মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তানে সিকি শতাব্দী ধরে চলছে এক ব্যক্তির শাসন। কঠোর শাসনে তিলমাত্র প্রতিবাদের অবকাশ নেই জনগণের। কিন্তু ‘বিদ্রোহ’ ধূমায়িত হয়ে উঠছে খোদ শাসক পরিবারের ভেতরেই। এসব নিয়েই হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী লিখেছেন লৌহ যবনিকার অন্তরালে
মধ্য এশিয়ায় কাজাখস্তানের পর উজবেকিস্তানই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ। ইউনেস্কো-ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যে ভরপুর দেশটি। যেমন বিখ্যাত রেশম পথের শহর সমরকন্দ, বুখারা ও খিভা এ দেশেই অবস্থিত। রয়েছে মোজাইকে আবৃত অসংখ্য মসজিদ। আছে রেশম পথে চলাচলকারী বাণিজ্যবহরের স্মৃতিবাহী অগণিত ক্যারাভান সরাই। এ ছাড়া দেশটির মাটির নিচেও আছে সম্পদের পাহাড় ইউরেনিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাসের
বিশাল ভাণ্ডার। আছে সোনার খনিও। এ ছাড়া বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তুলা রফতানিকারকও এই দেশ। এর বাইরে ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানও এ দেশের গুরুত্ব বাড়িয়েছে। তিন কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই দেশটির অবস্থান নতুন স্নায়ুযুদ্ধের ফল্ট লাইনে। ফলে এর সুবিধা নিতে তৎপর রাশিয়া, চীন এবং অবশ্যই আমেরিকা।
এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের শাসক পরিবারে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্বের খবর সম্প্রতি বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছে। বলা হচ্ছে, এ শুধু দ্বন্দ্ব নয়, রীতিমতো নাটক। এমন নাটক, যা মহান নাট্যকার শেক্সপিয়রের কলম ছাড়া আর কারো লেখায় বেরোনো সম্ভব নয়। এ নাটক ক্ষমতার, হাজার কোটি ডলারের এবং দুর্নীতির। এ নাটকের কেন্দ্রে আছেন এক প্রবল প্রতাপান্বিত একনায়ক, যিনি আপন বজ্রমুষ্টিতে ক্ষমতা আঁকড়ে আছেন গত ২৫ বছর। আছেন একনায়কের গ্ল্যামারাস কন্যা, যাকে ক্ষমতার পরবর্তী উত্তরাধিকারী করে গড়ে তোলা হচ্ছিল। আছেন একনায়কের পত্নী, যিনি আপন কন্যাকে পরবর্তী শাসক বানানোর পরিকল্পনার ঘোরবিরোধ। পরিকল্পনাটি ভণ্ডুল করতে তিনি হাত মিলিয়েছেন দেশটির গোয়েন্দাপ্রধানের সাথে।
এই হলো উজবেকিস্তান। এই হলো তার শাসক পরিবারের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের রূপরেখা। বিস্তারিত ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে দেখা যাক, দেশটি কিভাবে চলছে। চলুন যাওয়া যাক ‘মধ্য এশিয়ার আই ওয়েইওয়েই’ নামে খ্যাত শিল্পী ভায়াচেস্লাভ ওখুনভের গোপন স্টুডিওতে। ৬৬ বছর বয়সী এই শিল্পীর শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে প্যারিসের বিখ্যাত পম্পিদু সেন্টারে। কাসেলে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ডকুমেন্টা আর্ট শো-তে এবং ভেনিস বিয়েন্নালে। তার একটি বিখ্যাত স্থাপনাশিল্প হচ্ছে ‘নেতার খাঁচা’। এতে আছে জেলখানার মতো লোহার শিকে ঘেরা একটি বাক্সে লেনিনের আড়াই শ’ আবক্ষ মূর্তি।
ওখুনভের স্টুডিওটি উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দের অপেক্ষাকৃত অনুন্নত এলাকায়। চার দিকে কমিউনিস্ট যুগের কংক্রিটে তৈরি অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক। রাস্তায় কাদা ও জঞ্জাল। অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকগুলোর সিমেন্টের আস্তরণ এখানে-ওখানে খসে গেছে। যত দূর চোখ যায় এই একই দৃশ্য।
