WHAT'S NEW?
Loading...

এক জ্ঞানসাধকের তীর্থে

 


‘আমাকে দাফন করো এই গ্রন্থাগারের প্রবেশদ্বারে, যেন ইসলামি বিজ্ঞানের গবেষকদের পদচিহ্ন আঁকা থাকে আমার সমাধির পাশে’। এ দু’টি বাক্য কোনো কবির কবিতার অংশ নয়। এক জ্ঞানসাধকের অছিয়ত বা শেষ ইচ্ছা। এই অছিয়ত পূরণ করে গ্রন্থাগারের প্রবেশদ্বারেই সমাহিত করা হয়েছে জ্ঞানতাপসকে। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বিখ্যাত মনীষা, বিজ্ঞান, দর্শন ও

আইনশাস্ত্রের গবেষক বহু গ্রন্থপ্রণেতা আয়াতুল্লাহ আল-উজমা মারাশি আল-নাজাফি হলেন সেই জ্ঞানতাপস। লিখেছেন আযম মীর


 


শান্ত-পবিত্র নগরী কোমে প্রবেশের পর আমাদের কোচ দু’টি থামল নগরীর পুরনো এলাকার একটি ব্যস্ত সড়কে। আশপাশে প্রাচীন সব ভবন। তারই মাঝখানে একটি ভবনের সামনে আমরা কোচ থেকে নামলাম। বিভিন্ন দেশের অর্ধশতাধিক সাংবাদিকের কাছে তখনো অজানা ওই ভবনের ভেতর কি বিস্ময় অপেক্ষা করছে। ভবনের সরু প্রবেশদ্বারেই একটি সমাধি। কাচঘেরা এই সমাধির গায়েই লেখা আছে সমাধিতে শুয়ে থাকা সাধকের শেষ অছিয়ত। এই সাধকই আয়াতুল্লাহ মারাশি। তার সমাধির পাশে তারই ইচ্ছা অনুযায়ী প্রতিদিন জ্ঞানপিপাসু শত শত শিক্ষার্থী, গবেষক ও পরিদর্শক তাদের পদচিহ্ন এঁকে প্রবেশ করেন তার হাতে গড়া গ্রন্থাগার ও গবেষণাকেন্দ্রে।



সংক্ষিপ্ত জীবনী
আয়াতুল্লাহ মারাশির পুরো নাম আল-উজমা সাইয়ীদ শিহাব আল দ্বীন হুসাইনি আল-মারাশি আল-নাজাফি। ১৮৯৭ সালের ২১ জুলাই ইরাকের পবিত্র নগরী নাজাফে উচ্চ জ্ঞানচর্চার জন্য খ্যাত এক ধার্মিক পরিবারে তার জন্ম। তিনি তার পিতা, প্রখ্যাত আলেম আয়াতুল্লাহ আল-উজমা সাইয়ীদ শামস আল-দ্বীন মাহমুদ হুসাইনি আল-মারাশি আল-নাজাফির হাত ধরে জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করেন। তিনি নাজাফের প্রখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কুরআনভিত্তিক বিজ্ঞান, আইনশাস্ত্র, অঙ্কশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞানসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহু শাখায় জ্ঞান লাভ করেন। তিনি ইজতিহাদের সর্বোচ্চ ডিগ্রি এবং গবেষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।



কয়েক বছর পর আয়াতুল্লাহ মারাশি ইরানের মাশাদ নগরীতে অবস্থিত ইমাম রেজার মাজার

জিয়ারতের জন্য যান। এরপর তেহরানে অবস্থান করে পড়াশোনা ও গবেষণা শুরু করেন। এক বছর তেহরানে থাকার পর তিনি কোমে চলে যান এবং সেখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিছু দিনের মধ্যেই কোমের শীর্ষস্থানীয় উলেমা ও অধ্যাপকেরা তাকে শিয়াদের গ্রান্ড মারজা (ধর্মীয় নেতা) ঘোষণা করেন। সারা বিশ্বের শিয়া ধর্মীয় নেতারা তার ইসলামি আইন সম্পর্কিত ব্যাখ্যা অনুসরণ করেন। তিনি ৬৭ বছর ধরে কোমে শীর্ষস্থানীয় অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষাগবেষণার দায়িত্ব পালন করেন। অগণিত আলেম ও গবেষক তার বক্তৃতা শুনতেন নিয়মিত। প্রায় অর্ধশতাব্দী তিনি হজরত ফাতিমা মাসুমার মাজারে অবস্থিত মসজিদে নামাজে ইমামতি করেছেন। তার অগণিত ছাত্র ইরান ও অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় খ্যাতি অর্জন করেছে।



