কথিত ‘ইসলামিক স্টেট’ (আইএস) জঙ্গি সন্ত্রাসবাদীরা এক বছর ধরে আরব বিশ্বের বিরাট অংশ দখল করে রেখেছে। সিরিয়া ও ইরাকে তারা নতুন নতুন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করছে সরকারি বাহিনী এবং প্রতিপক্ষ সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে হটিয়ে। এ অবস্থায় আইএস হয়ে উঠেছে বিশ্বজুড়ে আতঙ্কের নাম। মার্কিন নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক জোটের দমনাভিযান সত্ত্বেও কী করে আইএসের উগ্রপন্থীরা শত শত মাইল বিস্তৃত জনপদে বিকল্প সরকার হয়ে আছে, সেটাই এক বিস্ময়কর রহস্য।
অনেকেই মনে করেন, আইএসকে সুকৌশলে টিকিয়ে রেখে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তি মধ্যপ্রাচ্যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ খুঁজছে। এমনকি এমন খবরও প্রকাশ পেয়েছে যে, আইএস মূলত মার্কিন মদদে ইসরাইলের নীলনকশার ফসল। পত্রিকায় গত বছর খবর বেরিয়েছিল, আইএসের প্রধান এবং স্বঘোষিত খলিফা আবু বকর বাগদাদি ইহুদিবাদীদের হাতে প্রশিক্ষণপ্র
াপ্ত। সম্প্রতি মার্কিন বিমান হামলায় তার মৃত্যুর খবর প্রচারের কিছুদিন পর আইএস এই ব্যক্তির ভিডিও বক্তব্য প্রকাশ করে জানিয়েছে, সে মারা যায়নি। যা হোক, সুন্নি নামধারী আইএস শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে সব মুসলমানের জন্য বিরাট শঙ্কা ও উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। তারা এ যাবৎ শত শত মানুষ হত্যা করেছে এবং বন্দী সাংবাদিক কিংবা এনজিওকর্মী পর্যন্ত নিস্তার পাননি।
এ ছাড়া বর্বরোচিতভাবে শিরñেদ ঘটিয়ে গর্বের সাথে এর ছবি প্রচার করে আইএস ইসলামের ইমেজ নস্যাৎ করে দিচ্ছে। তারা নামের মধ্যে ‘ইসলামিক স্টেট’ কথাটা অপব্যবহার করছে বলে এক দিকে কিছু লোক বিভ্রান্ত হচ্ছে; অপর দিকে পাশ্চাত্যের ইসলামবিদ্বেষী মহল সুযোগ পাচ্ছে অপপ্রচারের। উপরন্তু, যারা সত্যিকার অর্থে ইসলামি আদর্শের ভিত্তিতে সমাজ পরিবর্তন এবং রাষ্ট্র গঠন করার সংগ্রামে নিরত, তাদের জন্য আইএস প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আইএসের নাম প্রথমে ছিল আইএস-আইএল, অর্থাৎ ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভান্ট। এরপর ‘লেভান্ট’-এর স্থানে ‘সিরিয়া’ বসিয়ে আইএস-আইএস হিসেবে পরিচিত হয়েছিল। এই সশস্ত্র ও রহস্যময় সুন্নি সংগঠনটি হটাৎ মিডিয়ার শিরোনাম হয়ে ওঠে গত বছর জুন মাসে। মনে হচ্ছিল, তারা মাটি ফুঁড়ে আবির্ভূত হয়ে অকস্মাৎ সিরিয়ার আলেপ্পো থেকে ইরাকের মোসুল পর্যন্ত হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ অঞ্চল পদানত করে ফেলেছে। বিশ্বের মানুষ আলকায়েদার নাম শুনলেও আইএসের সাথে পরিচয় ছিল না। সুন্নি হওয়ার দাবিদার এই গোষ্ঠীর তৎপরতায় ক্ষুব্ধ সৌদি আরবের মতো সুন্নিশাসিত দেশের সরকার বলেছে, তারা ইসলামের কেউ নয়, বরং ‘ফাহিশ’ বা অশালীন। আইএস তাদের নেটওয়ার্ক ইরাক-সিরিয়া ছাড়িয়ে আরব উপদ্বীপে প্রসারিত করেছে। ইয়েমেনে তো বটেই, খোদ সৌদি ভূখণ্ডে তাদের নৃশংস কর্মকাণ্ড বিশ্বমুসলিমের মনে ভীতি ও উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে।
