WHAT'S NEW?
Loading...

সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ রুদ্ধ করছে নির্বাচন কমিশন



আলফাজ আনাম

সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে এখন এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখের সামনে দেশের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের প্রধানের গাড়িতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা হামলা চালাচ্ছে। তার নিরাপত্তারক্ষীদের পিটিয়ে রাস্

তায় ফেলে রাখা হচ্ছে। নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়ার সময় এসব ঘটনা ঘটলেও এ দেশের স্বাধীন নির্বাচন কমিশন নির্বিকার। শুধু তাই নয়, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর সমর্থকেরা বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থীদের নির্বাচন অফিস ও বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর করছে। এমনকি নিজেদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটলেও নির্বাচন কমিশন পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। বরং তারা এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যাতে অরাজকতাকে আরো উসকে দেয়া হচ্ছে।


সরকারের মন্ত্রীরা ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধের পরিবর্তে তাদের উসকানি দিচ্ছেন। বলা হচ্ছে বিক্ষুব্ধ মানুষ নাকি বেগম খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা করেছে। অথচ অনেকগুলো গণমাধ্যম ছাত্রলীগের কোন নেতা কিভাবে আগ্নেয়াস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে হামলা করেছে তার ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করেছে। এসব সংগঠনের কে কোন পদে আছে তারও উল্লেখ করা হয়েছে। এরপরও যখন এ ধরনের বক্তব্য দেয়া হচ্ছে তখন এই সন্ত্রাসীরা আরো দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে হামলা করছে।


নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তিন দিন আগে সেনাবাহিনী স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেনাসদস্যও চাওয়া হয়েছিল। হ
ঠাৎ করে সে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। এখন নির্বাচন কমিশন বলছে সেনাসদস্যরা সেনানিবাসের ভেতরে থাকবে, রিটার্নিং অফিসার যখন চাইবে তখন স্ট্রাইকিং ফোর্স আসবে। শুরু থেকেই নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিরোধিতা করেছিল ক্ষমতাসীন দল।

খালেদা জিয়া নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়ার পর থেকে ঢাকার ভোটের রাজনীতির চিত্র পাল্টে যেতে থাকে। বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে জনসমর্থন বাড়ার দিকটি দৃশ্যমান হতে থাকে। এর ফলে ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে শঙ্কা বাড়তে থাকে। ক্ষমতাসীনদের ভয় ভোটারদের। কারণ মানুষ যদি শান্তিপূর্ণভাবে নীরবে ভোট দিতে পারে তাহলে খালেদা জিয়ার ঘোষণা অনুযায়ী নীরব বিপ্লব শুধু ঘটবে না, ভবিষ্যতে সরব আন্দোলনে রূপ নিতে পারে।


ক্ষমতাসীনদের এখন একমাত্র কৌশল হচ্ছে ভোটারদের কিভাবে ভোটকেন্দ্র থেকে দূরে রাখা যায়। এ কারণে সেনাবাহিনীর টহল দেয়ার মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণে তারা রাজি নয়। নির্বাচন কমিশন যে চাপের মুখে সেনা মোতায়েনের এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে তা বোঝা কোনো কঠিন বিষয় নয়। নির্বাচন কমিশনের পরিবর্তিত ব্যারাকে সেনা প্রস্তুত থাকার এই সিদ্ধান্ত শুধু অকার্যকর নয়, হাস্যকরও বটে। সেনাসংক্রান্ত নতুন এই সিদ্ধান্তে নির্বাচন কমিশন বলছে রিটার্নিং অফিসার চাইলে সেনাবাহিনী স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করছে। যেখানে সরকারের মন্ত্রীরা সেনা মোতায়েনের বিরোধিতা করছে সেখানে সরকারি কর্মচারী কোন রিটার্নিং অফিসারের সাহস আছে সেনাবাহিনী তলব করবে? আর সেনানিবাস থেকে সেনাসদস্যরা টহল দেয়ার জন্য আসার যে সময় লাগবে তাতে ভোটডাকাতি সম্পন্ন করতে যা হওয়ার তা হবে।


নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয় ক্ষমতাসীন দল ও নির্বাচন কমিশন একমত হয়েছে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যাতে নিরাপদে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতে না পারে। কারণ সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্তের পর সাধারণ মানুষ আশ্বস্ত হয়েছিল; তারা হয়তো শেষ পর্যন্ত নিরাপদে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবে। এখন সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা আরো বাড়বে। যেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ওপর ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা নির্বাচনী প্রচারণায় যাওয়ার সময় প্রতিদিন হামলা করতে পারে। সেখানে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ছাড়া সাধারণ মানুষ কোন সাহসে ভোট দিতে যাবে?


