[অরুন্ধতী রায়ের মতো আর কেউ ভারতের রাষ্ট্রশক্তির কঠোর সমালোচনা করেননি। তার সংগ্রামের সূচনা পোখরান (পরমাণু বোমার বিস্ফোরণস্থল) দিয়ে। এরপর সোচ্চার হন নর্মদা নদীর বাঁধ ইস্যুতে। কয়েক বছরে তার প্রতিবাদী ভূমিকা বিস্তৃত ছিল জনগণের আন্দোলন ও বিদ্রোহের নানা বিষয়ে এবং গোপনে তৎপর মাওবাদীদের ক্ষেত্রে। ভারতের সরকার, এলিট শ্রেণী, করপোরেট দানব এবং ইদানীং বিশ্ব অর্থ ও পুঁজিবাদের পুরো কাঠামোর বিরুদ্ধে অরুন্ধতী কলম চালিয়েছেন। আদালতের কথিত অবমাননার দায়ে তিনি ২০০২ সালে এক দিনের জেল খেটেছেন। ২০১০-এর নভেম্বরে অরুন্ধতীর নামে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা ঠুকে দেয়া হয়। কারণ তিনি আরো ক’জনের সাথে দিল্লিতে এক সেমিনারে বক্তব্য দিয়েছিলেন।
কাশ্মিরের ওপর আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের বিষয় ছিল, আজাদি বা স্বাধীনতাই একমাত্র পথ। ইংরেজি সাহিত্যে
র সেরা পুরস্কার হিসেবে গণ্য, বুকার পুরস্কার অর্জন করে অনেক আগে থেকেই অরুন্ধতী আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুপরিচিত। আমেরিকার নোয়াম চমস্কি, ব্রিটেনের রবার্ট ফিস্ক ও ইসরাইলের উরি আভনারির মতো ভারতের অরুন্ধতী রায় স্বৈরতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ ও করপোরেট বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে সর্বদাই সরব। অন্যদিগন্তের পাঠকদের জন্য এখানে দেয়া হলো অরুন্ধতীর একটি সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ। নিয়েছেন পানিনি আনন্দ। বাংলায় ভাষান্তর করেছেন মীযানুল করীম।]
প্রশ্ন : রাষ্ট্রদ্রোহিতা, বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইন বা ইউএপিএ কিংবা সশস্ত্রবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইনের (এএফএসপিএ) মতো বিধানগুলোকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখছেন? এসব আইন এমন এক দেশে প্রচলিত রয়েছে যাকে ‘বৃহত্তম গণতন্ত্র’ বলতে বলতে বিরক্ত করে ফেলা হচ্ছে।
অরুন্ধতী : ভারতের গণতন্ত্র সম্পর্কে আপনার এমন কথা শুনে আমি খুব খুশি। নিঃসন্দেহে এটা মধ্যবিত্তের গণতন্ত্র। কাশ্মির, মনিপুর বা ছত্তিশগড়ের মতো জায়গাগুলোতে গণতন্ত্র পাওয়া যায় না। কালোবাজারেও গণতন্ত্র থাকে না। ইউএপিএ হলো, সন্ত্রাস প্রতিরোধ আইন বা পোটার নব্য সংস্করণ। এটা করেছে বর্তমান ইউপিএ সরকার। আর এএফএসপিএ তো স্বেচ্ছাচারিতাপূর্ণ। এসব কালাকানুন পুরোপুরি দায়মুক্তি ভোগ করে জনগণকে বন্দী রাখা, এমনকি হত্যার সুযোগ দিচ্ছে সরকারকে। গণতন্ত্রে এ ধরনের কোনো আইনের জায়গা থাকা উচিত নয়। তবে যদ্দিন এসব কিছু মূল ধারার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অসুবিধা সৃষ্টি করছে না, যে পর্যন্ত এই আইনগুলো মনিপুর, নাগাল্যান্ড বা কাশ্মিরের জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয় কিংবা দরিদ্র জনগোষ্ঠী অথবা মুসলিম ‘সন্ত্রাসবাদী’রা হয় এর টার্গেট, তত দিন মনে হয় না যে, কেউ এসব আইন নিয়ে ভাবে।
প্রশ্ন : জনগণ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, নাকি রাষ্ট্র নিজের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছে? সত্তরের দশকের জরুরি অবস্থা সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী? আগে শিখরা, এখন মুসলমানেরা অনুভব করে যে, তারা টার্গেটে পরিণত হয়েছে। সংখ্যালঘুদের এ অবস্থার ব্যাপারে কী মনে করেন?
