WHAT'S NEW?
Loading...

ইয়েমেন : যুদ্ধ থামার লক্ষণ নেই

 


৭ মে রাতের খবর, সৌদি আরব ইয়েমেনে পাঁচ দিনের মানবিক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে। তবুও অমানবিক বিমান হামলা অব্যাহত রয়েছে। এক দিকে ইয়েমেনের হাউছি বিদ্রোহী এবং সাবেক প্রেসিডেন্টের সমর্থকেরা; অন্য দিকে সৌদি নেতৃত্বাধীন ও আন্তর্জাতিক সমর্থনপুষ্ট জোট। এই জোটে কয়েকটি আরব রাষ্ট্র শামিল রয়েছে। তারা প্রধানত বিমান হামলায় লিপ্ত এবং বিদ্রোহীরা যুদ্ধ করছে ভূমিতে। যুদ্ধবিরতি ঘোষণার ঠিক আগের দিনের খবর হলো ইয়েমেনে বিমান হামলায় নিহত ১২০, আহত শতাধিক।


অপর দিকে, বিদ্রোহীরা সৌদি ভূখণ্ডে কামানের গোলা ছুড়েছে। এতে তিনজন নিহত হয়েছে। অর্থাৎ গৃহযুদ্ধ এখন ইয়েমেনের ঘর ছাড়িয়ে পরের অঙ্গনেও আগুন জ্বালাতে যাচ্ছে। আরব মোর্চার হামলা যত বাড়ছে, বিদ্রোহীরা ততই মরিয়া হয়ে উঠছে। আশঙ্কা হয়, আরো বহু নারী-পুরু

ষ শিশু-বৃদ্ধ হতাহত হবে ইয়েমেনে; বিধ্বস্ত হবে আরো অনেক জনপদ। ইয়েমেনের সৌদি সমর্থনপুষ্ট হাদি মনসুর সরকার আরব জোটের কাছে স্থলপথেও হামলা চালাতে অনুরোধ করেছে। জাতিসঙ্ঘে এর রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ‘হাউছিদের হাত থেকে রক্ষার জন্য বিমান হামলা অপর্যাপ্ত; এবার চাই স্থলসেনাও।’



ইয়েমেন আর উপদ্বীপ বা জাজিরাতুল আরবের সর্বদক্ষিণ প্রান্তে। এই বৃহৎ উপদ্বীপই মূল আরব ভূমি সেখানে পবিত্র মক্কা-মদিনা অবস্থিত। পাশের সৌদি আরবের তুলনায় ইয়েমেন অনেক ছোট। দেশটি মোটামুটিভাবে পূর্ব-পশ্চিমে প্রলম্বিত এবং সাবেক দক্ষিণ ইয়েমেন ছিল সাবেক উত্তর ইয়েমেনের দ্বিগুণেরও বড়। আর বিশ্বে ইয়েমেনের সবচেয়ে বেশি পরিচিত স্থান হলো এডেন যা একই সাথে ব্যস্ত নৌ ও বিমানবন্দর। এর নিকটবর্তী বাবেল মানদেব প্রণালী দিয়ে লোহিত সাগরে যাওয়া-আসা করতে হয়। এই নৌরুট বিশ্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ বললে অত্যুক্তি হয় না। যা হোক, দুই ইয়েমেন এক হলে ক্ষুদ্রতর ও দরিদতর উত্তর অংশের প্রেসিডেন্ট যেমন ঐক্যবদ্ধ ইয়েমেনেরও প্রেসিডেন্ট হলেন, তেমনি রাজধানী হলো ওই অংশের রাজধানী সানা। এটি প্রাচীন নগরী এবং আল কুরআনে বর্ণিত আবরাহার শাসনকেন্দ্রও ছিল। দরিদ্রতম আরব রাষ্ট্র ইয়েমেনের তেলসম্পদ কম নয়।


দেশটির পশ্চিম অংশে মারিব এবং মধ্য অঞ্চলে মাসিলা নামে দু’টি বড় তেলক্ষেত্র রয়েছে। জ্বালানিসম্পদ থাকা সত্ত্বেও কেন ইয়েমেন আজো গরিব, এর কারণ উদঘাটন এবং দূরীকরণের মাঝে দেশটির সমস্যার সমাধান অনেকটা নিহিত। এখন ইয়েমেনের হাউছিদের নির্মূল অভিযান চললেও তাদের চেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ চরমপন্থী আলকায়েদা। আরব উপদ্বীপে ওদের আস্তানা ইয়েমেনেই। এ দেশের মাঝ বরাবর, উত্তরে সৌদি সীমান্ত থেকে দক্ষিণে সাগরের উপকূল পর্যন্ত বিশাল এলাকা এই জঙ্গিদের প্রভাবিত।



ইয়েমেনের ইস্যুটিকে নিছক ‘বৈধ সরকারের বিরুদ্ধে অবৈধ বিদ্রোহ’ এমন সরলীকরণ শুধু খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গির পরি

