ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ২৬ মার্চ থেকে প্রচণ্ড বিমান হামলা চালিয়েছে। এতে রাজধানী সানা ও প্রধান নগরী এডেনের ব্যাপক ক্ষতি, আর অনেকে নিহত ও আহত হয়েছে। ইয়েমেনের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে হাউছি বিদ্রোহীদের দমনের জন্য এই হামলা চালানো হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র, ব
্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, পাকিস্তান, বাংলাদেশ প্রভৃতি রাষ্ট্র এবং ওআইসি, আরব লিগ এতে সমর্থন দিয়েছে। তবে এই যৌথ হামলায় দরিদ্র আরব দেশটিতে শান্তি-স্থিতি কতটুকু ফিরে আসে, তা অনিশ্চিত। বরং পরিস্থিতি আরো অগ্নিগর্ভ ও জটিল হয়ে ওঠে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।
ইয়েমেনে সঙ্কট যেমন পুরনো, তেমনি বহুমাত্রিক। যদিও এর নানা কারণ রয়েছে, তবে অনেকের মতে, বিগত প্রেসিডেন্ট এবং তিন দশকের স্বৈরতন্ত্রী শাসক, আলী আবদুল্লাহ সালেহ রয়েছেন বিদ্যমান সঙ্কটের নেপথ্যে। গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার প্রতিশোধই যেন নিচ্ছেন ইয়েমেনে নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা করে। তার স্ববিরোধী ও সুবিধাবাদী নীতি পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছে।
ইয়েমেনের শিয়া মতাবলম্বীরা ‘জায়েদি’ হিসেবে অভিহিত। তারা শিয়াদের মূল ধারা থেকে পৃথক এবং অন্যান্য শিয়ার চেয়ে তাদের সাথে সুন্নিদের ধর্মীয় পার্থক্য অনেক কম। তাই ইয়েমেনের শিয়াদের আন্দোলন বহু আগে থেকে চলে এলেও তা ইরাক-ইরানের শিয়া উত্থান বা বিদ্রোহের মতো গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি। কিন্তু গত কয়েক বছরে দেশটিতে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা এবং অব্যাহত রাজনৈতিক সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে শিয়া হাউছিদের বিদ্রোহ ও অগ্রযাত্রা শুধু আরব উপদ্বীপ নয়, মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইয়েমেন সঙ্কটের কিছু বৈশিষ্ট্য পরিস্থিতিকে বেশি জটিল করে তুলেছে। প্রথমত, ‘আরব বসন্ত’ স্বৈরশাসকের পতন নিশ্চিত করলেও দেশটির ভবিষ্যৎ এর চার বছর পরও ঘোর অনিশ্চিত। নৈরাজ্য এমন পর্যায়ে যে, লিবিয়ার চেয়েও ইয়েমেনে অবস্থা ভয়াবহ। এখানে কার্যত সরকার নেই। হাউছি, আইএস, উপজাতীয় সুন্নি, সালেহর অনুগত বাহিনী তারা ইচ্ছামতো একেকটি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে; তাণ্ডব চালাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, স্বৈরশাসক সালেহর ঘোর বিরোধী ছিল হাউছিরা। তার বিতাড়নে এই শিয়ারা বিরাট ভূমিকা রাখলেও এখন সালেহ আঁতাত করেছেন তাদের সাথে। তৃতীয়ত, সালেহ-পরবর্তী প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদির নিযুক্তি বৈধ করতে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তবে এর মাধ্যমে তিনি আইনগত বৈধতা পেলেও রাজনৈতিকভাবে অনুমোদন পাননি। কারণ এ গণভোটে অংশ নেয়নি উত্তরাঞ্চলের শিয়া হাউছি এবং দক্ষিণ অঞ্চলের সুন্নি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী।
