কামাল আহমেদ
কী অসাধারণ এক বিশ্বকাপ ক্রিকেট হয়ে গেল। তাসমানিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড ছিল এবারের বিশ্বকাপের আয়োজক। ১৪ ফেব্রুয়ারি শুরু। শেষ হলো ২৯ মার্চ। ৪৫ দিন পুরো বিশ্ব ক্রিকেটজ্বরে কেঁপে কেঁপে উঠেছে। কত কিছুই না ঘটেছে ১১তম আসরে। সবাই দেখেছেন অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেট ক
তটাই বদলে গেছে ভেতর থেকে। নান্দনিকতার পাশাপাশি ক্ষমতা যোগ হয়েছে ক্রিকেটে। রাজার খেলা ক্রিকেট এখন পরিণত হয়েছে খেলার রাজায়। কত কিছুই না ঘটেছে এবারের বিশ্বকাপে। প্রতিটি ম্যাচেই ছিল পায়ের হালকা চালের ছন্দ। ছিল অক্ষরবৃত্ত ছন্দের ভাবগাম্ভীর্য। শিল্প ছিল প্রায় প্রতিটি ম্যাচে।
অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের ভেনুগুলো ক্রিকেটারদের ‘ম্যাজিক টাচে’ ক্রিকেটের বিশাল ক্যানভাসে পরিণত হয়েছে। মাঠে উপস্থিত দুই দলের ২২ ক্রিকেটার তাদের সেরাটা দেয়ার জন্য সব সময়ই ছিলেন প্রস্তুত। শত ওভারের ম্যাচে কত শত ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। রেকর্ড বুক হয়েছে আরো সমৃদ্ধ। বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার নিজেদের নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। কেউ কেউ নিজের কারিশমাকে নিয়ে গেছেন হিমালয়সম উচ্চতায়। ব্যাটে-বলের লড়াইয়ে প্রতিটি দলের খেলোয়াড়রা জয়ী হওয়ার জন্য লড়াই করে গেছেন। অধিনায়কের বুদ্ধিমত্তার সামনে প্রতিপক্ষ পেরে ওঠেনি। কিংবা বোলারকে ব্যবহার করেছেন অনেকটা চিন্তাভাবনা করেই। প্রতিটি ব্যাটসম্যান প্রতিটি ম্যাচেই ছিলেন এক একজন শিল্পী। সবুজ ঘাসের চত্বরে উইলো হাতে ফুটিয়ে তুলেছেন অনন্যসাধারণ শিল্পকর্ম। না শুধু চেয়ে চেয়ে দেখার বিষয় নয়, অনুভবও করার বিষয়।
আসলে এবারের বিশ্বকাপে অনেক কিছুই বদলে গেছে। প্রতিটি ভেনুতে রান হয়েছে প্রচুর। বোলারদের তেমন কিছুই করার ছিল না। তারপরও ফাস্ট বোলাররা নিজেদের সেরাটা মেলে ধরেছেন আপন মহিমায়। শট বলের গতিময়তায় বিস্মিত হতে হয়েছে। ছক্কার বিশালত্ব দেখে অবাক হয়েছেন দর্শক-সমর্থকেরা। বিশ্বকাপে ডাবল সেঞ্চুরি ছিল না। এবার হয়েছে। কিউই ব্যাটসম্যান মার্টিন গুপতিল ২৩৭ রান করেছেন। আর উইন্ডিজের ক্রিস গেইল করেন ২০১৫। এই বিশ্বকাপে স্পিনারদের ঘূর্ণিবলের জাদু তেমন দেখা যায়নি। ফলে পেসারদের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত এই বিশ্বকাপে অসি মিচেল স্টার্ক এবং কিউই পেসার ট্রেন্ট বোল্ট ২২টি করে উইকেট নিয়ে সবাইকে চমকিত করেন।
আসলে বিশ্বকাপের সাতকাহন বলে শেষ করা যাবে না। কারণ এই প্রথমবার দু’টি আয়োজক দেশ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড ফাইনালে অংশ নেয়। মেলবোর্নে রেকর্ডসংখ্যক ৯৩ হাজার দর্শক উপভোগ করলেন ফাইনাল। অস্ট্রেলিয়া ৭ উইকেটে হারিয়ে দেয় নিউজিল্যান্ডকে। ফাইনাল অনেকটা একপেশে খেলা হয়েছে। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে আগের ৮ ম্যাচে দেখা কিউই ঝড় মেলবোর্নে দেখা যায়নি। আর যাবেই বা কেমন করে। প্রথমবার ফাইনাল খেলতে নেমে বিগ ম্যাচের চাপ নিতে পারেনি নিউজিল্যান্ড। ১৮৩ রানের মামুলি সংগ্রহ স্কোর বোর্ডে জমা করে তারা। পাল্টা ব্যাট করার সময় ১ রানে অসিরা তাদের ওপেনিং ব্যাটসম্যান ফিঞ্চকে হারালে সবাই বিশ্বকাপের ইতিহাসের দিকে তাকায়। কারণ ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপে প্রথমবার ফাইনাল খেলতে নেমে ভারত করেছিল ১৮৩। এরপর ব্যাট করতে নেমে দাপুটে দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ টানা তৃতীয়বার বিশ্বকাপ জিততে পারেনি। ১৪০ রান করে অলআউট হয়ে যায় কপিল দেব বাহিনীর কাছে। তাই মেলবোর্ন ফাইনালের চরিত্র দেখে সবাই বলতে শুরু করেন ‘ইতিহাস কথা কয়’। অসিরা হয়তো হেরে যাবে। পুনরাবৃত্তি ঘটবে তৃতীয় বিশ্বকাপের। কিন্তু তা হয়নি। অসি অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক তার ক্যারিয়ারের শেষ ওয়ানডে স্মরণীয় করে রাখার জন্য অসাধারণ ৭৩ রানের ইনিংস উপহার দেন। জিতে গেল অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বকাপ জিতেই ক্লার্ক তার বর্ণাঢ্য ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টানলেন।
ফাইনালের তাসমানিয়া সাগরের এক পাড়ে হাসি-কান্নার দোলাচল। অন্য দিকে আরেক পাড়ে বেদনা এবং হতাশার কাব্য। নিউজিল্যান্ড পরাজিত হওয়ার পর দর্শকেরা অনেকেই কেঁদেছেন। বিশ্বকাপ না জেতার দুঃখবোধ কিউই ক্রিকেটারদের চক্ষু করেছে অশ্রুসজল। ফ্লাডলাইটের রুপালি আলোর বন্যায় তাদের চোখের পানি চিকচিক করেছে। আতশবাজির বর্ণিল আলোর বন্যায় কিউই ক্রিকেটারদের বিমর্ষ মুখগুলো দেখে বেদনায় আপ্লুত হয়েছেন অনেকেই। তাদের সাবেক অধিনায়ক মার্টিন ক্রো বলেছিলেন যে, মাঠে বসে এটাই তার শেষ ক্রিকেট ম্যাচ দেখা। তিনি চেয়েছিলেন ব্ল্যাকক্যাপরা শিরোপা জিতে তাকে এবং নিউজিল্যান্ডবাসীদের খুশিতে উদ্বেলিত করবে। কিন্তু তা হয়নি। এমনকি আশায় বুক বেঁধে আরেক সাবেক ক্রিকেটার স্টিফেন ফ্লেমিং বলেছিলেন, ম্যাককুলাম বাহিনী বিশ্বকাপ জয় করে গর্বিত স্বরে উচ্চারণ করবে আমরাও পারি। কিন্তু তা হয়নি। ফাইনালে তাদের আগ্রাসী ব্যাটিং কিংবা কারিশমা ছিল পুরোপুরি অনুপস্থিত। চেনা নিউজিল্যান্ড ফাইনালে অচেনা নিউজিল্যান্ড হিসেবে নিজেদের মেলে ধরেছে।
অন্য দিকে অকল্যান্ডে নাটকীয় ম্যাচে ১ উইকেটে কিউইদের কাছে পরাজিত হয়ে ছিল অস্ট্রেলিয়া। তাই ফাইনালে তাদের পেয়ে মধুর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য প্রস্তুত হয় ক্লার্ক বাহিনী। নিজেদের মাঠে প্রতিপক্ষকে হারানোর সুযোগকে কাজে লাগায় গোল্ডেন জার্সিধারীরা। দারুণভাবে চেপে ধরে অসিরা কিউইদের। ক্লার্কের দল পরিচালনা যেকোনো অধিনায়কের কাছে শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। একটি সেরা দল হিসেবে তারা মাঠে নিজেদের মেলে ধরে। জয়ী হওয়ার পর তাদের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ শতধা ফল্গুধারার মতো মেলবোর্ন ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পঞ্চমবারের মতো বিশ্বকাপ জয় করার উল্লাস তো ভিন্নরূপেই উপস্থিত হবে। হয়েছেও তাই। বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো অসিরা উদযাপন করেছেন তাদের শিরোপা জয়ের উৎসব। উত্তেজনা এবং ক্রিকেট ফিভার তাদেরকে দিয়েছে অতিরিক্ত প্রাণশক্তি। আর দেবেই বা না কেন। পঞ্চমবারের মতো তারা ক্রিকেট বিশ্বকাপ শিরোপা নিজেদের ঘরে তুলেছে। ফুটবল বিশ্বকাপ জিতেছে ব্রাজিল পাঁচবার। দুই দলের জার্সিও প্রায় একই রঙের। এই মিল কাকতালীয় হলেও এখন বাস্তব। অস্ট্রেলিয়ার স্বপ্ন ছিল নিজ দেশে বিশ্বকাপ জয় করার। তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। কারণ ’৯২ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া স্বাগতিক হলেও সে সময় শিরোপা জয় করেছিল এশিয়ার অন্যতম ক্রিকেট পরাশক্তি পাকিস্তান।