শিল্পী ওখুনভের গালে উজ্জ্বল ধূসর দাড়ি। কথা বলেন কম। অনেক কথার জবাব দেন ঘাড় নাড়িয়ে বা ইশারায়। শ্রাগ করেন। মুখখানা হাসি-হাসি। সেই মানুষটিই তার স্টুডিওর তালা খোলার আগে সন্দেহভরা চোখে একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিলেন সরকারের টিকটিকিরা কেউ নেই তো! না, সেদিন ওরা কেউ ছিল না।
স্টুডিওতে ঢুকতে ঢুকতে ওখুনভ বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না। সব একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। ফ্লোর ভেঙে গেছে। বৃষ্টি হলে ছাদ থেকে পানি পড়ে।’ আসলেই। তবে এ ছাড়াও ‘বিশৃঙ্খলা’ আছে। তা হলো শৈল্পিক বিশৃঙ্খলা। দেখা গেল, স্টুডিওর অনেক ক্যানভাস ও ভাস্কর্যে খচিত হয়ে আছে মুসলিম ও খ্রিষ্টীয় প্রতীক। দেয়ালে ঝুলছে হরিণের শিং। এ-ই হলো উজবেকিস্তানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীর কর্মক্ষেত্র, শাসকগোষ্ঠীর সমালোচনা করার ‘অপরাধে’ যার বিদেশ ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাখা হয়েছে।
ওখুনভের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তিনি নিজেকে রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী মনে করেন কি না। জবাব দিতে একটু ইতস্তত করলেন এই শিল্পী। বললেন, ‘আসলে আমার ব্যাপারটাই এ রকম যে, আমি সবসময় কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরোধী। ইসলাম করিমভ একজন স্বৈরাচারী শাসক। তিনি আমাদের সবাইকে ভয় দেখিয়ে চেপে রেখেছেন। কিন্তু তাতে সব কিছু ভেঙে পড়ছে। এই দেখুন না, সামনের রোববার একটি ভোটাভুটি হওয়ার কথা রয়েছে। দেখবেন, ভোটের নামে আসলে তামাশাই হবে ওটা।’
ওখুনভ একটুও ভুল বলেননি। সেই রোববার অনুষ্ঠিত নির্বাচনী প্রহসনে প্রেসিডেন্ট করিমভ ৯০ শতাংশ ভোট পান। ভোটের সেই ফল নিয়ে উজবেকরা গোপনে এবং বিশ্ব সম্প্রদায় প্রকাশ্যে ব্যঙ্গের হাসি হেসেছিলেন।
এ অবস্থায়ও নিঃসঙ্গ সারথীর মতো প্রতিবাদের রথটি চালিয়ে যাচ্ছেন শিল্পী ওখুনভ। কমিউনিস্ট চীনে যেমন ক্ষীণকণ্ঠ ও কোণঠাসা হলেও একটি নাগরিক সমাজ আছে, উজবেকিস্তানে তাও নেই। ফলে ওখুনভ আক্ষরিক অর্থেই নিঃসঙ্গ, একা। তবুও তিনি করিমভের অপশাসনের বিরুদ্ধে ব্লগে লিখে চলেছেন আর তৈরি করছেন স্থাপনাশিল্প। তার একাকীত্বটি কেমন ভয়াল, তা বোঝা যায় তার একটি কথায় : ‘এই তো গতকাল আমি একটি চিত্রপ্রদর্শনীর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সবাই আমাকে দেখে দূরে সরে যায়। কেউ আমার সাথে হ্যান্ডশেক করার সাহসটি পর্যন্ত করেনি।’ এ-ই হলো উজবেকিস্তান। এ-ই হলো প্রেসিডেন্ট ইসলাম করিমভের দেশ শাসন।
শুধু নির্বাচন নয়, দেশ শাসনের সব ক্ষেত্রেই এ অবস্থা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অসংখ্য অভিযোগ তাসখন্দের শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। তারা বলে, রাজনৈতিক নিপীড়নের এমন কোনো পন্থা নেই, যা এই শাসক অবলম্বন করেন না। হাত-পায়ের নখ উপড়ে ফেলা, নগ্নদেহে গরম পানি ঢেলে দেয়া এবং ধর্ষণ এসব এখন নিয়মিত ঘটনা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ১০টি দেশের যে তালিকা করেছে, উজবেকিস্তান তারও অন্যতম।