চতুর্থত, ইয়েমেনে আলকায়েদা এবং তাদের ঘনিষ্ঠ জঙ্গি সংগঠন আইএস অত্যন্ত তৎপর। ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর আলকায়েদা অব আরব পেনিনসুলা, ইয়েমেনকে কেন্দ্র করে এখানে ও বাইরে বারবার ভয়াবহ সহিংসতা ঘটিয়েছে। আইএস এই চরমপন্থী সুন্নি গোষ্ঠীর শক্তি ও প্রেরণা বাড়িয়ে দিয়েছে। পঞ্চমত, ইয়েমেন, সবচেয়ে দরিদ্র আরব রাষ্ট্র যদিও জ্বালানি তেল ও গ্যাস রফতানিতালিকায় রয়েছে দেশটি। দেশটির উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যজনিত ক্ষোভ গণঅসন্তোষের একটি পুরনো কারণ। এ অবস্থায় দুই ইয়েমেন এক হওয়ার সিকি শতাব্দী পরও সমস্যা রয়ে গেছে। সর্বোপরি, ইয়েমেনের সাথে দীর্ঘ সীমান্তের নিকটতম ও সর্বাধিক প্রভাবশালী পড়শি দেশ, সৌদি আরবের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এবং এর বিপরীতে হাউছিদের মতো, শিয়া মতাবলম্বী রাষ্ট্র ইরানের পরোক্ষ প্রভাব বিস্তারের প্রয়াসে ইয়েমেন আঞ্চলিক এ দু’টি শক্তির ছায়াযুদ্ধক্ষেত্র হয়ে না দাঁড়ায়, সে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ইয়েমেনে শুধু যে গৃহযুদ্ধ চলছে, তা নয়। সরকারবিহীন এক চরম নৈরাজ্য বিরাজমান। আরব বসন্তের বিস্ফোরণের কয়েক বছরেও ইয়েমেনে গ্রীষ্মের উত্তাপ কমেনি, বরং কালবৈশাখীর ঝড় রয়েছে অব্যাহত। এ সময়ে শিয়া হাউছিদের ক্রমবর্ধিত শক্তি ও তৎপরতার পাশাপাশি সুন্নি চরমপন্থীরা সহিংসতা চালিয়েছে। শেষ পর্যন্ত গত সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদি রাজধানী ছাড়েন সেখানে হাউছি অগ্রযাত্রার মুখে। তিনি এডেন নগরীতে আশ্রয় নিলেও সম্প্রতি সেটাও হাউছির দখলে। অতএব, তার গন্তব্য সৌদি আরব। আরব ও পাশ্চাত্য নির্বিশেষে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের মিশন বন্ধ করে নিজস্ব লোকজন ইয়েমেন থেকে সরিয়ে এনেছে নিরাপত্তার অভাবে।
‘বৈধ’ প্রেসিডেন্ট দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েমে শুধু ব্যর্থই নন, জান বাঁচাতে পালিয়ে গেছেন। সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধভাবে তার পাশে থাকলে বিদ্রোহীরা প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে পারত না।
ইয়েমেনি সৈন্যবাহিনী উপজাতি অধ্যুষিত হওয়ায় এখন রাজনৈতিক মেরুকরণে বিভক্ত। তাদের কেউ পলাতক প্রেসিডেন্ট হাদি, আর কেউ বা পতিত প্রেসিডেন্ট সালেহ সমর্থক। একটা দেশের সেনাবাহিনী এর জাতীয় ঐক্য, আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রতীক। ইয়েমেনে সেনাবাহিনীর নিজেরই ঐক্য নেই। তা হলে তো দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা বিপন্ন হবেই।
ব্রিটেনের ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকার সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ইয়েমেনে সঙ্কটে সম্পৃক্ত হয়ে সৌদি আরব তাদের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানকেও দিচ্ছে জোরালো হুঁশিয়ারি। এমনিতেই ইয়েমেন দাঁড়িয়ে আছে ব্যর্থতার শেষ প্রান্তে। অভ্যন্তরীণ বিরোধ বহুমুখী।’
ইয়েমেনকে সর্বাত্মক গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়া হতে পারে এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করেও পত্রিকাটি মনে করে, ইরান ইয়েমেনে হস্তক্ষেপ করবে এমন ভাবনা আপাতত সৌদি আরব ও ইয়েমেনের সুন্নি গোষ্ঠীকে তাড়া করছে না। তাদের দুশ্চিন্তার কারণ, আরব বিশ্বে শিয়া, ইরান ও তাদের সমর্থক শক্তিগুলো শক্তি বাড়িয়ে চলেছে।
বাগদাদ-দামেস্ক-বৈরুতে পর্যায়ক্রমে শক্তি প্রতিষ্ঠা করে তেহরান তা দেখিয়েও দিয়েছে। ইয়েমেনের রাজধানীতে শিয়া হাউছি যোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ দৃশ্যত কায়েম হওয়ায় তেহরানের শক্তি বেড়েছে।’ শুধু বিমান হামলার মাধ্যমে ইয়েমেনের সঙ্কটের জট খোলা যাবে বলে এই পত্রিকা মনে করে না।
মীযানুল করীম
0 comments:
Post a Comment