WHAT'S NEW?
Loading...

সিটি নির্বাচনে বিএনপির চ্যালেঞ্জ

 
আলফাজ আনাম


সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ছে। এই অস্থিরতার চরম প্রকাশ ঘটেছে সোমবার কারওয়ান বাজারে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার মধ্য দিয়ে। তার বিরুদ্ধে আগের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর বক্তব্যের পর দেখা গেল, সকালে তার

বাসা থেকে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এরপর বিকেলে তার নির্বাচনী প্রচারণার সময় হামলার ঘটনা ঘটে।


এই হামলার সাথে জড়িত এমন কিছু তরুণের ছবি প্রকাশ পেয়েছে, যাদের আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আনিসুল হকের সাথে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে দেখা গেছে। বেগম জিয়া নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়ার পর থেকে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে নির্বাচনে সম্ভাব্য পরাজয়ের এক ধরনের শঙ্কা কাজ করছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করার বদলে বিএনপি চেয়ারপারসনের নির্বাচনী প্রচারণা ঠেকানো ক্ষমতাসীন দলের যেন প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়ার মধ্য দিয়ে সরকারের ওপর বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট যে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছে, ক্ষমতাসীন দলের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে তা ফুটে উঠেছে।
বিরোধী দলের আন্দোলনের মধ্যে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপিকে ফাঁদে ফেলানো। ক্ষমতাসীনদের ধারণা ছিল, বিএনপি হয়তো শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যাবে না। ফলে রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো গুরুত্বপূর্ণ তিন সিটি করপোরেশন সহজেই তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। আর নি

র্বাচনে অংশ নিলে বিএনপিকে আন্দোলন থেকে সরে আসতে হবে। এই কৌশল থেকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল। বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। খালেদা জিয়া স্পষ্ট করে বলেছেন, এই সরকারের অধীনে ২০ দলীয় জোট জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে না। তবে সব স্থানীয় নির্বাচনে অতীতে বিএনপি অংশ নিয়েছে। সে ধারাবাহিকতায় সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছে।



বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেয়ার পর প্রার্থী নিয়ে নানা ধরনের নাটকীয়তার সৃষ্টি করা হয়। উত্তরে বিরোধী জোট সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আবদুল আউয়াল মিন্টুর প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যায়। তার স্থলে বিএনপির সমর্থন পেলেন তারই ছেলে তাবিথ আউয়াল। আর দক্ষিণে সাবেক মেয়র ও এবারের প্রার্থী মির্জা আব্বাসের মনোনয়ন বাতিল না হলেও কাক্সিক্ষত জামিন তিনি এখনো পাননি। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হওয়ার পর দু’টি সিটি করপোরেশনেই বিএনপি প্রার্থীরা বেশ চমক সৃষ্টি করেছেন।



ঢাকা দক্ষিণে মির্জা আব্বাসের পক্ষে প্রচারণা শুরু করেন তার স্ত্রী আফরোজা আব্বাস। তিনি স্বামীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গিয়ে ইতোমধ্যে সবার দৃষ্টি কেড়েছেন। তার চলার গতি, মার্জিত বক্তব্য আর শালীন ও সহজ-সরল অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে যে অবস্থান তৈরি করেছেন, তাকে ঢাকায় বিএনপিতে একজন নারী নেত্রীর আবির্ভাব হিসেবে দেখা হচ্ছে। মির্জা আব্বাস নয়, আফরোজা আব্বাস হতে পারতেন ঢাকা দক্ষিণের মেয়র প্রার্থী এমন মন্তব্যও অনেককে করতে দেখা গেছে।