বাইশ বছর পর অস্ট্রেলিয়া নিজেদের মাটিতে বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতা করার সুযোগ পেল এবং তারা স্বপ্ন দেখতে শুরু করল যে, এবার জিততে হবে বিশ্বকাপ। এই মিশন শুরুর আগে অসি দল কম ধাক্কা খায়নি। নিয়মিত অধিনায়ক ক্লার্ক দলের হয়ে বিশ্বকাপ খেলতে পারবেন কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। অলরাউন্ডার ফকনার ইনজুরি থেকে সেরে ওঠার জন্য নিরন্তর লড়াই করতে থাকেন। তবে সময় যতই গড়ায় ততই অসি দলের সমস্যা কেটে উঠতে থাকে। সুস্থ হয়ে ওঠেন ক্লার্ক। মাঠে নামেন ফকনার। তারপরের ইতিহাস তো শুধুই সাফল্যগাথা মহাকাব্যের। লিগ পর্বে নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরে যাওয়ার পর এগিয়ে যাওয়ার পালা। উত্তেজনা, নাটকীয়তা এবং রোমাঞ্চকর ক্রিকেট অধ্যায়ের সৃষ্টি করে মেলবোর্নে বিশ্বকাপে পঞ্চমবারের মতো হাত রাখা। এ যেন অসিদেরই মানায়। ক্রিকেট নিয়ে নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া তাদের দলকে এইপর্যায়ে নিয়ে এসেছে। কিউইদের প্রতিপক্ষ হিসেবে পাওয়ার পর অসিরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করে যে, এবারের বিশ্বকাপ তাদের। অসি সাবেক অধিনায়ক রিকি পন্টিং বলেছেন, ক্লার্ক বাহিনীতে তেমন কোনো দুর্বলতা নেই। তাই অস্ট্রেলিয়াকে পরাজিত করতে পারে অস্ট্রেলিয়াই। ফাইনালে তাই কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেনি নিউজিল্যান্ড। হলুদের জয় হলো। তাই বিশ্বকাপ ক্রিকেটকে হলুদ রঙের বর্ণিল বিশ্বকাপ বললে নিশ্চয়ই ভুল বলা হবে না।
দুই অধিনায়কের কথা
বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দে উদ্ভাসিত ছিলেন অসি অধিনায়ক। কারণ তার বিদায় বেলায় পরাজয়ের করুণ বেহালা শোনা যায়নি। চার দিকে ছিল আতশবাজি এবং দর্শকদের শব্দময় পৃথিবী। এক জীবনে এত প্রাপ্তি তা কি কখনো চিন্তা করেছিলেন ক্লার্ক। তাই হয়েছে। ক্লার্ক এখন অসি ক্রিকেটের লিজেন্ড। আবেগাপ্লুত হয়ে ক্লার্ক বলেন, আমরা এই বিশ্বকাপে ১৬ জন খেলেছি। আমার বাকি ক্যারিয়ার তাই খেলব। এমন কোনো দিন যায়নি যেদিন আমরা হিউজকে নিয়ে কথা বলিনি। এখনো বলে যাবো। ওয়ানডেকে গুডবাই জানিয়েছি। তবে টেস্ট ম্যাচ তো খেলব। তখন আমার টুপিতে হিউজের টেস্ট নম্বর লেখা থাকবে। বিশ্বকাপ জয় আমরা হিউজকে উৎসর্গ করছি। ক্লার্ক আরো বলেন, খেলাধুলায় কোনো রূপকথা হয় না। কিন্তু মেলবোর্ন ফাইনালে যা হয়েছে তাকে রূপকথা বলা যেতে পারে। আমাদের কাছে অনেক প্রত্যাশা ছিল। ফলে চাপও ছিল। সেসব জয় করে নিজেদের দর্শকের সামনে বিশ্বকাপ জয় করা। এর চেয়ে ভালো আর কী-ই বা হতে পারে।
বিশ্বকাপ হাতে নেয়ার জন্য এক জয় দূরে ছিলেন অধিনায়ক ম্যাককুলাম। কিন্তু তার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। হেরে গেছে তারা সাত উইকেটে। তাই ফাইনাল শেষে ম্যাককুলাম পরাজয়ের হতাশাজনক কৃষ্ণ অধ্যায়কে পেছনে সরিয়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রশংসা করেছেন বেশি মাত্রায়। তিনি বলেন, আমরা পুরো বিশ্বকাপ আসরে অসাধারণ ক্রিকেট খেলেছি। তবে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার মতো দুর্দান্ত একটি দলের মুখোমুখি হয়েছিলাম। তারা নিজেদের সেরাটাই খেলেছে। জয় তাদেরই প্রাপ্য ছিল। আমরা এই পরাজয় থেকে শিক্ষা নিতে পারি। কিন্তু একই সাথে এটাও স্বীকার করতে হবে যে, কখনো কখনো দৌড়ে আপনাকে দ্বিতীয়ই হতে হবে। কেউ হারবে। কেউ জিতবে বলেই খেলার জন্ম হয়েছে। ম্যাককুলাম আরো বলেন, আমরা শিরোপা জিততে পারিনি। কিন্তু সে কারণে আমাদের আফসোস নেই। বিশ্বকাপে আমরা দারুণ ক্রিকেট খেলেছি। এবং মাথা উঁচু করেই বিদায় নিচ্ছি। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত। এবারের বিশ্বকাপ থেকে এই টুর্নামেন্টে আমাদের যা অর্জন সেটা নিয়ে গর্ব করাই যেতে পারে। আমি আক্রমণাত্মক কৌশল থেকে বেরিয়ে আসব না। আমরা এভাবেই খেলেছি বলেই সবাই নিউজিল্যান্ডের প্রশংসা করেছে। আর আমরাও এভাবে খেলেই আনন্দ পেয়েছি। এটাও তো এবার আমাদের সেরা অর্জন ও প্রাপ্তি।
বাংলাদেশের বিশ্বকাপ
টেস্ট পরিবারের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য বাংলাদেশ। এবার বিশ্বকাপে এই দলটি দারুণ চমক দেখিয়েছে। প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনাল। তাও আবার ভিন্ন কন্ডিশনে। ফ্লাট পিচে খেলতে অভ্যস্ত বাংলাদেশ। এই বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মাটিতে এত সাফল্য পাবে তা কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ক্রিকেটার এবং সমর্থক কেউই আশা করেনি। দেশ ছাড়ার আগে সবাই বলেছিলেন, দু’টি ম্যাচ জিততে পারলেই হবে। পরাজিত করতে হবে আফগানিস্তান ও স্কটল্যান্ডকে। তবে দল নির্বাচকদের কথা হলো তিন ম্যাচ জিতলে তা হবে বাংলাদেশের জন্য বড় প্রাপ্তি। কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার স্বপ্ন সবাই হৃদমাজারে লালন করেছে ঠিকই কিন্তু তা যে বাস্তবের বুকে আছড়ে পড়বে সেটা কারো কল্পনাতে ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশ পেরেছে। তারা ক্রিকেট দুনিয়াকে দেখিয়ে দিয়েছে যে, বাংলাদেশ দুর্বল দল হলেও বড় আসরে নিজেদের মেলে ধরতে পারে।
আফগানিস্তানকে পরাজিত করার পর বাংলাদেশ বৃষ্টির কারণে অস্ট্রেলিয়ার সাথে খেলতে পারেনি। ফলে ১ পয়েন্ট পায় তারা, যা ছিল টাইগারদের জন্য বোনাস। এরপর স্কটল্যান্ডকে ৩০০ রান চেজ করে পরাজিত করার পর মাশরাফি বাহিনী কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। বাংলাদেশ মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের মতো একজন কমপ্যাক্ট ব্যাটসম্যানকে পায় এবারের বিশ্বকাপে। এর আগে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরি ছিল না। রিয়াদ অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়ে নতুন রেকর্ডে পা রাখলেন। এমনকি ইংলিশ বোলারদের তেমনভাবে পাত্তাই দেননি তিনি। একেবারে বহতা নদীর মতো তিনি রান করেছেন। এরপর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আবার সেঞ্চুরি করলেন রিয়াদ। ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি। আলোচনায় চলে এলেন রিয়াদ। তার ইনিংস প্রশংসিত হলো সবার কাছে। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে আম্পায়ারের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে তাকে আউট হতে হয়।