চায়ক নয়। সঙ্কটের মূল কারণ উপলব্ধি না করে এভাবে পরিস্থিতি বিচার করা মানে, বাস্তবতার অস্বীকৃতি। কেবল ‘বিদ্রোহ দমন’কে লক্ষ্য হিসেবে নেয়া হলে ক্ষয়ক্ষতি বাড়তে থাকবে এবং দেশটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে; তবে শান্তি ও স্থিতি আসবে না। যত দেশই এক হয়ে হামলা করুক কিংবা জাতিসঙ্ঘ, আরব লিগ, ইইউ, আমেরিকা যত সমর্থন দিক না কেন, ভুল পন্থায় সঙ্কটের সুরাহা হবে না। সঙ্ঘাত নয়, সংলাপ চাই। যুদ্ধের পাশাপাশি শান্তি প্রয়াস শুরু করে অব্যাহত রাখা যায়। এ জন্য সমঝোতার মনোভাব থাকা জরুরি। ইরান মধ্যস্থতার উদ্যোগ নিলেও তার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ থাকায় এটা সফল হয়নি। বরং তুরস্কের মতো প্রভাবশালী মুসলিম রাষ্ট্র ঠিকমতো উদ্যোগ নিয়ে, বাস্তবতার যথাযথ উপলব্ধিসহকারে সমঝোতা প্রয়াস এগিয়ে নিতে পারলে সুফল মিলতে পারে। পাকিস্তানও অবিলম্বে সঙ্ঘাত বন্ধ করে সমঝোতার ওপর জোর দিয়েছে।


মুসলিম উম্মাহর দুর্ভাগ্য, এ ক্ষেত্রে ওআইসি বা ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার মুরব্বিসুলভ ভূমিকা সবার প্রত্যাশিত হলেও সংস্থাটি নীরব দর্শক, বড়জোর ‘লিপ সার্ভিস’দাতায় পরিণত হয়েছে। আরব লিগ তো অনেক আগেই অকার্যকর হয়ে গেছে।



সৌদি আরব পাকিস্তানকে অনুরোধ করেছিল ইয়েমেনে বিদ্রোহ দমনে সৈন্য পাঠাতে। এটা পাকিস্তানের জন্য ছিল বিরাট পরীক্ষা। কারণ, দেশটি সৌদি আরবের মিত্র; অন্য দিকে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে পাকিস্তানকে দুর্নাম কুড়াতে হবে এবং নানাভাবে সে ক্ষতি ও সমস্যার মুখে পড়বে। পাকিস্তানে সৌদি প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে জনমত বিভক্ত। শেষাবধি, পার্লামেন্ট সৈন্য না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আবার এটাও জানিয়ে দিয়েছে, মক্কা-মদিনা আক্রান্ত হলে পাকিস্তান সৈন্য পাঠাতে দ্বিধা করবে না। অবশ্য দু’টি আরব দেশের মধ্যে বিরোধ হলে পাকিস্তান নিরপেক্ষ থাকাই শ্রেয় মনে করে। ইয়েমেন ইস্যুর সুরাহার জন্য যেকোনো মধ্যস্থতা প্রয়াসকে ইসলামাবাদ স্বাগত জানাবে।
ইয়েমেনে বহুমাত্রিক বিভেগ ও বৈষম্য সঙ্কটের চরিত্র জটিল করে তুলেছে। অর্ধশতাব্দী আগেও শিয়া বিদ্রোহীদের তৎপরতা ছিল। এর বাস্তব প্রেক্ষাপটও ছিল। সেটা ছিল তদানীন্তন উত্তর ইয়েমেনের সমস্যা।


১৯৯০ সালে উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেন এক হয়ে অভিন্ন রাষ্ট্র গঠন ছিল একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। তবে দুই ইয়েমেনের মাঝে অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে যায়। এডেনের মতো নৌবন্দরের সুবাদে দক্ষিণ ইয়েমেনের আর্থিক অবস্থা আগে থেকেই অপেক্ষাকৃতভাবে উন্নত ছিল। ঐক্যবদ্ধ ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট হন উত্তর ইয়েমেনে ১৯৭৮ থেকে ক্ষমতাসীন আলী আবদুল্লাহ সালেহ। তিনি ২০১২ সালে বিতাড়িত হওয়া পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। অথচ ২২ বছরেও উত্তর ইয়েমেনের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত না করে নিজের স্বৈরক্ষমতা পোক্ত করার দিকে ছিলেন অধিক মনোযোগী। আরব বসন্ত সালেহর স্বৈরশাসনের অবসান ঘটালেও গণতন্ত্র আসেনি। প্রভাবশালী প্রতিবেশীরা দেশটিতে সত্যিকার গণতন্ত্র চায় কি না সন্দেহ। ইয়েমেনের ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক বিভাজন ও অসন্তোষ দূর না হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার আশা করা যায় না। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সবার জেদের মনোভাব ত্যাগ করে আপসের আগ্রহ দেখাতে হবে। গদি আঁকড়ে রাখা কিংবা দখল করার পাঁয়তারা শুধু হানাহানি-রক্তপাত বাড়িয়ে দেবে। শিয়া সংখ্যালঘুরা জাতীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া যেমন অবাস্তব, তেমনি তাদের বাদ দিয়ে শান্তি কায়েম করা অসম্ভব।



ইয়েমেনের এডেন ও তায়েজ নগর শিয়া বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। সাবেক প্রেসিডেন্ট সালেহর সমর্থক সুন্নিরাও বিদ্রোহ করে লড়াইয়ে নেমেছে। ২৪ মার্চ জাতিসঙ্ঘকে সানা সরকারের অনুরোধের সূত্রে ২৬ মার্চ থেকে সৌদি নেতৃত্বে প্রচণ্ড বিমান হামলা চলে আসছে। এতে শত শত মানুষ মারা গেছে যাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ শিশু। পরিস্থিতিদৃষ্টে আশঙ্কা হচ্ছে, অচিরেই আরব জোটের স্থলসেনারাও যাবে ইয়েমেনে। তখন যুদ্ধ প্রচণ্ডতর হওয়ার পাশাপাশি সীমান্ত পেরিয়ে সৌদি ভূখণ্ডেও বিস্তৃত হওয়া বিচিত্র নয়। অচিরে এই আত্মঘাতী লড়াই বন্ধ হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।


মীযানুল করীম


 

0 comments:

Post a Comment