আইএস সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদের তো বটেই, এমনকি আসাদবিরোধী গেরিলা যোদ্ধাদের জন্যও মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। কারণ তাদের উগ্র ‘সুন্নিবাদ’ এবং উপর্যুপরি নৃশংসতা স্বৈরাচারবিরোধী সশস্ত্র গণ-আন্দোলনের সফলতার পথে বাধা হয়ে উঠেছে। ইরাকের দ্বিতীয় প্রধান নগরী মোসুল বছরখানেক আগে আইএস দখলে নিয়ে ‘রাজধানী’ বানিয়েছে কথিত ইসলামি রাষ্ট্রের। সেখানে স্বঘোষিত খলিফা আবুবকর জুমার খোতবা পর্যন্ত দিয়েছে। মার্কিন প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রে পুষ্ট ইরাকের সেনাবাহিনী একের পর এক শহর ও এলাকা আইএসকে ছেড়ে দিয়ে প্রাণভয়ে পালিয়েছে, যা অবিশ্বাস্য লজ্জাকর ব্যাপার। এরপর শিয়া ও কুর্দি মিলিশিয়া বাহিনী কোথাও কোথাও প্রতিরোধ ও পুনরুদ্ধার অভিযানে অবতীর্ণ হলেও তাদের সাফল্য প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যর্থতার দায়ে শিয়াঅধ্যুষিত নূরী আল মালিকী সরকারের পতন ঘটেছে অনেক আগেই। তবে নতুন সরকারের সাফল্যের ঝুলি এখনো প্রায় ফাঁকা। অন্য দিকে কিছুদিন আগে ইরাকের বৃহত্তম প্রদেশ আনবার রাজধানী রামাদিসমেত কুক্ষিগত করেছে আইএস যোদ্ধারা। মাঝে কিছুদিন তাদের অগ্রাভিযান পরিলক্ষিত না হলেও ইদানীং বিভিন্ন মহাদেশ থেকে নারী-পুরুষ ওদের সাথে যোগদান এবং নেটওয়ার্ক ও অপারেশন মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে বিস্তৃত করার মধ্য দিয়ে আইএস আবার বিশ্বমিডিয়ার হট ইস্যু।
আইএস যে কতটা বেপরোয়া, তার একটি নজির একটি সংবাদ শিরোনাম। সিরিয়ায় ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ চলছে চার বছরের বেশি সময় ধরে। সেখানে ক্ষমতাসীন সরকার যেমন নৃশংসতাপূর্ণ দমননীতির জন্য কুখ্যাত, তেমনি বিদ্রোহীদের প্রতিরোধও প্রচণ্ড যাদের দখলে রয়েছে দেশের একটা বড় অংশ। এই পরিস্থিতিতেও ২ জুন পত্রিকায় হেডিং : ISIS advances in Syria against regime and rival rebels. বৈরুত থেকে এএফপি জানায়, ইসলামিক স্টেট বাহিনী সিরিয়ায় সরকারি ফৌজ ও প্রতিদ্বন্দ্বী বিদ্রোহী গ্রুপ উভয়ের কাছ থেকে বিরাট অঞ্চল দখল করে নিয়েছে। সিরিয়ার মধ্যাঞ্চলে হোমস প্রদেশ এবং উত্তরাঞ্চলে আলেপ্পো প্রদেশে সাফল্যের পর ইতোমধ্যে আইএস সিরিয়া রাষ্ট্রটার অর্ধেকই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এনেছে। একই খবরে আইএসের দুর্ধর্ষতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে জানানো হয়, আনবার প্রদেশে তাদের আত্মঘাতী হামলায় পুলিশ ঘাঁটিতে ৩০ জন সৈন্য নিহত হয়েছে। ইরাকি সেনাবাহিনী থেকে দখল করা গাড়ি নিয়ে তারা এই ভয়াবহ আক্রমণ চালায়। এ দিকে ইরাকে গত বছর ৯ জুন অপারেশন শুরু করে দেশটার এক-তৃতীয়াংশ পদানত করেছে আইএস। এখন তাদের দখলে রয়েছে ইরাক-সিরিয়ার তিন লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকা, যা ইতালির সমান এবং বাংলাদেশের প্রায় দ্বিগুণ।
মীযানুল করীম
0 comments:
Post a Comment