সৈয়দ সামসুজ্জামান নীপু
স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশে অর্থনৈতিক নীতি-কৌশলের ধারাবাহিক বাস্তবায়নেই সম্ভব হবে দারিদ্র্যমুক্ত, বৈষম্যহীন আর অসাম্প্রদায়িক মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ বিনির্মাণ।’ গত ১২ মার্চ সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদে ‘বাজেট ২০১৩-২০১৪ : প্রথম প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি ও আয়-ব্যয়ের গতিধারা এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণসংক্রান্ত প্রতিবেদন’-এ অর্থমন্ত্রী এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই আশাবাদ কতখানি বাস্তব হবে তা দেখার জন্য আমাদের এ বছরের শেষ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কারণ গত ৫ জানুয়ারি একতরফা ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকারটি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে তা কিন্তু আক্ষরিক অর্থে একটি দুর্বল সরকার। এই সরকারের পক্ষে আগামীতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে বাজেট বাস্তবায়ন করা কতটুকু সম্ভব হবে তা নিয়ে মোটা দাগ
এই বাস্তবতার নিরিখে সরকারের পক্ষ থেকে আগামী ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের জন্য একটি বিশাল বাজেট প্রণয়নে হাত দেয়া হয়েছে। বাজেটি যেমন বিশাল, এর ঘাটতিও দেখানো হয় বিশাল। অন্যান্য সময়, এই ঘাটতি পূরণের জন্য অভ্যন্তরীণ খাতের পাশাপাশি বিদেশী সাহায্য নেয়া হয়। একতরফা নির্বাচনের পর বিদেশী সহায়তা পাওয়া সরকারের জন্য বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়াতে পারে। এখানে দেখা দিয়েছে এক ধরনের অনিশ্চয়তা।
এত কিছুর মধ্যেও আগামী বাজেটের সম্ভাব্য আকার নির্ধারণ করা হয়েছে দুই লাখ ৫২ হাজার ২৫১ কোটি টাকা। বাজেটে ঘাটতিই থাকবে ৬৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। যা জিডিপির ৫ শতাংশ। এডিপির আকার প্রাক্কলন করা হচ্ছে ৮০ হাজার কোটি টাকা। তবে ‘রাজনৈতিক’ প্রকল্পের আধিক্য বেশি হলে এর আকারও শেষ পর্যন্ত খানিকটা বাড়ানো হতে পারে। চলতি অর্থবছরে এডিপি নির্ধারিত রয়েছে ৬৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা।
সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ৫ জুন নতুন ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের বাজেটটি অর্থমন্ত্রীর সংসদে উপস্থাপন করার কথা রয়েছে।
আগামী অর্থবছরের জন্য মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি আকার ধরা হচ্ছে আট শতাংশ, যা এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। চলতি অর্থবছরে এ হার ছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। কিন্তু এটি অর্জন করা সম্ভব হবে না। এখন সংশোধন করে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৬ শতাংশের ঘরে রাখার কথা চিন্তা করা হচ্ছে। ‘অন্য কিছু’ করা না হলে বছর শেষে তাও অর্জন করা বেশ দুরূহ হয়ে পড়বে। কারণ অর্থনীতিবিদসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা বলছে, এবার জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের নিচে নেমে আসবে। আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার প্রক্ষেপণ করা হচ্ছে ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে যা ছিল সাত শতাংশ।
রাজস্ব আয়
২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে মোট রাজস্ব প্রাপ্তির সম্ভাব্য প্রাক্কলন করা হয়েছে এক লাখ ৮৪ হাজার ৯১০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে যা ছিল এক লাখ ৬৭ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে রাজস্ব প্রাপ্তির আকার হবে প্রায় এক লাখ ৫১ হাজার ৭০০ কো
বাজেট ঘাটতি