এত কিছুর পরও ২০১১ সালে ব্রাসেলসে ইসলাম করিমভকে সাদর অভ্যর্থনা জানান ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) প্রেসিডেন্ট হোসে ম্যানুয়েল ব্যারোসো। আর তাসখন্দে লিয়াজোঁ অফিস খোলে ন্যাটো। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর ভূমিকাটি পালন করে জার্মানি। এই দেশটি উজবেকিস্তানের বিরুদ্ধে ইইউর একটি অবরোধ নস্যাৎ করে দেয়।
২০০৫ সালে আন্দিজানে জনতার বিক্ষোভে গুলি চালিয়ে পাঁচ শতাধিক লোককে হত্যা করে উজবেক সরকার। এর প্রতিবাদে দেশটির ওপর অবরোধ আরোপ করে ইইউ। কিন্তু তাতে শামিল হতে অস্বীকার করে জার্মানি। ফলে অবরোধ কার্যত ব্যর্থ হয় এবং একপর্যায়ে তা প্রত্যাহার করা হয়।
জার্মান সরকার উজবেক সেনাকর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়। উজবেকিস্তানের তারমিজে একটি সেনাঘাঁটি ব্যবহারের বিনিময়ে প্রতি বছর দেয় কয়েক কোটি মার্ক (জার্মান মুদ্রা)। উল্লেখ্য, উজবেকিস্তানের এই ঘাঁটি ব্যবহার করে আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েন এবং বর্তমানে প্রত্যাহারের সুবিধা পায় জার্মানি। এ ছাড়া মধ্য এশিয়ার ওপর দিয়ে প্রাকৃতিক গ্যাস সঞ্চালন লাইন বসানোর পরিকল্পনা চলছে, জার্মানি আশা করছে যে এর সুবিধা তারাও পাবে।
তুলনা শুধু উত্তর কোরিয়া
এমন একটি দেশকে অন্য কোনো দেশের সাথে তুলনা করা যায়? কমিউনিস্ট চীন? না। উজবেকিস্তানের তুলনা হতে পারে শুধু কমিউনিস্ট উত্তর কোরিয়ার সাথে।
কিভাবে? আসুন, উজবেক টিভির সুইচ অন করি। খবর শুরু হতেই দেখবেন মহামান্য প্রেসিডেন্ট ইসলাম করিমভ কোনো-না-কোনো নতুন কিছুর ফিতা কাটছেন। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের খবর কয়েক দিন দেখলে ও পড়লে আপনিও ভাবতে বসবেন যে, উজবেকিস্তান তো বেশ সুশাসিত একটি দেশ। সে দেশের মানুষ কী সুখেই না আছে!
তবে দেশবাসী যেমনই থাক, স্বয়ং প্রেসিডেন্ট করিমভ এবং তার দুই কন্যাসহ গোটা পরিবার ‘সবকিছুর ঊর্ধ্বে’ সুখেই ছিল। ‘ছিল’ বলা হচ্ছে কেন? হচ্ছে এ জন্য যে, সেসব দিন বুঝি আর থাকছে না। হাওয়া অন্তত তেমনটিই আভাস দিচ্ছে।
হাওয়ার পাখায় চড়ে এবার একটু পেছনে যাওয়া যাক। তখন সোভিয়েত যুগ। উজবেকিস্তান তখনো সোভিয়েতের একটি প্রজাতন্ত্র। সেই সময়, ১৯৮৯ সালে, উজবেক কমিউনিস্ট পার্টিতে নিজের সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে দমনের ‘কৃতিত্ব’ দেখান করিমভ এবং দলের প্রধান হন। ১৯৯১ সালে উজবেকিস্তান স্বাধীন হলে ইসলাম করিমভ সদ্য স্বাধীন দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি প্রায়ই অভিযোগ করতেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের দেশকে ‘কাঁচামালের উৎসস্থল’ হিসেবে শোষণ করেছে। তার আরো অভিযোগ ছিল, সোভিয়েত শাসকেরা উজবেকিস্তানে রাজনৈতিক বহুমতকে নির্মূল করেছে। অথচ প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এই করিমভই দেশের সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেন এবং নিজেকে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী করতে একটি গণভোটের আয়োজন করেন। সেই তথাকথিত গণভোটে তিনি অবিশ্বাস্য জয় পান। তার প্রাপ্ত ‘ভোটে’র হার ৯৯.৬ শতাংশ।
