আলফাজ আনাম
বাংলাদেশ এখন চূড়ান্ত বিচারে একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও দাবি করেন, এই সরকারকে পুলিশ টিকিয়ে রেখেছে। ফলে সরকারবিরোধী যেকোনো তৎপরতার বিরুদ্ধে পুলিশ অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন দ্রুত ও কঠোর অ্যাকশন নিতে পারছে। কারণ পুলিশের মধ্যে এই ধারণা তৈরি হয়েছে যে তাদের তৎপরতার ওপর সরকারের টিকে থাকার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। সরকারের সমালোচনা হয় বা বিরুদ্ধে যায় এমন যেকোনো তৎপরতা দমনে পুলিশ বদ্ধপরিকর। এক্ষেত্রে কোনো সংগঠন বা ব্যক্তির উদ্যেগে সভা-সমাবেশ বা মিছিল হচ্ছে তা বিবেচনার বিষয় নয়। বিবেচনার বিষয় হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের কেউ জড়িত আছে কি না তা দেখা। যদি তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকে তাহলে কোনোভাবেই পুলিশ কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেবে না। এটাই এখন পুলিশে
র দায়িত্ব। সরকারকে টিকিয়ে রাখার কর্তব্যবোধ থেকে পুলিশ এ ধরনের অবস্থান নিয়ে থাকে।
সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনে পুলিশের বিরুদ্ধে গুম ও খুনের অভিযোগ অনেক পুরনো। প্রকাশ্যে রাস্তায় পায়ে গুলি করার ঘটনাও আমরা দেখেছি। এমন ছবি সংবাদপত্রে বহুবার ছাপা হয়েছে। রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষের কাতরানির দৃশ্য টেলিভিশনে দেখানো হয়েছে। সে সময় সমাজের শিক্ষিত সচেতন মানুষ বিশেষ করে যারা সুশীলসমাজের সদস্য তারা ছিলেন নির্বিকার। পুলিশের এ ধরনের প্রথম টার্গেটে পরিণত হয়েছিল ইসলামপন্থী রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্টরা। আমাদের শিক্ষিত সমাজের বিরাট অংশের মধ্যে ধর্ম বিশেষত ইসলামের ব্যাপারে ঘোরতর আপত্তি আছে। স্বাভাবিকভাবেই ইসলামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত তরুণরা যখন গুম, খুন ও পঙ্গু হয়ে যাচ্ছিলেন তখন তারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা দূরে থাক, অনেকে এসব পুলিশি নিপীড়নের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। পুলিশের অ্যাকশন যে কতটা নায্য তার পক্ষে টকশো মাতিয়ে তুলতেন।
গত রোববার এভাবে পুলিশি নির্মমতার শিকার হয়েছেন কিছু ছাত্র। এরা ইসলামপন্থী রাজনীতির সম্পূর্ণ বিপরীত পক্ষের। পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় অনেক নারী লাঞ্ছনা ও শ্লীলতাহানির শিকার হন। এসব নারীকে রক্ষার জন্য সেখানে পুলিশ কোনো ভূমিকা পালন করেনি। পাশে অবস্থানরত ছাত্র ইউনিয়নের কিছু নেতাকর্মী লাঞ্ছিত নারীদের রক্ষার চেষ্টা করেন। এতে ছাত্র ইউনিয়নের কয়েকজন কর্মী আহত হন। এই নারী নির্যাতন ও রক্ষা করতে যাওয়া ছাত্রদের যারা আহত করেছিল, তারা সবাই ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের সদস্য। এর মধ্যে পয়লা বৈশাখের দিন নারী লাঞ্ছনার সময় ছাত্রলীগের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নেতাকে সাধারণ মানুষ মারধর করেন।
পয়লা বৈশাখে নারী লাঞ্ছনার ঘটনার বিচার দাবি করে ছাত্র ইউনিয়নসহ বাম ছাত্রসংগঠনগুলো ধারাবাহিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক কর্মসূচি পালন করছে। এর মধ্যে রোববার ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি ছিল। প্রধান বিচারপতির বাড়ির সামনে এই মিছিলে নির্বিবাদে লাঠিচার্জ করা হয়েছে। এতে বেশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রী আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ঘৃণ্য ও নির্মম ঘটনাটি ঘটেছে একজন ছাত্রীর ওপর। এই ছাত্রীর ওপর পুলিশি লাঞ্ছনার ভিডিও ছবি এখন ইন্টারনেটে ঘোরাঘুরি করছে। এই ছাত্রী পুলিশের লাঠির আঘাত থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় একদল পুলিশ তার পেছনে দৌড়াতে থাকে। মেয়েটি একটি গাছের আড়ালে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে তার চুল ধরে টেনে-হিঁচড়ে আনা হয়। এ সময় একজন পুলিশকে লাথি মারতে দেখা যায়। মেয়েটি মাটিতে পড়ে যায়। এরপর তার সহকর্মীরা তাকে উদ্ধার করেন। দেশের সব গণমাধ্যমে এই ছবি ছাপা হয়েছে।
