হাসান আব্দুল্লাহ
শুধু ওয়াশিংটনেই এক হাজার ৯০০ লবিং ফার্ম রয়েছে। এর সাথে যুক্ত রয়েছেন ১১ হাজার লবিস্ট (তদবিরকারক)। এক বছরে শুধু অর্থনৈতিক বিষয়ে লবিংয়ের জন্য দুই হাজার নতুন লবিস্ট নিবন্ধন করেছেন। তার মানে হলো, এক বছরই প্রত্যেক সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানের বিপরীতে চারজন করে নতুন লবিস্ট যুক্ত হয়েছেন।
কী করেন এসব লবিস্ট? ধরুন যুক্তরাষ্ট্র সরকার তামাকের বিরুদ্ধে একটি আইন করতে যাচ্ছে। এখন আইনে এমন ভাষা যেন ব্যবহার না হয় যাতে তামাক ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় লাটে ওঠে। সে জন্য তামাক কোম্পানির পক্ষ থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয় লবিং করার জন্য। লবিস্ট নিয়োগ করা হয় যারা আইনটি তৈরির সাথে জড়িত তাদের পেছনে এবং সংসদে যারা আইন পাসে ভোট দেবেন তাদের পেছনে। এটি আসল ঘটনা নয়
। বোঝার সুবিধার্থে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হলো। লবিস্টদের মূল কাজ হলো কিভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ট্যাক্স কম দেয়ার ব্যবস্থা করা যায়। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে হেন কাজ নেই যার জন্য লবিস্ট নেই।
শুটটাই পরা হাজার হাজার লবিস্ট স্যুটকেস-ভর্তি ডলার নিয়ে হোয়াইট হাইজ, ক্যাপিটল হিল থেকে শুরু করে সংসদের বারান্দায় সর্বত্র ঘুরে বেড়ান তদবিরের জন্য। যেমন ধরুন একটি টেলিফোন কল সেন্টারের কাজ হলো, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সাধারণ গৃহস্থরা কাঠমিস্ত্রির জন্য যেসব ফোন করেন তা রিসিভ করা। এখন ফেডারেল কমিউনিকেশনস রুল নামে একটি আইন হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের। আইনে এমন একটি বাক্য থাকতে পারে যাতে এই টেলিফোন আনসারিং সেন্টার বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আইনটি যাতে তাদের বিরুদ্ধে না যায় সে জন্য তারা মাসে চার হাজার ডলার খরচ করছেন লবিংয়ের পেছনে। এভাবে গত অর্থনৈতিক ধসের জন্য ব্যবসায়ীদের রাষ্ট্রীয় থোক বরাদ্দ (বেল আউট বিল) দিতে যে বিল পাস হয়েছে তা পাস করাতেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের পেছনে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে লবিংয়ের মাধ্যমে।
ওয়াশিংটনের সবচেয়ে নামকরা লবিং ফার্ম হলো ক্যাপিটল ট্যাক্স পার্টনার। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ট্যাক্স যাতে সরকার কম রাখে তা ম্যানেজ করাই তাদের কাজ। সে জন্য বিভিন্ন ট্যাক্স প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তারা বছরে কয়েক মিলিয়ন ডলার পায় লবিং বাবদ। লবিংয়ের কারণে ট্যাক্সবিষয়ক একটি নতুন নিয়ম ২০১০ সালের পরিবর্তে ২০১১ সালে চালু করতে রাজি হয়েছে সরকার। এর এ জন্য ক্যাপিটল ট্যাক্স পার্টনারের যেসব ক্লায়েন্ট রয়েছেন তাদের ২০০ কোটি ডলার ট্যাক্স বেঁচে গেছে। এভাবে লবিং করে যদি ট্যাক্স বাঁচানো যায় তাহলে লবিং নিয়োগ করতে অসুবিধা তো নেই তাদের? বরং নগদ ডলার লাভই বলা চলে।
