সৈয়দ সামসুজ্জামান নীপু
‘অগ্রগতির ধারবাহিকতা
সম্ভাবনাময় আগামীর পথে বাংলাদেশ’। চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতার বইয়ের শিরোনাম এটি। বাজেট বইতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থনীতির অনেক অগ্রগতির ফিরিস্তি দিয়েছেন। এর পাশাপাশি এ বছর তিনি অর্থনীতিকে কী অবস্থায় নিয়ে যাবেন তারও একটি রূপকল্প তুলে ধরেছেন। বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে দুই লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির(্এডিপি) আকার রয়েছে ৮০ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। মোট দেশজ উপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে মূল্যস্ফীতি সাত শতাংশের নিচে থাকবে।
<
p>
ইতোমধ্যে সাড়ে চার মাস চলে গেছে। কিন্তু বাজেট প্রক্ষেপিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণে তেমন কোনো অগ্রগতি চোখের পড়ছে না। অন্য দিকে মধ্য মেয়াদে নিঃসন্দেহে অর্থনীতি একটি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে রাজস্ব আদায় ও রফতানি কমে যাওয়ার কারণে এই ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয়, রেমিট্যান্স প্রবাহ যদি সামনের মাসগুলো কমতে থাকে তবে অর্থনীতিতে এই ঝুঁকির পরিমাণ আরো বাড়িয়ে তুলবে। কিন্তু এখন যে অর্থনীতির পরিস্থিতি তাতে এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না। আমাদের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী এটি ৬ দশমিক ৭ শতাংশ হতে পারে। তবে বছর শেষে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি অবনতি হয় তবে এই প্রবৃদ্ধি আরো কমে যেতে পারে।
অর্থনীতির খাতওয়ারি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অর্থবছরে তিন-চার মাসে রফতানি, রেমিট্যান্স, রাজস্ব আহরণ, এডিপি বাস্তবায়ন সব কিছুই হ্রাস পেয়েছে। সবচেয়ে শঙ্কার জায়গা সৃষ্টি হচ্ছে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের ক্ষেত্রে। গত তিন বছর পর সেপ্টেম্বর মাসে লেনদেনের ভারসাম্য (বিওপি) ঋণাত্মক হয়ে গেছে।
রফতানি
অর্থনীতি খাতে সবচেয়ে খারাপ সংবাদটি এসেছে রফতানি থেকে। এ খাতে প্রবৃদ্ধি বা লক্ষ্যমাত্রা কোনোটিই অর্জন করা যাচ্ছে না। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরে চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) প্রবৃদ্ধি ও লক্ষ্যমাত্রা কোনোটিই অর্জন করা সম্ভব হয়নি। আলোচ্য সময়ে মোট ৯৬৫ কোটি ২৬ লাখ ডলারের পণ্যসামগ্রী রফতানি করা গেছে। অপর দিকে গত অর্থবছরে একই সময়ে রফতানি করা সম্ভব হয়েছিল ৯৭৪ কোটি ৭১ লাখ ডলারের পণ্য। চার মাসের জন্য রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা রয়েছে এক হাজার ৪৪ কোটি টাকা। ফলে এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রফতানি কম হয়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ এবং গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে যা শূন্য দশমিক ৯৭ বা এক শতাংশ কম।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মূলত তৈরী পোশাক খাতে আয় কমে যাওয়ার কারণেই রফতানি আয় হ্রাস পেয়েছে। চলতি অর্থবছরের চার মাসে নিট ও ওভেন খাতে রফতানি হয়েছে ৭৭৫ কোটি ২৬ লাখ ডলারের পণ্য, যা কি না পোশাক খাতের রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আট দশমিক ২৮ শতাংশ এবং গত অর্থবছরে একই খাতের আয়ের চেয়ে এক দশমিক ৭৫ শতাংশ বা দুই শতাংশ কম। উল্লেখ্য, গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রফতানি আয়ের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ১৮ কোটি ডলার। এবার ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তিন হাজার ৩২০ কোটি ডলার।
বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সে বাজারেও কিন্তু তৈরী পোশাক রফতানি কমতে শুরু করেছে। চলতি বছরের ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানি হয়েছে ৩৭৮ কোটি মার্কিন ডলারের। গত বছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৩৮৬ কোটি মার্কিন ডলার। গত বছরের চেয়ে এবার রফতানি কমেছে দুই দশমিক ১২ শতাংশ।