আগামী অর্থবছরের বাজেটের সামগ্রিক ঘাটতি (অনুদান ছাড়া) নির্ধারণ করা হচ্ছে ৬৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ শতাংশ। এই ঘাটতির মধ্যে ২৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা মেটানো হবে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের মাধ্যমে এবং বাকি ৪৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ ঋণের মাধ্যমে পূরণ করা হবে। এই অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে রয়েছে ব্যাংকঋণ ও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ। চলতি অর্থবছরে বাজেটের আকার রয়েছে দুই লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে অনুদান ছাড়া সামগ্রিক ঘাটতি রয়েছে ৫৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা, যা জিডিপির চার দশমিক ৬ শতাংশ।
আগামী অর্থবছরের বাজেটের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের বাজেটটি বর্তমান সরকারের জন্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ এবং রাজনৈতিক কারণে তা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে। জুন মাসে বাজেট ঘোষণা করা হলেও নভেম্বর বা ডিসেম্বর মাসে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যায় তা এখন বলা সম্ভব হচ্ছে না। এখানে মধ্যবর্তী নির্বাচনের একটি সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। ফলে বাজেটে জনহিতকর বা জনতুষ্টিমূলক অনেক প্রকল্প রাখা হবে। যাতে আগামী নির্বাচনে সরকারের পক্ষে একটি ইতিবাচক ফল দেখা যায়।
তিনি বলেন, প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার এডিপিতে অনেক রাজনৈতিক প্রকল্প রাখা হবে। তবে এর পাশাপাশি মানব সম্পদ (শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য), কৃষি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, যোগাযোগ সর্বাধিক বরাদ্দ থাকবে। এর সাথে ৬ হাজার কোটি টাকার মতো বরাদ্দ থাকবে শুধু পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পেই।
সংশোধন করা হচ্ছে চলতি বাজেট
চলতি অর্থবছরে দুই লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকার বিশাল বাজেটটি এখন আর বাস্তবায়ন করতে পারছে না সরকার। ফলে অর্থবছরের সাত মাসের মাথায় এটি কাটছাঁট করা শুরু হয়েছে। পুরো বাজেট থেকে কেটে ফেলে হচ্ছে ১১ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। ফলে সংশোধিত বাজেটের আকার গিয়ে দাঁড়াচ্ছে দুই লাখ ১১ হাজার ২২০ কোটি টাকা, যা মূল বাজেট থেকে ৬ শতাংশ কম।
শুধু তাই নয়, সরকারের বড় বিনিয়োগ কর্মসূচি এডিপিও হ্রাস করা হচ্ছে ১১ হাজার কোটি টাকারও বেশি। কারণ সেটি বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না, সাত মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার মাত্র ৩৩ শতাংশ, যা বিগত কয়েক বছরের চেয়ে কম। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতিও ভালো। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ফেলা হচ্ছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। কমানো হয়েছে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও। বাজেটে এটির লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাত দশমিক ২ শতাংশ। এখন তা কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতিও রাখা হচ্ছে ৭ শতাংশের ঘরে।
ফলে চলতি ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে দুই লাখ ১১ হাজার ২২০ কোটি টাকা, যা মূল বাজেট অপেক্ষা ১১ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা বা ৬ শতাংশ কম। চলতি অর্থবছরে মূল বাজেটে আকার নির্ধারিত রয়েছে দুই লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। এই অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে সাড়ে ৬ শতাংশ। মূল বাজেটে যা নির্ধারিত রয়েছে সাত দশমিক ২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭ শতাংশ। এবারকার বাজেটে এডিপি আকার নির্ধারণ করা রয়েছে ৬৫ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। এটি কমিয়ে ৫৫ হাজার কোটি টাকা নামিয়ে আনা হচ্ছে।
টাকা আসবে কোথা থেকে
বিতর্কিত নির্বাচনের কারণে আগামী অর্থবছরে বিদেশী সাহায্য পাওয়া সরকারের জন্য বেশ দুরূহ হয়ে পড়বে। এখন পর্যন্ত কোনো দাতা দেশ বা সংস্থা সরকারের নতুন করে কোনো সহায়তা প্রতিশ্রুতি দেয়নি বলে জানা গেছে। এ পরিরিস্থিতে শিগগিরই সরকারের বিভিন্ন দাতা সংস্থার স্থানীয় প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
0 comments:
Post a Comment