আন্তর্জাতিক অস্ত্র বাণিজ্য, স্বাস্থ্যবীমা প্রভৃতি খাতে রহস্যজনক ট্যাক্স কোড প্রকাশ না করার জন্য ক্যাপিটল ট্যাক্সের মতো লবিং প্রতিষ্ঠানগুলোকে ৩.৪৯ বিলিয়ন ডলার প্রদান করা হয়েছে। ক্যাপিটল ট্যাক্সের কো-ফাউন্ডার লিন্ডসে হুপারের মতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ট্যাক্সসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে টেকনিক্যাল পরামর্শ প্রদান করা এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। মরগান স্ট্যানলি, থ্রি এম, গোল্ডম্যান স্যাকস, চ্যানেল, ফোর্ড, প্রাইভেট ইকুইটি কাউন্সিলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ক্লায়েন্ট। টাইম ম্যাগাজিনের মূল প্রতিষ্ঠান টাইম ওয়ার্নার ক্যাপিটল ট্যাক্স পার্টনারের একজন ক্লায়েন্ট। প্রাইভেট ইকুইটি কাউন্সিলের আটজন পার্টনার রয়েছেন। প্রাইভেট ইকুইটি কাউন্সিল ২০০৯ সাল থেকে মাসে ৩০ হাজার ডলার লবি বাবদ দিয়েছে, যাতে তাদের কোম্পানির ট্যাক্স কমিয়ে রাখা হয়। অন্য চারটি প্রতিষ্ঠান এবং সেখানে নিয়োজিত নিজস্ব লবিস্টদের খরচ বাবদ ২০০৯ সাল থেকে এ বছর মার্চ পর্যন্ত ৪.২ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। এ ছাড়া এপ্রিলের শুরু থেকে প্রতিষ্ঠানটি আরো ৪.৮ মিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত খরচ করেছে লবিংয়ের পেছনে। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটি লবিং বাবদ খরচ করেছে ১৫ মিলিয়ন ডলার।
এখন প্রশ্ন হলো, এভাবে ট্যাক্স কমানোর জন্য যদি লবিং বাবদ খরচ করা হয় তাহলে আগামী ১০ বছরে সরকার কর্তৃক ট্যাক্স আদায় করতে পারা ৭০ লাখ কোটি টাকার কী হবে। তা কি আদায় হবে না? না লবিংয়ের পেছনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে সব ট্যাক্স মওকুফের ব্যবস্থা করা হবে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের ম্যানেজ করে? ১০ বিলিয়ন ডলার ট্যাক্স কমানোর জন্য যারা ১৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছেন, তাদেরই বা কী হবে?
লবিং ব্যবসায় এখন যুক্তরাষ্ট্রে এতই জমজমাট যে এর মাধ্যমে বছরে কেউ এক থেকে চার মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত আয় করতে পারেন। অভ্যন্তরীণ এসব লবিং যারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, সিনেটর, কংগ্রেসম্যান, অবসরপ্রাপ্ত ক্ষমতাধর মন্ত্রীরা বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে লবিং করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে ওই বিষয়ে পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নিতে প্রভাবিত করার জন্য। এ বাবদও তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করে গোটা বিশ্ব থেকে।
লবিস্ট সবসময় খারাপ নয়। লবিস্টদের কারণে অনেক সময় অনেক কল্যাণকর কাজ হয়। যেমন লবিস্টদের কারণে অনেক সময় সত্যিই আইনকে এমনভাবে করা হয় যাতে তা জনস্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়া থেকে রক্ষা পায়। আইনের ভাষার হাজারো মানে থাকে। অনেক সময় কোনো কোনো লবিস্ট ফার্ম আইনের একটি প্যারার জন্য তিনজন লবিস্ট নিয়োগ করে, যাতে আইনের সঠিক মানে তৈরি হয় এবং তা জনস্বার্থের বিরুদ্ধে যাতে না যায়। এ জন্য লবিস্টদের একটি বক্তব্য হলো ‘ভালো উদ্দেশ্যে আনা প্রস্তাব যাতে খারাপ ফল বয়ে না আনে সে জন্য ভালো লবিস্টরা সিনেটর এবং অন্যান্য স্টাফের পেছনে পেছনে ঘুরে অনেক ভালো কাজ করে।’ তবে হোয়াইট হাউজে লবিস্টদের নির্বিচার আনাগোনার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
0 comments:
Post a Comment