ইরানের পরমাণুপ্রযুক্তি নিয়ে পাশ্চাত্যের তীব্র বিরোধিতা এবং ইসরাইলের হুমকি বেশ কয়েক বছর ধরে অন্যতম প্রধান আন্তর্জাতিক ইস্যু হয়ে রয়েছে। এ নিয়ে ইরানের বিগত প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমদিনেজাদের পরপর দুই মেয়াদের আমলে অচলাবস্থা বিরাজ করেছে। এ জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্যের একগুঁয়েমি এবং এর বিপরীতে তেহরানের অনমনীয়তা দা
য়ী। তবে বর্তমান প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ক্ষমতায় আসার পর সঙ্কটের সুরাহার আশা করেছে উভয় পক্ষ। এর প্রেক্ষাপটে পাঁচ বৃহৎশক্তি ও জার্মানির সাথে ইরানের উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়েছে একাধিকবার।
গত ৩১ মার্চের মধ্যে চুক্তিতে উপনীত হওয়ার কথা থাকলেও আলোচনার সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। দুই পক্ষের মধ্যে কিছু মতভেদ রয়ে যাওয়ায় আপাতত চূড়ান্ত চুক্তি না হলেও একটি প্রাথমিক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। এর আওতায় ইরান ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ করার সুযোগ পেয়েছে। তারা চুক্তি মেনে চলার অঙ্গীকার করেছেন। পরমাণু চুক্তি না হলে ইরান আরো কঠোর নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হতো এবং তার অর্থনীতি হতো আরো বিপন্ন। কারো কারো মতে, এখন লাভ হবে ইরানেরই।
পাশ্চাত্যের মোড়ল রাষ্ট্রগুলো বারবারই মুসলিম বিশ্বের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ করে আসছে। মার্কিন নেতৃত্বে তারা আরবদের বিপরীতে ইসরাইলকে মদদ জোগাতে যথাসাধ্য তৎপর। এরই ধারাবাহিকতায় শিয়া-সুন্নি বিভেদে উসকানি দেয়া হয় নানা কৌশলে। আসলে পশ্চিমা দুনিয়া চায় না, শিয়া বা সুন্নি কোনো মুসলিম রাষ্ট্র পারমাণবিক প্রতিরক্ষা শক্তি অর্জন করুক। অথচ পাশ্চাত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় আগ্রাসী ইসরাইল অনেক আগেই পরমাণু বোমার অধিকারী হয়ে গেছে। অপর দিকে ইরান বলেছে চিকিৎসা ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে সে পরমাণু প্রযুক্তি প্রয়োগ করবে।’ পাশ্চাত্য এটাও সহজে মেনে নিতে পারছে না।
অতীতেও ছ’টি প্রভাবশালী দেশের সাথে ইরানের বৈঠক বসেছিল পরমাণু ইস্যুর সুরাহার জন্য। এবার ২৬ মার্চ সুইজারল্যান্ডে তা শুরু হয়ে প্রায় সপ্তাহকাল চলে। পশ্চিমা মোড়লরা চান, ইরান যাতে কোনোমতেই পরমাণু বোমা বানানোর সুযোগ না পায়। এ জন্য কৌশল হলো, তেহরানের সংশ্লিষ্ট কর্মসূচি সীমিত রাখতে বাধ্য করা। পাশ্চাত্য বারবার অভিযোগ করেছে, ইরান বোমা বানাচ্ছে’, যদিও এর সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলেনি। ইরান জোর দিয়ে অস্বীকার করে বলেছে, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ভিত্তিহীন। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রতিনিধিরা ইরানের পরমাণু স্থাপনা পরিদর্শন করেছেন। এ দিকে পাশ্চাত্যেরই কোনো কোনো মহলের অভিমত, ইরান পরমাণু বোমা বানাতে অনেক সময় লাগবে।
আলোচনা বৈঠকে দেখা গেছে, পাশ্চাত্য চায় ‘বোমা বানানো’র কার্যক্রমের অবসান। আর ইরান চায়, তার ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার অবসান। সেই সাথে তেহরানের কাম্য, তার জাতীয় অর্থনীতি চাঙ্গা করার সাথে শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার সামঞ্জস্যবিধান। সমস্যা হলো, ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়/আমের চেয়ে আঁটি বড়।’ অর্থাৎ বৃহৎশক্তিগুলো সমঝোতায় আগ্রহী হলেও ‘ক্ষুদ্র’ ইসরাইল ইরানের সাথে কোনো আলোচনার প্রচণ্ড বিরোধী।