তিনি বহু গ্রন্থের প্রণেতা। এর বেশির ভাগই আরবিতে লেখা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : মোলহাকাত ও আল আহকাক, আল হাসিয়াহ আলা আল-ওরওয়াত আল-ওথকাহ, মিনহাজ আল-মোমিনিন, তাকরিরাত আল-কাসাস, তাবাকাত আল-নাসাবিন, আল-হাসিয়াহ আল কিফায়াহ আল-উসুল, আল-হাসিয়াহ আলা আল-রাসাইল, রেহলাহ ইসপাহান, সিরাজ, সামারাহ ওয়া আজারবাইজান।



বিশ্বের বহু মনিষী ও বিশিষ্ট ব্যক্তি আয়াতুল্লাহ মারাশির সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাফসির আল মানারের লেখক মিসরের রশিদ রাজা, তাফসির আল-জাওয়াহেরের লেখক শেখ আল তানতাবি আল-জাওয়াহারি, বাগদাদের কার্ডিনাল আল কারমিলি, ফরাসি দার্শনিক হেনরি করবিন, ইয়েমেনের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ শেখ মোহাম্মদ বিন জেবারাহ প্রমুখ।
আয়াতুল্লাহ মারাশি ১৯৯০ সালের ২৯ আগস্ট ৯৬ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। ৩১ আগস্ট, শুক্রবার তেহরানে লাখ মানুষ সমবেত হন তার নামাজে জানাজায়। সারা বিশ্বের বহু শিয়া নেতা ও আলেম এবং ইরানের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা শেষ শ্রদ্ধা জানান এই জ্ঞানতাপসের প্রতি। এরপর মরহুমের ইচ্ছা অনুযায়ী কোমে তারই প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগারের প্রবেশদ্বারে তাকে দাফন করা হয়। তার মাজার ও গ্রন্থাগার এখন ইরানের অন্যতম দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে।



গ্রন্থাগার
তেহরানে প্রতি বছর বেশ আড়ম্বরের সাথে ‘আন্তর্জাতিক প্রেস অ্যান্ড মিডিয়া প্রদর্শনী’ অনুষ্ঠিত হয়। এবারের আয়োজন ছিল অষ্টাদশ। তেহরানের বিশাল খোমেনি শেল্টারে ২৮ অক্টোবর থেকে সপ্তাহজুড়ে অনুষ্ঠিত এই প্রদর্শনী এক কথায় অনন্যসাধারণ। ইরানের ছোট বড় সব সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থা প্রদর্শনীতে বর্ণাঢ্য স্টল সাজায়। এসব স্টলে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম তুলে ধরা হয়। অবাক করার মতো ব্যাপার হলো, প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি অগণিত দর্শক এ প্রদর্শনীতে ভিড় করেছে। সংবাদপত্র-সংবাদ সংস্থার মত বিষয়ে সাধারণ মানুষের জানার এত আগ্রহ থাকতে পারে তা এ প্রদর্শনী না দেখলে কল্পনাও করতে পারতাম না। এই প্রদর্শনীতে বাংলাদেশসহ প্রায় ৩০টি দেশের স্টল ছিল। ইরানের সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় এর আয়োজক। আমন্ত্রিত হয়ে বাংলাদেশের চার সদস্যের প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম এই প্রদর্শনীতে। বাংলাদেশের স্টল সাজানো হয়েছিল দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা-ম্যাগাজিন দিয়ে। পর্যটন করপোরেশনের পোস্টার লিফলেট ছিল স্টলে। বড় ভিডিও স্ক্রিনে বিপিসির তৈরি করা ডকুমেন্টারি দেখানো হয়। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পের কিছু নমুনা দিয়ে সাজানো স্টলটি দেখতে প্রতিদিন অগণিত দর্শকের আগ্রহ আমাদের বিমোহিত করেছে। প্রশংসা করেছেন অন্য দেশ থেকে আসা সাংবাদিকেরাও।



এই প্রদর্শনীতে অংশ নেয়ার পাশাপাশি আমন্ত্রিত সাংবাদিকদের তেহরান ও কোমের কয়েকটি দর্শনীয় স্থান দেখানো হয়। এর একটি ছিল আয়াতুল্লাহ মারাশির গ্রন্থাগার। এটি এখন ইরানের ঐতিহ্যের অংশ। বিশ্বের যেক’টি ঐতিহ্যপূর্ণ গ্রন্থাগার আছে এটি তারও একটি। এর কারণ গ্রন্থাগারের বিশালত্বের জন্য নয়, বরং ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এবং সংগৃহীত বহু মূল্যবান পাণ্ডুলিপি ও গ্রন্থের জন্য। এ সফরকালে তেহরানের জাতীয় গ্রন্থাগার ও আর্কাইভস দেখার সুযোগ পেয়েছি। এটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং আধুনিক গ্রন্থাগার আর্কাইভের অন্যতম। স্থাপত্যের দিক দিয়েও অনন্য। চব্বিশ ঘণ্টাই খোলা থাকে প্রতিষ্ঠানটি। সর্বাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত এই গ্রন্থাগার ও আর্কাইভে গবেষণার আধুনিক ব্যবস্থা আছে। আছে আবাসিক সুবিধাও।



