তা, রেলপথ, খনি ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য যেকোনো জমি হুকুমদখল করতে পারে। সেই আইনে ভারতের স্বাধীনতা লাভ করার আগ পর্যন্ত আনুমানিক ছয় কোটি ভারতীয় বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যাদের দুই কোটি ৪০ লাখ আদিবাসী (২০১৪ সালে অবশ্য আইনটি সংশোধন করা হয়েছে)।
ব্রিটিশদের প্রণীত আইনটির সবচেয়ে বড় শিকার বনেজঙ্গলে বসবাসকারী আদিবাসী বা উপজাতিরা। তাদের বেশির ভাগেই বাস্তুচ্যুত হতে হয়, কিন্তু যথাযথভাবে পুনর্বাসন করা হয় না। অথচ ভারতের কয়লা মজুদের ৯০ শতাংশ, খনিজসম্পদের ৫০ শতাংশের বেশি এবং জনবিদ্যুৎ প্রকল্পের উপযুক্ত স্থানের বেশির ভাগই আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় অবস্থিত। আদিম পশুশিকারি সমাজের চাহিদা এবং উপযুক্ত অবকাঠামোর জন্য তৃষ্ণার্ত ও দ্রুত বর্ধনশীল শিল্প অর্থনীতির মধ্যে এ অবস্থাটি বিভেদরেখা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কী করছে মাওবাদীরা
এই বিভেদরেখার ওপর দাঁড়িয়ে মাওবাদীরা খনি মালিকদের কাছ থেকে চাঁদা নিচ্ছে, সরকারের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহ’ করছে, আদিবাসীদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে, দলে ভেড়াচ্ছে সাধারণ মধ্যবিত্ত তরুণদের। তারা আস্তানা গেড়েছে প্রধানত ছত্তিশগড় ও অন্ধ্রপ্রদেশসহ কয়েকটি রাজ্যের সংযোগস্থল দণ্ডকারণ্যে। ৩৫ হাজার ৬০০ বর্গমাইল আয়তনের এ বনভূমিটি পাহাড় এবং নানা গাছলতাগুল্মে আবৃত ও আক্ষরিক অর্থেই দুর্গম।
১৯৮৯ সালে অন্ধ্রপ্রদেশে সরকারি বাহিনীর তাড়া খেয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একদল কমিউনিস্ট প্রথম এই জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। তারপর তারা ধীরে ধীরে এ এলাকাটিতে গেরিলা তৎপরতার কেন্দ্রবিন্দু করে গড়ে তোলে। এই জঙ্গলে মৃত্যু আসে নানা পথ ধরে। রাস্তার পাশের জঙ্গলে ওঁৎ পেতে গুলি-বোমায় মাওবাদীরা হত্যা করে পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীকে। আর পুলিশ মাওবাদীদের হত্যা করে ‘এনকাউন্টারে।’ পুলিশ বা সরকারের চর সন্দেহে জঙ্গলবাসী কাউকে কাউকে আদালতে বিচারও করে মাওবাদীরা। তারপর তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ছুরি মেরে অথবা কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। তারা এভাবে গত দুই দশকে ১২ হাজারেরও বেশি মানুষ মেরেছে।
এত খুনখারাবি যেখানে, সেই জঙ্গলের দিকে বাইরে থেকে তাকালে কী অপূর্বই না লাগে! অথচ ভেতরে ঢুকলে যা দেখা যায় তা এককথায় বীভৎস। দণ্ডকারণ্য বনাঞ্চলের কুত্র গ্রামের কথাই ধরা যাক। আদিবাসী এই গ্রামের একজন মানুষও সুষম খাবার খেতে পায় না। সব শিশুই ভুগছে অপুষ্টিতে। রক্তশূন্যতা ও পালমোলারি যক্ষ্মার রোগী প্রায় প্রতি ঘরে ঘরে। আরো প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, শিশু মৃত্যুর ভয়াবহ হার প্রতি পাঁচজনে তিনজন। গড় আয়ু ও শিক্ষার হারও অতিক্রম। চার ভাগের তিন ভাগ মানুষের বসবাস দারিদ্র্যসীমার নিচে। প্রতি বছর ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য মওসুমি রোগে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। পোলিও ও অন্ধত্বের হারও অত্যন্ত বেশি। এই যে জীবন, যেখানে শিক্ষা নেই, রাস্তাঘাট নেই, বিদ্যুৎ নেই, চিকিৎসা নেই, এমন জীবন আদিবাসীরা নিজেরাও আর চায় না। খনিজসম্পদের মুনাফা সুষমভাবে বণ্টন ও ব্যবহার হলে তাদের জীবন বদলে যেতে পারত। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তেমন কিছু হচ্ছে না। তার চেয়ে বড় বিষয় হলো, সারা বিশ্বে প্রত্যাখ্যাত একটি আদর্শের ফাঁপা বুলি এবং নামেমাত্র নিরাপত্তা প্রদান ছাড়া মাওবাদীরাও কোনো গ্রহণযোগ্য বিকল্প দিতে পারছে না আদিবাসীদের।