ছাত্র ইউনিয়নের এই কর্মসূচি সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলন ছিল না। এদের মিছিলটি ৫ জানুয়ারি কিংবা ২৮ এপ্রিলের নির্বাচনের প্রতিবাদেও ছিল না। এমনকি তারা সরকারের পদত্যাগও দাবি করেননি। শুধু পয়লা বৈশাখে নারী লঞ্ছনার ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি দাবি করেছেন। কিন্তু তারা একটি বিষয় ভুলে গিয়েছিলেন, এ দেশে আর কোনো প্রতিবাদ হবে না। প্রতিবাদ বলে কোনো শব্দের ব্যবহার হবে না। এ দেশে যে ধরনের অন্যায়-অপকর্ম হোক না কেন তা স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিতে হবে। কিংবা মৌলবাদীদের তৎপরতা হিসেবে দেখতে হবে। বিশ্বাস করুক আর নাই করুক চোখ বন্ধ করে জনগণের সামনে সেটাই তুলে ধরতে হবে।
পয়লা বৈশাখের দিনের ঘটনাও এভাবে ভিন্ন খাতে প্রবাহের চেষ্টা করা হয়েছে। দেশের কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল আর সংবাদপত্র পয়লা বৈশাখের নারী লাঞ্ছনার দায় মৌলবাদীদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেছে। লাল পাঞ্জাবি আর চাপদাড়িওয়ালা একজন লোককে ভিড়ের কাছাকাছি দেখা গেছে তাই এ ঘটনার সাথে মৌলবাদীরা জড়িত বলে প্রচারণা চালানো হয়েছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে মিছিলে যেসব পুলিশ সদস্য ছাত্রীটিকে লাঞ্ছিত করলেন, তারা কোন ধরনের মৌলবাদী? সেখানে তো কোনো চাপদাড়িওয়ালা পুলিশ দেখা গেল না। তাহলে কেন এই মেয়েটির ওপর এই নির্মম অত্যাচার চালানো হলো? ভাগ্যিস চাপ দাড়িওয়ালা কোনো পুলিশ ছিল না। থাকলে হয়তো ঘটনার বিবরণ অন্য রকম হতো। এখন এই টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কি ভিডিও ফুটেজ দেখে অনুসন্ধান করবে যে পুলিশ কর্মকর্তা এই নির্মম নিপীড়নের নির্দেশ দিয়েছিলেন ছাত্রজীবনে তিনি কোন রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন? চাপদাড়ি ছাড়া ক্লিন শেভের এই পুলিশদের রাজনৈতিক পরিচয় কী? মহানগর পুলিশের কার্যালয় থেকে সামান্য দূরের এ ঘটনার ব্যাপারে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা কেন চুপ ছিলেন?
ছাত্র ইউনিয়নের এই নেতাকর্মীরা অভিনন্দন পাবেন এ কারণে যে পয়লা বৈশাখের নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে যেতে পেরেছেন। একটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ করেছেন। শুধু পয়লা বৈশাখ নয়, যেকোনো অন্যায় ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ছাত্রদের অনেক আগেই জেগে ওঠা উচিত ছিল। এই আন্দোলনগুলো কার্যকর হয় না কারণ দলীয় স্বার্থচিন্তা আর নির্মূলের রাজনীতির কৌশলের কারণে।
ইসলামপন্থী রাজনীতি করার কারণে যখন প্রকাশ্যে ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, পঙ্গু করা হয়েছে তখনো পুলিশকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালানো হয়েছে। গুম, খুন ও অপহরণের শিকার হওয়া পরিবারগুলো এখনো আহাজারি করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ যদি তখন করা হতো তাহলে আজ কোনো ছাত্রীকে এভাবে লাথি মারার সাহস পুলিশ পেত না। আশার কথা হলো, বেশির ভাগ বিরোধী রাজনৈতিক দল ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীদের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীও এই হামলার নিন্দা করে দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তি দাবি করেছে। গণতন্ত্র হরণের এই সময়ে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একাধিক রাজনৈতিক দল যেমন থাকবে তেমনি রাজনৈতিক আদর্শগত বিরোধও থাকবে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা যদি প্রতিপক্ষ নির্মূলের রাজনীতিতে পর্যবসিত হয়, তখন যে শক্তির আবির্ভাব হয় তা থেকে কেউ নিরাপদ থাকে না।
ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা ভেবে দেখতে পারেন এই পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যে তারা শাহবাগে দিনের পর দিন অবস্থান করেছিলেন। এই পুলিশের সহযোগিতায় নির্মূলের রাজনীতির মাধ্যমে একদলীয় শাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়েছে। এখন সেই আন্দোলনের নেপথ্যনায়কদের চাহিদা শেষ হয়ে গেছে। পুলিশের হাতেই এখন তারা লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন।