এমন পরিস্থিতিতে বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থীদের নির্বাচনে থাকা অনেকটা অর্থহীন হয়ে পড়ছে। ক্ষমতাসীন দলের কৌশল ছিল বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থীরা যাতে নির্বাচনে অংশ না নেয়। আর অংশ নিলেও তারা যাতে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে না পারে। নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীন দলের এই কৌশল বাস্তবায়নের পথ অনেকখানি সহজ করে দিলো।


এই নির্বাচন কমিশন ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন ও উপজেলা নির্বাচনে নির্লজ্জ কারচুপির আয়োজন করে দিয়ে অনেক আগেই মানুষের আস্থা হারিয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে এক জনসভায় বিএনপি চেয়ারপারসন বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে মেরুদণ্ডহীন বলে উল্লেখ করেছিলেন। সে সময় নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) জাবেদ আলী সাংবাদিকদের সামনে দাঁড়িয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন তাদের মেরুদণ্ড সোজা আছে। এখন সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত যেভাবে বদলে গেল তাতে মনে হচ্ছে নির্বাচন কমিশনারদের মেরুদণ্ড অনেকটা তেলাপোকার মেরুদণ্ডের মতো হয়ে যাচ্ছে। মেরুদণ্ডহীন প্রাণী তেলাপোকা তবু স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ততটুকু স্বাধীনতাও নেই। অবশ্য তারা স্বাধীন থাকতে চান কি না সেটাও একটি প্রশ্ন।


ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক কৌশল বাস্তবায়নে নির্বাচন কমিশনের দলীয় অবস্থানের পরও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেয়নি বিএনপি। বেগম খালেদা জিয়ার গাড়িতে হামলা ও নিরাপত্তাকর্মীদের মারধরের পর নয়া পল্টনে দলীয় কার্যালয়ে অবস্থানের সময় খালেদা জিয়া অনড় অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণা অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন। বুদ্ধিজীবীরা তার নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে প্রচারণা স্থগিত রাখা কিংবা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেয়ার পরামর্শ দিলেও তিনি তা নাকচ করেছেন। বরং প্রচারণা চালিয়ে যাওয়ার তার দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তার আপসহীন ভূমিকার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। ঝুঁকি নিয়ে বিএনপি সমর্থিত খালেদা জিয়া তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেননি। এই নির্বাচনের ফলাফল কী হবে তা তিনিও বোঝেন। সরকারের মন্ত্রীরা প্রকাশ্য বলেছেন, আওয়ামী লীগ জানে কিভাবে কৌশলে নির্বাচনে পাস করতে হয়। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে পাস করবে কিন্তু জনগণের সমর্থন পাবে না। কিন্তু খালেদা জিয়া নির্বাচনী প্রচারণার মধ্য দিয়ে জনগণের শক্তিকে সংহত করতে চান। তিনি এর মধ্য দিয়ে জনগণের মাঝে ফিরে এসেছেন।

ঢাকা মহানগরীতে তার প্রতি শুধু সহানুভূতি বাড়ছে না, বিএনপির পক্ষে জনসমর্থনও বাড়ছে। বেগম খালেদা জিয়া এই প্রচারণার মাধ্যমে সরকারবিরোধী আন্দোলনের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। আর এই ক্ষেত্র তৈরির সুযোগ দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল। এখন বিএনপির নেতাকর্মীরা কতটা সংহত করে জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগাতে পারে তার ওপর নির্ভর করছে সাফল্য। খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কৌশলের কাছে প্রকৃতপক্ষে সরকার পরাজিত হয়েছে। ২০ দলীয় জোটের হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার ও গুম-খুনের পরও খালেদা জিয়া যেন সরকারের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছেন। একজন ব্যক্তিকে ক্ষমতাসীন দল ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এর চেয়ে রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব আর কী হতে পারে?


সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের সামনে সুযোগ এসেছিল এ প্রতিষ্ঠানটির প্রতি মানুষের আস্থা পুনরুদ্ধারের। কিন্তু নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আরেকবার জনগণের সামনে নিজেদের প্রমাণ করল। এর মাধ্যমে সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটির মৃত্যৃ আরো ত্বরান্বিত হলো। নির্বাচন কমিশনের দলীয় ভূমিকা ইতিহাসে কলঙ্ক হিসেবে বিবেচিত হবে।


0 comments:

Post a Comment