আসলে বাংলাদেশ এবার বিশ্বকাপে একটি দল হিসেবে খেলেছে। রিয়াদ, মুশফিক, সাকিব, সাব্বির এবং সৌম্য তাদের নৈপুণ্য দিয়ে সবার নজর কেড়েছেন। তামিম ছিলেন অনুজ্জ্বল। তবে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে তার উইলো হেসেছিল। বোলিংয়ে অধিনায়ক মাশরাফি প্রতিটি ম্যাচেই ভালো করেছেন। ইনজুরি তাকে সমস্যায় ফেলেছিল ঠিকই। তার পরও তারা মাপা বোলিং বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানকে অনেকবার সমস্যায় ফেলেছে। তাসকিন তরুণ বোলার হলেও তার গতি দিয়ে সবাইকে বুঝিয়েছেন যে, আগামীতে তিনি ভালো করবেন। তবে বল হাতে সবচেয়ে আগ্রাসী ছিলেন রুবেল হোসেন। এই বিচিত্র চরিত্রের বোলার ইংল্যান্ডের সাথে জয়ের ম্যাচে দারুণ বল করেছেন। এমনকি ভারতের বিপক্ষেও তিনি জ্বলে উঠেছিলেন আপন মহিমায়।
ফিল্ডিংয়ে বাংলাদেশ খুব যে ভালো করেছে তা কিন্তু বলা যাবে না। শ্রীলঙ্কার সাথে খেলতে নামা বাংলাদেশকে চেনা বলে মনে হয়নি। একের পর এক ক্যাচ গ্রাউন্ড ফিল্ডিং যাচ্ছেতাই। কেন এমন হলো সে বিষয়ে কোনো কথাই বলতে পারেননি কোচিং স্টাফরা। যদিও পরের ম্যাচগুলোতে বাংলাদেশের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মনে হয়েছে তারা কিছু একটা করতে চায়। এবং শেষ পর্যন্ত তাই করেছে।
স্ক্যান্ডাল এবং স্ক্যান্ডাল
বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে পেসার রুবেল হোসেন পড়ে যান বড় সমস্যায়। অভিনেত্রী হ্যাপি মিডিয়াকে বলে বসেন রুবেল তাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করেছেন। নারী নির্যাতনে হ্যাপি মামলাও করেন। তবে রুবেল তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং মামলার কারণে তাকে জেলেও যেতে হয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড অবশ্য বলে যে, তারা পুরো বিষয়টির দিকে কড়া নজর রাখছেন। এবং দোষী সাব্যস্ত হলে রুবেলকে বিশ্বকাপ স্কোয়াড থেকে বাদ দেয়া হবে। যদিও শেষ পর্যন্ত রুবেলের জামিন হয় এবং তিনি বিশ্বকাপে খেলতে যান। রুবেল হয়তো তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়ার কারণে এক ধরনের চাপা দ্রোহ মনের মধ্যে লালন করেছেন। তাই বল হাতে জ্বলে উঠেছেন প্রতি ম্যাচেই। ম্যাচ শেষে রুবেলের কারিশমা দেখে আনন্দে উদ্ভাসিত হয়েছেন হ্যাপি। আগে বলেছিলেন তিনি কখনো রুবেলকে বিয়ে করতে চান না। তবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে রুবেলের সাফল্য দেখে হ্যাপি বলে বসেন তিনি রুবেলকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চান।
এ ছাড়া দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য বাংলাদেশের পেসার আল আমিনকে দেশে ফিরে আসতে হয়। তবে শৃঙ্খলা ভঙ্গের রকমফের কেমন সে ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যা দেননি বিসিবির কর্তাব্যক্তিরা। এমনকি ম্যানেজার সুজনকে জুয়ার আড্ডায় দেখা গেছে। তিনি অবশ্য এ ব্যাপারে বলেছেন যে, খাওয়ার জন্যই তিনি জুয়ার আড্ডায় গিয়েছিলেন। আসলে কি তাই!