কিন্তু আয়াতুল্লাহ মারাশির গ্রন্থাগারের বৈশিষ্ট্য আলাদা। একজন জ্ঞানতাপসের সাধনা ও ত্যাগের নিদর্শন এটি। মারাশি তার শিক্ষা ও অধ্যাপনা জীবনে বহু কষ্টে সংগ্রহ করেছেন বহু মূল্যবান বা অমূল্য সব পাণ্ডুলিপি। এসব পাণ্ডুলিপির কোনো কোনোটি হাজার বছরেরও আগে রচিত। ৩৭ হাজার মূল্যবান মুদ্রিত গ্রন্থের সংগ্রহ আছে এই গ্রন্থাগারে। কিন্তু তার চেয়েও যা মূল্যবান তা হলো দুই হাজারেরও বেশি পাণ্ডুলিপি। আয়াতুল্লাহ মারাশি নিজ হাতে পাণ্ডুলিপি ও গ্রন্থের নাম ও পরিচয় সংবলিত তালিকা প্রণয়ন করেছেন, যার ১১০টি ভলিউম মুদ্রিত হয়েছে। এই গ্রন্থাগারে সাহাবি, তাবেইন ও তাবে-তাবেইনদের লেখা কুরআন শরিফ ও অন্যান্য গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে। আছে আট শ’ বছর আগে হাতে লেখা ১৬ কিলোগ্রাম ওজনের বিশাল কুরআন শরিফ। হাতে লেখা জাবুর গ্রন্থের কপিও আছে এখানে। মারাশি গ্রন্থ বা পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের জন্য নিজের পোশাক, আসবাব এমনকি তৈজসপত্র পর্যন্ত বিক্রি করেছেন। একবেলা না খেয়ে অর্থ বাঁচিয়েছেন। তিনি ১৯৫৯ সালে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে ২৭৮টি মহামূল্যবান পাণ্ডুলিপি দান করেন। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও তার দান করা পাণ্ডুলিপি সযত্নে রক্ষিত।



১৯৬৫ সালে কোমে তিনি স্থাপন করেন ‘মারাশিয়া ইসলামিক শিক্ষাকেন্দ্র’। এই কেন্দ্রে স্থাপন করেন গ্রন্থাগার। সেটিই এখন মহামূল্যবান ঐতিহ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থী এই গ্রন্থাগার পরিদর্শন করেন এবং গবেষণার জন্য ব্যবহার করেন। ইমাম খোমেনীর নির্দেশে ইরান সরকার ১৯৮৯ সালে মারাশি ইসলামিক কেন্দ্রকে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়। এখন ২১ হাজার বর্গমিটার এলাকাজুড়ে আটতলা ভবনে এই গ্রন্থাগার ও গবেষণা কেন্দ্রটি বিস্তৃত। এতে মূল সংগ্রহশালার পাশাপাশি রয়েছে গবেষণা কক্ষ, পাঠকক্ষ, মুদ্রণালয়, গ্রন্থ হাসপাতাল, সেমিনার কক্ষ ইত্যাদি। প্রাচীন ও জীর্ণ গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপিগুলো অতি আধুনিক সরঞ্জাম দিয়ে মাইক্রোফিল্মে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।



কীটপতঙ্গের আক্রমণ বা অন্য কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বা পাণ্ডুলিপি মূল কপির অনুরূপ করে পুনরুদ্ধার করা হয় ‘বুক হসপিটালে’। মুমূর্ষু রোগীর মতোই প্রাচীন গ্রন্থগুলোর চিকিৎসা হয় এখানে। প্লাস্টিক সার্জারির মতো করে হুবুহু আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয় অঙ্গহানি হয়ে যাওয়া গ্রন্থের।



প্রতিবছর হাজার হাজার দর্শনার্থী পরিদর্শনে আসেন মারাশির এই গ্রন্থাগারে। জ্ঞানপিপাসুদের তীর্থে পরিণত হয়েছে কেন্দ্রটি। জ্ঞানতাপসের মাজার জিয়ারত করে গ্রন্থাগারে প্রবেশ করেছি। কিন্তু তার বিস্ময়কর সংগ্রহশালা দেখে ফেরার সময় বিনম্র শ্রদ্ধায় অশ্রু গড়িয়ে পড়েছে তার মাজার গাত্রে।


 

0 comments:

Post a Comment