এরপর চলে তার লৌহকঠিন শাসন। ২০০৪ সালে কথিত ইসলামি চরমপন্থীরা দেশে সিরিজ বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। এ ঘটনায় প্রেসিডেন্ট শুধু এর পরিকল্পনাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েই ক্ষান্ত হননি, তিনি পুলিশকে নির্দেশ দেন সর্বাত্মক অভিযান চালাতে। পুলিশ তার নির্দেশ পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা সরকারবিরোধী বিক্ষোভে নির্বিচারে গুলি চালায় এবং কয়েক হাজার মুসলমানকে গ্রেফতার করে। এ সময় তথাকথিত মানবাধিকারের প্রবক্তা পশ্চিমা বিশ্ব ছিল একেবারে চুপ। কারণ পশ্চিমারা এ সময় আফগানিস্তানে আলকায়েদা ও তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল এবং সেই যুদ্ধে পশ্চিমাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন প্রেসিডেন্ট ইসলাম করিমভ। বন্ধুর বিরুদ্ধে কি টুঁ-শব্দ করা যায়? আরো পরে, পশ্চিমাদের বন্ধুত্ব অর্জনে আরো এগিয়ে যান করিমভ। সে সময় অর্থাৎ ২০১২ সালের জুন মাসে প্রকাশ্যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের বিরোধিতায় নামেন করিমভ এবং রুশ নেতৃত্বাধীন একটি সামরিক জোট থেকে বেরিয়ে আসে উজবেকিস্তান। এতে খুশিতে বাগ বাগ হয় পশ্চিমা বিশ্ব আর করিমভ আত্মবিশ্বাসী হন এই ভেবে যে, পাশ্চাত্য তো আমার পাশে আছেই।
মাকড়সাভরতি জার
প্রেসিডেন্ট ইসলাম করিমভ আসলেই পাকা খেলোয়াড়। তিনি নিজ পরিবারের সদস্যদের একে অন্যের বিরুদ্ধে ঠেলে দিয়ে সেটা প্রমাণ করেছেন। স্বদেশ থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসিত রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলিশার ইলখামভ বিষয়টিকে বর্ণনা করেন এভাবে : ‘উজবেকিস্তানের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্ঘাতকে যদি আপনি একটি বয়ামে (জার) ভরতি মাকড়সার সাথে তুলনা করেন, তাহলে তার (করিমভ) ক্ষমতার মডেলটি অনুধাবন করতে পারবেন। তিনি মাঝে মাঝেই বয়ামটি খালি করে ফেলছেন এবং সেখানে নতুন মাকড়সা পুরে দিচ্ছেন।’
প্রেসিডেন্ট করিমভের নিজের পরিবারও অবিচ্ছিন্নভাবে এই খেলায় জড়িত। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের ফাঁক গলে যে দু-একটি ছোটখাটো খবর বেরিয়ে আসে তাতে জানা যায়, প্রেসিডেন্ট করিমভের উত্তরাধিকারী হবেন তার পরিবারেরই কোনো সদস্য। এ ক্ষেত্রে ফেবারিট হচ্ছেন প্রেসিডেন্টের গ্ল্যামারাস ও চতুর জ্যেষ্ঠ কন্যা গুলনারা করিমোভা (৪২)।
গুলনারা লেখাপড়া করেছেন তাসখন্দ ও হার্ভার্ডে। তরুণ বয়সে কিছু দিন কাজ করেছেন উজবেকিস্তানে মস্কোর দূতাবাসে। মনে করা হয়, বর্তমানে অনেকগুলো তেল ও তুলা রফতানিকারক কোম্পানিতে তার বিপুল শেয়ার রয়েছে। আর এটা তো জানা কথাই, পিতাজীর আশীর্বাদে তার জন্য সব দরজাই খোলা।
গুলনারার আরো কথা
ঘটনাক্রমে ক্ষমতার রাজনীতি ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অন্যতম খেলোয়াড়ে পরিণত হলেও গুলনারা করিমোভার মূল ঝোঁক কিন্তু ফ্যাশন ও পপসঙ্গীতের দিকে। এক সময় তিনি পোশাক ও স্বর্ণালঙ্কারের ব্যবসাও শুরু করেছিলেন। নিজের ডাকনামের সাথে মিলিয়ে এর নাম রেখেছিলেন ‘গুলি’। ২০১১ সালে নিউ ইয়র্কের ফ্যাশন উইকে তার সংগ্রহ প্রদর্শিত হয়। এ ছাড়া একজন বিখ্যাত গায়কের সাথে যৌথভাবে তিনি একটি প্রেমের গানও করেন। সেটির ভিডিও করার জন্য একজন স্টান্টম্যান ভাড়া করা হয়, যাকে বুখারার আকাশে উড়তে দেখা যায়। এই ভিডিওটি বানানোর জন্য বুখারা শহরকে পুরো এক দিনের জন্য অচল করে রাখা হয়। ২০১১ সালে এক মার্কিন কূটনীতিক স্বদেশে পাঠানো এক গোপন বার্তায় (যা পরে ফাঁস করে দেয় উইকিলিকস) লিখেন, ‘গুলনারা হচ্ছে পুরো উজবেকিস্তানে সবচেয়ে ঘৃণীত মহিলা।’ একই সময় গুলনারার অহংকে ব্যঙ্গ করে ‘গুলি লাভস গুলি’ নামে একটি রচনা লিখেন শিল্পী ওখুনভ। সেটি ওয়েবসাইটে দেয়ার অল্প সময় পরই সরকারি সেন্সররা সরিয়ে দেয়।
