ব্রিটেনের পার্লামেন্ট নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় আবার ক্ষমতাসীন হয়েছে রক্ষণশীল দল। ৭ মে জাতীয় নির্বাচনের পরদিন প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের কনজারভেটিভ পার্টি ৩৩১টি আসলে জিতেছে। এটাকে অবশ্য ‘সঙ্কীর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা’ বলতে হয়। কারণ এর চেয়ে মাত্র সাতটি আসন কম পেলেও রক্ষণশীলরা হারাতেন সংসদীয় গরিষ্ঠতা। তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী শ্রমিক দল বা লেবার পার্টি জয়ী হয়েছে ২৩২টি আসনে, যা রক্ষণশীল দলের চেয়ে শ’খানেক কম।
বিগত নির্বাচনে জয়ী হয়ে রক্ষণশীলদের সাথে মিলে কোয়ালিশন সরকার গড়েছিল যে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, তারা এবার মাত্র আটটি আসন পেয়েছে। অথচ তাদের সাত গুণ বা ৫৬টি আসনে জিতে তৃতীয় স্থানে রয়েছে এসএনপি বা স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি। ব
াকিরা পেলেন অবশিষ্ট ২৩ আসন। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত টিউলিপ সিদ্দিক, রুশনারা আলী, রূপা হক ও ইমরান হোসেন জয়লাভ করেছেন। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরপরই নিজ নিজ দলীয় প্রধানের পদ ছেড়ে দিলেন লেবার পার্টি নেতা এড মিলিব্যান্ড, ‘লিবডেম নেতা ও সদ্যবিগত সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী নিক ক্লেগ এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টি (ইউকেআইপি) নেতা নাইজেল ফারাজে।
ব্রিটেনসহ অনেক দেশেই নির্বাচনী পরাজয়ে দলীয় নেতা কিংবা নিজ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট বড় কোনো অন্যায় বা অঘটনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী সাথে সাথে পদত্যাগ করে থাকেন। আমাদের প্রতিবেশী ভারতেও গণতান্ত্রিক এই ঐতিহ্য পালিত হতে দেখা যায়। বাংলাদেশে পদত্যাগ দূরের কথা, দলপ্রধান বা মন্ত্রী ব্যর্থতা বা দুর্ঘটনার দায়ও স্বীকার না করে অন্যের ঘাড়ে তা চাপিয়ে দেন।
বিবিসি জানায়, বিজয়ী রক্ষণশীলদের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছেন, এক জাতির দল হিসেবে আমরা ব্রিটেনকে আরো শ্রেষ্ঠ করে তুলব।’ স্মর্তব্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, সামরিক শক্তি প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্রিটেন অন্যান্য ‘বৃহৎশক্তি’র চেয়ে পিছিয়ে আছে। কোনো কোনো সময়ে তার ভূমিকা যুক্তরাষ্ট্রের দোসর হিসেবে। এ দিকে বাজারে পড়েছে ব্রিটিশ নির্বাচনী ফলের প্রভাব।
চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার আগে জানা যায়, বুথফেরত ভোটারদের ওপর চালানো জরিপের ফলাফল। এতে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল দল ৩১৬টি, প্রধান বিরোধী দল শ্রমিক দল ২৩৯টি, স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি (এসএনপি) ৫৮টি এবং বর্তমান সরকারের শরিক উদার গণতন্ত্রী দল (লিবডেম) ১০টি আসন পেতে যাচ্ছে। বাস্তবে, রক্ষণশীলরা এর চেয়ে ১৩টি বেশি এবং শ্রমিক দল সাতটি কম পেয়েছে। আর এসএনপি এবং লিবডেম পেল এই পরিসংখ্যান থেকে দু’টি করে কম আসন।
ব্রিটেনের ইতিহাসে এটি ৫৬তম পার্লামেন্ট নির্বাচন। এবার এক দিকে এশীয় বংশোদ্ভূত, তথা অভিবাসীরা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, অন্য দিকে ব্রিটেন কল্যাণ রাষ্ট্রের চরিত্র বজায় রাখতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। এর পাশাপাশি, প্রার্থীরা ‘ভাসমান ভোট’কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, স্কটিশদের ছাড়া ব্রিটিশ সরকার বৈধতা হারাতে পারে বলে তারা হুঁশিয়ারি করে দিয়েছেন।