আজকে দেশে যে বিভেদ, বিভক্তি ও বিভাজন, তার দায় এ দেশের গণমাধ্যমকেও নিতে হবে। পুলিশি নিপীড়ন ও নির্যাতনকে রীতিমতো উসকে দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক মেধাবী ছাত্রকে জঙ্গি হিসেবে উপস্থাপন করেছে। একজন ছাত্রের টেবিলে থাকা ধর্মীয় বইকে ‘জিহাদি বই পাওয়া গেছে’ বলে অপপ্রচার চালানো হয়েছে এবং হচ্ছে। কার্যত এ ধরনের প্রচারণার মাধ্যমে মানুষের মুক্তভাবে লেখা-পড়ার স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছে। জিহাদি বই বলে প্রচার চালানো সেই বইগুলোর বিষয়বস্তু কেউ তুলে ধরেনি। মনে হচ্ছে গণমাধ্যমের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ধর্ম, বিশেষ করে ইসলামসংক্রান্ত বই। আমাদের গণমাধ্যমেও সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে ধর্মের প্রভাব কিভাবে কমানো যায় সে চেষ্টা নিরন্তর করে যাচ্ছেন। একটি উদহারণ দেয়া যাক। গত রোববার বিশ^ মা দিবস উপলক্ষে দেশের একটি প্রভাবশালী দৈনিক পত্রিকা ভারতের রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের একটি স্মৃতিকথার অনুবাদ প্রকাশ করেছে। মাকে নিয়ে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি হৃদয়নিংড়ানো বিবরণ দিয়েছেন। যেখানে মায়ের প্রতি তার অন্তহীন ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেছে। এ পি জে আবদুল কালাম লিখেছেন :
My mother used to get up before me, and gave bath to me and prepared me to go for the tuition. I use to comeback at 5:30 when my father would be waiting for taking me to the Namaz and Koran Sharif learning in Arabic school. After that I used to go to Rameswaram Road Railway station, three kilometers away to collect newspaper. Madras Dhanushkodi Mail will pass through the station but will not stop, since it was war time. The newspaper bundle will be thrown from the running train to the platform.
দেখুন http://www.abdulkalam.com
এর বাংলা করলে দাঁড়ায়, “আমার মা আমার আগে ঘুম থেকে উঠতেন। এরপর গোসল করে পড়তে পাঠানোর জন্য আমাকে প্রস্তুত করতেন। স্যারের বাসায় পড়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সাড়ে পাঁচটা বেজে যেত। তখন দেখতাম বাবা আমাকে নামাজে নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। নামাজের পর আরবি স্কুলে কুরআন শরিফ পড়তে যেতাম। এরপর তিন কিলোমিটার দূরের রেলস্টেশনে যেতাম খবরের কাগজ আনার জন্য।”
দেশের দৈনিকটি যে অনুবাদ প্রকাশ করেছে তাতে লেখা হয়েছে, “আমার মা আশিয়াম্মা ঘুম থেকে উঠতেন আমারও আগে। তিনি আমাকে গোসল করিয়ে তৈরি করে তারপর পড়তে পাঠাতেন। পড়া শেষে সাড়ে পাঁচটার দিকে বাড়ি ফিরতাম। তারপর তিন কিলোমিটার দূরের রেলস্টেশনে যেতাম খবরের কাগজ আনতে। যুদ্ধের সময় বলে স্টেশনে ট্রেন থামত না, চলন্ত ট্রেন থেকে খবরের কাগজের বান্ডিল ছুড়ে ফেলা হতো প্ল্যাটফর্মে।’ অর্থাৎ এ পি জে আবদুল কালামের নামাজ ও কুরআন শরিফ পড়ার কথাটি বাদ দেয়া হয়েছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি ছাত্র থাকার সময় নামাজ আর কুরআন শরিফ পড়তেন এ তথ্যও এসব গণমাধ্যম জানাতে রাজি নয়। এ শুধু কূপমণ্ডূকতা নয়, পাঠকের সাথেও একধরনের শঠতা।
এদের ধারণা ইসলাম মানেই পশ্চাৎপদতা। আর ইসলামের নামে রাজনীতি তো আরো খারাপ। ফলে ইসলামপন্থী মাত্রই বর্বর, খারাপ এদের মারলে আর কী বা আসে যায়। ফলে নীরবে এরা পুলিশের গুম-খুন-হত্যাকে সমর্থন দিয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে এ ধরনের মনোভঙ্গির মাধ্যমে কূপমণ্ডূকতার পরিচয় দিচ্ছে। প্রগতিশীলতার নামে আমাদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে আরো পেছন দিকে। সমাজে বিভক্তি আর বিভাজন বাড়ানো হচ্ছে। আমরা যদি বিভক্তির রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে না পারি তাহলে ফ্যাসিবাদের রাজনীতি নানাভাবে আমাদের ওপর চেপে বসবে। ইসলামপন্থী ছাড়াও আরো বহু মতের লোককে রাজপথে লাঞ্ছনা, নির্যাতন, গুলি কিংবা পঙ্গুত্ব বরণ করতে হবে। ইসলামপন্থী নয় বলে কেউ রক্ষা পাবে না। একদলীয় শাসনের দায় সবাইকে নিতে হয়।
alfazanambd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment