WHAT'S NEW?
Loading...

থাইল্যান্ড : মানবপাচার ট্র্যাজেডি

 


বাংলাদেশ থেকে শত শত মানুষকে ভালো চাকরির লোভ দেখিয়ে বেআইনিভাবে পাচার করা হয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই সমুদ্রপথে এটা চলছে, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে। আগে স্থলপথে গরিব নারী-পুরুষকে পাচার করা হতো ভারত হয়ে পশ্চিম দিকের দেশগুলোতে। আর সর্বশেষ খবর হলো, আকাশপথেও এখন চলছে অবৈধ মানবপাচার।



সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ও মর্মান্তিক হলো, থাই-মালয় সীমান্তে নির্যাতনশিবির ও গণকবর আবিষ্কার। পাচারচক্র সেখানকার জঙ্গলে অসহায় বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা অভিবাসীদের এনে রাখত গোপনে। মালয়েশিয়া পাচারের প্রাক্কালে অনেককে সেখানে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করা হতো। এ জন্য চলত নির্যাতন। রোগে বা নির্যাতনে মৃত্যু হলে ভাগ্যহত এসব লোককে বনের মাঝে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হতো। থাইল্যান্ড ইতোমধ্যেই মানবপাচারের কু

খ্যাত রুট হিসেবে বিশ্বে নিন্দিত হয়েছে। সে দেশের প্রশাসনের অসৎ ও দুর্নীতিবাজ অনেকের যোগসাজশেই বছরের পর বছর বেআইনি পাচার চলে আসছে।



মে মাসের শুরুতে থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলাকীর্ণ শঙ্খলা অঞ্চলে, মালয়েশিয়ার সীমান্তের কাছে দু’টি গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। পুলিশ এগুলো থেকে ২৬ জনের দেহাবশেষ উদ্ধার করে। তারা বাংলাদেশী নাগরিক এবং মিয়ানমারের রোহিঙ্গা। জানা গেছে, মুক্তিপণ আদায়ে ব্যর্থ হয়ে পাচারকারী দুর্বৃত্তরা এদের নির্যাতন করে হত্যা করেছিল। এভাবে কতজনকে প্রাণ দিতে হয়েছে, কে জানে। মিডিয়ার আরো খবর, পাচারকারীরা থাই-মালয় সীমান্ত-ঘেঁষে অন্তত ৬০টি বন্দিশিবির চালু করেছে। একেকটিতে আটকে রাখা হয় দেড় শ’ থেকে আট শ’ জনকে, যারা প্রধানত বাংলাদেশ থেকে গিয়েছেন।


জানা গেছে, ভালো আয় ও উন্নত জীবনযাত্রার স্বপ্নে অসংখ্য মানুষ পাচারচক্রের ফাঁদে পা দিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন দেশের বাইরে অনিশ্চিতের পথে। পাচারকার্যক্রম সম্পূর্ণ বেআইনি এবং রুটও বিপজ্জনক। এই ঝুঁকিপূর্ণ তৎপরতা পরিচালনা করছে ২৪১ জন দালাল। এরা বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার লোক। এদের আন্তঃদেশীয় নেটওয়ার্কের সাথে কোনো কোনো দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও জড়িত। শুধু ২০১৪ সালেই দালালচক্র ২০ হাজার মানুষকে আমাদের দেশ থেকে পাচার করে দিয়েছে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায়। সমুদ্রপথে যাওয়ার সময়ে নৌকা ডুবে মারাও গেছে অনেকে।



বিভিন্ন সূত্রে সাংবাদিকেরা খবর নিয়ে আশঙ্কা করছেন, থাই বন্দিশিবিরে অর্ধসহস্রাধিক অভিবাসীকে দুর্বৃত্তরা হত্যা করেছে। এসব মানুষ পাচার ও অপহরণের শিকার। মানবপাচার বন্ধ করতে ব্যর্থ হলে থাইল্যান্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন হুঁশিয়ারি দিয়েছে।



পাচারকারীদের কবল থেকে কোনো মতে রক্ষা পেয়ে এক ব্যক্তি জানান, চাকরির আশ্বাস দিয়

ে কিংবা স্রেফ ‘মুক্তিপণ’ আদায়ের জন্য কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে থাই বন্দিশিবিরগুলোতে আটক রাখা হতে পারে। ছয় মাস আগে তাকে পাচারকারীরা নিয়ে যায় মিয়ানমারের রাখাইন স্টেট (আরাকান) থেকে। তিনি থাই অঞ্চলের যে শিবিরে বন্দী ছিলেন, সেখানে প্রায় ৮০০ জন আটক ছিলেন। এই অভিবাসীর মা জমি বেচে টাকা জোগাড় করে পাচারকারীদের কাছে পাঠানোর পর তিনি ছাড়া পান।