অভিবাসী ফ্যাক্টর ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা এবং এর বিপরীতে কিছু বর্ণবিদ্বেষী কর্মকাণ্ডের মাঝে এবার বাংলাদেশী ‘ওরা এগারোজন’ আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠেন। তাদের সাতজন লেবার পার্টি, তিনজন কনজারভেটিভ পার্টি এবং অপরজন লিবারেল ডেমোক্র্যাট পার্টি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তাদের মধ্যে ‘তিন কন্যা’কে বেশি সম্ভাবনাময় মনে করা হয়েছে। তারা জয়লাভ করেছেন প্রত্যাশামাফিক।
এবার ব্রিটেনে প্রধান নির্বাচনী ইস্যুগুলোর মধ্যে ছিল জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা, অভিবাসন, এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মতো বিষয়। ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের প্রতিদ্বন্দ্বী এড মিলিব্যান্ড সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিলেন স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিকে। তার মতে, দেশের হাসপাতালসহ চিকিৎসাব্যবস্থার করুণ দশা। প্রচারণার শেষপর্যায়ে মিলিব্যান্ডের আহ্বান ছিল স্বাস্থ্য খাত বাঁচিয়ে রাখতে ভোট দিন রক্ষণশীল দলকে। অপর দিকে, ক্যামেরন ভোটারদের কাছে ওয়াদা করেছেন, এখন থেকে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য খাতে নজর দেবো। অর্থনীতি শক্তিশালী হলে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিতে সক্ষম হবো।
ব্রিটেনের এবারের নির্বাচনকে সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে অনিশ্চিত নির্বাচন বলে অভিহিত করা হয়েছিল। ব্রিটেন কল্যাণ রাষ্ট্ররূপে ভূমিকা রাখবে কি না ভবিষ্যতে, বিষয়টি বড় হয়ে উঠেছিল। এবারই প্রথম অনলাইনে ভোট দেয়ার ব্যবস্থা ছিল। উল্লেখ্য, ব্রিটেনের ৬ কোটি ৪৩ লাখ মানুষের মধ্যে ভোটার ৫ কোটি। ভোটকেন্দ্র ছিল ৫০ হাজার। ২০১০ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন। এর মেধ্য ১৫ শতাংশ ছিল ডাকযোগে দেয়া ভোট। যা হোক, এবার নির্বাচনের আগে সম্ভাব্য ফলাফল সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করা যাচ্ছিল না।
এক-চতুর্থাংশ ভোটার ছিলেন সিদ্ধান্তবিহীন। তাই এই ‘ভাসমান ভোটার’ নির্বাচনী ফল নির্ধারণে ‘ফ্যাক্টর’ হবেন বলে মনে করা হয়েছিল।
ব্রিটিশ নির্বাচনে বিভিন্ন দলের ফলাফল বিশ্লেষণ করে মিডিয়া রক্ষণশীলদের পুনঃবিজয়কে 'Surge in Tory votes' এবং 'gain in key seats' হিসেবে অভিহিত করেছে। অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ স্কটল্যান্ড এবং ক্ষুদ্র উত্তর আয়ারল্যান্ডে মূল আসনগুলোতে রক্ষণশীলদের সাফল্য নেই।
অপর দিকে, এবার শ্রমিক দলের ফলাফলকে ‘অনেক বছরের মধ্যে সবচেয়ে মন্দ ফল’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। সিএনএন শেক্সপিয়রের একটি সাহিত্যকর্মের শিরোনামে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন এনে বলেছে শ্রমিক দল সম্পর্কে, No Love, Lagour's Lost (ভালোবাসা পায়নি, লেবার হেরে গেছে)। ক্যামেরনের বিদায়ী সরকারের অংশীদার লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা গতবারের চেয়ে এবার নির্বাচনে ১৫ শতাংশ ভোট কম পেয়েছে। উত্থান ঘটছে এসএনপির। স্কটল্যান্ডের আঞ্চলিক দল না হলে হয়তো বলা যেত, একদিন দলটি জাতীয় রাজনীতিতে ‘তৃতীয় শক্তি’ হয়ে উঠবে।
টিভি চ্যানেলে উল্লেখ করা হয়েছে, SNP wipes out Labours in Scotland (এসএনপি স্কটল্যান্ডে শ্রমিক দলকে নির্মূল করে দিয়েছে)। ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের পুরনো আসনেও জয় পেয়েছে এসএনপি। তাদের নির্বাচনী কৃতিত্ব মিডিয়ার দৃষ্টিতে যঁমব মধরহ (বিপুল অর্জন)।
রক্ষণশীল দল আবার ব্রিটেনের ক্ষমতায় অধিষ্টিত হলো। জনগণের কাছে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করাই এখন বড় করণীয়। অন্যথায় পরবর্তী নির্বাচনে বিজয়ের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব না-ও হতে পারে। এটা স্পষ্ট, আগামী বছরগুলোতে সরকারের রাজনৈতিক সাফল্য অনেকটা নির্ভর করবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দক্ষতার ওপর।
মীযানুল করীম
0 comments:
Post a Comment