অরুন্ধতী : কিছু লোক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। অপর দিকে রাষ্ট্র যুদ্ধ করছে তার নাগরিকদের বেশির ভাগের বিরুদ্ধে। সত্তরের দশকের জরুরি অবস্থা সঙ্কটের জন্ম দিয়েছিল। কারণ ইন্দিরা গান্ধীর সরকার এত বোকা ছিল যে, তারা টার্গেট করেছিল মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীকে। নিম্নবিত্ত আর নাগরিক অধিকারহারা লোকজনের পর্যায়ে মধ্যবিত্তকে নামিয়ে ফেলা ছিল সে সরকারের বোকামি। এখন এ দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল আরো অনেক কঠোর জরুরি অবস্থার মতো পরিস্থিতির কবলে। অবশ্য এই ‘জরুরি অবস্থা’ ঝালাই-সারাই, মেরামত ও মোছামুছির জন্য ওয়ার্কশপে পাঠানো হয়েছিল। সেখান থেকে আরো স্মার্ট-চটপটে, আরো দক্ষ ও কর্মক্ষম হয়ে এটা বেরিয়ে এসেছে। ভারতীয়রা সার্বভৌম জাতি হওয়ার পর থেকে ভারত সরকার যেসব যুদ্ধে নিয়োজিত, সেগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন। নিজের জনগণের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে ডাকার দৃষ্টান্তগুলোর প্রতি নজর দিন। যেমন নাগাল্যান্ড, আসাম, মিজোরাম, মনিপুর, কাশ্মির, তেলেঙ্গানা, গোয়া, বাংলা, পাঞ্জাব ও (শিগগিরই) ছত্তিশগড়। ভারত এমন এক রাষ্ট্র, যে অবিরাম যুদ্ধে লিপ্ত। আর ভারত রাষ্ট্র সর্বদাই উপজাতীয় লোকজন, খ্রিষ্টান, মুসলিম, শিখ প্রভৃতি সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে; তবে কখনো মধ্যবিত্ত ও উচ্চবর্ণ হিন্দুর বিপক্ষে নয়।
প্রশ্ন : রাষ্ট্র যদি চরম বামপন্থী ‘সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলো’র বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়, সন্ত্রাসের দুষ্টচক্র কিভাবে ভাঙা যাবে?
অরুন্ধতী : মনে করি না যে, সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া অনুচিত এমন উপদেশ কেউ দিচ্ছেন। এমনকি ‘সন্ত্রাসবাদী’রা নিজেরাও তা দেয় না। কাজের আইনগত বা অন্যবিধ পরিণাম কী দাঁড়াবে, তা পুরো জেনেই তারা যা করার করছে। তারা তো সন্ত্রাসবিরোধী আইন বাতিল করতে বলছে না। যে সিস্টেম অবিচার-অসাম্য তৈরি করে, এর পরিবর্তনের জন্য ওরা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে, লড়ছে। তারা নিজেদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ মনে করে না। আপনি কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়াকে (মাওবাদী) সন্ত্রাসবাদী হিসেবে অভিহিত করলেও আমি নিশ্চিতভাবেই তা মনে করি না, যদিও নিজে মাওবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী নই। করপোরেট-রাষ্ট্র যৌথ বেদীমূলে জনগণকে বলি দেয়ার বিরুদ্ধে যে-ই প্রতিরোধ গড়ে তুলুক, তাকেই ‘মাওবাদী’ তকমা এঁটে দেয়া হচ্ছে। তারা মাওবাদ সমর্থন করুক আর না-ই করুক, তাদের এ নামেই আখ্যা দেয়া হয়। নিষিদ্ধ সাহিত্য রাখার দায়ে সীমা আজাদের মতো মানুষকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হচ্ছে। তাহলে এখন ২০১২ সালে ‘সন্ত্রাসবাদী’ শব্দটার সংজ্ঞা কী? আসলে অর্থনৈতিক পলিসি দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে বিপন্ন করছে প্রতিবাদী জনতা নয়। অর্থনীতির কারণেই ব্যাপক অসাম্য ও অনটন সৃষ্টি হচ্ছে; মানুষ হচ্ছে উচ্ছেদের শিকার। আমরা রোগের লক্ষণ, নাকি রোগটাই দূর করতে চাই? এই রোগের নাম সন্ত্রাসবাদ নয়; বরং প্রকট অবিচারই প্রকৃত রোগ।
হ্যাঁ, আমরা উন্নত সমাজ গড়লেও মাওবাদী থাকত। সশস্ত্র প্রতিরোধ কিংবা সন্ত্রাসী হামলায় বিশ্বাসী অন্যান্য চরমপন্থী গ্রুপও থাকত। কিন্তু আজ তারা যে সমর্থন পাচ্ছে, তা তখন পেত না। দেশ হিসেবে আমাদের নিজে নিজেই লজ্জিত হওয়া উচিত এই পুঁতিগন্ধময় ঘিঞ্জি বস্তি, এই দুঃখ দৈন্য আর চার পাশে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় উগ্রপন্থাকে সহ্য করার জন্য। নরেন্দ্র মোদি হবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী! বিবেচনাবোধ থাকলে কে তা কল্পনা করতে পারেন? আমাদের ন্যায়বিচারের অনুভূতি নেই; এমনকি তা থাকার ভানও আর আমরা করছি না। যা আমরা করছি, তা হলো আমরা বড় বড় করপোরেশনের কাছে নতজানু। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ডুবন্ত জাহাজের কাছেও আমরা নতজানু হয়ে আছি।
প্রশ্ন : রাষ্ট্র কি জর্জ অরওয়েলের ‘বিগ ব্রাদার’-এর মতো আচরণ করছে ফোনে আড়ি পাতা এবং সামাজিক নেটওয়ার্কে হামলার মাধ্যমে?
অরুন্ধতী : সরকার এতটাই নির্লজ্জ হয়ে গেছে যে, সে স্বীকার করছে আমাদের সবার বিরুদ্ধে সর্বক্ষণই তারা গোয়েন্দাগিরি করছে। আর যদি এর কোনো প্রতিবাদ সরকারের নজরে না পড়ে, তাহলে তারা এটা করবে না কেন? সব শাসকেরই স্বভাব হলো জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করা। সারা দেশ আরো ‘ধর্মভীরু’ হচ্ছে বলে মনে হলেও আমরা রোবটের যুগে প্রবেশ করছি। সেখানে কম্পিউটারচালিত যন্ত্রপাতি সব কিছু নির্ধারণ করবে এবং আমাদের নিয়ন্ত্রণ করবে সম্পূর্ণভাবে। এসব মেশিনপত্রই নির্ধারণ করবে কোনটি নৈতিক, আর কোনটা অনৈতিক। কোন ‘আনুষঙ্গিক ক্ষতি’ গ্রহণীয় এবং কোনটি গ্রহণের অযোগ্য। কম্পিউটার সত্য-মিথ্যার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। মাছির আকারের মতো ক্ষুদ্র যন্ত্র আছে, যা গোয়েন্দাকার্যক্রম চালাতে পারে। এটা আমাদের প্রতিটি নড়াচড়া রেকর্ড করতে সক্ষম। আমি নিশ্চিত, ভারতে এটা আসছে শিগগিরই। এখন চ্যালেঞ্জ হলো, নিবিড় নজরদারি এই পর্যায়ে পৌঁছা সত্ত্বেও কিভাবে প্রতিরোধ অব্যাহত রাখা যায়।
প্রশ্ন : কেন আপনি মনে করছেন জেলে বিচারাধীন বন্দীদের দুর্দশা, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মানুষের হেনস্তা কিংবা ‘এনকাউন্টার’ নামে হত্যাযজ্ঞের প্রতিক্রিয়া নেই? এগুলো কি দু-চারটি মানবাধিকার গ্রুপের তৈরি করা নন-ইস্যু?