এ ছাড়া ভারতের নতুন সেনসেশন ব্যাটিং প্রতিভা বিরাট কোহলির বান্ধবী ও প্রেমিকা মুম্বাই অভিনেত্রী আনুশকা শর্মা মাঠে গিয়েছিলেন। সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার সাথে মাঠে বিরাট কোহলি কিছুই করতে পারেননি। সব দোষ চেপে বসে আনুশকার কাঁধে। দারুণ সমালোচনার মুখে পড়েন এই অভিনেত্রী।
আইসিসি সভাপতি সমাচার
ভারতের সাথে বাংলাদেশের ম্যাচে আম্পায়ারিং এত পক্ষপাতিত্ব হয়েছে যে, তা বিশ্বকাপকে কলঙ্কিত করেছে। রোহিত শর্মার আউট দেননি আম্পায়ার। এমনকি সুরেশ রায়না এলবিডব্লিউ হলেও তা এড়িয়ে যান আম্পায়ার। বাংলাদেশের ইনফর্ম ব্যাটসম্যান রিয়াদ যে ছক্কা মারেন তা ধরতে গিয়ে ধাওয়ানের পা বাউন্ডারি লাইনের দড়ি স্পর্শ করে। এটাও এড়িয়ে যান আম্পায়ার। এত উলঙ্গ ও পক্ষপাতিত্ব আম্পায়ারিং দেখে সারা ক্রিকেটবিশ্ব বিস্মিত হয়। সাবেক অনেক ক্রিকেটার এ ম্যাচ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় মেতে ওঠেন। সবাই আম্পায়ারদের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অনেক নেতিবাচক মন্তব্য করেন। কিন্তু ভারত নির্বিকার। কোয়ার্টার ফাইনালে যেনতেনভাবে জয়ী হতে হবে ভারতকে। তাই এত সব কাণ্ডকারখানা।
এ ব্যাপারে আইসিসি প্রেসিডেন্ট মোস্তফা কামালও মুখ খোলেন। তিনি বলেন, আম্পায়ারদের শাস্তি হওয়া উচিত। তারা যা করেছেন তা সত্যিই বেদনাদায়ক। তার এই মন্তব্যে নাখোশ হন আইসিসি চেয়ারম্যান শ্রীনিবাসন। তাই ফাইনালে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে আইসিসির সভাপতি মোস্তফা কামালকে বক্সে বসিয়ে রেখে নিজেই বিজয়ী দল অস্ট্রেলিয়ার হাতে বিশ্বকাপ তুলে দেন। তার ব্যাখ্যা ছিল আইসিসি সভাপতি কোড অব কন্ডাক্ট মানেননি। তাই তাকে দিয়ে পুরস্কার দেয়া সম্ভব হলা না। আসলে ভারত প্রতিশোধ নিলো। আইসিসি পরিণত হলো ইন্ডিয়ান ক্রিকেট বোর্ডে। বিশ্বক্রিকেট হলো কলঙ্কিত এবং অপমানিত। দেশে ফিরে আইসিসি সভাপতি মুস্তাফা কামাল পদত্যাগ করলেন। ঢাকা বিমানবন্দরে আইসিসি চেয়ারম্যান শ্রীনিকে একহাত নিলেন। তিনি বললেন শ্রীনির হাতে বিশ্বক্রিকেট নিরাপদ নয়। আসলেই তাই। এখন তিন মোড়ল ভারত, অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডের কাছে ক্রিকেট ব্যবসার খেলা। এখন আর নান্দনিকতা ও শিল্পের প্রয়োজন নেই।
0 comments:
Post a Comment