প্রত্যক্ষদর্শী এক ব্যক্তি পুলিশকে জানিয়েছেন, অসহায় অভিবাসীদের ওপর নির্যাতন, এমনকি পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। এক লোকের মুক্তিপণ রূপে ৯৫ হাজার বাথ (থাই মুদ্রা) দেয়ার পরও তাকে জীবিত পাওয়া যায়নি। পাচারকারীরা কত বেশি নিষ্ঠুর ও বেপরোয়া, এর নগ্ন নজির এই ঘটনা। নিহত ব্যক্তির মামা জানান, তার ভাগ্নের মুক্তির জন্য প্রথমে ৯৫ হাজার বাথ দেয়ার ১৫ দিন পর আরো এক লাখ ২০ হাজার বাথ দাবি করা হয়। তা পূরণে অপারগ হলে পিটিয়ে ওকে মেরে ফেলা হয়।



৮ মে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে জাতিসঙ্ঘের উদ্বাস্তু সংক্রান্ত হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর)। তাদের পরিসংখ্যান মতে, ২০১৫ সালের মাত্র প্রথম তিন মাসে, অর্থাৎ অতি সম্প্রতি ২৫ হাজার বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গাকে থাইল্যান্ডে পাচার করা হয়েছে বঙ্গোপসাগর দিয়ে। তাদের মধ্যে ৩০০ জনের মৃত্যু ঘটেছে। এই সংখ্যা গত দুই বছরের হিসাবের দ্বিগুণ। অর্থাৎ, গত কিছু দিনের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বিশেষ করে সমুদ্রপথে থাইল্যান্ড হয়ে মানুষ পাচারের ঘটনা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। এ দিকে থাই সরকার অর্ধশত পুলিশকে বদলি করেছে, যারা মানবপাচারে জড়িত। তবে নিছক বদলি করা এমন জঘন্য অপরাধের কোনো শাস্তি নয়, আইওয়াশ মাত্র। এদের কঠোর শাস্তিই ন্যায়নীতি ও মানবতার দাবি।



টিভিতে ইউএনএইচসিআরের ওই তথ্যের সাথে বাংলাদেশের আরো দু’টি প্রাসঙ্গিক খবর প্রচারিত হয়েছে। একটি হলো, এ দেশে মানবপাচারের ‘অভয়ারণ্য’ মনে করা কক্সবাজার জেলায় তিনজন শীর্ষ পাচারকারী বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। আটক হয়েছে এদের আগ্নেয়াস্ত্র গুলিসহ। এই সংঘর্ষে চারজন পুলিশও আহত হয়। আরেক খবর হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে অবৈধ মানবপাচারে জড়িত ২৬৭ জন দালাল ‘ধরাছোঁয়ার বাইরে’। এদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটকালে সহজেই জামিনে বেরিয়ে এসে একই অপকর্মে লিপ্ত হয়। যেখানে এই সরকারের আমলে বহু নিরীহ-নিরপরাধ লোকও আটক বা গ্রেফতার হচ্ছে, মামলা ও রিমান্ডের শিকার; সেখানে পাচারকারী দুর্বৃত্তরা অনায়াসে জামিন পায় কিভাবে? নিঃসন্দেহে অসৎ ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারসাজিতে এবং পলিটিক্যাল কানেকশনে। আর যে দালালদের ‘ধরাছোঁয়া’ যায় না, এদের হাত কত লম্বা, তা অনুমেয় সহজেই।


শুধু এদের নয়, সংশ্লিষ্ট গডফাদারদের বিরুদ্ধেও অবিলম্বে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
সর্বশেষ খবর হলো, থাইল্যান্ডে শঙ্খলা এলাকায় মোট ১১৭ জনকে পুলিশ উদ্ধার করেছে, যাদের গোপনে পাচার করা হচ্ছিল। এদের ৯১ জন বাংলাদেশী এবং বাকিরা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসিলম। এযাবৎ পাচারকারীদের চারটি নির্যাতন ক্যাম্পের খোঁজ মিলেছে আর গণকবরে সন্ধান পাওয়া গেছে ৩৩ জনের লাশ। পাচারকারী দুর্বৃত্তরা মৃত্যুর পর তাদের মাটিচাপা দিয়েছিল। এ দিকে মানবপাচারের প্রধান রুট কক্সবাজার অঞ্চলে পুলিশ ব্যাপক অভিযানে অবতীর্ণ হয়েছে। পুলিশের আইজি বলেছেন, প্রতিবেশী দেশের সহায়তা নিয়ে পাচার প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।


মীযানুল করীম


 

0 comments:

Post a Comment