তারপরও তারা আছে সদর্পে নিজেদের ‘বিপ্লবী’ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এ তৎপরতার একটি নমুনা দেখা যাক। দণ্ডকারণ্য জঙ্গলের গহিনে বারপে নামে একটি গ্রাম থেকে জনাত্রিশেক লোকের একটি দল এক রাতে পালিয়ে চলে এলো কুত্রা গ্রামে। ব্যাপার কী? সেই দলে ছিল সারিতা (১৯) নামে মারিয়া গোত্রের এক তরুণী। ঘটনার বিবরণ দিলো ওই তরুণী। জানাল, সপ্তাহখানেক আগে ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে একদল লোক তাদের গ্রামে হামলা চালায়। দলটিতে নারী ও পুুরুষ সবাই ছিল। তাদের মাথায় বাঁধা ছিল সবুজ ফেট্টি। হাতে অস্ত্র। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল রনজিতা নামের এক মোটাসোটা মহিলা। এমনিতে গেরিলারা আসে প্রতি এপ্রিলে। আদিবাসীদের কাছ থেকে টেন্ডু পাতা বিক্রির টাকার বখরা নিয়ে যায়। কিন্তু এবার মনে হলো, তাদের চাওয়াটা আরো বেশি। এ সময় সারিতার আত্মীয়রা একটি ‘ভুল’ করে ফেলল। ওই পরিবারটি ছিল মোটামুটি শিক্ষিত। তারা গেরিলাদের হাত থেকে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ফাঁড়ি বসানোর আবেদন জানিয়ে স্থানীয় সরকারকে দরখাস্ত দিলো। আর যায় কোথায়, বিষয়টি জানাজানি হতেই রনজিতার দল সারিতার বাবা, ভাই ও এক জাতিভাইকে ধরে নিয়ে গেল। তারপর গ্রামবাসীকে খবর দিলো ‘জনআদালতে’ তাদের বিচার দেখতে আসার জন্য।
‘জনআদালতে’ রনজিতা প্রথমে তিন অভিযুক্তের ‘অপরাধের বিবরণ’ পড়ে শোনায়। তারপর তিনজনের চোখ বেঁধে ফেলা হলো। এরপর শুরু হলো লাঠিপেটা। নিশ্চুপ গ্রামবাসীর চোখের সামনে তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো। এরপর রনজিতা আবার গ্রামবাসীর উদ্দেশে বক্তৃতা দিলো। বললো, ‘গ্রামে পুলিশ বা সরকারের চরদের কোনো আত্মীয়স্বজন থাকলে এক সপ্তাহের মধ্যে গ্রাম ছেড়ে চলে যাও। নইলে তাদের আমরা খুন করব।’
এরপর সারিতার কাছে এলো রনজিতা। বলল ‘রাস্তার ধারের বাড়িতে তোমার বাপ-ভাই ‘ঘুমিয়ে’ থাকবে। সেখানেই ওদের পাবে।’ সারিতা বলে, এরপর সে আমাদের দিয়ে কয়েকবার মাওবাদী স্লোগান দেয়ালো, তারপর উধাও হয়ে গেল।
এভাবে আরো একটি গোষ্ঠী গ্রামছাড়া হলো। বাস্তুহারা মানুষের মিছিলে যোগ হলো আরো কিছু মানুষ। মাওবাদীদের তাতে কিছু যায়-আসে না। কয়লাখনির মালিকদের চাঁদায় তাদের ‘বিপ্লব’ কয়েক দশক ধরে চলছে এবং কেড়ে নিয়েছে কাশ্মির সঙ্ঘাতের চেয়েও অনেক বেশি মানুষের জীবন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং একে বলেছিলেন ‘ভারতের সবচেয়ে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকি।
এই হুমকির মোকাবেলায় মনমোহন সিং মন্ত্রিসভার সদস্য জয়রাম রমেশ প্রস্তাব দিয়েছিলেন গেরিলা অধ্যুষিত এলাকায় কয়লাখনিগুলো এক বছর বন্ধ রাখার। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, গেরিলা তৎপরতার মূল জ্বালানি হিসেবে কাজ করছে কয়লাখনির টাকা। হয়তো তা-ই ঠিক। কিন্তু তাই বলে কয়লাখনি কি বন্ধ করা যাবে? আর যদি না যায় তবে কি মাওবাদী গেরিলা তৎপরতাও চলতেই থাকবে? এ এক উত্তরহীন প্রশ্ন। কেউ এর জবাব জানে না।
0 comments:
Post a Comment