অরুন্ধতী : অবশ্যই নন-ইস্যু নয়। এগুলো বিরাট ইস্যু। হাজার হাজার মানুষ জেলে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে নতুবা বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইনের আওতায় তারা বন্দী। মাওবাদী বা মুসলিম ‘সন্ত্রাসবাদী’ হওয়ার অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। উদ্বেগের বিষয় হলো, এই বন্দীদের সংখ্যা কত, তার কোনো সরকারি হিসাব নেই। বিভিন্ন জায়গা ঘুরে এবং ভিন্ন ভিন্ন এলাকার মানবাধিকার কর্মীদের থেকে খোঁজ নিয়ে এই সংখ্যাটা পাওয়ার চেষ্টা করতে হয়। সরকার ও পুলিশের কাছে নির্যাতন এখন পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য ব্যাপার। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (এনএইচআরসি) রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, শুধু গত বছরেই ভারতে বন্দী অবস্থায় মারা গেছে তিন হাজার মানুষ। আপনি জানতে চাইলেন, এর গণপ্রতিক্রিয়া নেই কেন? জবাব হলো প্রতিক্রিয়া জানায়, এমন প্রতিটি লোকই যে, এখন কারাগারে। অথবা তারা হুমকি বা সন্ত্রাসের শিকার। এনজিওগুলো নরম ও বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। এ দিকে চলছে রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও নজরদারি। জানি না, এ অবস্থায় গণ-আন্দোলনের ভবিষ্যৎ আছে কি না। হাঁ, আমরা তাকিয়ে আছি আরব বসন্তের দিকে। তবে একটু কঠিন দৃষ্টিতে তাকান। দেখবেন, সেখানেও মানুষকে দিয়ে ‘খেলানো’ হচ্ছে কলকাঠি নেড়ে। আশঙ্কা হয় আগামী দিনগুলোতে গণপ্রতিরোধের ওপর প্রাধান্য পাবে নাশকতা। সন্ত্রাসবাদ নাশকতার চূড়ান্ত রূপ।
প্রশ্ন : যদি রাষ্ট্রীয় আইন, তৎপর পুলিশ, গোয়েন্দা, এমনকি সশস্ত্রবাহিনীও না থাকে, আমরা কি নৈরাজ্যের কবলে পড়ব না?
অরুন্ধতী : আমরা যদি জনগণের ক্রমবর্ধমান ক্রোধের কারণগুলো দূর না করি তাহলে দেশে নৈরাজ্য নয়, যুদ্ধ বেঁধে যাবে। যখন এমন আইন বানাবেন, যা ধনীর সেবায় নিয়োজিত, যা তাদের সম্পদ কুক্ষিগত রাখা এবং দিন দিন আরো সম্পদ অর্জন করায় সাহায্য করে থাকে, তখন ভিন্ন মত এবং বেআইনি কাজকর্ম সম্মানজনক হয়ে দাঁড়ায়। আমি নিশ্চিত নই যে, মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে গরিব বানানো, তাদের ভূমি ও জীবিকা হরণ করে বড় বড় শহরের দিকে ঠেলে দেয়া, সেখানে তাদের বস্তি গুঁড়িয়ে আবার কোথাও ঠেলে দেয়া, ইত্যাদি অব্যাহত রাখা যাবে। সৈন্য, পুলিশ ও জেলজুলুমের বলে মানুষের ক্রোধকে টুঁটি চিপে থামিয়ে দিতে পারবে বলে মনে হয় না। তাদের অনাহারে রেখে, জেল দিয়ে ও হত্যা করে এর নাম দেয়া হবে ‘মানবিক চেহারার বিশ্বায়ন’।
0 comments:
Post a Comment