রেমিট্যান্স কমছে
রেমিট্যান্স খাতেও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। অক্টোবর মাসে রেমিট্যান্স কমেছে ১০১ কোটি টাকা। মূলত মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
এডিপি বাস্তবায়ন শোচনীয় অবস্থায়
সরকারের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ কর্মসূচি হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি। এডিপির মাধ্যমে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়ে থাকে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন সময়ে গ্রাম-গঞ্জে ব্যাপক মানুষের কর্মসংস্থান হয় এবং বাড়ে টাকার প্রবাহ ও ভোগ। আর কে না জানে ভোগ বাড়লে গতিশীল হয় অর্থনীতি। কিন্তু এ খাত থেকেও এখন দুঃসংবাদ আসছে। চলতি অর্থবছরে অনেক ঢাকডোল পিটিয়ে একটি বিশাল আকারের এডিপি বাস্তবায়নের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। টাকার অঙ্কে এই এডিপির আকার সর্বমোট ৮৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু অর্থবছরে তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) প্রান্তিকে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৯ শতাংশ। গত অর্থবছরে এই হার ছিল ১১ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরে একই সময়ে যা ছিল ১৩ শতাংশ। বছর শেষে এই এডিপি পুরোটা বাস্তবায়ন যে অসম্ভব তা এখনই টের পাওয়া যাচ্ছে।
লেনদেনের ভারসাম্যও ঋণাত্মক
তিন বছর পর লেনদেনের চলতি হিসাবে ভারসাম্যে ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। নিয়মিত আমদানি-রফতানিসহ অন্যান্য আয়-ব্যয় এ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত। এ হিসাব ধনাত্মক বা উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনো দেশের ঋণ করতে হচ্ছে না। আর এটি যদি ঋণাত্মক হয় তবে দেশকে নিয়মিত লেনদেন চালানোর জন্য ঋণ নিতে হয়। লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায় চলতি অর্থবছরে জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়কালে চলতি হিসাবে ঘাটতি হয়েছে ৩৫ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার। আগের মাসে আগস্ট পর্যন্ত দুই মাসে চলতি হিসাবে উদ্ধৃত্ত ছিল ৩২ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা যুক্তি দেখিয়েছেন, রফতানির চেয়ে আমদানি বেশি হওয়ার কারণে লেনদেনের ভারসাম্যে কিছুটা অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। কিন্তু তা খুব খারাপ বলা যাবে না। কারণ শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি একটি ভালো লক্ষণ, কারণ এতে বোঝা যায় দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। তবে এই ঘাটতি যাতে না বাড়ে সে দিকে আমাদের যথেষ্ট মনোযোগ রয়েছে। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলেছেন ভিন্ন কথা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন, আমদানির সাথে বিনিয়োগ গতির কোনো সম্পর্ক লক্ষ করা যাচ্ছে না। কাজেই আমদানির আড়ালে দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। তিনি বলেছেন, ভবিষ্যতে চলতি হিসাবে ঘাটতি বাড়তে থাকলে তা রিজার্ভের ওপর চাপ ফেলবে এবং মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে।
কমছে রিজার্ভ
সরকারের একটি বড় গর্ব করার জায়গা ছিল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। চলতি নভেম্বর মাসেও এটির আকার ছিল সাড়ে ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু নভেম্বর মাসে ১১ তারিখের হিসাব অনুযায়ী এই রিজার্ভ এক বিলিয়ন ডলার কমে গেছে। এখন রিজার্ভের পরিমাণ ২১ দশমিক ৪৬ বিলিয়ান ডলার। এটি আরো কমলে লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
অর্থবছর শুরুর তিন মাস অর্থনীতির ইতিবাচক সূচকগুলো যে নেতিবাচক হওয়া শুরু করেছে তা তথ্য পরিসংখ্যানই প্রমাণ করছে। আগামীতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা শুরু হলে এই সূচকের পতন আরো কতখানি হয় তা নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েই গেছে।
0 comments:
Post a Comment