বিশেষ করে ইসরাইলে আবার ক্ষমতাসীন, কট্টর প্রধানমন্ত্রী অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরো কঠোর করে তোলার ঘোর পক্ষপাতী। আসলে ইসরাইল আয়াতন-লোকসংখ্যায় ক্ষুদ্র হলেও সে শক্তির দিক দিয়ে বৃহৎ। তার পরমাণু বোমা আছে; আমেরিকায় শক্তিশালী লবি আছে এবং ব্রিটেন-ফ্রান্স-জার্মানি কার্যত তার পক্ষেই থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেসের উভয় কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ, রিপাবলিকান পার্টি ইসরাইলের অন্ধ সমর্থক বলা যায়।
আগেই নির্ধারিত ছিল, দুই পক্ষের মতপার্থক্য দূর করে কিংবা যতটা সম্ভব কমিয়ে এনে রাজনৈতিক সমঝোতার রূপরেখা প্রণীত হবে লুসান বৈঠকে। এর মধ্য দিয়ে প্রাথমিকভাবে একটা চুক্তি করা সম্ভব। তিন মাস পর সম্পাদিত হবে প্রযুক্তি-সংশ্লিষ্ট চুক্তি। জুন মাসের সে চুক্তিই চূড়ান্ত। ১ এপ্রিল ব্রিটেন জানায়, কিছু কাজ বাকি থাকলেও দুই পক্ষের বড় রকমের বোঝাপড়া হয়েছে।
রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ এবং ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ বলেছেন, রূপরেখা তৈরি করার ব্যাপারে অর্জিত সাফল্য বিরাট। একই দিন মিডিয়ার খবর, উভয় পক্ষ সমঝোতার খুব কাছাকাছি। অবশ্য ইরান তার পরমাণু অধিকারের বিষয়ে জোর দেয়ায় একপর্যায়ে মার্কিন প্রতিনিধি বৈঠক ত্যাগ করার হুমকি দেন। তবে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ড আলোচনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির দাবি করেছিলেন। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সব প্রধান বিষয়ে সাধারণ সমঝোতায় আমরা উপনীত হয়েছি। কিন্তু ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী লঁরা ফ্যাবিয়াসের বক্তব্য, ‘চুক্তি করার লক্ষ্যে ফলপ্রসূ অগ্রগতি হয়নি।’ তাহলে সবাই চুক্তির বিষয়ে কিভাবে ঐকমত্যে পৌঁছলেন?
পয়লা এপ্রিল আলোচনার শেষ দিনে সিএনএন-এর রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় বিশ্বশক্তির (জার্মানিসমেত) সাথে ইরানের পরমাণু চুক্তির লক্ষ্যে সমঝোতার প্রয়াস চলছে একযুগ ধরে। সময়ের পরিক্রমায় তেহরান আরো শক্তিশালী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। (সর্বশেষ, সুইজারল্যান্ডের লুসানে চলমান বৈঠকে) চুক্তি হোক কিংবা না হোক, লাভ হবে ইরানেরই।
এমন ধারণা পাশ্চাত্যের বিশেষজ্ঞদের। Iran's Power Rises, With or Without শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানের সাম্প্রতিক মনোভাব তাদের চরম সামর্থ্যরে ইঙ্গিত দেয়। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলোর সাথে আলোচনার টেবিলে ইরানের ভূমিকা জানিয়ে দিচ্ছে, তাদের আন্তর্জাতিক মর্যাদা অনেক উঁচু। আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা কার্যক্রমের উপদেষ্টা ফোরাম, ঝঃৎধঃভড়ৎ-এর সূত্র বলেছে, ইরান আরব বসন্তের সুযোগ নিয়েছে পুরোপুরি। ইরান ভূরাজনীতি নিয়ন্ত্রণে মেতে উঠেছে।
এমনকি হোয়াইট হাউজের চিফ অব স্টাফস ডেনিস ম্যাকডোনাফ মনে করেন, পরমাণু চুক্তি হলেও আমাদের এ উদ্বেগ থেকে যাবে যে, তেহরানের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রভাব বাড়তেই থাকবে। এ দিকে পরমাণু চুক্তির সাফল্যে ইরানের প্রভাব বৃদ্ধির সম্ভাবনায় সৌদি আরব সতর্ক ভূমিকা নিচ্ছে বলে জানা গেছে। এই চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ঘনিষ্ঠ হবে বলে সৌদি সরকারের ধারণা।
মীযানুল করীম
0 comments:
Post a Comment