তবে এতে যে গুলনারা বেঁচে গেল, তা কিন্তু নয়। ২০১৪ সালের মার্চে সুইজারল্যান্ডের ফেডারেল প্রসিকিউটররা ঘোষণা দেন যে, তারা গুলনারার সন্দেহজনক অর্থ পাচারের বিষয়টি তদন্ত করে দেখছেন। একই রকম তদন্ত শুরু করে স্ক্যানডিনেভিয়াও। তবে যথারীতি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন গুলনারা। আর কন্যার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটেছেন পিতাজী। তবে মুখ খুলেছেন গুলনারারই ছোট বোন লোলা করিমোভা। আপন বড় বোনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও শিথিল চরিত্রের অভিযোগ তুলে তিনি বলেছেন, ‘এসব কারণে এখন তাকে আমি আর আমাদের পরিবারের কেউ বলে মনে করি না।’
অবশ্য বড় বোনের বিরুদ্ধে অভিযোগকারিণী লোলা নিজেও ধোয়া তুলসী পাতা নন, সে কথা তামাম উজবেকিস্তান জানে। লোলা এখন ইউনেস্কোয় উজবেকিস্তানের রাষ্ট্রদূত। বাস করেন জেনেভায় চার কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের একটি ম্যানসনে। তিনি করেন বড় বোনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ!
‘আমরা কেউই পরিচ্ছন্ন নই’
কাজে কাজেই ছোট বোনের অভিযোগের জবাব দিতে দেরি করেন না গুলনারা। টুইটারে লিখেন ‘আমরা কেউই পরিচ্ছন্ন নই।’ বলেন, আমার এই বোনটি মাদকাসক্ত। সে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। আমার মায়ের সাথে জোট বেঁধে সে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের বাথটাবের নিচে গোপন স্থানে বিপুল পরিমাণ ডলার লুকিয়ে রেখেছে।
এসব কাণ্ডকীর্তির মুখে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে গুলনারা করিমোভাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। তার অভিযোগ, আমি ও আমার ১৬ বছর বয়সী মেয়েটিকে প্রেসিডেন্টের ধারেকাছে ভিড়তে দেয়া হয় না। আমাদের কোনো চিকিৎসা দেয়া হয় না। পুলিশ একবার আমার আঙুল ভেঙে দিতে চেয়েছিল। মোট কথা, আমাদের সাথে যে আচরণ করা হচ্ছে মানুষ তা কুত্তার সাথেও করে না।
সম্প্রতি প্রাসাদের চোরাইপথ গলিয়ে গুলনারা করিমোভার বর্তমান জীবনের কিছু ছবি বেরিয়ে এসেছে। তাতে দেখা যায়, চার পাশে ইউনিফর্ম পরা রক্ষীর দল তাকে ঘিরে আছে। আর মাঝখানে যে গুলনারা, তাকে চেনাই যাচ্ছে না। এ দিকে সরকারি কৌঁসুলিরা ঘোষণা দিয়েছেন তারা প্রেসিডেন্ট তনয়ার দুর্নীতি তদন্ত করে দেখবেন।
প্রশ্ন উঠেছে, করিমভ সিস্টেম কি তাহলে ব্যর্থ হতে চলেছে? তাহলে দেশটির সরকারি সংবাদমাধ্যম এসব বিষয়ে কিছু লিখছে না বা বলছে না কেন? নাকি এসবই বিশ্ব সম্প্রদায়কে বোকা বানানোর একটা সস্তা কৌশলমাত্র? শিল্পী ওখুনভ বলেন, না। নিজের অতীতকে ছাড়া এই স্বৈরাচারীর আর ভয় পাওয়ার কিছু আছে বলে মনে করি না।
এই শিল্পীর সর্বসাম্প্রতিক শিল্পকর্ম একটি ভিডিও স্থাপনা। তিনি এর নাম দিয়েছেন কানাগলি। প্রশ্ন হলো, কানাগলিতে আটকে গেছে কে উজবেকিস্তান, এর জনগণ নাকি এর শাসকগোষ্ঠী?
0 comments:
Post a Comment