মির্জা আব্বাসের প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন ঢাকার সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ হানিফের ছেলে মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় সংস্কারপন্থী হিসেবে দলের মধ্যে তেমন গুরুত্ব ছিল না তার। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা চেয়েছিলেন, পুরান ঢাকার সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিম হোন মেয়র প্রার্থী। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সাঈদ খোকনকেই প্রার্থী করতে আগ্রহী ছিলেন। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় খোকন প্রার্থী হয়েছেন। সংসদ সদস্য হিসেবে পদত্যাগপত্র গৃহীত না হওয়ায় হাজী সেলিম আর প্রার্থী হতে পারেননি। ফলে সাঈদ খোকনের পক্ষে বাইরে যতই সক্রিয় থাকার দৃশ্য দেখা যাক না কেন, মহানগর আওয়ামী লীগের ভেতরে দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে। বলা যায়, আওয়ামী লীগ সমর্থিত দুই প্রার্থীই ওয়ান-ইলেভেনের বেনিফিশিয়ারি। ফলে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে।



ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি আনিসুল হক। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে তিনি কখনো সম্পৃক্ত ছিলেন না। আনিসুল হক প্রকাশ্যে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় তিনি প্রার্থী হয়েছেন। কখনো মেয়র নির্বাচন করবেন, তা ভাবনার মধ্যেও ছিল না। আনিসুল হকের জেতার বিষয়কে ক্ষমতাসীন দল সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে। বলা যায়, ঢাকা উত্তর ক্ষমতাসীনদের জন্য শেষ পর্যন্ত প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে দাঁড়াতে পারে। 



উত্তরে বিএনপির প্রার্থী হলেন এফবিসিসিআই’র আরেক সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ আউয়াল। তার নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়টি অপ্রত্যাশিত হলেও নির্বাচনী প্রচারণায় এই তরুণ কয়েক দিনের মধ্যেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। উচ্চশিক্ষিত এবং দেশের বাইরে পড়ালেখা করা এই তরুণ স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতির ধারা রপ্ত করে ফেলেছেন। দেশের একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর ছেলে, যিনি লেখাপড়া করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে, তিনি যখন অনায়াসে বস্তির কিশোরকে ঘাড়ে নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় মেতে ওঠেন; সত্যিই তা বাংলাদেশের রাজনীতিতে তরুণদের সম্ভাবনার একটি নজির হয়ে দাঁড়ায়। বিএনপির সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সম্ভবত বড় অর্জন আফরোজা আব্বাস আর তাবিথ আউয়ালের মতো নতুন ও তরুণদের সামনে আনতে পারা। অবশ্য বিএনপি অনেক ওয়ার্ডে একেবারে নতুন মুখকে সামনে এনেছে।


 


২.
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এখন পর্যন্ত সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। পাড়া-মহল্লায় প্রচারণা দেখলে তা বোঝা যায়। বিএনপি সমর্থিত দুই মেয়র প্রার্থী তাদের নিরাপত্তা এবং নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের দাবি করেছেন। উত্তরের মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল বলেছেন, তিনি গুমের ভয়ে অনেক কথাই বলতে পারছেন না। ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রার্থী, বিশেষ করে সাঈদ খোকন নির্বাচনী প্রচারণায় বিরোধী দলের সমালোচনা করলেও বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থীরা সরকারবিরোধী বক্তব্য দেয়া অনেকটা এড়িয়ে চলছেন। প্রচারণা চলছে উদ্বেগ ও শঙ্কা নিয়ে। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর পক্ষে মিছিল, মিটিং ও সমাবেশ সবই হচ্ছে। কিন্তু বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের মিছিল-সমাবেশ দূরে থাক, অনেক স্থানে পোস্টারও দেখা যায় না। অর্থাৎ নির্বাচনী প্রচারণা হচ্ছে অনেকটাই একতরফাভাবে।



বিএনপির প্রতিটি ওয়ার্ডের সক্রিয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের মামলা দেয়া হয়েছে। পুলিশের ভয়ে অনেকেই বাসায় থাকতে পারেন না। অনেকে এলাকায় থাকতে পারছেন না। এর মধ্যে পুলিশ প্রতিদিন হুমকি দিচ্ছে, মামলার আসামিদের ধরতে তারা কাজ করে যাচ্ছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, নির্বাচনের মধ্যেও যৌথবাহিনীর অভিযান চলবে। অপরাধী ও মামলার আসামিদের গ্রেফতার করতে নির্দেশ দিয়েছেন। মামলার কার্যক্রম ‘আরো জোরদার করার’ কথাও বলেছেন। নির্বাচন কমিশন নয়, ক্ষমতাসীনদের নির্দেশে কাজ করছে পুলিশ। ইতোমধ্যে বিএনপি সমর্থিত দু’জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসবে, ক্ষমতাসীন দল ও পুলিশ প্রশাসন আরো বেশি তৎপর হবে। আরো একাধিক ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী গ্রেফতার হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
বিএনপির পক্ষ থেকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি করা হলেও তা ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে নাকচ করে দেয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত  নির্বাচন কমিশন সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু সেনাবাহিনী ভোট কেন্দ্রগুলোতে থাকবে না স্টাইকিং ফোস হিসাবে থাকবে তা এখন্ও স্পষ্ট নয়।  তবে র‌্যাবের একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালক নির্বাচন কমিশনের সাথে বৈঠক শেষে ‘সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রয়োজন নেই’ বলে মন্তব্য করেছেন। তার এ ধরনের বক্তব্য সাধারণ ভোটার ও বিরোধী নেতাকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেত্রীর নির্বাচনী প্রচারণার সময় হামলার ঘটনা থেকে প্রমাণিত হচ্ছে, বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থীরা কত নাজুক অবস্থায় নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী মোতায়েন ছাড়া কোনো অবস্থাতেই সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের আয়োজন করা সম্ভব হবে না। খালেদা জিয়ার ওপর হামলার ঘটনা ভোটকেন্দ্রে সেনাবাহিনী মোতায়েনের অপরিহার্যতাই প্রমাণ করেছে।



বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের আশার দিক হচ্ছে, রাজধানীতে খালেদা জিয়ার নির্বাচনী প্রচারণায় মানুষের ঢল নামছে। তার প্রচারণায় ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। এর ফলে ক্ষমতাসীন দল অসহিষ্ণু হয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় হামলা থেকে শুরু করে নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করছে। বেগম জিয়ার এই প্রচারণার ফল হিসেবে নিশ্চিত করে বলা যায়, ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে। পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়া সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যে নীরব বিপ্লবের আহ্বান জানিয়েছিলেন, ভোটার অংশগ্রহণ বাড়লে তা বাস্তবে রূপ পেতে পারে। কিন্তু এই নীরব বিপ্লবের ফল নির্ভর করবে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞার ওপর। নির্বাচনে বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জ হবে ভোটকেন্দ্রে এজেন্ট দেয়া। কারণ, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের হুমকি ও প্রলোভনের মুখে এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালনের মতো ঝুঁকি নেয়ার দৃঢ়তা থাকতে হবে।


ভোটকেন্দ্রগুলোতে যদি এজেন্ট রাখা সম্ভব না হয়, তাহলে ভোটাররা নীরব বিপ্লব ঘটালেও তার কোনো ফল পাওয়া যাবে না। এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে বিগত উপজেলা নির্বাচনে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফার ভোটের সময় কিভাবে ফলাফল পাল্টে দেয়া হয়েছে, তার নজির আমরা দেখেছি। এ জালিয়াতি ঠেকানোর জন্য অন্য সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো বিশেষ করে গাজীপুর, খুলনা ও রাজশাহীতে ২০ দলীয় জোটের প্রার্থীরা যেভাবে ভোটকেন্দ্র পাহারা দিয়ে নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন, ঢাকাতেও এ ধরনের সুদৃঢ় ও সাহসী ভূমিকা রাখতে হবে। বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতারা তা কতটা করতে পারবেন, তার ওপর নির্ভর করবে সাফল্য। প্রকৃতপক্ষে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির একটি কৌশল হচ্ছে, বেশিসংখ্যক ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসা। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা যদি পরাজিত হন, তাহলে নির্বাচনকে সামনে রেখে সাধারণ মানুষের সাথে বিএনপির নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততা ভবিষ্যৎ আন্দোলনের ক্ষেত্রই প্রস্তুত করবে।


 

0 comments:

Post a Comment